শিশূপদেশ


শিশূপদেশ।



ঢাকা জিলার অন্তর্গত পাঁচদোনা নিবাসি



শ্রীহরচন্দ্র সেন কর্ত্তৃক



বিরচিত



দ্বিতীয়বার মুদ্রিত



কলিকাতা



সুচারু যন্ত্রে শ্রীলালচাঁদ বিশ্বাস এণ্ড কোম্পানি কর্ত্তৃক
বাহির মৃজাপুর, ১৩ সঙ্খ্যক ভবনে মুদ্রিত।


১৮৬২।—১২৬৮।



[ মূল্য ৴৫ পয়সা মাত্র। ]





বিজ্ঞাপন।

 জনকজননী কর্ত্তৃক বালক-বালিকাগণ যে সমস্ত উপকার প্রাপ্ত হয়, এবং তাঁহাদের প্রতি বলকক-বালিকাদিগের যে ৰূপ ব্যবহার করা কর্ত্তব্য, তদ্বিষয় বিজ্ঞানার্থে এই পুস্তক সংগ্রহ করা গেল।

ঢাকা পাঁচদোনা
শ্রীহরচন্দ্র সেন


দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন।

 শিশূপদেশ দ্বিতীয়বার মুদ্রিত ও প্রচারিত হইল। এইবারে পূর্ব্ববারের অবিকল নাই, বালক বালিকাগণের সুখবোধ নিমিত্ত অনেক স্থানে সরল ভাষার প্রয়োগ করা গেল, এবং কোন কোন স্থান পরিবর্ত্তিত ও পরিবর্দ্ধিত হইল।

শ্রীহরচন্দ্র সেন



শিশূপদেশ।

 এই পৃথিবীমধ্যে আমাদের পিতামাতা হইতে গুরুতর কেহই নাই। সেই সর্ব্বপ্রধান মহামান্য জনকজননীর প্রতি অভক্তি কি তাঁহাদিগকে অমান্য করা সর্ব্বতোভাবে অকর্ত্তব্য। তাঁহাদদের সেবা ও সর্ব্বদা বাক্য প্রতিপালন করাই আমাদের কর্ত্তব্য কর্ম্ম। যাহারা জনকজননীকে অমান্য, অশ্রদ্ধা করে, তাঁহারা অবশ্য সর্ব্বকর্ত্তা পরমেশ্বরের নিকট অপরাধী হয় ও চিরকাল অশেষ পরিতাপ ভোগ করে, এবং তাদের অন্তকালেও পরমগতির সম্ভাবনা নাই। যতই পুণ্য কর্ম্ম করুক না কেন, যতই লোকের আদরণীয় হউক না কেন পিতামাতার প্রিয় না হইতে পারিলে তাহার কিছুতেই সুখ হইতে পারে না। দেখ দেখি, আমাদের নিমিত্ত জনকজননী কত ক্লেশ করিয়া লালন পালন করতঃ আমাদের সুখ ঐশ্বর্য্য জ্ঞানোপার্জ্জনের কতষ্ট অনুসন্ধান করিতে থাকেন, আমরা যদি ভক্তি শ্রদ্ধা ও বিনয় বাক্যে শুশ্রুষা না করি, তবে ইহা হইতে আমাদের পাপকর ব্যাপার আর কি আছে? আহা! কোন কোন হতভাগ্য ব্যক্তি সেই পরম গুরু জননীকে কত যাতনা দিয়া থাকে। কি পাপিষ্ঠ! বোধ করি, যাবৎ ব্রহ্মাণ্ড বর্ত্তমনে থাকে, তাবৎ তাহাদের নরকভোগ দূর হইবে না।

 সন্তাননিমিত্ত জনকজননী যে ক্লেশ ভোগ করিয়া থাকেন, তাহা ভাবিতে গেলে যাহার শরীরে দয়ার লেশ নাই, সেও দয়াবান হইতে পারে। যে ব্যক্তি মাতাপিতার ক্লেশ অবগত হইয়া তাঁহাদিগকে কায়মমোবাক্যে ভক্তি ও শুশ্রূষা করিবেন, তিনিই মনুষ্য নামের সম্পূর্ণ পত্র হইবেন, তাহার সন্দেহ নাই।


