শিশু/মঙ্গলগীত
মঙ্গলগীত
এত বড়ো এ ধরণী মহাসিন্ধু-ঘেরা
দুলিতেছে আকাশসাগরে-
দিন দুই হেথা রহি মোরা মানবেরা
শুধু কি মা, যাব খেলা করে।
তাই কি ধাইছে গঙ্গা ছাড়ি হিমগিরি,
অরণ্য বহিছে ফুল ফল,
শতকোটি রবি তারা আমাদের ঘিরি
গনিতেছে প্রতি দণ্ড পল॥
নাই কি মা, মানবের গভীর ভাবনা,
হৃদয়ের সীমাহীন আশা।
জেগে নাই অন্তরেতে অনন্ত চেতনা,
জীবনের অনন্ত পিপাসা!
হৃদয়েতে শুষ্ক কি মা, উৎস করুণার,
শুনি না কি দুখীর ক্রন্দন।
জগৎ শুধু কি মা গো, তোমার আমার
ঘুমাবার কুসুম-আসন॥
শুনো না কাহারা ওই করে কানাকানি
অতি তুচ্ছ ছোটো ছোটো কথা—
পরের হৃদয় লয়ে করে টানাটানি
শকুনির মতো নির্মমতা।
শুনো না করিছে কারা কথা-কাটাকাটি
মাতিয়া জ্ঞানের অভিমানে—
রসনায় রসনায় ঘোর লাঠালাঠি,
আপনার বুদ্ধিরে বাখানে॥
আছে মা, তোমার মুখে স্বর্গের কিরণ,
হৃদয়েতে উষার আভাস,
খুঁজিছে সরল পথ ব্যাকুল, নয়ন,
চারি দিকে মর্তের প্রবাস।
আপনার ছায়া ফেলি আমরা সকলে
পথ তোর অন্ধকারে ঢাকি—
ক্ষুদ্র কথা, ক্ষুদ্র কাজ, ক্ষুদ্র শত ছলে
কেন তোরে ভুলাইয়া রাখি॥
তুমি এসো দূরে এসো পবিত্র নিভৃতে,
ক্ষুদ্র অভিমান যাও ভুলি।
সযতনে ঝেড়ে ফেলো বসন হইতে
প্রতি নিমেষের যত ধূলি।
নিমেষের ক্ষুদ্র কথা ক্ষুদ্র রেণুজাল
আচ্ছন্ন করিছে মানবেরে-
উদার অনন্ত তাই হতেছে আড়াল
তিল তিল ক্ষুদ্রতার ঘেরে॥
অনন্তের মাঝখানে দাঁড়াও মা আসি,
চেয়ে দেখো আকাশের পানে;
পড়ুক বিমল বিভা পূর্ণরূপরাশি
স্বর্গমুখী কমলনয়ানে।
আনন্দে ফুটিয়া ওঠো শুভ্র সূর্যোদয়ে
প্রভাতের কুসুমের মতো;
দাঁড়াও সায়াহ্ন-মাঝে পবিত্রহৃদয়ে
মাথাখানি করিয়া আনত॥
শোনো শোনো উঠিতেছে সুগম্ভীর বাণী,
ধ্বনিতেছে আকাশ পাতাল—
বিশ্বচরাচর গাহে কাহারে বাখানি
আদিহীন অন্তহীন কাল।
যাত্রী সবে ছুটিয়াছে শূন্যপথ দিয়া,
উঠেছে সংগীত-কোলাহল—
ওই নিখিলের সাথে কণ্ঠ মিলাইয়া
মা, আমরা যাত্রা করি চল্॥
যাত্রা করি বৃথা যত অহংকার হতে,
যাত্রা করি ছাড়ি হিংসাদ্বেষ;
যাত্রা করি স্বর্গময়ী করুণার পথে
শিরে ধরি সত্যের আদেশ।
যাত্রা করি মানবের হৃদয়ের মাঝে
প্রাণে লয়ে প্রেমের আলোক;
আয় মা গো, যাত্রা করি জগতের কাজে
তুচ্ছ করি নিজ দুঃখশোক॥
জেনো মা, এ সুখে-দুঃখে-আকুল সংসারে
মেটে না সকল তুচ্ছ আশ;
