শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব)/অষ্টম পরিচ্ছেদ
৮
লিখিতে বসিয়া আমি অনেক সময়ই আশ্চর্য্য হইয়া ভাবি, এই সব এলোমেলো ঘটনা আমার মনের মধ্যে এমন করিয়া পরিপাটিভাবে সাজাইয়া রাখিয়াছিল কে? যেমন করিয়া বলি, তেমন করিয়া ত তাহারা একটির পর একটি শৃঙ্খলিত হইয়া ঘটে নাই। আবার তাই কি সেই শিকলের সকল গ্রন্থিগুলিই বজায় আছে? তাও ত নাই। কত হারাইয়া গিয়াছে টের পাই, কিন্তু তবু ত শিকল ছিঁড়িয়া যায় না! কে তবে নূতন করিয়া এ সব জোড়া দিয়া রাখে?
আরও একটা বিস্ময়ের বস্তু আছে। পণ্ডিতেরা বলেন, বড়দের চাপে ছোটরা গুঁড়াইয়া যায়। কিন্তু তাই যদি হয়, তবে জীবনের প্রধান ও মুখ্য ঘটনাগুলিই ত কেবল মনে থাকিবার কথা। কিন্তু তাও ত দেখি না। ছেলে-বেলার কথা-প্রসঙ্গে হঠাৎ এক সময়ে দেখিতে পাই, স্মৃতির মন্দিরে অনেক তুচ্ছ ক্ষুদ্র ঘটনাও কেমন করিয়া না জানি বেশ বড় হইয়া জাঁকিয়া বসিয়া গিয়াছে, এবং বড়রা ছোট হইয়া কবে কোথায় ঝরিয়া পড়িয়া গেছে। অতএব বলিবার সময়েও ঠিক তাহা ঘটে। তুচ্ছ, বড় হইয়া দেখা দেয়, বড়, মনেও পড়ে না। অথচ কেন যে এমন হয়, সে কৈফিয়ৎ আমি পাঠককে দিতে পারিব না, শুধু যা ঘটে, তাহা জানাইয়া দিলাম।
এমনি একটা তুচ্ছ বিষয়ে যে মনের মধ্যে এতদিন নীরবে, এমন সঙ্গোপনে এত বড় হইয়া উঠিয়াছিল, আজ তাহার সন্ধান পাইয়া আমি নিজেও বড় বিস্মিত হইয়া গেছি। সেইটাই আজ পাঠককে বলিব। অথচ জিনিষটি ঠিক কি, তাহার সমস্ত পরিচয়টা না দেওয়া পর্য্যন্ত, চেহারাটা কিছুতেই পরিষ্কার হইবে না। কারণ গোড়াতেই যদি বলি—সে একটা প্রেমের ইতিহাস—মিথ্যাভাষণের পাপ তাহাতে হইবে না বটে, কিন্তু ব্যাপারটা নিজের চেষ্টায় যতটা বড় হইয়া উঠিয়াছে, আমার ভাষাটা হয় ত তাহাকেও ডিঙ্গাইয়া যাইবে। সুতরাং অত্যন্ত সতর্ক হইয়া বলা আবশ্যক।
সে বহুকাল পরের কথা। দিদির স্মৃতিটাও তখন ঝাপ্সা হইয়া গেছে। যাঁর মুখখানি মনে করিলেই, কি জানি কেন প্রথম যৌবনের উচ্ছৃঙ্খলতা আপনি মাথা হেঁট করিয়া দাঁড়াইত, সে দিদিকে আর তখন তেমন করিয়া মনে পড়িত না। এ সেই সময়ের কথা। এক রাজার ছেলের নিমন্ত্রণে তাঁর শিকার-পার্টিতে গিয়া উপস্থিত হইয়াছি। এঁর সঙ্গে অনেকদিন স্কুলে পড়িয়াছি, গোপনে অনেক আঁক কষিয়া দিয়াছি—তাই তখন ভারি ভাব ছিল। তার পরে এণ্ট্রান্স ক্লাস হইতে ছাড়াছাড়ি। রাজার ছেলেদের স্মৃতিশক্তি কম, তাও জানি। কিন্তু ইনি যে মনে করিয়া চিঠিপত্র লিখিতে সুরু করিবেন, ভাবি নাই। মাঝে হঠাৎ একদিন দেখা। তখন সবে সাবালক হইয়াছেন। অনেক জমানো টাকা হাতে পড়িয়াছে এবং তার পরে ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজার ছেলের কানে গিয়াছে—অতিরঞ্জিত হইয়াই গিয়াছে—রাইফেল চালাইতে আমার জুড়ি নাই; এবং আরও এত প্রকারের গুণগ্রামে ইতিমধ্যে মণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছি যে, একমাত্র সাবালক রাজপুত্রেরই অন্তরঙ্গ বন্ধু হইবার আমি উপযুক্ত। তবে কিনা, আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবেরা আপনার লোকের সুখ্যাতিটা একটু বাড়াইয়াই করে, না হইলে সত্য সত্যই যে অতখানি বিদ্যা অমন বেশি পরিমাণে ওই বয়সটাতেও অর্জ্জন করিতে পারিয়াছিলাম, সে অহঙ্কার করা আমার শোভা পায় না, অন্ততঃ একটু বিনয় থাকা ভাল। কিন্তু যাক্ সে কথা। শাস্ত্রকারেরা বলেন, রাজা-রাজড়ার সাদর আহ্বান কখনো উপেক্ষা করিবে না। হিঁদুর ছেলে, শাস্ত্র অমান্য করিতে ত আর পারি না। কাজেই গেলাম। ষ্টেশন হইতে দশ-বারো ক্রোশ পথ গজপৃষ্ঠে গিয়া দেখি, হাঁ, রাজপুত্রের সাবালকের লক্ষণ বটে। গোটা-পাঁচেক তাঁবু পড়িয়াছে। একটা তাঁর নিজস্ব, একটা বন্ধুদের, একটা ভৃত্যদের, একটায় খাবার বন্দোবস্ত। আর একটা অমনি একটু দূরে—সেটা ভাগ করিয়া জন-দুই বাইজী ও তাঁহাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের আড্ডা।
তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছে। রাজপুত্রের খাস-কামরায় অনেকক্ষণ হইতেই যে সঙ্গীতের বৈঠক বসিয়াছে, তাহা প্রবেশমাত্রই টের পাইলাম। রাজপুত্র অত্যন্ত সমাদরে আমাকে গ্রহণ করিলেন। এমন কি আদরের আতিশয্যে দাঁড়াইবার আয়োজন করিয়া, তিনি তাকিয়ায় ঠেস্ দিয়া শুইয়া পড়িলেন। বন্ধু-বান্ধবেরা বিহ্বল কলকণ্ঠে সংবর্দ্ধনা করিতে লাগিলেন। আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত। কিন্তু সেটা, তাঁহাদের যে অবস্থা, তাহাতে অপরিচয়ের জন্য বাধে না।
এই বাইজীটি পাটনা হইতে অনেক টাকার সর্ত্তে দুই সপ্তাহের জন্য আসিয়াছেন। এইখানে রাজকুমার যে বিবেচনা এবং যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়াছেন, সে কথা স্বীকার করিতেই হইবে। বাইজী সুশ্রী, অতিশয় সুকণ্ঠ, এবং গাহিতে জানে।
আমি প্রবেশ করিতেই গানটা থামিয়া গিয়াছিল। তার পর সময়োচিত বাক্যালাপ ও আদব-কায়দা সমাপন করিতে কিছুক্ষণ গেল। রাজপুত্র অনুগ্রহ করিয়া আমাকে গান ফর্মাস করিতে অনুরোধ করিলেন। রাজাজ্ঞা শুনিয়া প্রথমটা অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া উঠিলাম, কিন্তু অল্প কিছুক্ষণেই বুঝিলাম, এই সঙ্গীতের মজলিসে আমিই যা-হোক একটু ঝাপ্সা দেখি, আর সবাই ছুঁচোর মত কাণা।
বাইজী প্রফুল্ল হইয়া উঠিলেন। পয়সার লোভে অনেক কাজই পারা যায় জানি। কিন্তু এই নিরেটের দরবারে বীণা-বাজানো বাস্তবিকই এতক্ষণ তাহার একটা সুকঠিন কাজ হইতেছিল। এইবার একজন সমঝদার পাইয়া সে যেন বাঁচিয়া গেল। তার পরে গভীর রাত্রি পর্য্যন্ত সে যেন শুধুমাত্র আমার জন্যই, তাহার সমস্ত শিক্ষা, সমস্ত সৌন্দর্য্য ও কণ্ঠের সমস্ত মাধুর্য্য দিয়া আমার চারিদিকের এই সমস্ত কদর্য্য মদোন্মত্ততা ডুবাইয়া অবশেষে স্তব্ধ হইয়া আসিল।
বাইজী পাটনার লোক—নাম পিয়ারী। সে রাত্রে আমাকে সে যেমন করিয়া সমস্ত প্রাণ দিয়া গান শুনাইয়াছিল, বোধ করি এমন আর সে কখনও শুনায় নাই। মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলাম। গান থামিলে আমার মুখ দিয়া শুধু বাহির হইল—বেশ!
পিয়ারী মুখ নিচু করিয়া হাসিল। তারপর দুই হাত কপালে ঠেকাইয়া প্রণাম করিল—সেলাম করিল না। মজ্লিস রাত্রির মত শেষ হইয়াছিল।
তখন দলের মধ্যে কেহ সুপ্ত, কেহ তন্দ্রাভিভূত—অধিকাংশই অচৈতন্য। নিজের তাঁবুতে যাইবার জন্য বাইজী যখন তাহার দলবল লইয়া বাহির হইতেছিল, আমি তখন আনন্দের আতিশয্যে হিন্দী করিয়া বলিয়া ফেলিলাম, বাইজী, আমার বড় সৌভাগ্য যে, তোমার গান দু-সপ্তাহ ধ’রে প্রত্যহ শুন্তে পাব।
বাইজী প্রথমটা থমকিয়া দাঁড়াইল। পরক্ষণেই একটুখানি কাছে সরিয়া আসিয়া অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে পরিষ্কার বাঙ্গালা করিয়া কহিল, টাকা নিয়েছি, আমাকে ত গাইতেই হবে, কিন্তু আপনি এই পনেরো ষোল-দিন ধ’রে এঁর মোসাহেবি করবেন? যান, কালকেই বাড়ী চ’লে যান।
কথা শুনিয়া আমি হতবুদ্ধি, কাঠ হইয়া গেলাম এবং কি জবাব দিব, তাহা ভাবিয়া ঠিক করিবার পূর্ব্বেই, বাইজী বাহির হইয়া গেল। সকালে সোর-গোল করিয়া কুমারজী শিকারে বাহির হইলেন। মদ্য-মাংসের আয়োজনটাই সবচেয়ে বেশি। সঙ্গে জন-দশেক শিকারী অনুচর। বন্দুক পনরটা—তার মধ্যে ছয়টা রাইফেল। স্থান—একটা আধশুক্না নদীর উভয় তীর! এপারে গ্রাম, ওপারে বালুর চর। এপারে ক্রোশ ব্যাপিয়া বড় বড় শিমূলগাছ, ওপারে বালুর উপর স্থানে স্থানে কাশ ও কুশের ঝোপ। এইখানে এই পনরটা বন্দুক লইয়া শিকার করিতে হইবে। শিমূল গাছে-গাছে ঘুঘু গোটা-কয়েক দেখিলাম, মরা নদীর বাঁকের কাছটায়ও দুটো চকাচকি ভাসিতেছে বলিয়াই মনে হইল।
কে কোন্ দিকে যাইবেন, অত্যন্ত উৎসাহের সহিত পরামর্শ করিতে করিতেই সবাই দুই-এক পাত্র টানিয়া লইয়া দেহ ও মন বীরের মত করিয়া লইলেন। আমি বন্দুক রাখিয়া দিলাম। একে বাইজীর খোঁচা খাইয়া রাত্রি হইতেই মনটা বিকল হইয়াছিল, তাহাতে শিকারের ক্ষেত্র দেখিয়া সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল।
কুমার প্রশ্ন করিলেন, কি হে কান্ত, তুমি বড় চুপচাপ? ও কি, বন্দুক রেখে দিলে যে!