মাতা।

 মাতা আদৌ আমাদিগকে গর্ভে ধারণ করিয়া দশটি মাস যে পরিতাপ পাইয়াছেন, তাহা একবার মনে করিয়া দেখিলে কেবা দুঃখেতে অবশ না হইয়া থাকিতে পারেন, কার বা আর বাক্য বলিবার সমর্থ হইতে পারে, কেবা রোদন না করিয়া অধিক কাল স্থির থাকিতে পারেন্‌! আহা! মাতা সন্তানকে গৰ্ব্ভে ধারণ করিয়া কি শয়ন সময়, কি ভোজন সময়, কি অটন সময়, কিছুই সুখানুভব করিতে পারেন না, ক্ষুধা এবং পিপাসার নিবৃত্তি করিয়া আহার কি জলপান করিতে সমর্থ হন না। পরম সুখাদ্য সুকোমল সুগন্ধি দ্রব্যেও ইচ্ছা জন্মে না, শরীর একেবারে বিবর্ণ হইয়া যায়, দুই এক পদ গমন করিলে কত বড় আয়াস বোধ হয় যে, অবিশ্রামে মনুষ্যের তাবৎ দিন দৌড়িয়া চলিলেও এমত আয়াস বোধ হয় না। যতই গৰ্ব্ভস্থ সন্তান বৃদ্ধি পাইতে থাকে, ততই জননীর ক্লেশও অধিক হইতে থাকে, উদর গুরতর হওয়াতে বিষম ভার বোধ হয়, উঠিবার বসিবার শক্তি রহিত হয়। দেখ দেখি, আমরা পরিমিত আহার হইতে কিঞ্চিৎ গুরুতর আহার করিলে কত আলস্য বোধ করিয়া সুখকর কর্ম্মেও বিমুখ হইয়া থাকি, কেবল নিদ্রাই প্রিয় হইয়া উঠে। মাতার এ গুরুতর ভার বহন করা, কত বড় অসহ, কত বড় দুঃখকর। হা! বল দেখি, ইহা হইতে ক্লেশকর ব্যাপার কি আছে? মাতা এমত ক্লেশ পাইয়াও উদরস্থ সন্তান কি ৰূপে ভাল থাকিবে, কি মতেই বা অঙ্ক প্রত্যঙ্গ সবল হইবে, তাহার পরম যত্ন করিয়া থাকেন। যদি জঠরমধ্যগত বেদনা কিংবা অন্য কোন তাড়না উপস্থিত হয়, এবং যদ্যপি কর দ্বারা মর্দ্দন করিলে কিছুকাল উপশম হইবার সম্ভাবনা থাকে, তথাপি সন্তান পীড়িত কি অঙ্গভঙ্গ হইবে বিবেচনায় করস্পর্শও করেন না, কোন এক ঔষধ প্রয়োগ করিলে বেদনার লাঘব হইতে পারে, সন্তানটি বিনষ্ট হইবে, এ বিষম আশঙ্কায় তাহা নিকটেও আনিতে দেন না, কেবল মাত্র করুণস্বরে আর্ত্তনাদ করিয়া রোদন করিতে থাকেন, দেখ, যে সন্তান হইতে এত ক্লেশ, মাতা তাহার অমঙ্গল স্বপ্নেও দেখিতে পারেন না।

 আবার প্রসব সময় যে যাতনা উপস্থিত হয়, আহা! জননী সে যাতনা হইতে অবশ্য আত্মমরণ বাসনা করিয়া থাকেন, এমত বেদনা কি প্রাণিমণ্ডলের সহ্য হইতে পারে? কত অবলা দশমাস পর্য্যন্ত কত ক্লেশে কত যত্নে অপত্যকে গৰ্ব্ভে ধারণ করিয়া প্রসব সময় অপত্যযাতনা সহ্য করিতে না পারিয়া ভয়ানক কালের হাতে পতিত হইতেছে। কি পরিতাপের বিষয়! আমাদের কৃমি বা কোন উদরাময়জনিত যদি কোন দিবস উদরে বেদনা হয়, আমরা কত আর্ত্তনাদ করিয়া থাকি, কত বা ধূলায় লুণ্ঠিত হইতে থাকি, কত বা চীৎকার করিতা রোদন করিতে থাকি, পিতামাতা কত সুমধুস্বরে সম্বোধন করিয়া ক্রোড়ে করিতে উদ্যত হন, তাহাও আমাদের সুখকর বোধ হয় না। হা! প্রসবযাতনা ইহা হইতে কত বড় অধিক, কত বড় দুঃখকর অনুভব করিয়া কাহার সাধ্য যে সীমালাভ করিতে পারে। আহা! সন্তান ভূমিষ্ঠ হইবার সময় যে দুঃসহ জীবনবিনাশক ক্লেশটি উপস্থিত হয়, তাহাতে প্রাণরক্ষার কারণ কেবল জগদীশ্বরের করুণা ভিন্ন আর কিছুই নিশ্চিত হইতে পারে না। মাতা একেবারে মৃতকল্পা হইয়া যান, বাক্য বলিবার শক্তি থাকে না, তথাপি সন্তানটি রোদন করিলে ইচ্ছা করেন, যে ক্রেড়ে লইয়া তাহাকে শান্ত করি। মাতা এত অপত্যজনিত ক্লেশ ভোগ করিয়াও অপত্যদুঃখদর্শন করিতে পারেন না।

