নয়

ভালােবেসে মন বললে,
“আমার সব রাজত্ব দিলেম তােমাকে।”
অবুঝ ইচ্ছাটা করলে অত্যুক্তি।
দিতে পারবে কেন।
সবটার নাগাল পাব কেমন করে?
ও যে একটা মহাদেশ,
সাত সমুদ্রে বিচ্ছিন্ন।
ওখানে বহুদূর নিয়ে একা বিরাজ করছে
নির্বাক্ অনতিক্রমণীয়।
তার মাথা উঠেছে মেঘে-ঢাকা পাহাড়ের চূড়ায়,
তার পা নেমেছে আঁধারে-ঢাকা গহবরে।

এ যেন অগম্য গ্রহ এই আমার সত্তা,
বাম্প-আবরণে ফাঁক পড়েছে কোণে কোণে,
দুরবীনের সন্ধান সেইটুকুতেই।
যাকে বলতে পারি আমার সবটা,
তার নাম দেওয়া হয় নি,
তার নকশা শেষ হবে কবে!
তার সঙ্গে প্রত্যঙ্গ ব্যবহারের সম্পর্ক হবে কার!

নামটা রয়েছে যে পরিচয়টুকু নিয়ে
টুকরাে-জোড়া-দেওয়া তার রূপ,
অনাবিষ্কৃতের-প্রান্ত-থেকে-সংগ্রহ-করা।

চার দিকে ব্যর্থ ও সার্থক কামনার
আলােয় ছায়ায় বিকীর্ণ আকাশ।
সেখান থেকে নানা বেদনার রঙিন ছায়া নামে
চিত্তভূমিতে;
হাওয়ায় লাগে শীত-বসন্তের ছোঁওয়া-
সেই অদৃশ্যের চঞ্চল লীলা
কার কাছেই বা স্পষ্ট হল।
ভাষার অঞ্জলিতে
কে ধরতে পারে তাকে।
জীবনভূমির এক প্রান্ত দৃঢ় হয়েছে
কর্মবৈচিত্রের বন্ধুরতায়,
আর-এক প্রান্তে অচরিতার্থ সাধনা
বাষ্প হয়ে মেঘায়িত হল শূন্যে,
মরীচিকা হয়ে আঁকছে ছবি।
এই ব্যক্তিজগৎ মানবলােকে দেখা দিল
জন্মমৃত্যুর সংকীর্ণ সংগমস্থলে।
তার আলােকহীন প্রদেশে
বৃহৎ অগােচরতায় পুঞ্জিত আছে-

আত্মবিস্মৃত শক্তি,
মূল্য পায় নি এমন মহিমা,
অনঙ্কুরিত সফলতার বীজ মাটির তলায়
সেখানে আছে ভীরুর লজ্জা,
প্রচ্ছন্ন আত্মাবমাননা,
অখ্যাত ইতিহাস।
আছে আত্মাভিমানের
ছদ্মবেশের বহু উপকরণ;
সেখানে নিগূঢ় নিবিড় কালিমা
অপেক্ষা করছে মৃত্যুর হাতের মার্জনা।

এই অপরিণত অপ্রকাশিত আমি-
এ কার জন্যে, এ কিসের জন্যে।
যা নিয়ে এল কত সূচনা, কত ব্যঞ্জনা,
বহু বেদনায় বাঁধা হতে চলল যার ভাষা,
পৌঁছল না যা বাণীতে,
তার ধবংস হবে অকস্মাৎ নিরর্থকতার অতলে-
সইবে না সৃষ্টির এই ছেলেমানুষি।

অপ্রকাশের পর্দা টেনেই কাজ করেন গুণী;
ফুল থাকে কুঁড়ির অবগুণ্ঠনে;
শিল্পী আড়ালে রাখেন অসমাপ্ত শিল্পপ্রয়াসকে—

কিছু কিছু আভাস পাওয়া যায়,
নিষেধ আছে সমস্তটা দেখতে পাওয়ার পথে।

আমাতে তাঁর ধ্যান সম্পূর্ণ হয় নি,
তাই আমাকে বেষ্টন ক'রে এতখানি নিবিড় নিস্তব্ধতা।
তাই আমি অপ্রাপ্য, আমি অচেনা;
অজানার ঘেরের মধ্যে এ সৃষ্টি রয়েছে তাঁরই হাতে,
কারও চোখের সামনে ধরবার সময় আসে নি,
সবাই রইল দূরে-
যারা বললে ‘জানি’ তারা জানল না।

শান্তিনিকেতন
২৭।৩।৩৫