আমি পাখি মারি না।
সে কি হে? কেন, কেন?
আমি গোঁফ ওঠবার পর থেকে আর ছর্রা দেওয়া বন্দুক ছুঁড়িনি—ও আমি ভুলে গেছি।
কুমার সাহেব হাসিয়াই খুন। কিন্তু সে হাসির কতটা দ্রব্যগুণে, সে কথা অবশ্য আলাদা।
সূরযুর চোখ-মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল। তিনিই এ দলের প্রধান শিকারী এবং রাজপুত্রের প্রিয় পার্শ্বচর। তাঁহার অব্যর্থ লক্ষ্যের খ্যাতি আমি আসিয়াই শুনিয়াছিলাম॥ রুষ্ট হইয়া কহিলেন, চিড়িয়া শিকারমে কুছ্ সরম হ্যায়?
আমারও মেজাজ ত ভাল ছিল না, সুতরাং জবাব দিলাম, সবাইকার নেহি হ্যায়, কিন্তু আমার হ্যায়! যাক্ আমি তাঁবুতে ফিরিলাম—কুমারসাহেব, আমার শরীরটা ভাল নেই, বলিয়া ফিরিলাম। ইহাতে কে হাসিল, কে চোখ ঘুরাইল, কে মুখ ভ্যাঙাইল, তাহা চাহিয়াও দেখিলাম না।
তখন সবেমাত্র তাঁবুতে ফিরিয়া ফরাসের উপর চিৎ হইয়া পড়িয়াছি এবং আর-এক পেয়ালা চা আদেশ করিয়া একটা সিগারেট ধরাইয়াছি, বেয়ারা আসিয়া সসম্ভ্রমে জানাইল, বাইজী একবার সাক্ষাৎ করিতে চায়। ঠিক এইটি আশাও করিতেছিলাম, আশঙ্কাও করিতেছিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, কেন সাক্ষাৎ করিতে চায়?
তা জানিনে।
তুমি কে?
আমি বাইজীর খান্সামা।
তুমি বাঙ্গালী?
আজ্ঞে হাঁ—পরামাণিক। নাম রতন।
বাইজী হিন্দু?
রতন হাসিয়া বলিল, নইলে থাক্ব কেন বাবু?
আমাকে সঙ্গে করিয়া আসিয়া তাঁবুর দরজা দেখাইয়া দিয়া রতন সরিয়া গেল। পর্দ্দা তুলিয়া ভিতরে ঢুকিয়া দেখিলাম, বাইজী একাকিনী প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া আছে। কাল রাত্রে পেশোয়াজ ও ওড়নায় ঠিক চিনিতে পারি নাই; আজ দেখিয়াই টের পাইলাম, বাইজী যেই হোক, বাঙ্গালীর মেয়ে বটে। একখণ্ড মূল্যবান কার্পেটের উপর গরদের শাড়ী পরিয়া বাইজী বসিয়া আছে। ভিজা এলোচুল পিঠের উপর ছড়ানো; হাতের কাছে পানের সাজ-সরঞ্জাম, সুমুখে গুড়গুড়িতে তামাক সাজা। আমাকে দেখিয়া গাত্রোত্থান করিয়া হাসিমুখে সুমুখের আসনটা দেখাইয়া দিয়া কহিল, বোসো। তোমার সুমুখে তামাকটা খাবো না আর—ওরে রতন, গুড়গুড়িটা নিয়ে যা। ওকি দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বোসো না?
রতন আসিয়া গুড়গুড়ি লইয়া গেল। বাইজী কহিল,—তুমি তামাক খাও তা জানি; কিন্তু দেব কিসে? অন্য জায়গায় যা কর, তা কর; কিন্তু আমি জেনেশুনে আমার গুড়গুড়িটা ত আর তোমাকে দিতে পারি নে। আচ্ছা, চুরুট আনিয়ে দিচ্চি—ওরে ও—
থাক থাক, চুরুটে কাজ নেই; আমার পকেটেই আছে।
আছে? বেশ তা হ’লে ঠাণ্ডা হয়ে একটু বসো; ঢের কথা আছে। ভগবান কখন যে কার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন, তা কেউ বল্তে পারে না। স্বপ্নের অগোচর। শিকারে গিয়েছিলে, হঠাৎ ফিরে এলে যে?
ভাল লাগলো না।
না লাগ্বারই কথা। কি নিষ্ঠুর এই পুরুষমানুষ জাতটা। অনর্থক জীবহত্যা ক’রে কি আমোদ পায়, তা তারাই জানে। বাবা ভাল আছেন?
বাবা মারা গেছেন।
মারা গেছেন! মা?
তিনি আগেই গেছেন।
ওঃ—তাইতেই, বলিয়া বাইজী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া আমার মুখপানে চাহিয়া রহিল। একবার মনে হইল, তাহার চোখ দুটি যেন ছলছল করিয়া উঠিল। কিন্তু সে হয়ত আমার মনের ভুল। পরক্ষণেই যখন সে কথা কহিল, তখন আর ভুল রহিল না যে, এই মুখরা নারীর চটুল ও পরিহাস-লঘু কণ্ঠস্বর সত্য সত্যই মৃদু ও আর্দ্র হইয়া গিয়াছে। কহিল, তা হ’লে যত্নটত্ন করবার আর কেউ নেই, বল। পিসিমার ওখানেই আছ ত? নইলে আর থাক্বেই বা কোথায়? বিয়ে হয়নি, সে ত দেখতেই পাচ্চি। পড়াশুনা কর্চ? না, তাও ঐ সঙ্গে শেষ ক’রে দিয়েচ?
এতক্ষণ পর্য্যন্ত ইহার কৌতূহল এবং প্রশ্নমালা আমি যথাসাধ্য সহ্য করিয়া গিয়াছি। কিন্তু এই শেষ কথাটা কেমন যেন হঠাৎ অসহ্য হইয়া উঠিল। বিরক্ত এবং রুক্ষকণ্ঠে বলিয়া উঠিলাম, আচ্ছা, কে তুমি? তোমাকে জীবনে কখনো দেখেচি ব’লেও ত মনে হয় না। আমার সম্বন্ধে এত কথা তুমি জান্তে চাইচই বা কেন? আর জেনেই বা তোমার লাভ কি।
বাইজী রাগ করিল না, হাসিল; কহিল, লাভ-ক্ষতিই কি সংসারে সব? মায়া, মমতা, ভালবাসাটা কি কিছু নয়? আমার নাম পিয়ারী, কিন্তু আমার মুখ দেখেও যখন চিন্তে পার্লে না, তখন ছেলেবেলার ডাকনাম শুনেই কি আমাকে চিন্তে পার্বে? তা ছাড়া আমি তোমাদের—ও গ্রামের মেয়েও নই।
আচ্ছা তোমাদের বাড়ী কোথায় বল?
না, সে আমি বল্ব না।
তবে তোমার বাবার নাম কি বল?
বাইজী জিভ্ কাটিয়া কহিল, তিনি স্বর্গে গেছেন। ছি-ছি, তাঁর নাম কি আর এ মুখে উচ্চারণ কর্তে পারি?
আমি অধীর হইয়া উঠিলাম। বলিলাম, তা যদি না পারো, আমাকে চিন্লে কি ক’রে, সে কথা বোধ হয় উচ্চারণ কর্তে দোষ হবে না?
পিয়ারী আমার মনের ভাব লক্ষ্য করিয়া আবার মুখ টিপিয়া হাসিল। কহিল, না, তাতে দোষ নাই। কিন্তু সে কি তুমি বিশ্বাস করতে পার্বে?
বলেই দেখ না।
পিয়ারী কহিল, তোমাকে চিনেছিলাম ঠাকুর, দুর্ব্বুদ্ধির তাড়ায়—আর কিসে? তুমি যত চোখের জল আমার ফেলেছিলে, ভাগ্যি সূয্যিদেব তা শুকিয়ে নিয়েচেন, নইলে চোখের জলের একটা পুকুর হয়ে থাক্তো। বলি বিশ্বাস করতে পারো কি?
সত্যই বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। কিন্তু সে আমারই ভুল। তখন কিছুতেই মনে পড়িল না যে, পিয়ারীর ঠোঁটের গঠনই এইরূপ—যেন সব কথাই সে তামাশা করিয়া বলিতেছে, এবং মনে মনে হাসিতেছে। আমি চুপ করিয়া রহিলাম। সেও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া এবার সত্য সত্যই হাসিয়া উঠিল। কিন্তু এতক্ষণে কেমন করিয়া জানি না, আমার সহসা মনে হইল, সে নিজের লজ্জিত অবস্থা যেন সাম্লাইয়া ফেলিল। সহাস্যে কহিল, না ঠাকুর, তোমাকে যত বোকা ভেবেছিলুম, তুমি তা নও। এ যে আমার একটা বলার ভঙ্গি, তা তুমি ঠিক ধরেচ। কিন্তু তাও বলি, তোমার চেয়ে অনেক বুদ্ধিমানও আমার এই কথাটায় অবিশ্বাস করতে পারেনি। তা এতই যদি বুদ্ধিমান, তবে মোসাহেবী ব্যবসাটা ধরা হ’ল কেন? এ চাকরী ত তোমাদের মত মানুষ দিয়ে হয় না। যাও, চট্পট্ স’রে পড়।
ক্রোধে সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল; কিন্তু প্রকাশ পাইতে দিলাম না। সহজভাবে বলিলাম, চাকরী যতদিন হয়, ততদিনই ভাল। ব’সে না থাকি বেগার খাটি—জান ত? আচ্ছা, এখন উঠি। বাইরের লোক হয় ত বা কিছু মনে ক’রে বস্বে।
পিয়ারী কহিল, কর্লে সে ত তোমার সৌভাগ্য ঠাকুর! এ কি আর একটা আপ্শোষের কথা?