 এই ৰূপ পরম-স্নেহময়ী জননীকে প্রাণসংশয় যাতন দিয়া সম্ভানটি ভূমিষ্ঠ হয়। আবার লালন পালন করিতে কত ক্লেশ বোধ করিয়া থাকেন, শ্রবণ করিলে কাহার মনে ভক্তিভাব উদয় না হয়। মাতা সন্তানের মলমূত্র সকল স্বহস্তে দূর করিরা থাকেন, তাহাতে কিছু মাত্র ঘৃণা করেন না, বিষ্ঠা কি দুর্গন্ধি বস্তু আমাদের চক্ষুর নিকট হইলে আমরা ৰস্ত্র দ্বারা মালিকা আচ্ছাদন করিয়া থাকি। মাতা তাছাতে থুৎও পরিত্যাগ করেন না, আমরা মলমূত্রকে অশুচি বিবেচনা করিয়া থাকি, বালক বালিকার মলমূত্র জনক জননীয় শরীরে বস্ত্রেও লিপ্ত হইয়া থাকে কিছু মাত্র ঘৃণা কি বিরক্তি ভাৰেন না। বড় শীতের সময়ে সস্তান শয্যাতে প্রস্রাব করিলে সন্তানটিকে আপন স্থানে আনিয়া ঐ মূত্র মধ্যে আপনি কি কষ্টে রাত্রি শেষ করেন? আহা! আমরা শীতের সময় জলস্পর্শও করতে চাই না, করিলে কত ক্লেশ পাই, তৎক্ষণাৎ অগ্নির নিকট যাই, কিম্বা কোন এক উষ্ণকর বসনে কি স্থানে হস্তপদ সম্বরণ করয়া থাকি।

 শিশু সন্তান যদি কোন এক রোগগ্রস্ত হয়, তবে মাতা কি পর্য্যন্ত ক্লেশ করিয়া থাকেন, সকলেই দেখিতেছেন। মাতার কি আহার, কি বিহার, কি নিদ্রা, কি সুখের চেষ্টা, কিছুই থাকে না, রোগের যে পথ্য, যে ৰূপ আচরণ তাহা জননীই স্বীকার করিয়া থাকেন। সন্তানের আরোগ্য লাভের জন্যে কত উপবাস, কত বা দেবতার আরাধনা, কত বা লোকের নিকট বিনয় করিয়া থাকেন, যদি কেও বলে সর্ব্বস্ব দিলে সন্তান অরোগী হইবে, তাহাতেও অস্বীকার করেন না। সন্তানকে আপন প্রাণ হইতেও অধিক বিবেচনা করিয়া থাকেন। কি শয়ন করিতে, কি ভোজন করিতে, কি ঈশ্বরের অর্চ্চনা করিতে, সকল সময়ই মাতার সন্তানের মঙ্গল ভিন্ন আর কিছুই সঙ্কল্প নাই। যখন কোন এক দেবতার মূর্ত্তির বা দেবতুল্য কোন ব্যক্তিকে দর্শন করেন, আমার সন্তানটি সুখে থাকুক, চিরজীবী হউক, তাহার বিদ্যা হউক, এই বলিয়া একাগ্রচিত্ত্বে বিনয় পূর্ব্বক প্রার্থনা করিয়া থাকেন। পরম সুখাদ্য সুমিষ্ট দ্রব্য প্রস্তুত করিয়া দেবতাকে কি গুরুতর ব্যক্তিকে কি আপন মুখে কিঞ্চিন্মাত্রও না দিয়া আগে সন্তানের মুখে অৰ্পণ করেন। সন্তান আহার করিয়া পরিতৃপ্ত হইলে মাতার কত বড় আনন্দ হয়, এমত আনন্দ আর কিছুতেই হইতে পারে না।

