ষোল-আনি/তৃতীয় পরিচ্ছদ
[ ৩ ]
সেদিন একাদশী। কালু মুখুয্যের বাড়ীর পাশেই তাহাদের জ্ঞাতি চণ্ডী মুখুয্যের বাড়ী। চণ্ডী বাবুর অবস্থা পূর্ব্বে তেমন ভাল ছিল না। তাঁহার পিতা জ্যেষ্ঠা কন্যা রমাসুন্দরীর দেবগ্রামের জমিদার হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের সহিত বিবাহ দেন এবং তদুপলক্ষে কিছু জমিজমা ও নগদ টাকা পান। চণ্ডী মুখুয্যের সেই জোত-জমার আয়েই চলে এবং যখন যা দরকার হয়, দেবগ্রামে দিদির নিকট চাইলেই তাহা পূর্ণ হয়। চণ্ডী বাবুর পরপর ছয়টী মেয়ের পর এবার একটী পুত্র-সন্তান হইয়াছে। ছয় মেয়ের পর ছেলে, তাহার অন্নপ্রাশনে ঘটা না করিলে কি ভাল দেখায়। তাই তিনি অনেক আত্মীয়-কুটুম্ব নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। তাঁহার দিদিও এই শুভকর্ম্ম উপলক্ষে সুবর্ণপুরে আসিয়াছেন। জমিদার হরিপ্রসন্ন বাবুর মৃত্যু হইয়াছে; উপযুক্ত পুত্র সিদ্ধেশ্বর বাবুই এখন মালিক। মায়ের সঙ্গে সিদ্ধেশ্বর বাবুও মাতুল-পুত্রের অন্নপ্রাশন উপলক্ষে আসিয়াছেন। বলা বাহুল্য যে, এই অন্নপ্রাশনের সমস্ত ব্যয়ভারই চণ্ডী বাবুর দিদি বহন করিয়াছেন। সঙ্গে লোকজন, দাস-দাসীও অনেক আসিয়াছে। এই একাদশীর দিনই অন্নপ্রাশন। গ্রামের ভদ্র ইতর সকল লোকই নিমন্ত্রিত হইয়াছে। কালাচাঁদের বাড়ীতে আজ আর উনানে হাঁড়ি চড়াইবারই প্রয়োজন হয় নাই। মানদার একাদশী; কালাচাঁদ ও-বাড়ীর ব্যাপারেই নিযুক্ত; সুহার এবং চাকর-চাকরাণীরা সকলেই সেখানে নিমন্ত্রণ খাইয়াছে। লোকজনের আহারাদি শেষ হইতে প্রায় অপরাহ্ণ হইয়া গিয়াছিল। কালাচাঁদ সন্ধ্যার সময় বাড়ীতে আসিয়া পুনরায় স্নান করিয়া চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে আহার করিতে গেল,—দিনমানে আর তাহার আহার হয় নাই।
রাত্রিতে কালাচাঁদ বাড়ীতে থাকিত না; তাহার রাত্রি-বাসের অন্য স্থান ছিল। বাড়ীতে বৃদ্ধ দাসী গোপালের মা রাত্রিতে মানদার ঘরের বারান্দায় শয়ন করিত; বাহিরে বৈঠকখানায় দুইজন চাকর থাকিত। মন্দাকিনীর ঘর এ কয়দিন বন্ধই আছে। মন্দাকিনী এখানে থাকিবার সময়েও রাত্রিতে মানদার ঘরেই তিনি শয়ন করিতেন।
একে বৈশাখ মাস, তাহাতে একাদশী। মানদা ক্লান্ত হইয়া তাঁহার ঘরের বারান্দায় একখানি মাদুর পাতিয়া শয়ন করিয়া ছিলেন। গোপালের মা অন্য দিন সেই বারান্দার অপর পাশেই শয়ন করিত। সে দিন মানদাকে বারান্দায় শয়ন করিতে দেখিয়া সে মন্দাকিনীর ঘরের বারান্দায় সুহারকে লইয়া শয়ন করিয়া তাহাকে নানা গল্প শুনাইতেছিল; তখনও তাহাদের নিদ্রাকর্ষণ হয় নাই।
রাত্রি তখন সাতটা বাজিয়া গিয়াছে।কালাচাঁদ চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে আহার শেষ করিয়া বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। গোপালের মা ও সুহার তখনও জাগিয়া ছিল। কালাচাঁদকে আসিতে দেখিয়া তাহারা গল্প বন্ধ করিয়া চুপ করিয়া শুইয়া রহিল। কালাচাঁদ প্রাঙ্গণ অতিক্রম করিয়া মানদার ঘরের বারানায় উঠিয়া ডাকিল “বড়বৌ, একবার ওঠ ত।”