উত্তর না দিয়া যখন আমি দ্বারের কাছে আসিয়া পড়িয়াছি, তখন সে অকস্মাৎ হাসির লহর তুলিয়া বলিয়া উঠিল, কিন্তু দেখো ভাই, আমার সেই চোখের জলের গল্পটা যেন ভুলে যেয়ো না। বন্ধু-মহলে, কুমারসাহেবের দরবারে প্রকাশ কর্লে—চাই কি তোমার নসিবটাই হয় ত ফিরে যেতে পারে।
আমি নিরুত্তরে বাহির হইয়া পড়িলাম। কিন্তু এই নির্লজ্জার হাসি এবং কদর্য্য পরিহাস আমার সর্ব্বাঙ্গ ব্যাপিয়া যেন বিছার কামড়ের মত জ্বলিতে লাগিল।
স্বস্থানে আসিয়া এক পেয়ালা চা খাইয়া চুরুট ধরাইয়া মাথা যথাসম্ভব ঠাণ্ডা করিয়া ভাবিতে লাগিলাম—কে এ? আমার পাঁচবছর বয়সের ঘটনা পর্য্যন্ত আমি স্পষ্ট মনে করিতে পারি। কিন্তু অতীতের মধ্যে যতদূর দৃষ্টি যায়, ততদূর পর্য্যন্ত তন্ন তন্ন করিয়া দেখিলাম, কোথাও এই পিয়ারীকে খুঁজিয়া পাইলাম না। অথচ এ আমাকে বেশ চিনে। পিসিমার কথা পর্য্যন্ত জানে। আমি যে দরিদ্র, ইহাও তাহার অবিদিত নহে। সুতরাং আর কোন অভিসন্ধি থাকিতেই পারে না। অথচ যেমন করিয়া পারে, আমাকে সে এখান হইতে তাড়াইতে চায়। কিসের জন্য? আমার থাকা-না-থাকায় ইহার কি? তখন কথায় কথায় বলিয়াছিল, সংসারে লাভ-ক্ষতিই কি সমস্ত? ভালবাসাটাসা কিছু নাই? আমি যাহাকে কখনো চোখেও দেখি নাই, তাহার মুখের এই কথাটা মনে করিয়া আমার হাসি পাইল! কিন্তু সমস্ত কথাবার্ত্তা ছাপাইয়া তাহার শেষ বিদ্রূপটাও আমাকে যেন অবিশ্রান্ত মর্ম্মান্তিক করিয়া বিঁধিতে লাগিল।
সন্ধ্যার সময় শিকারীর দল ফিরিয়া আসিল। চাকরের মুখে শুনিলাম, আটটা ঘুঘুপাখী মারিয়া আনা হইয়াছে। কুমার ডাকিয়া পাঠাইলেন, অসুস্থতার ছুতা করিয়া বিছানায় পড়িয়াই রহিলাম, এবং এইভাবেই অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত পিয়ারীর গান এবং মাতালের বাহবা শুনিতে পাইলাম।
তার পরের তিন-চারিদিন প্রায় একভাবেই কাটিয়া গেল। ‘প্রায়’ বলিলাম—কারণ এক শিকার করা ছাড়া আর সমস্তই একপ্রকার। পিয়ারীর অভিশাপ ফলিল না কি, প্রাণিহত্যার প্রতি আর কাহারো কোন উৎসাহই দেখিলাম না। কেহ তাঁবুর বাহির হইতেই যেন চাহে না। অথচ আমাকেও ছাড়িয়া দেয় না। আমার পলাইবার আর যে কোন বিশেষ কারণ ছিল তাহা নয়। কিন্তু এই বাইজীর প্রতি আমার কি যে ঘোর বিতৃষ্ণা জন্মিয়া গেল; সে হাজির হইলেই, আমাকে কিসে যেন মারিতে থাকিত, উঠিয়া গিয়া স্বস্তি পাইতাম। উঠিতে না পারিলে, অন্ততঃ আর কোনদিকে মুখ ফিরাইয়া, কাহারও সহিত কথাবার্ত্তা কহিয়া, অন্যমনস্ক হইবার চেষ্টা করিতাম। অথচ সে প্রতি-মুহূর্ত্তেই আমার সহিত চোখাচোখি করিবার কৌশল করিত, তাহাও টের পাইতাম। প্রথম দুই-একদিন সে আমাকে লক্ষ্য করিয়াই পরিহাসের চেষ্টা করিয়া ছিল; কিন্তু আমার ভাব দেখিয়া সেও একেবারে নির্ব্বাক হইয়া গেল।
সেদিন ছিল শনিবার। আমি আর কোনমতেই থাকিতে পারি না। খাওয়া-দাওয়ার পরেই রওনা হইয়া পড়িব স্থির হওয়ায়—আজ সকাল হইতেই গান-বাজনার বৈঠক বসিয়া গিয়াছিল। শ্রান্ত হইয়া বাইজী গান থামাইয়াছে, হঠাৎ গল্পের সেরা গল্প—ভূতের গল্প উঠিয়া পড়িল। নিমিষে যে যেখানে ছিল আগ্রহে বক্তাকে ঘেরিয়া ধরিল।
প্রথমটা আমি তাচ্ছিল্যভরেই শুনিতেছিলাম। কিন্তু শেষে উৎগ্রীব হইয়া উঠিয়া বসিলাম। বক্তা ছিলেন, একজন গ্রামেরই হিন্দুস্থানী প্রবীণ ভদ্রলোক। গল্প কেমন করিয়া বলিতে হয় তাহা তিনি জানিতেন। তিনি বলিতেছিলেন, প্রেত-যোনিতে যদি কাহারও সংশয় থাকে—যেন আজিকার এই শনিবার অমাবস্যা তিথিতে, এই গ্রামে আসিয়া চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিয়া যান। তিনি যে জাত, যেমন লোকই হন, এবং যত ইচ্ছা লোক সঙ্গে করিয়া লইয়া যান, আজ রাত্রে মহাশ্মশানে যাওয়া তাঁহার পক্ষে নিষ্ফল হইবে না। আজিকার ঘোর রাত্রে এই শ্মশানচারী প্রেতাত্মাকে শুধু যে চোখে দেখা যায়, তাহা নয়; তাহার কণ্ঠস্বর শুনা যায়, এবং ইচ্ছা করিলে তাহার সহিত কথাবার্ত্তা পর্য্যন্ত বলা যায়। আমি ছেলে-বেলার কথা স্মরণ করিয়া হাসিয়া ফেলিলাম। বৃদ্ধ তাহা লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, আপনি আমার কাছে আসুন। আমি নিকটে সরিয়া গেলাম। তিনি প্রশ্ন করিলেন, আপনি বিশ্বাস করেন না?
না।
কেন করেন না? না করার বিশেষ কোন হেতু আছে?
না।
তবে? এই গ্রামেই এমন দুই-একজন সিদ্ধ সাধক আছেন, যাঁরা চোখে দেখেচেন। তবুও যে আপনারা বিশ্বাস করেন না, মুখের উপর হাসেন, সে শুধু দুপাতা ইংরিজি পড়ার ফল। বিশেষতঃ বাঙালীরা ত নাস্তিক—ম্লেচ্ছ। কি কথায় কি কথা আসিয়া পড়িল দেখিয়া, আমি অবাক হইয়া গেলাম। বলিলাম, দেখুন এ সম্বন্ধে আমি তর্ক কর্তে চাইনে। আমার বিশ্বাস আমার কাছে। আমি নাস্তিকই হই, ম্লেচ্ছই হই, ভূত মানিনে। যাঁরা চোখে দেখেচেন বলেন—হয় তাঁরা ঠকেচেন, না হয় তাঁরা মিথ্যাবাদী—এই আমার ধারণা।
ভদ্রলোক খপ্ করিয়া আমার ডান হাতটা চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, আপনি আজ রাত্রে শ্মশানে যেতে পারেন? আমি হাসিয়া বলিলাম, পারি। আমি ছেলেবেলা থেকে অনেক শ্মশানেই অনেক রাত্রে গেছি।
বৃদ্ধ চটিয়া উঠিয়া বলিলেন, আপ্ সেখি মৎ করো বাবু, বলিয়া তিনি সমস্ত শ্রোতৃবর্গকে স্তম্ভিত করিয়া, এই শ্মশানের মহা ভয়াবহ বিবরণ বিবৃত করিতে লাগিলেন। এ শ্মশান যে, যে-সে স্থান নয়, ইহা মহাশ্মশান, এখানে সহস্র নরমুণ্ড গণিয়া লইতে পারা যায়, এ শ্মশানে মহা-ভৈরবী তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া প্রত্যহ রাত্রে নরমুণ্ডের গেণ্ডুয়া খেলিয়া নৃত্য করিয়া বিচরণ করেন, তাঁহাদের খল্ খল্ হাসির বিকট শব্দে কতবার কত অবিশ্বাসী ইংরাজ, জজ-ম্যাজিষ্ট্রেটেরও হৃদ্স্পন্দন থামিয়া গিয়াছে—এম্নি সব লোমহর্ষণ কাহিনী এমন করিয়াই বলিতে লাগিলেন যে, এত লোকের মধ্যে দিনের-বেলা তাঁবুর ভিতরে বসিয়া থাকিয়াও অনেকের মাথার চুল পর্য্যন্ত খাড়া হইয়া উঠিল। আড়চোখে চাহিয়া দেখিলাম, পিয়ারী কোন এক সময়ে কাছে ঘেঁসিয়া আসিয়া বসিয়াছে এবং কথাগুলা যেন সর্ব্বাঙ্গ দিয়া গিলিতেছে।
এইরূপে এই মহাশ্মশানের ইতিহাস যখন শেষ হইল, তখন বক্তা গর্ব্বভরে আমার প্রতি কটাক্ষ হানিয়া প্রশ্ন করিলেন, কেয়া বাবুসাহেব, আপ্ যায়েগা?