 আমরা দেখিতেছি, কত কত অবোধ দুঃশীল বালক ইহা দে উহা দে ইহা খাব এই বলিয়া পরম গুরু জননীকে কত বা করাঘাত, কত বা পদাঘাত করিয়া থাকে, জননী তাহাতেও বিরক্তি ভাবিয়া থাকেন না, কটুবাক্য বলেন না, তাহার বাঞ্ছাসিদ্ধি করিবার জন্যই যত্ন করিয়া থাকেন। জননী এই ৰূপ নানা যন্ত্রণাতোগ ও সর্ব্বস্ব পণ করিয়া আপন সন্তানকে প্রতিপালন করিতেছেন, সেই জননীর স্নেহপ্রসাদেই আমাদের চক্ষুঃ কর্ণ নাসঙ্কা প্রভৃতি ইন্দ্রিয় সকল সবল হইতেছে।


পিতা।

 সন্তানের বাক্য প্রস্ফুটিত হইলে পিতা কি ৰূপে তনয়কে বিদ্বান্‌ করিবেন, তাহারই সুযুক্তি করিতে থাকেন। পুত্র জ্ঞানবান করিবার মানসে কত অর্থব্যয় করিয়া থাকেন, কত বা যাত্নিক হইয়া থাকেন। আপন সুখভোগ বিসর্জ্জিয়া যাহাতে পুত্রটি বিদ্যালাভ করিয়া পরমসুখে কালযাপন করিবে, দশজনের মধ্যে গণ্য হইবে, সকলে প্রশংসা করিবে, তাহাই দিবারাত্রি চিন্তা করিয়া থাকেন। সন্তানের ইচ্ছানুৰূপ বসন, ইচ্ছানুৰূপ ভূষণ, ইচ্ছানুৰূপ ভোজন দিতে ক্রটি করেন না। পুত্র গুণজ্ঞ হইলে পিতা যে ৰূপ অহ্লাদে প্রফুল্ল হন, সসাগরা পৃথিবীর আধিপত্য পাইলেও সে ৰূপ আহ্লাদিত হইবার সম্ভাবনা নাই।

 এই ৰূপে জনকজননী আমাদের মঙ্গল নিমিত্ত বস্তুতর যত্ন করিযা থাকেন। আমরা বলিষ্ঠ হইব বিবেচনায় সুখাদ্য সুমিষ্ট নানাবিধ উত্তম দ্রব্য আহার করাইতেছেন। আমরা বিদ্বান হইব বিবেচনায় বহুতর ধন ক্ষয় করিতেছেন। আমরা সচ্চরিত্র ছইব বিবেচনায় অশেষ প্রকার হিতোপদেশ দিতেছেন। মাতাপিতার আমাদের প্রতি রাগ করাও আমাদের মঙ্গল নিমিত্তই, আমাদের অমঙ্গল হউক এমত ভাব কখনই হইয়া থাকে না। আহা! আমরা পিতার কি মঙ্গল চিন্তা করিয়া থাকি, কিছুই করিতেছি না; কেবল আমাদের বিদ্যালাভ হইলে ঐ বিদ্যাই মাতাপিতা তাঁহাদের মঙ্গল বলিয়া বিবেচনা করিয়া থাকেন, এবং উহাদের লালন পালন সার্থক বোধ করেন।

 বল দেখি, অপরের মঙ্গলে আপন মঙ্গল জনকজননী ভিন্ন এ পৃথিবীমণ্ডলে কে গণ্য করিয়া থাকে? বিদ্যা আমাদেরই হিতকরী, আমাদেরই অর্থকরী, পিতামাতার কিছুই নয়। হা! মাতাপিতার কি আশ্চর্য্য ক্ষমতা। আমাদের সুখেই মাতাপিতার সুখ, আমাদের গুণেই মাতাপিতার গুণ, আমাদের ভোজনেই মাতাপিতার ভোজন, আমাদের দুঃখেই মাতাপিতার দুঃখ অনুভব হইয়া থাকে। আমাদের মুখ প্রফুল্প দেখিলে মাতা পিতার মুখ প্রফুল্ল হয়, আমাদের মুখ মলিন দেখিলে মাতাপিতার মুখ মলিন হয়, আপন প্রাণ হইতে সন্তানের প্রাণ অধিক বিবেচনা করেন, আপন শরীর হইতে সন্তানের শরীর অধিক ভূষিত করেন।

