শৈশব সঙ্গীত/লীলা
“সাধিনু—কাঁদিনু—কতনা করিনু—
ধন মান যশ সকলি ধরিনু—
চরণের তলে তার—
এত করি তবু পেলেম না মন
ক্ষুদ্র এক বালিকার!
না যদি পেলেম—নাইবা পাইনু—
চাইনা চাইনা তারে!
কি ছার সে বালা!—তার তরে যদি
সহে তিল দুখ এ পুরুষ-হৃদি,
তা হলে পাষাণো ফেলিবে শোণিত
ফুলের কাঁটার ধারে!
এ কুমতি কেন হয়েছিল বিধি,
তারে সঁপিবারে গিয়েছিনু হৃদি!
এ নয়ন-জল ফেলিতে হইল
তাহার চরণ-তলে?
বিষাদের শ্বাস ফেলিনু, মজিয়া
তাহার কুহক বলে?
এত আঁখিজল হইল বিফল,
বালিকা হৃদয়, করিব যে জয়
নাই হেন মোর গুণ?
হীন রণধীরে ভালবাসে বালা;
তার গলে দিবে পরিণয় মালা!
এ কি লাজ নিদারুণ!
হেন অপমান নারিব সহিতে,
ঈর্ষ্যার অনল নারিব বহিতে,
ঈর্ষ্যা?—কারে ঈর্ষ্যা? হীন রণধীরে?
ঈর্ষ্যার ভাজন সেও হল কিরে
ঈর্ষা-যোগ্য সে কি মোর?
তবে শুন আজি—শ্মশান-কালিকা
শুন এ প্রতিজ্ঞা ঘোর!
আজ হতে মোর রণধীর অরি—
শত নৃ-কপাল তার রক্তে ভরি
করাবো তোমারে পান,
এ বিবাহ কভু দিবনা ঘটিতে
এ দেহে রহিতে প্রাণ!
তবে নমি তোমা—শ্মশান কালিকা!
শোণিত-লুলিতা—কপাল মালিকা!
কর এই বর দান—
তাহারি শোণিতে মিটায় পিপাসা
যেন মোর এ কৃপাণ!"
কহিতে কহিতে বিজন-নিশীথে
শুনিল বিজয় সুদুর হইতে
শত শত অট্ট হাসি—
একেবারে যেন উঠিল ধ্বনিয়া
শমশান শান্তিরে নাশি!
শত শত শিবা উঠিল কাঁদিয়া
কি জানি কিসের লাগি!
কুস্বপ্ন দেখিয়া শ্মশান যেন রে
চমকি উঠিল জাগি!
শতেক আলেয়া উঠিল জ্বলিয়া—
আঁধার হাসিল দশন মেলিয়া,
আবার যাইল মিশি!
সহসা থামিল অট্ট হাসি ধ্বনি,
শিবার রোদন থামিল অমনি,
আবার ভীষণ সুগভীরতর
নীরব হইল নিশি!
দেবীর সন্তোষ বুঝিয়া বিজয়
নমিল চরণে তাঁর।
মুখ নিদারুণ—আঁখি রোষারুণ—
হৃদয় জ্বলিছে রোষের আগুন
করে আসি খর ধার!
গিরি অধিপতি রণধীর গৃহে
লীলা আসিতেছে আজি,
গিরিবাসীগণ হরষে মেতেছে,
বাজানা উঠেছে বাজি।
অস্তে গেল রবি পশ্চিম শিখরে,
আইল গোধূলী কাল,
ধীরে ধরণীরে ফেলিল আবরি
সঘন আঁধার জাল।
ওই আসিতেছে লীলার শিবিকা
নৃপতি ভবন পানে—
শত অনুচর চলিয়াছে সাথে
মাতিয়া হরষ গানে।
জ্বলিছে আলোক—বাজিছে বাজনা
ধ্বনিতেছে দশ দিশি।
ক্রমশঃ আঁধার হইল নিবিড়
গভীর হইল নিশি।
চলেছে শিবিকা গিরিপথ দিয়া
সাবধানে অতিশয়,
বন মাঝ দিয়া গিয়াছে সে পথ
বড় সে সুগম নয়।
অনুচরগণ হরষে মাতিয়া
গাইছে হরষ গীত—
সে হরষ বনি—জন কোলাহল
ধ্বনিতেছে চারিভিত।
থামিল শিবিকা, পথের মাঝারে
থামে অনুচর দল
সহসা সভয়ে “দস্যু দসু” বলি
উঠিলরে কোলাহল।
শত বীর-হৃদি উঠিল নাচিয়া
বাহিরিল শত অসি,
শত শত শর মিটাইল তৃষা
বীরের হৃদয়ে পশি।
আঁধার ক্রমশঃ নিবিড় হইল
বাধিল বিষম রণ,
লীলার শিবিকা কাড়িয়া লইয়া
পলাইল দস্যুগণ।
কারাগার মাঝে বসিয়া রমণী
বরষিছে আঁখি জল।
বাহির হইতে উঠিছে গগনে
সমরের কোলাহল।
"হে মা ভগবতী—গুন এ মিনতি
বিপদে ডাকিব কারে!
