ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/১৭
১৭
অধিবেশন সভাপতির ভাষণ দিতে উঠে পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ দুই হাত জোড় করে সংস্কৃত মঙ্গলাচরণ করে সর্ববিঘ্ন বিনাশকারী গণপতির কাছে প্রার্থনা জানালেন যে, তিনি যেন কাছাড় জেলার পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ভুবন পর্বত শিখরে উপস্থিত হয়ে আজকের এই আয়োজনকে সার্থক করে তুলুন। এ প্রারম্ভিক কথাটির প্রতিটি শব্দ রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্রকে উন্মনা করে তুলল। তিনি যে অতি সম্প্রতি ওই ভুবন তীর্থ দর্শন করে কয়েকটি ভগ্নপ্রায় মূর্তি প্রত্যক্ষ করে এসেছেন, মন্দির সংস্কারের কাজও শুরু করে এসেছেন। এরপর পদ্মনাথ জেলার পশ্চিমপ্রান্তে সিদ্ধেশ্বর কপিলাশ্রম, হেড়ম্বরাজ আরাধিতা খঙ্গরূপা দেবী রণচণ্ডী, খাসপুর রাজধানীর প্রাসাদ সংলগ্ন ইষ্টক নির্মিত দেবীমন্দিরের বন্দনা করলেন। একসঙ্গে এতগুলো প্রসঙ্গের ভার বিপিনচন্দ্রের পক্ষে বহন করা দুঃসহ। তিনি চক্ষু বন্ধ করে মাথা নত করে বসে রইলেন। বাকি কথাগুলো কর্ণকুহরে গেলেও তিনি যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না।
সম্বিত ফিরে এল হঠাৎ যখন কানে এল মণিচরণ বর্মন প্রণীত ‘হৈড়িম্ব ভাষাপ্রবেশ’ গ্রন্থখানির নাম। এরপর নানাবিধ প্রসঙ্গ এল, এল কলের গান প্রসঙ্গ যা আমাদের সংগীতের বুনিয়াদ নষ্ট করছে বলে পদ্মনাথ ক্ষোভ ব্যক্ত করলেন। রায়বাহাদুর এ কথা শুনে কুণ্ঠিত হয়ে উঠলেন। কলিকাতা, শিলং, গৌহাটি বা সিলেট ভ্রমণ কালে অনেক সৌখিন জিনিসের সঙ্গে এই গ্রামোফোন যন্ত্রটিও যে তিনি কিনে এনেছেন, চালিয়ে গানও শোনেন মাঝে মাঝে। ঘরে সাজিয়েও রেখেছেন যন্ত্রটি।
সাহিত্যের জগৎ থেকে পণ্ডিতপ্রবর দেখি একেবারে জাগতিক বিষয়ে নেমে এসেছেন। রায়বাহাদুরের মনে হল কথাগুলো যেন সরাসরি তাঁকেই উদ্দেশ করে বলা,
—পল্লিগ্রামে আমরা নিত্য আহার্য ধান্যাদি শস্যের চাষ ছাড়িয়া দিয়া পাটের চাষ করিতেছি, খড়ের চাল ভাঙিয়া টিনের ঘর করিতেছি। তুলসি ছাড়িয়ে পাতাবাহারের উপবন বানাইতেছি।
বিদ্যাবিনোদের চোখের সামনে কি রায়বাহাদুরের টিনের ছাউনি দেওয়া সুদৃশ্য বাড়ি, সামনে পাতাবাহারের ঝাড় ভেসে উঠছে? বক্তৃতায় উল্লিখিত সোনার গয়না, সাবান, গন্ধতেল, পার্শি শাড়ি, জ্যাকেট শব্দগুলো তাঁর কানকে সরাসরি বিদ্ধ করছে।
তবে একটি বিষয়ে বিপিনচন্দ্রকে কেউ দোষ দিতে পারবে না। শিলচরের ইটখোলায় তিনি একটি বাড়ি করলেও ওখানে একরাত্রির বেশি থাকলেই হাফিয়ে ওঠেন। পল্লি ছেড়ে শহরবাসী হবার কোনও পরিকল্পনা রাখেননি। তাঁর মুখে হাসি ফুটল যখন বিদ্যাবিনোদ বললেন,
—এতদঞ্চলে যাঁরা শিক্ষিত বলিয়া পরিচিত তাঁদের মধ্যে কেহ কেহ স্বীয় বাসভূমি পরিত্যাগের উপক্রম করিতেছেন, ... যাঁহারা বিদেশে থাকেন তাঁহারা বাড়ি আইসেন না ...ইত্যাদি ইত্যাদি।
যথেষ্ট দীর্ঘ ভাষণ, কিন্তু সমবেত শ্রোতারা প্রতিটি শব্দ গভীর অভিনিবেশ সহকারে শুনছেন, যেন সবই তাঁদের প্রাণের কথা। সামাজিক প্রসঙ্গ থেকে এলেন ধর্ম বিষয়ে। এদিকে আবার রায়বাহাদুরের বিশেষ কোনও ভাবনা নেই। ধর্মাধর্মের বিষয়টা তাঁর পুবের বাড়ির খুড়া জেঠারা ভালো বোঝেন অবশ্য তাঁর বাড়িতেও সমস্ত বিধি মতেই দোল দুর্গোৎসব প্রচলিত রয়েছে।
সভাপতির অভিভাষণের শেষ পর্বের কথাগুলোতে রায়বাহাদুর আবার মনোযোগ দিলেন। বিশ্বব্যাপী মারণযজ্ঞের প্রসঙ্গ টেনে এনে মহামহোপাধ্যায় জার্মান শক্তির প্রতি কিছুটা কটাক্ষও করেন, শিল্প বিজ্ঞান দর্শনে এত অগ্রগতি সত্ত্বেও এ জাতির ধর্মবোধ নাশ হয়ে গেছে এবং তাই হিংসার দাবানলে এরা বিশ্বকে অশান্ত করে তুলছে। অবশেষে তিনি আশার বাণী শোনালেন,
—আমাদের রাজার জাতি এই মহাসমরে ধর্মের পক্ষ অবলম্বন করিয়াছেন।
রায়বাহাদুরের কাছে ব্যাপারটি স্পষ্ট হল, ভারতবর্ষও এই মহাসমরে জড়িত হয়ে গেছে। এটা ভালো কি মন্দ ভাবার কি আর কোন অবকাশ আছে—এ চিন্তা মনে জাগতে না জাগতেই পদ্মনাথের দৃপ্ত উচ্চারণ,
—আমাদের রাজার জয় হউক, ধর্মের জয় হউক, পৃথিবীতে ধর্মের অভ্যুদয় হোক।
ভাষণ শেষ। সভাগৃহ নিস্তব্ধ। শীতের দমকা হাওয়া এসে সন্ধ্যার আবহাওয়াকে ভারী করে তুলল। শ্রোতারা নিঃশব্দে বহির্গমনের দিকে এগিয়ে চললেন।