ষোল-আনি/প্রথম পরিচ্ছদ
ষোল-আনি
[ ১ ]
গোরাচাঁদ আর কালাচাঁদ দুই ভাই। তাহারা সহোদর নহে, —সম্বন্ধ অতি দুর। সেকালে এমন দূর-সম্পৰ্কীয় ব্যক্তিও আপন হইয়া যাইত। গোরাচাঁদের পিতার এক মাস্তুতো ভাই বড়ই দরিদ্র ছিলেন। তাঁহার সংসারে একমাত্র স্ত্রী ছিলেন, আর কেহই ছিল না। একটা পুত্রসন্তান প্রসব করিয়াই এই মাসতুতো ভাইয়ের স্ত্রী যখন মারা যান, তখন গোরাচাঁদের পিতা এই মাতৃহীন শিশুটীর লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন। ছেলেটীর রং বড়ই কালো বলিয়া গোরাচাঁদের পিতা নিজপুত্র গোরাচাঁদের নামের সঙ্গে মিল করিয়া এই ছেলেটীর নাম রাখেন কালাচাঁদ।
গোরাচাঁদ আর কালাচাঁদ সহোদরের মতই প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। যাঁহারা প্রকৃত সংবাদ জানিতেন না, তাঁহারা মনে করিতেন, ইঁহারা সহোদর ভ্রাতা। কিন্তু দুই ভাইয়ের প্রকৃতি এমন বিভিন্ন ছিল যে, চক্ষুস্মান ব্যক্তিমাত্রেই বলিতে পারিতেন, এক পিতার ঔরসে, এক মায়ের গর্ভে এমন বিরুদ্ধ স্বভাবের দুই ভাই জন্মগ্রহণই করিতে পারে না। গোরাচাঁদ সর্ব্ববিষয়েই গোরাচাঁদ, আর কালাচাঁদ ভিতর-বাহিরেই কালাচাঁদ।
ইঁহাদের উপাধি মুখোপাধ্যায়,—মহা কুলীন, ফুলের মুখুটী, বিষ্ণুঠাকুরের সন্তান। বাড়ী সুবর্ণপুর। অবস্থা তেমন মন্দই বা কি? জমাজমি যাহা আছে, তাহাতে বেশ চলিয়া যায় এবং দুপয়সা সঞ্চয়ও হয়। তাহার পর কালাচাঁদ মুখুয্যে যেমন-তেমন লোক নহে; যেখানে সূচ প্রবেশের পথও লোকে দেখিতে পায় না, কালু মুখুয্যে সেখানে হাতী চালাইতে পারে। বড় ভাই গোরাচাঁদ অতি কোমল-প্রকৃতি, সদাশয় ব্যক্তি। তিনি গ্রামের বিদ্যালয় হইতে এণ্ট্রান্স পরীক্ষায় ফেল করিয়াই পড়াশুনা ত্যাগ করিয়াছিলেন। পিতা যতদিন বাঁচিয়া ছিলেন, ততদিন তিনিই বিষয়-কর্ম্মের তত্ত্বাবধান করিতেন, গোরাচাঁদকে কিছুই দেখিতে হইত না। পিতা যখন পরলোকগত হইলেন, তখন কালাচাঁদের বয়স কুড়ি বৎসর; কিন্তু সেই বয়সেই তাহার বুদ্ধি-বিবেচনা এমন পরিপক্ক হইয়াছিল যে, গোরাচাঁদ আর বিষয়-কর্ম্মের ভার গ্রহণ করিলেন না, কালাচাঁদের উপরেই সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া সেই বয়সেই অর্থাৎ ২৬ বৎসর বয়সেই ধর্ম্মকর্ম্মে মনোনিবেশ করিলেন। তিনি খান-দান, পূজার্চ্চনা করেন, গ্রামের দশজনের সুখ-দুঃখের সময় উপস্থিত হন এবং যথাসাধ্য সকলের সাহায্য করেন। গ্রামের সকলেই তাঁহাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিত।
