ষোল-আনি/ষষ্ঠ পরিচ্ছদ
[ ৬ ]
পূর্ব্ব রাত্রিতে চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে যে বৈঠক বসিয়াছিল, তাহাতে কথাবার্ত্তা বেশীদূর অগ্রসর হইতে পারে নাই। রমাসুন্দরীর তেজে সকলেই যেন একটু সংকুচিত হইয়া গিয়াছিলেন। তদ্ব্যতীত আরও একটা কারণ ছিল। সুবর্ণপুর গ্রামের সমস্ত সামাজিক ব্যাপারের যিনি অধিনায়ক বা অধিনায়িকা, তিনি সে বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি আর কেহই নহেন—গ্রামের পরমপূজনীয় শ্রীযুক্তা শ্যামা ঠাকুরাণী। মুখোপাধ্যায় মহাশয়েরাই বলুন, গাঙ্গুলী মহাশয়ই বলুন, আর মহাপণ্ডিত পুরোহিত ঠাকুরই বলুন, শ্যামা ঠাকুরাণীর কাছে কেহই মনুষ্য-পদ-বাচ্যই নহেন। শ্যামা ঠাকুরাণীই এ গ্রামের সমাজকে শাসনে রাখিয়া থাকেন। পূর্ব্ব রাত্রিতে যখন গোলমাল উপস্থিত হয়, যখন চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে পাড়ার সকলে সমবেত হন, তখন শ্যামা ঠাকুরাণীকে সংবাদ দেওয়ার কথা যে না উঠিয়াছিল, তাহা নহে। কিন্তু তিনি এই সমস্ত দিন চণ্ডী বাবুর বাড়ীর এত বড় ব্যাপারের কার্য্য শেষ করিয়া সন্ধ্যার সময় গৃহে গিয়াছেন এবং তাঁহার গৃহও গ্রামের অপর প্রান্তে, সেই জন্য এত রাত্রিতে তাঁহাকে বিরক্ত করা কেহই কর্ত্তব্য মনে করেন নাই; সেই জন্যই তাঁহাকে রাত্রিতে সংবাদ দেওয়া হয় নাই; সুতরাং কর্ত্তব্যও নির্দ্ধারিত হয় নাই। প্রাতঃকালে তাঁহাকে সংবাদ দেওয়া হইবে স্থির হইয়া সে রাত্রির মত সভা ভঙ্গ হয়।
এই স্থানে শ্রীযুক্ত শ্যামা ঠাকুরাণীর একটু পরিচয় দিতে হইতেছে। তিনি এই গ্রামেরই কিশোরী ঘোষাল মহাশয়ের কন্যা। ঘোষাল মহাশয়ের যখন স্ত্রী-বিয়োগ হয়, তখন শ্যামা ঠাকুরাণীর বয়স আট বৎসর। ঘোষাল মহাশয় আর দারপরিগ্রহ না করিয়া মেয়েটীকেই প্রতিপালন করিতে থাকেন। দশম বৎসর বয়সে, তাঁহার যাহা সাধ্য তাহার ও অতিরিক্ত ব্যয় করিয়া শ্যামা বিবাহ দেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ছয়মাস যাইতে না যাইতেই শ্যামা বিধবা হন; তাঁহাকে আর স্বামীর ঘর করিতে হয় না। সেই হইতে শ্যামা ঠাকুরাণী পিত্রালয়েই বাস করিতেছেন। বছর আট পরে যখন কিশোরী ঘোষাল মারা যান, তখন তিনি তাঁহার যে সামান্য জোত-জমা ছিল, তাহা বিধবা কন্যা শ্যামার ভরণ পোষণের জন্য লেখা পড়া করিয়া দিয়া যান। শ্যামার অবর্ত্তমানে ঘোষাল মহাশয়ের জ্ঞাতিদের মধ্যে যাহার আইন অমুসারে প্রাপ্য হইবে, তিনিই বিষয় পাইবেন।
সেই হইতে শ্যামা ঠাকুরাণী এই গ্রামেই বাস করিতেছেন। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন শ্যামা ঠাকুরাণীর বয়স প্রায় ৬০ বৎসর; কিন্তু তাঁহাকে দেখিলে কেহ চল্লিশের উপর বলিয়া কিছুতেই মনে করিতে পারেন না। দশ বৎসর বয়সে বিধবা হইয়া এই পঞ্চাশ বৎসর কাল শ্যামা ঠাকুরাণী নিষ্কলঙ্ক জীবন যাপন করিয়া আসিতেছেন; সুবর্ণপুরের কেহ কোন দিন তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে পারে নাই। এই চরিত্রবলেই শ্যামা ঠাকুরাণী গ্রামে একাধিপত্য করিয়া আসিতেছেন। তাঁহার যে জমাজমি আছে, তাহার আয় হইতে তাঁহার বেশ চলিয়া যায়; গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কাহারও মুখের দিকে চাহিতে হয় না; জমাজমির ব্যবস্থার জন্যও শ্যামা ঠাকুরাণী কাহারও মুখাপেক্ষা করেন না; নিজেই সমস্ত করেন। দশ টাকা সুদেও তিনি লাগাইয়া থাকেন; সকলে বলে তাঁহার হাতেও কিছু আছে।