যায়েগা বৈকি।
যায়েগা? আচ্ছা, আপ্কা খুসি। প্রাণ যানেসে—
আমি হাসিয়া বলিলাম, না বাবুজী, না। প্রাণ গেলেও তোমাকে দোষ দেওয়া হবে না, তোমার ভয় নেই। কিন্তু অজানা জায়গায় আমিও শুধু হাতে যাব না—বন্দুক নিয়ে যাব।
তখন আলোচনাটা একটু অতিমাত্রায় খর হইয়া উঠিল দেখিয়া আমি উঠিয়া গেলাম। আমি পাখী মারিতে পারি না, কিন্তু বন্দুকের গুলিতে ভূত মারিতে পারি, বাঙ্গালীরা ইংরাজী পড়িয়া হিন্দুশাস্ত্র মানে না; তাহারা মুরগি খায়, তাহারা মুখে যত বড়াই করুক, কার্য্যকালে ভাগিয়া যায়, তাহাদিগকে তাড়া দিলেই তাহাদের দাঁত-কপাটি লাগে, এই প্রকারের সমালোচনা চলিতে লাগিল। অর্থাৎ যে সকল সূক্ষ্ম যুক্তিতর্কের অবতারণা করিলে আমাদের রাজা-রাজড়াদের আনন্দোদয় হয় এবং তাঁহাদের মস্তিষ্ককে অতিক্রম করিয়া যায় না—অর্থাৎ তাঁহারাও দুকথা কহিতে পারেন, সেই সব কথাবার্ত্তা।
ইহাদের দলে একটিমাত্র লোক ছিল, যে স্বীকার করিয়াছিল, সে শিকার করিতে জানে না, এবং কথাটাও সে সচরাচর একটু কম কহিত এবং মদও একটু কম করিয়া খাইত। তাহার নাম পুরুষোত্তম। সে সন্ধ্যার সময় আসিয়া আমাকে ধরিল—সঙ্গে যাইবে। কারণ ইতিপূর্ব্বে সেও কোনদিন ভূত দেখে নাই। অতএব আজ যদি এমন সুবিধা ঘটিয়াছে, তবে ত্যাগ করিবে না, বলিয়া খুব হাসিতে লাগিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি কি ভূত মান না?
একেবারে না।
কেন মান না?
মানি না, নেই ব’লে, এই বলিয়া সে প্রচলিত তর্ক তুলিয়া বারংবার অস্বীকার করিতে লাগিল। আমি কিন্তু অত সহজে সঙ্গে লইতে স্বীকার করিলাম না। কারণ বহুদিনের অভিজ্ঞতায় জানিয়াছিলাম, এ সকল যুক্তিতর্কের ব্যাপার নয়—সংস্কার। বুদ্ধি দিয়া যাহারা একেবারেই মানে না, তাহারাও ভয়ের জায়গায় আসিয়া পড়িলে ভয়ে মূর্চ্ছা যায়।
পুরুষোত্তম কিন্তু নাছোড়বান্দা। সে মালকোঁচা মারিয়া পাকা বাঁশের লাঠি ঘাড়ে ফেলিয়া কহিল, শ্রীকান্তবাবু, আপনার ইচ্ছা হয় বন্দুক নিন্, কিন্তু আমার হাতে লাঠি থাক্তে ভূতই বল আর প্রেতই বল, কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেব না।
কিন্তু সময়ে, লাঠি হাতে থাক্বে ত?
ঠিক্ থাক্বে বাবু, আপনি তখন দেখে নেবেন! এক ক্রোশ পথ—রাত্রি এগারোটার মধ্যেই রওনা হওয়া চাই।
দেখিলাম, তাহার আগ্রহটা যেন একটু অতিরিক্ত।
যাত্রা করিতে তখনও ঘণ্টা-খানেক বিলম্ব আছে। আমি তাঁবুর বাহিরে পায়চারি করিয়া এই ব্যাপারটী মনে মনে আন্দোলন করিয়া দেখিতেছিলাম—জিনিসটা সম্ভবতঃ কি হইতে পারে। এ সকল বিষয়ে আমি যে লোকের শিষ্য তাহাতে ভূতের ভয়টা আর ছিল না। ছেলে-বেলার কথা মনে পড়ে—সেই একটি রাত্রে যখন ইন্দ্র কহিয়াছিল, শ্রীকান্ত, মনে মনে রাম নাম কর! ছেলেটি আমার পিছনে বসিয়া আছে—সেই দিনই শুধু ভয়ে চৈতন্য হারাইয়াছিলাম, আর না। সুতরাং সে ভয় ছিল না। কিন্তু আজিকার গল্পটা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে এটাই বা কি? ইন্দ্র নিজে ভূত বিশ্বাস করিত। কিন্তু সেও কখনো চোখে দেখে নাই। আমি নিজেও মনে মনে যত অবিশ্বাসই করি, স্থান এবং কাল মাহাত্ম্যে গা ছম্ ছম্ যে না করিত, তাহা নয়। সহসা সম্মুখের এই দুর্ভেদ্য অমাবস্যার অন্ধকারের পানে চাহিয়া আমার আর একটা অমা-রজনীর কথা মনে পড়িয়া গেল। সে দিনটাও এমনি শনিবারই ছিল।
বৎসর পাঁচ-ছয় পূর্ব্বে আমাদের প্রতিবেশিনী হতভাগিনী নিরুদিদি বালবিধবা হইয়াও যখন সূতিকা-রোগে আক্রান্ত হইয়া ছয় মাস ভুগিয়া ভুগিয়া মরেন, তখন সেই মৃত্যুশয্যার পাশে আমি ছাড়া আর কেহ ছিল না। বাগানের মধ্যে একখানি মাটীর ঘরে তিনি একাকিনী বাস করিতেন। সকলের সর্ব্বপ্রকার রোগে, শোকে, সম্পদে, বিপদে এতবড় সেবাপরায়ণা, নিঃস্বার্থ পরোপকারিণী রমণী পাড়ার মধ্যে আর কেহ ছিল না। কত মেয়েকে তিনি যে লেখাপড়া শিখাইয়া, সূচের কাজ শিখাইয়া, গৃহস্থালীর সর্ব্বপ্রকার দুরূহ কাজকর্ম শিখাইয়া দিয়া, মানুষ করিয়া দিয়াছিলেন, তাহার সংখ্যা নাই। একান্তস্নিগ্ধ, শান্তস্বভাব এবং সুনির্ম্মল চরিত্রের জন্য পাড়ার লোকও তাঁহাকে বড় কম ভালবাসিত না। কিন্তু সেই নিরুদিদির ত্রিশ বৎসর বয়সে হঠাৎ যখন পা-পিছলাইয়া গেল এবং ভগবান এই সুকঠিন ব্যাধির আঘাতে তাঁহার আজীবন উঁচু মাথাটি একেবারে মাটীর সঙ্গে একাকার করিয়া দিলেন, তখন পাড়ার কোন লোকই দুর্ভাগিনীকে তুলিয়া ধরিবার জন্য হাত বাড়াইল না। দোষস্পর্শ-লেশহীন নির্ম্মল হিন্দুসমাজ হতভাগিনীর মুখের উপরেই তাহার সমস্ত দরজা জানালা আঁটিয়া বন্ধ করিয়া দিলেন। সুতরাং সে পাড়ার মধ্যে এমন একটি লোকও বোধকরি ছিল না, যে, কোন-না-কোন প্রকারে নিরুদিদির সযত্ন সেবা উপভোগ করে নাই, সেই পাড়ারই এক প্রান্তে অন্তিমশয্যা পাতিয়া এই দুর্ভাগিনী ঘৃণায়, লজ্জায়, নিঃশব্দে নতমুখে একাকিনী দিনের পর দিন ধরিয়া এই সুদীর্ঘ ছয়মাসকাল বিনা চিকিৎসায় তাহার পদস্খলনের প্রায়শ্চিত্ত সমাধা করিয়া শ্রাবণের এক গভীর রাত্রে ইহকাল ত্যাগ করিয়া যে-লোকে চলিয়া গেলেন, তাহার অভ্রান্ত বিবরণ যে-কোনো স্মার্ত্ত ভট্টাচার্য্যকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানা যাইতে পারিত।
আমার পিসিমা যে অত্যন্ত সঙ্গোপনে তাহাকে সাহায্য করিতেন, এ কথা আমি এবং বাটীর বুড়া ঝি ছাড়া আর জগতে কেহই জানে না। পিসিমা একদিন দুপুর-বেলা আমাকে নিভৃতে ডাকিয়া বলিলেন, বাবা শ্রীকান্ত, তোরা ত এমন অনেকেরই রোগে শোকে গিয়ে দেথিস্; এই ছুঁড়িটাকে এক-আধবার গিয়ে দেখিস্ না। সেই অবধি আমি মাঝে মাঝে গিয়া দেখিতাম এবং পিসিমার পয়সায় এট—ওটা—সেটা কিনিয়া দিয়া আসিতাম। তাঁর শেষকালে একা আমিই কাছে ছিলাম। মরণকালে অমন পরিপূর্ণ বিকার এবং পরিপূর্ণ জ্ঞান আমি আর দেখি নাই। বিশ্বাস না করিলেও যে ভয়ে গা ছম্ ছম্ করে, আমি সেই কথাটাই বলিতেছি।
সেদিন শ্রাবণের অমাবস্যা। রাত্রি বারোটার পর ঝড় এবং জলের প্রকোপে পৃথিবী যেন উপড়াইয়া যাইবার উপক্রম করিল। সমস্ত জানালা দরজা বন্ধ; আমি খাটের অদূরে বহু প্রাচীন অর্দ্ধভগ্ন একটা ইজি-চেয়ারে শুইয়া আছি। নিরুদিদি স্বাভাবিক মুক্তকণ্ঠে আমাকে কাছে ডাকিয়া হাত তুলিয়া আমার কানটা তাঁর মুখের কাছে আনিয়া, ফিস্ ফিস্ করিয়া বলিলেন, শ্রীকান্ত, তুই বাড়ী যা।
সে কি নিরুদি, এই ঝড়-জলের মধ্যে?
তা হোক। প্রাণটা আগে। ভুল বকিতেছেন ভাবিয়া বলিলাম, আচ্ছা যাচ্চি—জলটা একটু থামুক। নিরুদিদি ভয়ানক ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, না, না, শ্রীকান্ত, তুই যা। যা ভাই যা—আর এতটুকু দেরি করিস্নে—তুই পালা। এইবার তার কণ্ঠস্বরের ভঙ্গীতে আমার বুকের ভিতরটায় ছ্যাঁৎ করিয়া উঠিল। বলিলাম, আমাকে যেতে বল্ছ কেন?
প্রত্যুত্তরে তিনি আমার হাতটা টানিয়া লইয়া রুদ্ধ জানালার প্রতি লক্ষ্য করিয়া চেঁচাইয়া উঠিলেন, যাবিনি, তবে কি প্রাণটা দিবি? দেখ্চিস্নে, আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে কালো কালো সেপাই এসেচে? তুই আছিস্ বলে ঐ জানালা দিয়ে আমাকে শাসাচ্চে?