কালাচাঁদের আহবান শুনিয়াই মানদা বস্ত্রাদি সংযত করিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়লেন।
কালাচাঁদ বলিল “বড়বৌ, কাল যে তোমার কাছে একটা কাগজের বাণ্ডিল রেখেছিলাম, সেইটা বের করে দাও ত। এখনই দরকার।”
মানদার ঘরের মধ্যে আলো ছিল না। তিনি আলো জ্বালিবারও প্রয়োজন বোধ করিলেন না, কারণ সেই কাগজের বাণ্ডিলটা তিনি বাহিরে তাকের উপরই রাখিয়াছিলেন। অন্ধকারেই তাহা আনিয়া দিতে পারিবেন ভাবিয়া তিনি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। তিনি প্রবেশ করিতে না করতেই কালাচাঁদ সেই অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। বোধ হয় এক মিনিটও অতীত হয় নাই—মানদা ঘরের মধ্যে চীৎকার করিয়া উঠিল। সে ভীষণ চীৎকার!
সেই চীৎকার শুনিয়াই গোপালের মা ও সুহার তাড়াতাড়ি উঠানে নামিয়া জ্যোৎস্নার আলোকে দেখিল মানদার ঘরের দ্বার বন্ধ এবং ভিতরে কেমন যেন “গোঁ গোঁ” শব্দ হইতেছে। সুহার কাঁদিয়া উঠিল; গোপালের মা চীৎকার করিতে করিতে পাশের বাড়ীর দিকে দৌড়িল “ওগো, তোমরা এসে গো! সর্ব্বনাশ হোলে! ছোট বাবু বড়-মাকে মেরে ফেলছে গো!”
চণ্ডী বাবুর বাড়ী তখন আত্মীয় কুটুম্বে পূর্ণ! গোপালের মায়ের চীৎকার এবং সুহারের ক্রন্দনের শব্দ শুনিয়া স্ত্রীপুরুষ যিনি যে অবস্থায় ছিলেন, উৰ্দ্ধশ্বাসে এ-বাড়ীতে আসিয়া পড়িলেন। সকলের মুখেই “কি হয়েছে? ব্যাপার কি?” শব্দ।
গোপালের মা চীৎকার করিয়া বলিল “ওগো, শীগগির বড় মায়ের ঘরের দোর ভেঙ্গে ফেল! হায় হায়, ছোটবাবু বুঝি তাকে মেরে ফেল্লে গো।”
তখন চণ্ডী বাবু ও আরও দুই তিনজন একসঙ্গে মানদার ঘরের বারান্দায় উঠিয়া দেখেন দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ। ঘরের মধ্যে কি যেন একটা ‘গোঁ গোঁ’ শব্দ হইতেছে। আর বিলম্ব না করিয়া তাঁহারা দুয়ারে পদাঘাত করিতে লাগিলেন। চার পাঁচ আঘাতেই দ্বারের অর্গল ভাঙ্গিয়া গেল। ঘর অন্ধকার! মেজের এক কোণ হইতে কেবল একটা কাতরোক্তি শুনিতে পাওয়া যাইতেছিল। একজনের হাতে একটা দিয়াশলাই ছিল; সে একটা কাঠি জ্বালিতেই ঘরের মধ্যের অন্ধকার দূর হইল। সকলে সভয়ে দেখিল, মানদা ঘরের মেজের উপর পড়িয়া আছেন। তাঁহারই কণ্ঠ হইতে অব্যক্ত কাতরোক্তি বাহির হইতেছে। ঘরের চারিদিকে দেখিবার পূর্ব্বেই দিয়াশলাই নিবিয়া গেল। চণ্ডী বাবু বলিলেন “খবরদার, তোমরা দোর আগ্লে, দাঁড়াও, পাজিটা যেন পালাতে না পারে। আর একটা দিয়াশলাই জ্বাল।”
আর দিয়াসলাই জ্বালিতে হইল না; চণ্ডী বাবুর বাড়ী হইতে তিন-চারিটা লণ্ঠন আসিয়া উপস্থিত হইল। প্রাঙ্গণ তখন লোকে পূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
চণ্ডী বাবু তখন চীৎকার করিয়া বলিলেন “ওগো, তোমরা মেয়েরা কে এসেছ, শীগ্গির ঘরের মধ্যে এস। বড়-বৌ যে কেমন করছেন?”