তাহার পর শ্যামা ঠাকুরাণী পরোপকারে কখনও পরান্মুখ নহেন; গ্রামের সকলেরই বিপদ-আপদে তিনি বুক দিয়া পড়িয়া থাকেন। এই সকল গুণের জন্য সকলেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা করে। আবার সকলে তাঁহাকে বিশেষ ভয়ও করে, কারণ শ্যামাঠাকুরাণীর মুখের সম্মুখে কাহারও দাঁড়াইবার যো নাই; রাগ ও অভিমান তাঁহার অত্যন্ত বেশী; তাঁহার মতের প্রতিবাদ করিলে আর রক্ষা নাই; তিনি তখন একেবারে উগ্রচণ্ডা হইয়া উঠেন। তাঁহার অভিমানে আঘাত করিতে কেহই সাহস করে না। সকলেই তাঁহার পরামর্শমত কাজ করিয়া থাকে।
রমাসুন্দরী যে অতি প্রত্যুষেই মানদা ও তাহার মেয়েকে লইয়া চলিয়া যাইবেন, একথা রাত্রিতে কেহই ভাবেন নাই; তিনি যদিও সে কথা বলিয়াছিলেন, কিন্তু সকলেই মনে করিয়াছিলেন যে, প্রাতঃকালে শ্যামা ঠাকুরাণীর সহিত পরামর্শ করিয়াই রমাসুন্দরী কর্ত্তব্য স্থির করিবেন। রাত্রিতে যাহাই বলুন, শ্যামা ঠাকুরাণীকে উপেক্ষা করিয়া রমাসুন্দরী কিছুই করিবেন না, এ কথা সকলেই স্থির জানিতেন। শ্যামা ঠাকুরাণী যদি রমাসুন্দরীর প্রস্তাবে মত না দেন, তাহা হইলে মানদাকে লইয়া যাওয়া অসম্ভব হইবে, এই কথা ভাবিয়াই রমাসুন্দরী প্রাতঃকালেই যাত্রা করিয়াছিলেন; পাড়ার কেহই সে কথা জানিতেও পারে নাই; চণ্ডী বাবুও তাঁহার ভগিনীকে নিষেধ করিতে সাহসী হন নাই; তাঁহার যাহা বক্তব্য, তাহা তিনি পূর্ব্ব রাত্রিতেই বলিয়াছিলেন। রমাসুন্দরীকে ত তিনি চটাইতে পারেন না, ভগিনীর সাহায্যেই তিনি এখন গ্রামের দশজনের একজন। এ অবস্থায় তিনি আর আপত্তি করিলেন না। রমাসুন্দরী চলিয়া যাইবার পর কথাটা ক্রমে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল।
শ্যামা ঠাকুরাণী এত বড় ব্যাপারের কিছুই রাত্রিতে জানিতে পারেন নাই। পূর্ব্বদিন চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে অধিক পরিশ্রম হওয়ায় পরদিন শয্যা ত্যাগ করিতে তাহার একটু বিলম্বই হইয়াছিল। তিনি যখন ঘরের বাহিরে আসিয়া প্রাত্যহিক কাজকর্ম্মে হাত দিয়াছেন, এমন সময় প্রতিবেশিনী হরি সরকারের মা আসিয়া বলিল “ও দিদি! তুমি বুঝি এই উঠ্লে? রাতের খবর বুঝি কিছুই জান না?”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “হ্যাঁ ভাই, কাল বড় খাটুনী গিয়াছে। বুড়ো বয়স, এখন আর অত পরিশ্রম সহ্য হয় না, তাই আজ সকালে উঠতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছে। তা, কি বলছিলে,ঐ রাতের খবর! কৈ না, আমি ত কিছুই জানিনে।”
“সে কি কথা, এমন একটা ব্যাপার হয়ে গেল, আর তুমি জান না।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বিস্মিত হইয়া বলিলেন “না, আমি কোন খবরই পাই নি। কি, হয়েছে কি?”