তা বলিয়া অভিমানে অনন্ত তাঁহারে
কোরো না কোরো না অবিশ্বাস।
সুখ ব'লে যাহা চাই সুখ তাহা নয়,
কী যে চাই জানি না আপনি;
আঁধারে জ্বলিছে ওই, ওরে কোরো ভয়—
ভুজঙ্গের মাথার ও মণি॥
কিছুই চাব না, মা গো, আপনার তরে—
পেয়েছি যা শুধিব সে ঋণ;
পেয়েছি যে প্রেমসুধা হৃদয়-ভিতরে
ঢালিয়া তা দিব নিশিদিন।
সুখ শুধু পাওয়া যায় সুখ না চাহিলে,
প্রেম দিলে প্রেমে পূরে প্রাণ,
নিশিদিশি আপনার ক্রন্দন গাহিলে
ক্রন্দনের নাহি অবসান॥
দাঁড়াও সে অন্তরের শান্তিনিকেতনে
চিরজ্যোতি চিরচ্ছায়াময়;
ঝড়হীন রৌদ্রহীন নিভৃত সদনে
জীবনের অনন্ত আলয়।
পুণ্য জ্যোতি মুখে লয়ে পুণ্য হাসিখানি
অন্নপূর্ণা জননী-সমান,
মহাসুখে সুখ দুঃখ কিছু নাহি মানি
করো সবে সুখশান্তি দান॥
মা আমার, এই জেনো হৃদয়ের সাধ—
তুমি হও লক্ষ্মীর প্রতিমা;
মানবেরে জ্যোতি দাও, করো আশীর্বাদ
অকলঙ্ক-মূর্তি মধুরিমা।
কাছে থেকে এত কথা বলা নাহি হয়,
হেসে খেলে দিন যায় কেটে;
দূরে ভয় হয় পাছে না পাই সময়,
বলিবার সাধ নাহি মেটে॥
কত কথা বলিবারে চাহি প্রাণপণে—
কিছুতে মা, বলিতে না পারি;
স্নেহমুখখানি তোর পড়ে মোর মনে,
নয়নে উথলে অশ্রুবারি।
সুন্দর মুখেতে তোর মগ্ন আছে ঘুমে
একখানি পবিত্র জীবন;
ফলুক সুন্দর ফল সুন্দর কুসুমে
আশীর্বাদ করো মা, গ্রহণ॥
২
চারি দিকে তর্ক উঠে সাঙ্গ নাহি হয়,
কথায় কথায় বাড়ে কথা।
সংশয়ের উপরেতে চাপিছে সংশয়,
কেবলি বাড়িছে ব্যাকুলতা।
ফেনার উপরে ফেনা, ঢেউ-’পরে ঢেউ
গরজনে বধির শ্রবণ-
তার কোন্ দিকে আছে নাহি জানে কেউ,
হা হা করে আকুল পবন॥
এই কল্লোলের মাঝে নিয়ে এসো কেহ
পরিপূর্ণ একটি জীবন—
নীরবে মিটিয়া যাবে সকল সন্দেহ,
থেমে যাবে সহস্ৰ বচন।
তোমার চরণে আসি মাগিবে মরণ
লক্ষ্যহারা শত শত মত,
যে দিকে ফিরাবে তুমি দুখানি নয়ন
সে দিকে হেরিবে সবে পথ॥
অন্ধকার নাহি যায় বিবাদ করিলে,
মানে না বাহুর আক্রমণ;
একটি আলোকশিখা সমুখে ধরিলে
নীরবে করে সে পলায়ন।
এসো মা, ঊষার আলো, অকলঙ্কপ্রাণ—
দাঁড়াও এ সংসার-আঁধারে;
জাগাও জাগ্রত হৃদে আনন্দের গান,
কূল দাও নিদ্রার পাথারে॥
চারি দিকে নৃশংসতা করে হানাহানি,
মানবের পাষাণপরান;
শানিত ছুরির মতো বিঁধাইয়া বাণী
হৃদয়ের রক্ত করে পান।
তৃষিত কাতর প্রাণী মাগিতেছে জল,