তার পরে সেই যে শুরু করিলেন—ঐ খাটের তলায়! ওই মাথার শিয়রে। ওই মার্তে আস্চে! ওই নিলে! ওই ধর্লে! এ চীৎকার শুধু থামিল শেষরাত্রে, যখন প্রাণটাও প্রায় শেষ হইয়া আসিল।
ব্যাপারটা আজও আমার বুকের মধ্যে কাটিয়া কাটিয়া বসিয়া আছে। সে রাত্রে ভয় পাইয়াছিলাম ত বটেই। বোধ করি বা যেন কি সব চেহারাও দেখিয়াছিলাম। এখন মনে করিয়া হাসি পায় সত্য; কিন্তু সেদিন অমাবস্যার ঘোর দুর্য্যোগ তুচ্ছ করিয়াও, বোধ করি বা ছুটিয়া পলাইতাম, যদি না এ কথা অসংশয়ে বিশ্বাস হইত—কপাট খুলিয়া বাহির হইলেই নিরুদিদির কালো কালো সেপাই-সান্ত্রির ভিড়ের মধ্যে গিয়া পড়িব। অথচ এ সব কিছুই নাই, কিছুই ছিল না, তাহাও জানিতাম, মুমূর্ষু যে কেবলমাত্র নিদারুণ বিকারের ঘোরেই প্রলাপ বকিতেছিলেন; তাহাও বুঝিয়াছিলাম। অথচ—
বাবু?
চমকিয়া ফিরিয়া দেখিলাম, রতন।
কি রে?
বাইজী একবার প্রণাম জানাচ্চেন।
যেমন বিস্মিত হইলাম, তেম্নি বিরক্ত হইলাম। এতরাত্রে অকস্মাৎ আহ্বান করাটা শুধু যে অত্যন্ত অপমানকর স্পর্ধা বলিয়া মনে হইল, তাহা নয়; গত তিন-চারি দিনের উভয়পক্ষের ব্যবহারগুলা স্মরণ করিয়াও এই প্রণাম পাঠানোটা যেন সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড বলিয়া ঠেকিল। কিন্তু ভৃত্যের সম্মুখে কোনরূপ উত্তেজনা পাছে প্রকাশ পায়, এই আশঙ্কায় নিজেকে প্রাণপণে সংবরণ করিয়া কহিলাম, আজ আমার সময় নেই রতন, আমাকে বেরুতে হবে; কাল দেখা হবে।
রতন সুশিক্ষিত ভৃত্য, আদব-কায়দায় পাকা। সম্ভ্রমের সহিত মৃদুস্বরে কহিল, বড় দরকার বাবু, এখনি একবার পায়ের ধূলো দিতে হবে। নইলে বাইজীই আস্বেন বললেন।—কি সর্ব্বনাশ! এই তাঁবুতে এত রাত্রে, এত লোকের সুমুখে! বলিলাম, তুমি বুঝিয়ে বল গে রতন, আজ নয়, কাল সকালেই দেখা হবে। আজ আমি কোনমতেই যেতে পার্ব না।
রতন কহিল, তা হ’লে তিনিই আস্বেন। আমি এই পাঁচ বছর দেখে আস্চি বাবু, বাইজীর কোনদিন এতটুকু কথার কখনো নড়-চড় হয় না। আপনি না গেলে তিনি নিশ্চয়ই আসবেন।
এই অন্যায় অসঙ্গত জিদ্ দেখিয়া পায়ের নখ হইতে মাথার চুল পর্য্যন্ত জ্বলিয়া গেল। বলিলাম, আচ্ছা দাঁড়াও, আমি আস্চি। তাঁবুর ভিতরে ঢুকিয়া দেখিলাম, বারুণীর কৃপায় জাগ্রত আর কেহ নাই। পুরুষোত্তম গভীর নিদ্রায় মগ্ন। চাকরদের তাঁবুতে দুই-চারি জন জাগিয়া আছে মাত্র। তাড়াতাড়ি বুট্টা পরিয়া লইয়া একটা কোট গায়ে দিয়া ফেলিলাম। রাইফেল ঠিক করাই ছিল। হাতে লইয়া রতনের সঙ্গে সঙ্গে বাইজীর তাঁবুতে গিয়া প্রবেশ করিলাম। পিয়ারী সুমুখেই দাঁড়াইয়া ছিল। আমার আপাদমস্তক বার বার নিরীক্ষণ করিয়া, কিছুমাত্র ভূমিকা না করিয়াই, ক্রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিল, শ্মশানে-টশানে তোমার কোনমতেই যাওয়া হবে না—কোন মতেই না!
ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া গেলাম—কেন?
কেন আবার কি? ভূত প্রেত কি নেই যে, এই শনিবারের অমাবস্যায় তুমি যাবে শ্মশানে? প্রাণ নিয়ে কি তা হ’লে আর ফিরে আস্তে হবে! বলিয়াই পিয়ারী অকস্মাৎ ঝর্ ঝর্ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। আমি বিহ্বলের মত নিঃশব্দে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। কি করিব, কি জবাব দিব, ভাবিয়াই পাইলাম না। ভাবিয়া না পাওয়ার আর আশ্চর্য্য কি? যাহাকে চিনি না, জানি না, সে যদি উৎকট হিতাকাঙ্ক্ষায় দুপুর রাত্রে ডাকাইয়া আনিয়া সুমুখে দাঁড়াইয়া খামোকা কান্না জুড়িয়া দেয়—হতবুদ্ধি হয় না কে? আমার জবাব না পাইয়া পিয়ারী চোখ মুছিতে মুছিতে কহিল, তুমি কি কোন দিন শান্ত-সুবোধ হবে না? তেম্নি একগুঁয়ে হয়ে চিরকালটা কাটাবে? কই, যাও দিকি কেমন করে যাবে,—আমিও তা হ’লে সঙ্গে যাবো, বলিয়া সে শালখানা কুড়াইয়া লইয়া নিজের গায়ে জড়াইবার উপক্রম করিল।
আমি সংক্ষেপে কহিলাম, বেশ, চল। আমার এই প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপে জ্বলিয়া উঠিয়া পিয়ারী বলিল, আহা! দেশ-বিদেশে তা হ’লে সুখ্যাতির আর সীমা-পরিসীমা থাক্বে না! বাবু শিকারে এসে একটা বাইউলি সঙ্গে করে দুপুর রাত্রে ভূত দেখতে গিয়েছিলেন। বলি, বাড়ীতে কি একেবারে আউট্ হয়ে গেছ নাকি? ঘেন্না-পিত্তি লজ্জা-সরম আর কিছু দেহতে নেই? বলিতে বলিতেই তাহার তীব্র কণ্ঠ ভিজিয়া যেন ভারি হইয়া উঠিল; কহিল, কখনো ত এমন ছিলে না। এত অধঃপথে তুমি যেতে পারো, কেউ ত কোন দিন ভাবেনি। তাহার শেষ কথাটায় অন্য কোন সময়ে আমার বিরক্তির হয় ত অবধি থাকিত না, কিন্তু এখন রাগ হইল না। মনে হইল পিয়ারীকে যেন চিনিয়াছি। কেন যে মনে হইল, তাহা পরে বলিতেছি। কহিলাম, লোকের ভাবাভাবির দাম কত, সে নিজেও ত জানো? তুমিই যে এত অধঃপথে যাবে, সেই বা ক’জন ভেবেছিল?
মুহূর্ত্তের জন্য পিয়ারীর মুখের উপর শরতের মেঘলা জ্যোৎস্নার মত একটা সহজ হাসির আভা দেখা দিল। কিন্তু সে ঐ মুহূর্ত্তের জন্যই! পরক্ষণেই সে ভীতস্বরে কহিল, আমার তুমি কি জানো? কে আমি, বল ত দেখি?
তুমি পিয়ারী।
সে ত সবাই জানে!
সবাই যা জানে না, তা আমি জানি—শুন্লে কি তুমি খুশি হবে? হ’লে ত নিজেই তোমার পরিচয় দিতে। যখন দাওনি তখন আমার মুখ থেকেও কোন কথা পাবে না। এর মধ্যে ভেবো দেখো, আত্মপ্রকাশ কর্বে কি না। কিন্তু এখন আর সময় নেই—আমি চল্লুম।
পিয়ারী বিদ্যুৎগতিতে পথ আগ্লাইয়া দাঁড়াইয়া কহিল, যদি যেতে না দিই, জোর করে যেতে পার?
কিন্তু যেতেই বা দেবে না কেন?
পিয়ারী কহিল, দেবই বা কেন? সত্যিকারের ভূত কি নেই যে, তুমি যাবে বল্লেই যেতে দেব? মাইরি, আমি চেঁচিয়ে হাট বাধাব—তা বলে দিচ্চি, বলিয়াই আমার বন্দুকটা কাড়িয়া লইবার চেষ্টা করিল। আমি এক পা পিছাইয়া গেলাম। কিছুক্ষণ হইতেই আমার বিরক্তির পরিবর্ত্তে হাসি পাইতেছিল। এবার হাসিয়া ফেলিয়া বলিলাম, সত্যিকারের ভূত আছে কি না জানি না, কিন্তু মিথ্যাকারের ভূত আছে জানি; তারা সুমুখে দাঁড়িয়ে কথা কয়, কাঁদে, পথ আগ্লায়—এমন অনেক কীর্ত্তি করে, আবার দরকার হ’লে ঘাড় মট্কেও খায়। পিয়ারী মলিন হইয়া গেল; এবং ক্ষণকালের জন্য বোধ করি বা কথা খুঁজিয়া পাইল না। তারপরে বলিল, আমাকে তা হ’লে তুমি চিনেচ বল! কিন্তু ওটা তোমার ভুল। তারা অনেক কীর্ত্তি করে সত্যি, কিন্তু ঘাড় মট্কাবার জন্যে পথ আগ্লায় না। তাদেরও আপনার-পর বোধ আছে। আমি পুনরায় সহাস্যে প্রশ্ন করিলাম, এ ত তোমার নিজের কথা, কিন্তু তুমি কি ভূত?