 আহা! আমরা, পিতামাতার কিছুই তত্ত্ব করিতেছি না, আমরা আত্মসুখেই মগ্ন থাকি, যাঁহার প্রসাদে বিশ্বপতির বিশ্বকৗশল স্বচক্ষে অবলোকন করিতেছি, যাঁহার প্রসাদে পৃথিবীতলে কত সুখামোদ করিতেছি, সেই জমকজননী ভিন্ন এ সংসারে আমাদের আর পরমারাধ্য কি আছে? সর্ব্ব শাস্ত্রেই বলিয়া থাকে, শরীর দ্বারা মনের দ্বারা বাক্যের দ্বারা মাতাপিতাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করিবে; মাতাপিতা সন্তানের দ্বারা সুখী হইলে জগদীশ্বরও পরিতুষ্ট হইয়া থাকেন।

 হে শিশুগণ! যাবজ্জীবন জনকজননীর আজ্ঞানুবর্ত্তী হইয়া একাগ্রমনে সেবা করিতে থাক, যাহাঁতে সেই পরম গুরুর আত্মা সর্ব্বদা তুষ্ট থাকে, তাহাতে যত্নবান হও, তাঁহাদের যাহা প্রিয় হইবে তাহাি করিবে, আজ্ঞা লঙ্ঘন করিবে না, এবং তাঁহাদের অপ্রিয় কর্ম্মে দৃষ্টিপাত করিবে না, মধুর বচনে পিতামাতাকে সম্ভাষণ করিবে; বিদ্বান্‌ পুত্র মাতাপিতার অত্যন্ত প্রিয় হইয়া থাকে, গুণবান পুত্রের তুল্য জনকজননীর আর পরম প্রিয় পাত্র নাই, অতএব অতি পরিশ্রমে অতি সাবধানে বিদ্যাশিক্ষা করিয়া মাতাপিতাকে আহ্লাদে প্রফুল্ল কর, মূর্খ পুত্র মাতাপিতার অতিদুঃখকর, মূর্খের সহিত কেও আলাপও করিয়া থাকে না।

 যাবজ্জীবন পিতামাতার বাক্য প্রতিপালন করা পুত্রের প্রধান কর্ম্ম। পিতামাতা যদি অসাধ্য কর্ম্ম করিতে তোমাদিগকে অনুমতি করেন, তাহাও অস্বীকার করিবে না! সাধ্যানুসারে যত্ন করিবে, যদি জনক জ্ননী অকর্ত্তব্য কর্ম্ম কবিতে বলেন, তাহাতেও হঠাৎ বিরোধী হইবে না, বিনয়ে মিষ্টবচনে ঐ অকর্ত্তব্য কর্ম্মের যে যে দোষ অর্থাং যে দোষবশতঃ অকর্ত্তব্য হইল, তাহা আদ্যোপান্ত নিবেদন করিবে, তবেই তোমাদের প্রতি স্নেহের সঞ্চার হইবে।

 সেই অকর্ত্তব্য কর্ম্ম করিতে আর পুনরাজ্ঞা করিবেন না। মনে মনে তোমাদের প্রশংসা ও জগদীশ্বরের নিকটে তোমাদের চিরজীবন প্রার্থনা করিবেন।

 তোমাদের যাহা যখন করিতে হইবে, মাতাপিতার নিকট হইতে অনুমতি গ্রহণ করিয়া প্রবৃত্ত হইবে। যে কর্ম্ম করিতে জনকজননী নিষেধ করিবেন, তাহা মনেও করিবে না, বিবেচনা করিবে, যদি ঐ কার্য্য আপন জনক জননীর হিতকর হয়, তবে অতি কাতরোক্তিতে বিনয় করিবে, তাহাতে বশীভূত না হইলে সদ্ব্যবহার ও সদালাপ ও সুকৌশল করিয়া আজ্ঞা গ্রহণ করিবে। পুত্র ক্লেশ পাইবে বিবেচনায় জনকজননী আপন সুখকর কর্ম্মেও তনয়কে নিয়োজিত করিয়া থাকেন না।