“হবে আর কি? গাঁময় একেবারে ঢি ঢি পড়ে গেছে। ওপাড়ার কালু মুখুয্যে না কি রাত্তিরে তার ভাই-বৌকে বেইজ্জত করেছে। তাই নিয়ে একেবারে কুরুক্ষেত্তর কাণ্ড! চণ্ডী মুখুয্যের বোন সুন্দরী ঠাকুরাণী ওদের ছেলের ভাতে এসেছিল কি না। সে না কি আজ সকালেই গোরা মুখুয্যের বৌ আর তার মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে।”
শ্যামা ঠাকুরাণী উগ্রভাবে বলিলেন “কি বলিস্, এত বড় কাণ্ড হয়ে গেল, আর আমি খবরটাও পেলুম না, আমাকে কেউ কথাটাও জিজ্ঞাসা করল না। না, তুই হয় ত শুন্তে ভুল করেছিস্। তাও কি কখন হয়?”
“আমি কি আর না জেনে-শুনেই কথা বল্ছি। আমার ছেলে যে কাল রাত্রিতে মুখুয্যে-বাড়ীতেই ছিল। সে আর ঐ গোলমালে বাড়ী আস্তেই পারে নাই। এই সকাল বেলা এসে সব কথা বল্ল। তারা নৌকা ছেড়ে দিয়ে চলে গেলে তবে ত আমার ছেলে বাড়ী এসেছে।”
শ্যামা ঠাকুরাণী রাগে, অভিমানে একেবারে জ্বলিয়া উঠিলেন। কি, এত বড় কথা! এখনও তিনি মরেন নাই; ইহারই মধ্যে এমন অশ্রদ্ধা! তাঁহাকে না জানাইয়াই ও-পাড়ার লোকেরা এত বড় কাজটা করিয়া ফেলিল। তিনি তখন ক্রোধভরে বলিলেন “বেশ, যার যা ইচ্ছে, সে তাই করুক গে! শ্যামা বামণী এ গাঁয়ের আর কাহার কোন কথার মধ্যে নেই। কি বেইমান গো, এই গাঁয়ের লোকগুলো! এই যে এতদিন দিন নেই, রাত নেই, যে যখন বিপদে পড়েছে, যার যখন দরকার পড়েছে, তখনই এই শ্যামা বামণী না খেয়ে না দেয়ে একেবারে বুক দিয়ে পড়েছে, এ বুঝি তারই ফল। যাক্ আমি আর কারো কিছুর মধ্যে নেই। কারও বাড়ীও যাব না, কারও কোন কথাতেও থাক্ব না। আমি কি কারও খাই না ধারি যে, যে ডাক্বে তার বাড়ী যাবো। আজ থেকে নাকে-কাণে খত দিচ্ছি হরির মা! আমার পায়ে এসে মাথা খুঁড়লেও কারও উপকার করছিনে। এত হেনেস্তা, এমন অপমান।” শ্যামা ঠাকুরাণী এই বলিয়াই ঘরের মধ্যে চলিয়া গেলেন; হরি সরকারের মা প্রাঙ্গণে একটু দাঁড়াইয়া থাকিয়া আপন কাজে চলিয়া গেল।
শ্যামা ঠাকুরাণীর রাগও হইল, অভিমানও হইল; কিন্তু এত বড় একটা ব্যাপারে তাঁহাকে না ডাকিয়া, তাঁহার সঙ্গে পরামর্শ না করিয়া যে গ্রামের সকলে একটা কাজ করিয়া বসিল, ইহাতে মুখে তিনি যতই উপেক্ষা প্রদর্শন করুন না কেন, তাঁহার মনে কিন্তু বড়ই বাজিল। গ্রামের মধ্যে তাঁহার যে একাধিপত্য ছিল, তাহা এক কথায় ছাড়িয়া দিতে ত তিনি পারেন না; তাহা হইলে যে তিনি একেবারে দশজনের একজন হইয়া পড়িবেন; ভবিষ্যতে যে কেহই তাঁহাকে মানিবে না। সুতরাং এমন করিয়া সমস্ত সম্পর্ক ছাড়িয়া দিয়া সুবর্ণপুরে বাস করা তাঁহার পক্ষে একেবারে যে অসম্ভব। গ্রামের দশজনের দশ কথা, দশ ব্যাপার লইয়াই যে তিনি জীবনের এই সুদীর্ঘকাল কাটাইয়াছেন। তাঁহার আর গৃহকর্ম্ম এমন কি? বিধবা ব্রাহ্মণ-কন্যার এক বেলার দুটা হবিষ্যি, তার জন্য ত আর সারা দিন-রাত দরকার হয় না; জোতজমা ও খাতক লইয়াই বা কতক্ষণ সময় কাটে?