পিয়ারী কহিল, ভূত বই কি। যারা মরে গিয়েও মরেনা, তারাই ভূত; এই ত তোমার বল্বার কথা। একটুখানি থামিয়া নিজেই পুনরায় কহিতে লাগিল, এক হিসাবে আমি যে মরেছি, তা সত্যি। কিন্তু সত্যি হোক্, মিথ্যা হোক্—নিজের মরণ আমি—নিজে রটাইনি। মামাকে দিয়ে মা রটিয়েছিলেন। শুন্বে সব কথা? তাহার মরণের কথা শুনিয়া এতক্ষণে আমার সংশয় কাটিয়া গেল। ঠিক চিনিতে পারিলাম—এই সেই রাজলক্ষ্মী। অনেক দিন পূর্ব্বে মায়ের সহিত সে তীর্থযাত্রা করিয়াছিল—আর ফিরে নাই। কাশীতে ওলাউঠা রোগে মরিয়াছে—এই কথা মা গ্রামে আসিয়া প্রচার করিয়াছিলেন। তাহাকে কখনো যে আমি ইতিপূর্ব্বে দেখিয়াছিলাম—এ কথা মনে করিতে পারি নাই বটে, কিন্তু তাহার একটা অভ্যাস আমি এখানে আসিয়া পর্য্যন্ত লক্ষ্য করিতেছিলাম। সে রাগিলেই দাঁত দিয়া অধর চাপিয়া ধরিতেছিল। কখন্, কোথায়, কাহাকে যেন ঠিক এম্নি ধারা করিতে অনেকবার দেখিয়াছি বলিয়া কেবলি মনে হইতেছিল; কিন্তু কে সে, কোথায় দেখিয়াছি, কবে দেখিয়াছি কিছুতেই মনে পড়িতেছিল না। সেই রাজলক্ষ্মী এই হইয়াছে দেখিয়া আমি ক্ষণকালের জন্য বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া গেলাম। আমি যখন আমাদের গ্রামের মনসা পণ্ডিতের পাঠশালার সর্দ্দার-পোড়ো, সেই সময়ে ইহার দুইপুরুষে কুলীন বাপ আর একটা বিবাহ করিয়া ইহার মাকে তাড়াইয়া দেয়। স্বামী-পরিত্যক্তা মা সুরলক্ষ্মী ও রাজলক্ষ্মী দুই মেয়ে লইয়া বাপের বাড়ি চলিয়া আসে। ইহার বয়স তখন আট-নয় বৎসর; সুরলক্ষ্মীর বারো-তেরো। ইহার রঙটা বরাবরই ফর্সা; কিন্তু ম্যালেরিয়া ও প্লীহায় পেট্টা ধামার মত, হাত-পা কাঠির মত, মাথার চুলগুলা তামার শলার মত—কতগুলি তাহা গুণিয়া বলা যাইতে পারিত। আমার মারের ভয়ে এই মেয়েটা বঁইচির বনে ঢুকিয়া প্রত্যহ একছড়া পাকা বঁইচি ফলের মালা গাঁথিয়া আনিয়া আমাকে দিত। সেটা কোনদিন ছোট হইলেই, পুরানো পড়া জিজ্ঞাসা করিয়া, ইহাকে প্রাণ ভরিয়া চপেটাঘাত করিতাম। মার খাইয়া এই মেয়েটা ঠোঁট কামড়াইয়া গোঁজ হইয়া বসিয়া থাকিত; কিন্তু কিছুতেই বলিত না—প্রত্যহ পাকা ফল সংগ্রহ করা তাহার পক্ষে কত কঠিন। তা সে যাই হোক্, এতদিন জানিতাম, মারের ভয়েই সে এত ক্লেশ স্বীকার করিত; কিন্তু আজ যেন হঠাৎ একটুখানি সংশয় হইল। তা সে যাক্। তার পরে ইহার বিবাহ। সেও এক চমৎকার ব্যাপার! ভাগ্নীদের বিবাহ হয় না, মামা ভাবিয়া খুন। দৈবাৎ জানা গেল, বিরিঞ্চি দত্তের পাচকব্রাহ্মণ ভঙ্গ-কুলীনের সন্তান। এই কুলীন-সন্তানকে দত্তমশাই বাঁকুড়া হইতে বদলী হইয়া আসার সময় সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলেন। বিরিঞ্চি দত্তের দুয়ারে মামা ধন্না দিয়া পড়িলেন—ব্রাহ্মণের জাতিরক্ষা করিতেই হইবে। এতদিন সবাই জানিত দত্তদের বামুনঠাকুর হাবা-গোবা ভালোমানুষ। কিন্তু প্রয়োজনের সময় দেখা গেল, ঠাকুরের সংসার বুদ্ধি কাহারো অপেক্ষা কম নয়। একান্নো টাকা পণের কথায় সে সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, অত সস্তায় হবে না মশাই—বাজার যাচিয়ে দেখুন। পঞ্চাশ-এক টাকায় একজোড়া ভাল রামছাগল পাওয়া যায় না—তা জামাই খুঁজচেন। একশ-একটি টাকা দিন—একবার এ-পিঁড়িতে ব’সে, আর একবার ও-পিঁড়িতে ব’সে, দুটো ফুল ফেলে দিচ্চি। দুটি ভগ্নীই একসঙ্গে পার হবে। আর একশখানি টাকা—দুটো ষাঁড় কেনার খরচটাও দেবেন না? কথাটা অসঙ্গত নয়, তথাপি অনেক কষা-মাজা ও সহি-সুপারিশের পর সত্তর টাকায় রফা হইয়া একরাত্রে একসঙ্গে সুরলক্ষ্মী ও রাজলক্ষ্মীর বিবাহ হইয়া গেল। দুইদিন পরে সত্তর টাকা নগদ লইয়া দু-পুরুষে কুলীন জামাই বাঁকুড়া প্রস্থান করিলেন। আর কেহ তাহাকে দেখে নাই। বছর-দেড়েক পরে প্লীহা-জ্বরে সুরলক্ষ্মী মরিল এবং আরও বছর-দেড়েক পরে এই রাজলক্ষ্মী কাশীতে মরিয়া শিবত্ব লাভ করিল। এই ত পিয়ারী বাইজীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
বাইজী কহিল, তুমি কি ভাবছ, বলব?
কি ভাবচি?
তুমি ভাবচ, আহা! ছেলে-বেলায় একে কত কষ্টই দিয়েচি! কাঁটার বনে পাঠিয়ে রোজ-রোজ বঁইচি তুলিয়েচি, আর তার বদলে শুধু মার-ধোর করেছি। মার খেয়ে চুপ ক’রে কেবল কেঁদেছে, কিন্তু কখনো কিছু চায় নি। আজ যদি একটা কথা বল্চে ত শুনিই না। না হয় নাই গেলাম শ্মশানে। এই না?
আমি হাসিয়া ফেলিলাম।
পিয়ারীও হাসিয়া কহিল, হবেই ত। ছেলে-বেলায় একবার যাকে ভালবাসা যায়, তাকে কি কখনো ভোলা যায়? সে একটা অনুরোধ কর্লে কেউ কখনো কি পায়ে ঠেলে যেতে পারে? এমন নিষ্ঠুর সংসারে আর কে আছে। চল, একটু বসিগে, অনেক কথা আছে। রতন, বাবুর বুটটা খুলে দিয়ে যা রে। হাস্চ যে?
হাসচি, কি ক’রে তোমরা মানুষ ভুলিয়ে বশ করো, তাই দেখে।
পিয়ারীও হাসিল, কহিল, তাই বই কি। পরকে কথায় ভুলিয়ে বশ করা যায়, কিন্তু জ্ঞান হওয়া পর্য্যন্ত নিজেই যার বশ হয়ে আছি, তাকেও কি কথায় ভুলানো যায়? আচ্ছা, আজই না হয় কথা কইচি; কিন্তু প্রত্যহ কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যখন বঁইচির মালা গেঁথে দিতুম, তখন কটা কথা কয়েছিলুম শুনি? সে কি তোমার মারের ভয়ে না কি? মনেও ক’রো না। সে মেয়ে রাজলক্ষ্মী নয়। কিন্তু ছিঃ! আমাকে তুমি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলে—দেখে চিন্তেও পারোনি! বলিয়া হাসিয়া মাথা নাড়িতেই তাহার দুই কানের হীরাগুলা পর্য্যন্ত দুলিয়া হাসিয়া উঠিল।
আমি বলিলাম, তোমাকে মনেই বা কবে করেছিলাম যে, ভুলে যাবো না? বরং আজ চিন্তে পেরেচি দেখে, নিজেই আশ্চর্য্য হয়ে গেছি। আচ্ছা, বারোটা বাজে—চল্লুম।
পিয়ারীর হাসিমুখ এক নিমেষেই একেবারে বিবর্ণ, ম্লান হইয়া গেল। একটুখানি স্থির থাকিয়া কহিল, আচ্ছা, ভূত-প্রেত না মানো, সাপ-খোপ, বাঘ-ভালুক, বুনোশূয়ার এগুলোকে ত বনে-জঙ্গলে অন্ধকার রাত্রে মানা চাই।
আমি বলিলাম, এগুলোকে আমি মেনে থাকি, এবং যথেষ্ট সতর্ক হয়েও চলি।
আমাকে যাইতে উদ্যত দেখিয়া ধীরে ধীরে কহিল, তুমি যে-ধাতুর মানুষ, তাতে তোমাকে যে আটকাতে পারব না, সে ভয় আমার খুবই ছিল, তবু ভেবেছিলাম, কান্নাকাটি ক’রে হাতে পায়ে ধর্লে শেষ পর্য্যন্ত হয় ত নাও যেতে পারো। কিন্তু আমার কান্নাই সার হ’ল। আমি জবাব দিলাম না দেখিয়া পুনরায় কহিল, আচ্ছা, যাও—পেছু ডেকে আর অমঙ্গল করব না। কিন্তু একটা কিছু হ’লে, এই বিদেশ বিভূঁয়ে রাজা-রাজড়া বন্ধু-বান্ধব কোন কাজেই লাগ্বেনা, তখন আমাকেই ভুগতে হবে। আমাকে চিন্তে পারো না, আমার মুখের পরে ব’লে তুমি পৌরষী ক’রে গেলে, কিন্তু আমার মেয়েমানুষের মন ত? বিপদের সময় আমি ত আর বল্তে পার্ব না—এঁকে চিনিনে। বলিয়া সে একটি দীর্ঘশ্বাস চাপিয়া ফেলিল। আমি যাইতে যাইতে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া হাসিলাম। কেমন যেন একটা ক্লেশ বোধ হইল। বলিলাম, বেশ ত বাইজী, সেও ত আমার একটা মস্ত লাভ। আমার কেউ কোথাও নেই—তবু ত জান্তে পারব, একজন আছে—যে আমাকে ফেলে যেতে পারবে না।
পিয়ারী কহিল, সে কি আর তুমি জানোনা? একশবার ‘বাইজী’ ব’লে যত অপমানই কর না কেন, রাজলক্ষ্মী তোমাকে যে ফেলে যেতে পার্বে না—এ কি আর তুমি মনে মনে বোঝো না? কিন্তু ফেলে যেতে পার্লেই ভালো হ’তো। তোমাদের একটা শিক্ষা হ’তো। কিন্তু কি বিশ্রী এই মেয়েমানুষ জাতটা; একবার যদি ভালোবেসেচে, ত মরেচে।
আমি বলিলাম, পিয়ারী, ভালো সন্ন্যাসীতেও ভিক্ষা পায় না, কেন জানো?