 বুদ্ধির কৌশল ক্রমে ঐ কর্ম্ম সাধন করিয়া মাতাপিতাকে সুখী করিবে। মাতাপিতা যদি কোন এক রোগে কাতর হন, তোমরা সর্ব্বক্ষণ নিকটে থাকি্যা যাহাতে মাতাপিতার ক্লেশ বোধ না হয়, সেই ৰূপ সেবা করিবে, এবং রোগের শান্তি নিমিত্ত চিকিৎসকেরা যে সকল ঔষধ প্রদান করিবে, তাহা যথা নিয়মে যথা সময়ে খাওয়াইবে। যদি কুপথ্যপ্রিয় হইয়া তোমাদিগকে কটুভাষা বলেন, তাহাতে রাগ করিবে না, সর্ব্বক্ষণ মিষ্টবাক্যে কুপথ্যের দোষ প্রকাশ করিতে থাকিবে। কখনই কুপথ্য করিতে দিবে না, তাহাতে যদি তোমাদের প্রতি অত্যন্ত বিরক্তও হন, সহ্য করিতে হইবে। যদি অত্যন্তু পীড়িত হইয় শয্যাতে কি গৃহমধ্যে মলমূত্র পরিত্যাগ করেন, তাহাতে ঘৃণা কি অশুচি বোধ করিবে না। আপন হস্তে দূরীকৃত করিয়া শয্যা কি স্থান তৎক্ষণাৎ পরিস্কৃত করলেও ক্ষতি হইবে না। আমাদের মলমূত্র যদি জনকজনীর অশুচি কি ঘৃণাকর না হইল, তবে আমাদের ঘৃণা ও অশুচি বোধ করা কোন মতেই কর্ত্তব্য নহে।

 আপন জনকজননীর প্রতি এরূপ ভক্তি প্রকাশ করা আমাদের কত বড় সুখের বিষয়। আমরা চিরকাল জনক জননীর পরম স্নেহের পাত্র হইব, জনসমাজে প্রতিষ্ঠিত হুইব, এবং সকল ব্যক্তিই সাদরে এবং স্নেহবচনে আমাদিগকে সম্ভাষণ করিবে, আমরা পরমামোদে পরিতৃপ্ত হইব, জগদীশ্বর আমাদের প্রতি কৃপবান হইয়া আমাদের শ্রীবৃদ্ধি করিবেন। শাস্ত্রকারেরা লিখিয়াছেন ‘পৃথিব্যাং গুরুতরা মাতা পিতাচ পরমে গুরুঃ’, অর্থাৎ ধরণীতলে প্রধান গুরুই মাতা এবং পরম গুরু পিতা।

 যে যাহার উপকার করে অবশ্য সে তাহার উপকার করিতে সুচেষ্টিত হইবে, দেখ দেখি, পোষিত পশু সকলও স্বামীর যথেষ্ট উপকারে চেষ্টিত হইতেছে। আমাদের পিতামাতা কর্ত্তৃক আমরা কত বড় উপকৃত হইতেছি। তাঁহাদের প্রতিপালনেই এই শরীর বৃদ্ধি হইয়াছে, এবং তাঁহাদের প্রসাদেই জগদীশ্বরের অপার কৌশল জানিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। যদি জনকজননী আমাদিগকে সস্নেহান্তঃকরণে প্রতিপালন না করিতেন, তবে অবশ্যই অকালে কালগ্রাসে পতিত হওয়ার অসম্ভাবনা ছিল না, এবং যদি আমাদিগকে বিদ্যামন্দিরে দিয়া উপদেশ বাক্য গ্রহণ ন করাইতেন, আমরা কখনই সেই পরম কারুণিক পরমেশ্বরের সুচারু বিশ্বকৌশল দর্শন করিতে পারিতাম না, যেমন প্রায় মানব জাতিই বৃদ্ধাবস্থায় চক্ষুঃসত্ত্বেও নেত্রদর্পণ অবলম্বন না করিলে ক্ষুদ্র অক্ষর সকল দেখিতে পারে না, মনুষ্য জ্ঞানদর্পণ বিহীনে নেত্র বিদ্যমানেও সংসারকৌশল সকল দর্শন করিতে পারে না, হিতাহিত বিবেচনা রহিত হইয়া অন্ধ প্রমত্ত মাতঙ্গের মত কত অসৎপথাবলম্বন করিতে থাকে। এই সকল দোষাবহ অহিতকর ব্যাপার হইতে নিবৃত্ত করার মানসেই জনকজননীর জ্ঞানার্জ্জন করাইবার প্রধান উদেশ্য। অতএব এই পরমোপকার ব্রতে ব্রতী জনক জননীর উপকার করিতে আমাদের সর্ব্বথ, চিত্ত স্থি্র করা কর্ত্তব্য/ আত্মক্লেশ দেখিলেও পরাঙ্মুখ হইবে না।

সম্পূর্ণম।

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।