উল্কাধারা করিছে বর্ষণ,
শ্যামল আশার ক্ষেত্র করিয়া নিষ্ফল
স্বার্থ দিয়ে করিছে কর্ষণ॥
শুধু এসে একবার দাঁড়াও কাতরে
মেলি দুটি সকরুণ চোখ;
পড়ুক দু ফোঁটা অশ্রু জগতের 'পরে
যেন দুটি বাল্মীকির শ্লোক।
ব্যথিত করুক স্নান তোমার নয়নে
করুণার অমৃতনির্ঝরে;
তোমারে কাতর হেরি মানবের মনে
দয়া হবে মানবের 'পরে॥
সমুদয় মানবের সৌন্দর্যে ডুবিয়া
হও তুমি অক্ষয় সুন্দর-
ক্ষুদ্র রূপ কোথা যায় বাতাসে উবিয়া
দুই চারি পলকের পর।
তোমার সৌন্দর্যে হোক মানব সুন্দর,
প্রেমে তব বিশ্ব হোক আলো।
তোমারে হেরিয়া যেন মুগুধ-অন্তর
মানুষে মানুষ বাসে ভালো॥
৩
আমার এ গান, মা গো, শুধু কি নিমেষে
মিলাইবে হৃদয়ের কাছাকাছি এসে।
আমার প্রাণের কথা নিদ্রাহীন আকুলতা
শুধু নিশ্বাসের মতো যাবে কি মা, ভেসে॥
এ গান তোমারে সদা ঘিরে যেন রাখে,
সত্যের পথের 'পরে নাম ধ'রে ডাকে।
সংসারের সুখে দুখে চেয়ে থাকে তোর মুখে,
চির-আশীর্বাদ-সম কাছে কাছে থাকে॥
বিজনে সঙ্গীর মতো করে যেন বাস,
অনুক্ষণ শোনে তোর হৃদয়ের আশ;
পড়িয়া সংসারঘোরে কাঁদিতে হেরিলে তোরে
ভাগ ক'রে নেয় যেন দুখের নিশ্বাস॥
সংসারের প্রলোভন যবে আসি হানে
মধুমাখা বিষবাণী দুর্বল পরানে,
এ গান আপন সুরে মন তোর রাখে পুরে-
ইষ্টমন্ত্রসম সদা বাজে তোর কানে॥
আমার এ গান যেন সুদীর্ঘ জীবন
তোমার বসন হয়, তোমার ভূষণ—
পৃথিবীর ধূলিজাল ক'রে দেয় অন্তরাল,
তোমারে করিয়া রাখে সুন্দর শোভন॥
আমার এ গান যেন নাহি মানে মানা-
উদার বাতাস হয়ে এলাইয়া ডানা
সৌরভের মতো তোরে নিয়ে যায় চুরি ক'রে,
খুঁজিয়া দেখাতে যায় স্বর্গের সীমানা॥
এ গান যেন রে হয় তোর ধ্রুবতারা,
অন্ধকারে অনিমেষে নিশি করে সারা;
তোমার মুখের 'পরে জেগে থাকে স্নেহভরে,
অকূলে নয়ন মেলি দেখায় কিনাৱা॥
আমার এ গান যেন পশি তোর কানে
মিলায়ে মিশায়ে যায় সমস্ত পরানে—
তপ্ত শোণিতের মতো বহে শিরে অবিরত,
আনন্দে নাচিয়া উঠে মহত্ত্বের গানে॥
এ গান বাঁচিয়া থাকে যেন তোর মাঝে,
আঁখিতারা হয়ে তোর আঁখিতে বিরাজে।
এ যেন রে করে দান সতত নূতন প্রাণ,
এ যেন জীবন পায় জীবনের কাজে॥
যদি যাই, মৃত্যু যদি নিয়ে যায় ডাকি,
এই গানে রেখে যাব মোর স্নেহ-আঁখি।
যবে হায় সব গান হয়ে যাবে অবসান
এ গানের মাঝে আমি যেন বেঁচে থাকি॥