পিয়ারী বলিল, জানি। কিন্তু তোমার এ খোঁচায় এত ধার নেই যে, আমাকে বেঁধো। এ আমার ঈশ্বর দত্ত ধন। যখন সংসারের ভাল মন্দ জ্ঞান পর্য্যন্ত হয়নি, তখনকার, আজকের নয়। আমি নরম হইয়া বলিলাম, বেশ কথা। আশা করি, আমার আজ একটা কিছু হবে। হলে তোমার ঈশ্বর দত্ত ধনের হাতে হাতে একটা যাচাই হয়ে যাবে।
পিয়ারী কহিল, দুর্গা! দুর্গা! ছিঃ! অমন কথা ব’লো না। ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো—এ সত্যি আর যাচাই ক’রে কাজ নেই। আমার কি সেই কপাল যে, নিজের হাতে নেড়ে-চেড়ে সেবা ক’রে, দুঃসময়ে তোমাকে সুস্থ, সবল ক’রে তুল্ব! তা হ’লে ত জান্তুম, এ জন্মের একটা কাজ ক’রে নিলুম। বলিয়া সে যে মুখ ফিরাইয়া অশ্রু গোপন করিল, তাহা হারিকেনের ক্ষীণ আলোতেও টের পাইলাম।
আচ্ছা, ভগবান তোমার এ সাধ হয়ত একদিন পূর্ণ ক’রে দেবেন, বলিয়া আমি আর দেরি না করিয়া, তাঁবুর বাহিরে আসিয়া পড়িলাম। তামাসা করিতে গিয়া যে মুখ দিয়া একটা প্রচণ্ড সত্য বাহির হইয়া গেল, সে কথা তখন আর কে ভাবিয়াছিল?
তাঁবুর ভিতর হইতে অশ্রু-বিকৃত কণ্ঠের, দুর্গা! দুর্গা! নামের সকাতর ডাক কানে আসিয়া পৌঁছিল! আমি দ্রুতপদে শ্মশানের পথে প্রস্থান করিলাম।
সমস্ত মনটা পিয়ারীর কথাতেই আচ্ছন্ন হইয়া রহিল। কখন্ যে আম-বাগানের দীর্ঘ, অন্ধকার পথ পার হইয়া গেলাম, কখন্ নদীর ধারের সরকারী বাঁধের উপর আসিয়া পড়িলাম, জানিতে পারিলাম না। সমস্ত পথটা শুধু এই একটা কথাই ভাবিতে ভাবিতে আসিয়াছি—এ কি বিরাট্ অচিন্তনীয় ব্যাপার এই নারীর মনটা। কবে যে এই পিলেরোগা মেয়েটা তাহার ধামার মত পেট এবং কাঠির মত হাত-পা লইয়া আমাকে প্রথম ভালবাসিয়াছিল, এবং বঁইচি ফলের মালা দিয়া তাহার দরিদ্র পূজা নীরবে সম্পন্ন করিয়া আসিতেছিল, আমি টেরও পাই নাই। যখন টের পাইলাম, তখন বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। বিস্ময় সেজন্যও নয়। নভেল-নাটকেও বাল্য প্রণয়ের কথা অনেক পড়িয়াছি। কিন্তু এই বস্তুটি, যাহাকে সে তাহার ঈশ্বর দত্ত ধন বলিয়া সগর্ব্বে প্রচার করিতেও কুণ্ঠিত হইল না, তাহাকে সে এতদিন তাহার এই ঘৃণিত জীবনের শত কোটি মিথ্যা প্রণয়-অভিনয়ের মধ্যে কোন্খানে জীবিত রাখিয়াছিল। কোথা হইতে ইহাদের খাদ্য সংগ্রহ করিত? কোন্ পথে প্রবেশ করিয়া তাহাকে লালন-পালন করিত?
বাপ্!
চমকিয়া উঠিলাম। সম্মুখে চাহিয়া দেখি, ধূসর বালুর বিস্তীর্ণ প্রান্তর, এবং তাহাকেই বিদীর্ণ করিয়া শীর্ণ নদীর বক্ররেখা আঁকিয়া-বাঁকিয়া কোন্ সুদূরে অন্তর্হিত হইয়া গেছে। সমস্ত প্রান্তর ব্যাপিয়া এক-একটা কাশের ঝোপ। অন্ধকারে হঠাৎ মনে হইল, এগুলো যেন এক-একটা মানুষ—আজিকার এই ভয়ঙ্কর অমানিশায় প্রেতাত্মার নৃত্য দেখিতে আমন্ত্রিত হইয়া আসিয়াছে, এবং বালুকার আস্তরণের উপর যে যাহার আসন গ্রহণ করিয়া, নীরবে প্রতীক্ষা করিতেছে! মাথার উপর নিবিড় কালো আকাশ, সংখ্যাতীত গ্রহতারকাও আগ্রহে চোখ মেলিয়া চাহিয়া আছে। হাওয়া নাই, শব্দ নাই, নিজের বুকের ভিতরটা ছাড়া, যতদূর চোখ যায়, কোথাও এতটুকু প্রাণের সাড়া পর্য্যন্ত অনুভব করিবার জো নাই। যে রাত্রিচর পাখিটা একবার বাপ্ বলিয়াই থামিয়াছিল, সেও আর কথা কহিল না। পশ্চিম-মুখে ধীরে ধীরে চলিলাম—এই দিকেই সেই মহাশ্মশান। একদিন শীকারে আসিয়া সেই যে শিমূলগাছগুলা দেখিয়া গিয়াছিলাম, কিছু দূর আসিতেই তাহাদের কালো কালো ডাল-পালা চোখে পড়িল। ইহারাই মহাশ্মশানের দ্বারপাল। ইহাদের অতিক্রম করিয়া যাইতে হইবে। এইবার অতি অস্ফুট প্রাণের সাড়া পাইতে লাগিলাম; কিন্তু তাহা আহ্লাদ করিবার মত নয়। আরো একটু অগ্রসর হইতে, তাহা পরিস্ফুট হইল। এক একটা মা ‘কুম্ভকর্ণের ঘুম’ ঘুমাইলে তাহার কচি ছেলেটা কাঁদিয়া কাঁদিয়া শেষকালে নির্জ্জীব হইয়া যে প্রকারে রহিয়া রহিয়া কাঁদে, ঠিক তেম্নি করিয়া শ্মশানের একান্ত হইতে কে যেন কাঁদিতে লাগিল। যে এ ক্রন্দনের ইতিহাস জানে না, এবং পূর্ব্বে শুনে নাই—সে যে এই গভীর অমানিশায় একাকী সেদিকে আর এক পা অগ্রসর হইতে চাহিবে না, তাহা বাজি রাখিয়া বলিতে পারি। সে যে মানব-শিশু নয়, শকুন-শিশু—অন্ধকারে মাকে দেখিতে না পাইয়া কাঁদিতেছে—না জানিলে কাহারো সাধ্য নাই, এ কথা ঠাহর করিয়া বলে। আরো কাছে আসিতে দেখিলাম—ঠিক তাই বটে। কালো কালো ঝুড়ির মত শিমূলের ডালে ডালে অসংখ্য শকুন রাত্রিবাস করিতেছে; এবং তাহাদেরই কোন একটা দুষ্ট ছেলে অমন করিয়া আর্ত্তকণ্ঠে কাঁদিতেছে।
গাছের উপরে সে কাঁদিতেই লাগিল; আমি নিচে দিয়া অগ্রসর হইয়া ঐ মহাশ্মশানের একপ্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইলাম। সকালে তিনি যে বলিয়াছিলেন, লক্ষ নরমুণ্ড গণিয়া লওয়া যায়—দেখিলাম, কথাটা নিতান্ত অত্যুক্তি নয়। সমস্ত স্থানটাই প্রায় নরকঙ্কালে খচিত হইয়া আছে। গেণ্ডুয়া খেলিবার নরকপাল অসংখ্য পড়িয়া আছে; তবে খেলোয়াড়েরা তখন আসিয়া জুটিতে পারেন নাই। আমি ছাড়া আর কোন অশরীরী দর্শক তথায় উপস্থিত ছিলেন কি না, এই দুটা নশ্বর চক্ষে আবিষ্কার করিতে পারিলাম না। তখন ঘোর অমাবস্যা। সুতরাং খেলা সুরু হইবার আর বেশি দেরী নাই আশা করিয়া, একটা বালুর ঢিপির উপর গিয়া চাপিয়া বসিলাম। বন্দুকটা খুলিয়া, টোটাটা আর একবার পরীক্ষা করিয়া, পুনরায় যথাস্থানে সন্নিবিষ্ট করিয়া, কোলের উপর রাখিয়া প্রস্তুত হইয়া রহিলাম। হায় রে টোটা! বিপদের সময় কিন্তু সে কোনই সাহায্য করিল না।
পিয়ারীর কথাটা মনে পড়িল। সে বলিয়াছিল, যদি অকপটে বিশ্বাসই কর না, তবে কর্ম্মভোগ করিতে যাওয়া কেন? আর যদি বিশ্বাসের জোর না থাকে, তাহা হইলে ভূত-প্রেত থাক্ বা না থাক্, তোমাকে কিছুতেই যাইতে দিব না। সত্যই ত! এ কি দেখিতে আসিয়াছি? মনের অগোচরে ত পাপ নাই। আমি কিছুই দেখিতে আসি নাই; শুধু দেখাইতে আসিয়াছি—আমার সাহস কত। সকালে যাহারা বলিয়াছিল, ভীরু বাঙ্গালী কার্য্যকালে ভাগিয়া যায়, তাহাদের কাছে শুধু এই কথাটা সপ্রমাণ করা যে, বাঙ্গালী বড় বীর।
আমার বহুদিনের দৃঢ়-বিশ্বাস, মানুষ মরিলে আর বাঁচে না; এবং যদি বা বাঁচে, যে শ্মশানে তাহার পার্থিব দেহটাকে অশেষপ্রকারে নিপীড়িত করা হয়, সেইখানেই ফিরিয়া নিজের মাথাটায় লাথি মারিয়া মারিয়া গড়াইয়া বেড়াইবার ইচ্ছা হওয়া তাহার পক্ষে স্বাভাবিকও নয়, উচিতও নয়। অন্ততঃ আমার পক্ষে তা নয়; তবে কি না, মানুষের রুচি ভিন্ন। যদি বা কাহারো হয়, তাহা হইলে এমন একটা চমৎকার রাত্রে রাত্রি-জাগিয়া আমার এতদূরে আসাটা নিষ্ফল হইবে না। অথচ এম্নি একটা গুরুতর আশাই আজিকার প্রবীণ ব্যক্তিটি দিয়াছিলেন।