পতি বোলে যাঁরে করেছি বরণ
বাঁচাও বাঁচাও তাঁরে!
মোর তরে কেন এ শোণিত-পাত
আমি মা—অবোধ বালা,
জনমিয়া আমি মরিনু না কেন
ঘুচিত সকল জ্বালা।”
কহিতে কহিতে উঠিল আকাশে
দ্বিগুণ সময়-ধ্বনি—
জয় জয় রব, আহতের স্বর
কৃপাণের ঝনঝনি!
সাঁজের জলদে ডুবে গেল রবি,
আকাশে উঠিল তারা;
একেলা বসিয়া বালিকা সে লীলা
কাঁদিয়া হতেছে সারা!
সহসা খুলিল কারাগার দ্বার–
বালিকা সভয় অতি,—
কঠোর কটাক্ষ হানিতে হানিতে
বিজয় পশিল তথি।
অসি হতে ঝরে শোণিতের ফোঁটা,
শোণিতে মাখানো বাস,
শোণিতে মাখানো মুখের মাঝারে
ফুটে নিদারুণ হাস!
অবাক্ বালিকা;—বিজয় তখন
কহিল গভীর রবে,
"সমর বারতা শুনেছ কুমারী?
সে কথা শুনিবে তবে?”
"বুঝেছি—বুঝেঝি, জেনেছি—জেনেছি!
বলিতে হবেনা আর,—
না—না, বল বল—শুনিব সকলি
যাহা আছে শুনিবার।
এই বাঁধিলাম পাষাণে হৃদয়,
বল কি বলিতে আছে।
যত ভয়ানক হোক্না সে কথা
লুকায়োনা মোর কাছে।”
"শুন তবে বলি” কছিল বিজয়
তুলি অসি খর ধার—
"এই আসি দিয়ে বধি রণধীরে
হরেছি ধরার ভার।”
"পামর, নিদয়—পাষাণ, পিশাচ।”
মূরছি পড়িল লীলা,
অলীক বারতা কহিয়া বিজয়
কারণ হতে বাহিরিলা।
সমরের ধ্বনি থামিল ক্রমশঃ,
নিশা হল সুগভীর।
বিজয়ের সেনা পলাইল রণে—
জয়ী হল রণধীর।
কারাগার মাঝে পশি রণধীর
করিল অধীর স্বরে—
"লীলা!—রণধীর এসেছে তোমার
এস এ বুকের পরে!"
ভূমিতল হতে চাহি দেখে লীলা
সহসা চমকি উঠি,
হরষ-আলোকে জ্বলিতে লাগিল
লীলার নয়ন দুটি।
"এস নাথ এস অভাগীর পাশে
বস একবার হেথা,
জনমের মত দেখি ও মুখানি
শুনি ও মধুর কথা।
ডাক নাথ সেই আদরের নামে
ডাক মোরে স্নেহভরে,
এ অবশ মাথা তুলে লও সখা
তোমার বুকের পরে!"
লীলার হৃদয়ে ছুরিকা বিঁধানো
বহিছে শোণিত ধারা—
রহে রণধীর পলক বিহীন
যেন পাগলের পারা।
রণধীর বুকে মুখ লুকাইয়া
গলে বাঁধি বাহুপাশ;
কাঁদিয়া কাঁদিয়া কহিল বালিকা,
"পূরিল না কোন আশ।
মরিবার সাধ ছিল না আমার
কত ছিল সুখ আশা।
পারিনু না সখা করিবারে ভোগ
তোমার ও ভালবাসা।
হারে হা পামর, কি করিলি তুই?
নিদারুণ প্রতারণা!
এত দিনকার সুখ সাধ মোর
পূরিল না পূরিল না।”
এত বলি ধীরে অবশ বালিকা
কোলে তার মাথা রাখি—
রণধীর মুখে রহিল চাহিয়া
মেলি অনিমেষ আঁখি।
রণধীর যবে শুনিল সকল
বিজয়ের প্রতারণা,
বীরের নয়নে জ্বলিয়া উঠিল
রোষের অনল-কণা।
'পৃথিবীর মুখ ফুরালো আমার,
বাঁচিবার সাধ নাই।
এর প্রতিশোধ তুলিতে হইবে,
বাঁচিয়া রহিব তাই।'
লীলার জীবন আইল ফুরায়ে
মুদিল নয়ন দুটি,
শোকে রোষানলে জ্বলি রণধীর
রণভূমে এল ছুটি।
দেখে বিজয়ের মৃতদেহ সেই
রয়েছে পড়িয়া সমর-ভূমে।
রণধীর যবে মরিছে জ্বলিয়া
বিজয় ঘুমায় মরণ ঘুমে।