কালাচাঁদ কিন্তু গোরাচাঁদের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল; দয়াধর্ম্ম তাহার ছিল না। যাহাতে দুপয়সা প্রাপ্তি হয়, এই চিন্তাতেই সে নিবিষ্ট থাকিত। এতদ্ব্যতীত তাহার স্বভাব-চরিত্রও তেমন, ভাল ছিল না।
গোরাচাঁদ ভুলিয়াই গিয়াছিলেন যে, কালাচাঁদ তাঁহার দুরসম্পর্কের ভাই—বলিতে গেলে কেহই নহে; কিন্তু তাঁহার পিতা মৃত্যুকালে বলিয়া গিয়াছিলেন যে, কালাচাঁদকে যখন তিনি পুত্রনির্ব্বিশেষে পালন করিয়াছেন এবং তাহার যখন আর কেহই নাই, তখন গোরাচাঁদ যেন তাহাকে কিছুতেই পরিত্যাগ না করে; নিজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলিয়া মনে করে। গোরাচাঁদ তাহাই করিয়াছেন, কালাচাঁদের উপরেই সমস্ত ভার দিয়া তিনি নিশ্চিন্ত। কালাচাঁদ কাজকর্ম্মে খুব উপযুক্ত; এ অবস্থায় তাহার চরিত্র-দোষ এবং অন্তবিধ অত্যাচারের কথা শুনিয়াও গোরাচাঁদ মুখ ফুটিয়া তাহাকে কিছু বলিতে পারিতেন না-শাসন করা ত দুরের কথা।
বাড়ীতে স্ত্রীলোকের মধ্যে দুই ভাইয়ের স্ত্রী; গোরাচাঁদের মাতাঠাকুরাণী অনেক দিন হইল, পিতা পরলোক গমনের পূর্ব্বেই দেহত্যাগ করিয়াছিলেন। গোরাচাঁদের স্ত্রী পরমা সুন্দরী ছিলেন; তাঁহার পিতৃকুলে কেহই ছিলনা। একটী কন্যা ব্যতীত তাঁহার আর সন্তানও হয় নাই।
গোরাচাঁদ যেমন মানুষ ছিলেন, তাঁহার স্ত্রীও তেমনই লক্ষীস্বরূপিনী; কিন্তু কালাচাঁদের স্ত্রীর অবস্থা বড়ই শোচনীয় ছিল। কালাচাঁদ নিজেও কালাচাঁদ, তাহার অদৃষ্টে প্রজাপতি মিলাইয়া দিয়াছিলেনও তেমনই অর্দ্ধাঙ্গিনী। শুনিতে পাওয়া যায়, সম্পন্ন গৃহস্থের একমাত্র কন্যা দেখিয়া গোরাচাঁদের পিতা কালাচাঁদের ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়াই কুৎসিত মেয়েটীকে কালাচাঁদের অঙ্কলক্ষ্মী করিয়া দিয়াছিলেন। দেখিতে কুৎসিত হইলেও কালাচাঁদের স্ত্রী বড় ভাল মেয়ে। স্বামী যে তাহাকে দুইচক্ষে দেখিতে পারিত না, কোন দিন ভাল মুখে একটা কথাও বলিত না, সর্ব্বদা দূর দূর করিত, তাহাতেও কিন্তু ব্রাহ্মণ-কন্যাকে কেহ বিচলিত দেখে নাই। ছোটবধু মন্দাকিনী বড় যায়ের মুখের দিকে চাহিয়া, তাঁহার স্নেহ আদরের অধিকারিণী হইয়া স্বামীর অনাদর নির্য্যাতন নীরবে সহ করিতেন। বড়-যা মানদা তাঁহার স্নেহের অঞ্চল দিয়া এই অভাগিনী ছোট যাকে ঢাকিয়া রাখিতেন। দেবর স্বামীর ছয় বৎসরের ছোট হইলেও মানদা কোন দিন তাহার সহিত কথা বলিতেন না। সাধারণতঃ, দেবরের সহিত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃবধু যে প্রকার ব্যবহার