এই কথা শুনিয়াই চণ্ডী বাবুর দিদি অগ্রসর হইলেন। তাঁহাকে ঘরে প্রবেশ করিতে দেখিয়াই দ্বারের নিকট যাঁহারা ছিলেন, তাঁহারা একটু সরিয়া দাঁড়াইলেন।
কালাচাঁদ তখন দ্বারের আড়ালে দাঁড়াইয়া ছিল। সে মনে করিল, এই তাহার পলায়নের সুযোগ; সে ঘরের অন্য যে দ্বার ছিল, তাহা খুলিবার উপায় ছিল না। সে তখন রমামুন্দরীকে এক ধাক্কা দিয়া বারান্দায় আসিয়া পড়িল। সকলেই সতর্ক ছিল—তাহার আর পলায়নের পথ হইল না। একজন তাহাকে এমন এক ধাক্কা দিল যে, সে বারান্দা হইতে একেবারে নীচের উঠানে পড়িয়া গেল। তিনচারি জন আসিয়া তাহাকে চাপিয়া ধরিল; দু-চারটী উত্তম-মধ্যমও হইয়া গেল।
সিদ্ধেশ্বর বাবু বাহিরে উঠানে দাঁড়াইয়া ছিলেন। তিনি বলিলেন “আহা মেরো না গো! যাতে পালাতে না পারে, তাই কর। কোন অত্যাচার কোরে না।”
চণ্ডী বাবু তখন বারান্দা হইতে নামিতে নামিতে বলিলেন “ঘরের মধ্যে আর গোল করে কাজ নাই। মেয়েরাই যা হয় করবেন। তোমরা নেমে এস।”
প্রাঙ্গণে আসিয়া দেখেন, পাড়ার অনেক লোক আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। চণ্ডী বাবু বলিলেন “আর এখানে গোল করে কাজ নেই; আমার ওখানে যাওয়া যাক্। সেখানে গিয়ে যা কর্ত্তব্য তা স্থির করা যাবে।” চাকরদের উদ্দেশ করিয়া বলিলেন “ওরে, তোরা তিন চারজন এখানে থাক, দিদি যা বলেন তাই করিস।”
রমাসুন্দরী ঘরের মধ্যে হইতেই বলিলেন “কোন ভয় নেই, জ্ঞান হয়েছে। ডাক্তার ডাকতে হবে না। তোমরা বাড়ীতে যাও।”
একজন বলিল “ওরে, হারামজাদা যেন পালিয়ে যেতে না পারে।” এই বলিয়া কালাচাঁদকে পদাঘাত করিল। কালাচাঁদের মুখে আর কথা নাই; সে চোরের মত, মার খাইতে লাগিল। যে মারিতে নিষেধ করে, সেও কিন্তু দুই-ঘা দিয়া পথ দেখায়।