শেষ সপ্তক/ছাব্বিশ
ছাব্বিশ
আকাশে চেয়ে দেখি
অবকাশের অন্ত নেই কোথাও।
দেশকালের সেই সুবিপুল আনুকূল্যে
তারায় তারায় নিঃশব্দ আলাপ,
তাদের দ্রুতবিচ্ছুরিত আলােকসংকেতে
তপস্বিনী নীরবতার ধ্যান কম্পমান।
অসংখ্যের ভারে পরিকীর্ণ আমার চিত্ত;
চার দিকে আশু প্রয়ােজনের কাঙালের দল;
অসীমের অবকাশকে খণ্ড খণ্ড ক'রে
ভিড় করেছে তারা
উৎকণ্ঠ কোলাহলে।
সংকীর্ণ জীবনে আমার স্বর তাই বিজড়িত,
সত্য পৌঁছয় না অনুজ্জ্বল বাণীতে।
প্রতি দিনের অভ্যস্ত কথার
মূল্য হল দীন,
অর্থ গেল মুছে।
আমার ভাষা যেন
কুয়াশার জড়িমায় অবমানিত
হেমন্তের বেলা,
তার সুর পড়েছে চাপা।
সুস্পষ্ট প্রভাতের মতাে
মন অনায়াসে মাথা তুলে বলতে পারে না-
'ভালােবাসি'।
সংকোচ লাগে কণ্ঠের কৃপণতায়।
তাই ওগাে বনস্পতি,
তােমার সম্মুখে এসে বসি সকালে বিকালে,
শ্যামচ্ছায়ায় সহজ করে নিতে চাই
আমার বাণী।
দেখি চেয়ে, তােমার পলবস্তবক
অনায়াসে পার হয়েছে
শাখাব্যুহের জটিলতা,
জয় করে নিয়েছে চার দিকে নিস্তব্ধ অবকাশ।
তােমার নিঃশব্দ উচ্ছ্বাস সেই উদার পথে
উত্তীর্ণ হয়ে যায়
সূর্যোদয়মহিমার মাঝে।
সেই পথ দিয়ে দক্ষিণবাতাসের স্রোতে
অনাদি প্রাণের মন্ত্র-
নব কিশলয়ের মর্মে এসে মেলে
বিশ্বহৃদয়ের সেই আনন্দমন্ত্র
‘ভালােবাসি'।
বিপুল ঔৎসুক্য আমাকে বহন করে নিয়ে যায়
সুদূরে;
বর্তমান মুহূর্তগুলিকে
অবলুপ্ত করে কালহীনতায়।
যেন কোন্ লােকান্তরগত চক্ষু
জন্মান্তর থেকে চেয়ে থাকে
আমার মুখের দিকে-
চেতনাকে নিষ্কারণ বেদনায়
সকল সীমার পরপারে দেয় পাঠিয়ে।
ঊর্ধবলােক থেকে কানে আসে
সৃষ্টির শাশ্বতবাণী-
‘ভালােবাসি'।
যেদিন যুগান্তরের রাত্রি হল অবসান
আলােকের রশ্মিদূত
বিকীর্ণ করেছিল এই আদিমবাণী
আকাশে আকাশে।
সৃষ্টিযুগের প্রথম লগ্নে
প্রাণসমুদ্রের মহাপ্লাবনে
তরঙ্গে তরঙ্গে দুলেছিল এই মন্ত্রবচন।
এই বাণীই দিনে দিনে রচনা কবেছে
স্বর্ণচ্ছটায় মানসী প্রতিমা
আমার বিরহগগনে
অস্তসাগরের নির্জন ধূসর উপকূলে।
আজ দিনান্তের অন্ধকারে
এ জন্মের যত ভাবনা, যত বেদনা,
নিবিড় চেতনায় সম্মিলিত হয়ে
সন্ধ্যাবেলার একলা তারার মতাে
জীবনের শেষবাণীতে হােক উদ্ভাসিত-
‘ভালােবাসি'।