করিয়া থাকে, পরস্পরের মধ্যে যে প্রকার সম্বন্ধ প্রায় সকল গৃহস্থের বাড়ীতেই দেখিতে পাওয়া যায়, মানদা সে রকম ভাবে দেবরের সঙ্গে ব্যবহার করিতেন না। তিনি দেবরকে যে ঘৃণা করিতেন তাহা নহে; কিন্তু কালাচাঁদের ব্যবহার তাহার নিকট ভাল বোধ হইত না। এই কারণে তাহার সহিত ঘনিষ্ঠতা করিতেন না। কালচাঁদ, অনেক সময়ে এ জন্য বিরক্তি প্রকাশ করিত, রাগ করিত, অনেক ঠাট্টা-তামাসাও করিত; কিন্তু মানদা তাহাতে কর্ণপাতও করিতেন না। দুই যায়ে সংসারের কাজকর্ম্ম করিতেন, একমাত্র কন্যা সুহারের লালন-পালন করিতেন।
কালাচাঁদের একটা গুণ ছিল; সে নানা উপায়ে অর্থ উপার্জ্জন করিত, ন্যায় অন্যায় অবিচার অত্যাচার করিয়া টাকা, সংগ্রহ করিত; টাকার জন্য কাহারও প্রাণনাশ করিতেও হয়ত দ্বিধা বোধ করিত না; ব্যয়ের বেলায় কিন্তু সে ভারি হিসাবী ছিল। যাহাদের স্বভাব-চরিত্র খারাপ হয়, তাহারা অপব্যয়ী হইয়া থাকে; তাহাদের হাতে বিষয় বা টাকাকড়ি পড়িলে তাহারা দুইদিনেই উড়াইয়া সর্ব্বস্বান্ত হইয়া পড়ে। কালাচাঁদ কিন্তু সে রকমের মানুষ ছিল না। তাহার স্বভাব অতি মন্দ ছিল; কিন্তু সে ব্যাপারেও সে মুক্তহস্ত ছিল না; সে বিশেষ হিসাব করিয়াই অপব্যয় করিত। তাহার রোজগারের অনুপাতে সে ব্যয় অতি সামান্য বলিলেই হয়। সংসার-খরচের দিকেও তাহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল; কোন প্রকারে ছপয়সা বেশী খরচ হইবার যো ছিল না। অথচ কাহার জন্য যে সে জোতজমা বৃদ্ধি করিতেছিল, অর্থ সঞ্চয় করিতেছিল, লগ্নী কারবারে একেবারে পিশাচের ন্যায় ব্যবহার করিত, কাহাকেও একটা পয়সা রেন্থাই দিত না, তাহা বুঝিয়া উঠা যাইত না। স্ত্রীর সহিত তাহার মুখ দেখাদেখিও ছিল না; সে রাত্রিতে বাড়ীতেই থাকিত না। সংসারে অবলম্বন একমাত্র তাহার দাদার মেয়েটী। তাহাকেও সে তেমন আদর-যত্ন করিত না; তাহার জন্যও কখন কোন দ্রব্য কিনিয়া দিত না। তবুও যে কেন যে এমন করিয়া অর্থ উপার্জন করিত, সেই জানে। গোরাচাঁদ যদি কখন কোন বিষয়ে কিছু বলিতেন, তাহা হইলে কালাচাঁদ অতি গম্ভীর ভাবে বলিত, “সময় অসময় আছে দাদা! চারিদিকে দেখে-শুনে খরচ করতে হয়। দু-দশ টাকা হাতে না থাক্লে কি মান-সম্ভ্রম রক্ষা করে চলা যায় না, না দশজনে মানে চেনে।” গোরাচাঁদ আর দ্বিরুক্তি করিতেন না।
এই ভাবেই কয়েক বৎসর গেল। তাহার পরই এই মুখোপাধ্যায় পরিবারে এক অভাবনীয় পৈশাচিক দৃশ্যের অভিনয় হইল। সেই কথা বলিবার জন্যই তাঁহাদের পরিবারের এই পরিচয়টুকু দিতে হইল।