হঠাৎ একটা দম্কা বাতাস কতকগুলা ধূলা-বালি উড়াইয়া গায়ের উপর দিয়া বহিয়া গেল; এবং সেটা শেষ না হইতেই, আর একটা এবং আর একটা বহিয়া গেল। মনে হইল, এ আবার কি? এতক্ষণ ত বাতাসের লেশমাত্র ছিল না। যতই কেন না বুঝি এবং বুঝাই, মরণের পরেও যে কিছু-একটা অজানা গোছের থাকে—এ সংস্কার হাড়ে মাসে জড়ানো। যতক্ষণ হাড় মাস আছে, ততক্ষণ সেও আছে—তাহাকে স্বীকার করি, আর না করি। সুতরাং এই দমকা বাতাসটা শুধু ধূলা-বালিই উড়াইল না, আমার মজ্জাগত সেই গোপন সংস্কারে গিয়াও ঘা দিল। ক্রমশঃ ধীরে ধীরে বেশ একটু জোরে হাওয়া উঠিল। অনেকেই হয়ত জানে না যে, মড়ার মাথার ভিতর দিয়া বাতাস বহিলে ঠিক দীর্ঘশ্বাস ফেলা গোছের শব্দ হয়। দেখিতে দেখিতে আশে-পাশে, সুমুখে পিছনে দীর্ঘশ্বাসের যেন ছড়াছড়ি পড়িয়া গেল। ঠিক মনে হইতে লাগিল, কত লোক যেন আমাকে ঘিরিয়া বসিয়া অবিশ্রাম হা-হুতাশ করিয়া নিশ্বাস ফেলিতেছে; এবং ইংরেজিতে যাহাকে বলে ‘uncanny feeling’ ঠিক সেই ধরনের একটা অস্বস্তি সমস্ত শরীরটাকে যেন গোটা-দুই ঝাঁকানি দিয়া গেল। সেই শকুনির বাচ্চাটা তখনও চুপ করে নাই, সে যেন পিছনে আরও বেশি করিয়া গোঙাইতে লাগিল। বুঝিলাম, ভয় পাইয়াছি। বহু অভিজ্ঞতার ফলে বেশ জানিতাম, এ যে-স্থানে আসিয়াছি, এখানে এই বস্তুটাকে সময়ে চাপিতে না পারিলে, মৃত্যু পর্য্যন্ত অসম্ভব ব্যাপার নয়। বস্তুতঃ এরূপ ভয়ানক জায়গায় ইতিপূর্ব্বে আমি কখনো একাকী আসি নাই। একাকী যে স্বচ্ছন্দে আসিতে পারিত, সে ইন্দ্র—আমি নয়। অনেকবার তাহার সঙ্গে অনেক ভয়ানক স্থানে গিয়া গিয়া আমারও একটা ধারণা জন্মিয়াছিল যে ইচ্ছা করিলে আমিও তাহার মত এই-সব স্থানে একাকী আসিতে পারি। কিন্তু সেটা যে কত বড় ভ্রম, এবং আমি যে শুধু ঝোঁকের উপরেই তাহাকে অনুসরণ করিতে গিয়াছিলাম, এক মুহূর্ত্তেই আজ তাহা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। আমার সেই চওড়া বুক কই? আমার সে বিশ্বাস কোথায়? আমার সেই রামনামের অভেদ্য কবচ কই? আমি ত ইন্দ্র নই যে, এই প্রেতভূমিতে নিঃসঙ্গ দাঁড়াইয়া, চোখ মেলিয়া প্রেতাত্মার গেণ্ডুয়া-খেলা দেখিব? মনে হইতে লাগিল, একটা জীবন্ত বাঘ-ভালুক দেখিতে পাইলেও বুঝি বাঁচিয়া যাই। হঠাৎ কে যেন পিছনে দাঁড়াইয়া আমার ডান কানের উপর নিশ্বাস ফেলিল। তাহা এম্নি শীতল যে তুষার কণার মত সেইখানেই জমিয়া উঠিল। ঘাড় না তুলিয়াও স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম, এ নিশ্বাস যে নাকের মস্ত ফুটাটা হইতে বাহির হইয়া আসিল, তাহাতে চামড়া নাই, মাংস নাই, এক ফোঁটা রক্তের সংশ্রব পর্য্যন্ত নাই—কেবল হাড় আর গহ্বর। সুমুখে, পিছনে, দক্ষিণে, বামে অন্ধকার। স্তব্ধ নিশীথ রাত্রি ঝাঁঝাঁ করিতে লাগিল। আশে-পাশের হা-হুতাশ ও দীর্ঘশ্বাস ক্রমাগতই যেন হাতের কাছে ঘেঁষিয়া আসিতে লাগিল। কানের উপর তেমনই কন্কনে ঠাণ্ডা নিশ্বাসের বিরাম নাই। এইটাই সর্ব্বাপেক্ষা আমাকে অবশ করিয়া আনিতে লাগিল। মনে হইতে লাগিল, সমস্ত প্রেতলোকের ঠাণ্ডা হাওয়া যেন এই গহ্বরটা দিয়াই বহিয়া আসিয়া আমার গায়ে লাগিতেছে।
এত কাণ্ডের মধ্যেও কিন্তু এ কথাটা ভুলি নাই যে, কোনমতেই আমার চৈতন্য হারাইলে চলিবে না। তাহা হইলে মরণ অনিবার্য্য। দেখি, ডান পা-টা ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতেছে। থামাইতে গেলাম, থামিল না। সে যেন আমার পা নয়।
ঠিক এম্নি সময়ে অনেক দূরে অনেকগুলা গলার সমবেত চীৎকার কানে পৌঁছিল—বাবুজী! বাবুসাব! সর্ব্বাঙ্গ কাঁটা দিয়া উঠিল। কাহারা ডাকে? আবার চীৎকার করিল—গুলি ছুঁড়বেন না যেন! শব্দ ক্রমশঃ অগ্রসর হইয়া আসিতে লাগিল—গোটা-দুই ক্ষীণ আলোর রেখাও আড়চোখে চাহিতে চোখে পড়িল। একবার মনে হইল, চীৎকারের মধ্যে যেন রতনের গলার আভাস পাইলাম। খানিক পরেই টের পাইলাম, সেই বটে। আর কিছুদূর অগ্রসর হইয়া, সে একটা শিমূলের আড়ালে দাঁড়াইয়া চেঁচাইয়া বলিল, বাবু, আপনি যেখানেই থাকুন, গুলি-টুলি ছুঁড়্বেন না—আমরা রতন। রতন লোকটা যে সত্যই নাপিত তাহাতে আর ভুল নাই।
উল্লাসে চেঁচাইয়া সাড়া দিতে গেলাম, কিন্তু স্বর ফুটিল না। একটা প্রবাদ আছে, ভূত-প্রেত যাবার সময় কিছু-একটা ভাঙ্গিয়া দিয়া যায়। যে আমার পিছনে ছিল, সে আমার কণ্ঠস্বরটা ভাঙ্গিয়া দিয়াই বিদায় হইল।
রতন এবং আরও তিনজন লোক গোটা-দুই লণ্ঠন ও লাঠিসোঁটা হাতে করিয়া কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। এই তিনজনের মধ্যে একজন ছট্টুলাল—সে তব্লা বাজায়; এবং আর একজন পিয়ারীর দরওয়ান। তৃতীয় ব্যক্তি গ্রামের চৌকিদার।
রতন কহিল, চলুন—তিনটে বাজে।
চল, বলিয়া আমি অগ্রসর হইলাম। পথে যাইতে যাইতে রতন বলিতে লাগিল, বাবু, ধন্য আপনার সাহস। আমরা চারজনে যে কত ভয়ে ভয়ে এসেচি, তা বল্তে পারিনে।
এলি কেন?
রতন কহিল, টাকার লোভে। আমরা সবাই এক মাসের মাইনে নগদ পেয়ে গেছি। বলিয়া আমার পাশে আসিয়া গলা খাটো করিয়া বলিতে লাগিল, বাবু, আপনি চলে এলে গিয়ে দেখি মা বসে বসে কাঁদ্চেন। আমাকে বল্লেন, রতন, কি হবে বাবা; তোরা পিছনে যা। আমি এক-একমাসের মাইনে তোদের বকসিস্ দিচ্ছি। আমি বল্লুম, ছট্টুলাল আর গণেশকে সঙ্গে নিয়ে আমি যেতে পারি মা; কিন্তু পথ চিনিনে। এমন সময় চৌকিদার হাঁক দিতেই মা বল্লেন, ওকে ডেকে আন্ রতন, ও নিশ্চয়ই পথ চেনে। বেরিয়ে গিয়ে ডেকে আন্লুম। চৌকিদার ছ টাকা হাতে পেয়ে, তবে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। আচ্ছা বাবু, কচিছেলের কান্না শুন্তে পেয়েছেন? বলিয়া রতন শিহরিয়া উঠিয়া, আমার কোটের পিছনটা চাপিয়া ধরিল। কহিল, আমাদের গণেশ পাঁড়ে বামুনমানুষ, তাই আজ রক্ষে পাওয়া গেছে, নইলে—
আমি কথা কহিলাম না। প্রতিবাদ করিয়া কাহারো ভুল ভাঙ্গিবার মত মনের অবস্থা আমার ছিল না। আচ্ছন্ন অভিভূতের মত নিঃশব্দে পথ চলিতে লাগিলাম।
কিছুদূর আসার পর রতন প্রশ্ন করিল, আজ কিছু দেখতে পেলেন বাবু?
আমি বলিলাম, না।
আমার এই সংক্ষিপ্ত উত্তরে রতন ক্ষুব্ধ হইয়া কহিল, আমরা যাওয়ায় আপনি কি রাগ করেচেন বাবু? মার কান্না দেখলে কিন্তু—
আমি তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলাম, না রতন, আমি একটুও রাগ করিনি।
তাঁবুর কাছাকাছি আসিয়া চৌকিদার তাহার কাজে চলিয়া গেল। গণেশ ছট্টুলাল চাকরদের তাঁবুতে প্রস্থান করিল। রতন কহিল, মা বলেছিলেন, যাবার সময় একটিবার দেখা দিয়ে যেতে।
থমকিয়া দাঁড়াইলাম। চোখের উপর যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম, পিয়ারী দীপের সম্মুখে অধীর-আগ্রহে, সজল-চক্ষে বসিয়া প্রতীক্ষা করিয়া আছে, এবং আমার সমস্ত মনটা উন্মত্ত ঊর্দ্ধশ্বাসে তাহার পানে ছুটিয়া চলিয়াছে।
রতন সবিনয়ে ডাকিল, আসুন।
মুহূর্ত্তকালের জন্য চোখ বুজিয়া নিজের অন্তরের মধ্যে ডুব দিয়া দেখিলাম, সেখানে প্রকৃতিস্থ কেহ নাই! সবাই আকণ্ঠ মদ খাইয়া মাতাল হইয়া উঠিয়াছে! ছি, ছি! এই মাতালের দল লইয়া যাইব দেখা করিতে? সে আমি কিছুতেই পারিব না।
বিলম্ব দেখিয়া রতন বিস্মিত হইয়া কহিল, ওখানে অন্ধকারে দাঁড়ালেন কেন বাবু—আসুন?
আমি তাড়াতাড়ি বলিয়া ফেলিলাম, না, রতন, এখন নয়—আমি চল্লুম।
রতন ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিল, মা কিন্তু পথ চেয়ে বসে আছেন—
পথ চেয়ে? তা হোক্! তাঁকে আমার অসংখ্য নমস্কার দিয়ে বোলো, কাল যাবার আগে দেখা হবে—এখন নয়; আমার বড় ঘুম পেয়েছে রতন, আমি চল্লুম! বলিয়া বিস্মিত, ক্ষুব্ধ রতনকে জবাব দিবার সময়মাত্র না দিয়া দ্রুতপদে ওদিকের তাঁবুর দিকে চলিয়া গেলাম।