শ্যামা ঠাকুরাণী ঘরের মধ্যে যাইয়া এটা ওটা নাড়াচাড়া করেন, আর ঐ কথাই তাঁহার মনে হয়। তাই ত, এতদিন না ততদিন, গ্রামের লোক তাঁহাকে এতবড় কাণ্ড সম্বন্ধে একটা কথাও জিজ্ঞাসা করিল না। একবার ভাবিলেন, কাজ নাই, চুপ করিয়াই থাকিবেন; কিছুর মধ্যেই যাইবেন না; কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, না, সে কিছুতেই হইতে পারে না। কথাটার বৃত্তান্ত তাঁহার জানিতেই হইতেছে। তখন আর তিনি ঘরে থাকিতে পারিলেন না; কাজকর্ম্ম আর করা হইল না; বাসি কাজ পড়িয়াই রহিল। তিনি ঘরে তালা বন্ধ করিয়া বাহির হইলেন।
রাস্তা দিয়া যাইতে ও-বাড়ীর তারার পিসি তাহার উঠান হইতে বলিল “কি গো দিদি ঠাকরুণ, মুখুয্যে বাড়ী যাচ্ছ বুঝি। তা তুমি না গেলে চলবে কেন? বাবা গো, এমন কথা ত কখন শুনিনি দিদি! তুমি গাঁয়ে আছ, কা’ল রাত্তিরেই মিটিয়ে দিতে পার নেই। আজ আবার শুনলাম, মাগীটা না কি গাঁ ছেড়ে গিয়েছে? হ্যাঁ দিদি ঠাকরুণ, তুমি গায়ে থাক্তে এক গাঁয়ের কলঙ্ক আর এক গাঁয়ে যেতে দিলে। তা যাই বল না, এ কাজটা তোমার ভাল হয় নাই।”
শ্যামা ঠাকুরাণী আত্ম-প্রতিষ্ঠা অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য বলিলেন “তা কি করি বল বোন! রমা আমার ত পর নয়। তার সঙ্গে আমার যে ভাব, সে আমাকে যে রকম ভালবাসে, তাতে তার কথাও ফেলে দেওয়া যায় না। তাইতে বুঝলে বোন! ছেড়ে দিতে হোল। এখন যাই দেখি, সব মিটিয়ে দিয়ে আসি। এ গায়ের কোন কাজেই ত এই শ্যামা বামণী না হলে চলে না।”
তারার পিসি বলল “সে কি আর বল্তে দিদি ঠাকরুণ, তুমি আছ বলেই আমাদের এই গাঁটা ঠিক আছে, নইলে এতদিন কি কেউ গাঁয়ে বাস করতে পারত। তা হ্যাঁ দেখ, ও-বেলা তোমার ওখানে যাব মনে করেছিলাম। তা এখনই দেখা হয়ে গেল, এখনই কথাটা বলি। তারা বল্ছিল পিসিমা, হাতে ত টাকা নেই, জমিদারের খাজনা তিন টাকা দুই-এক,দিনের মধ্যেই দিতে হবে। তুমি যদি বামুনঠাকরুণের কাছ থেকে ধার করে এনে দাও। তাই তোমার কাছে যেতে চেয়েছিলাম। পথেই দেখা হোলো। ও-বেলা কখন যাব দিদিঠাকরুণ!”
শ্যামা ঠাকরুণ বলিলেন “এই যে তারা সে-দিন দশ টাকা নিয়ে গেছে; আবার আজ টাকা। দশ দশ টাকা; কি করে শোধ দেবে। তোমরা যে টাকা দিয়ে কি কর, তা বুঝতে পারি নে। আর আমারই কি ন-শ পঞ্চাশ আছে যে, যার যখন দরকার পড়বে, তখনই কুলোবো। এখন তাড়াতাড়ি, আর কথা বল্তে পারছিনে। তুমি আর যেও না, তারাকেই ও-বেলা পাঠিয়ে দিও। দেখ্ব, কি করতে পারি।”
তারার পিসি বলিল “আর করা-করি নয় দিদি ঠাকরুণ, এ দায়টা তোমার উদ্ধার করে দিতেই হবে। তুমি না হলে আমাদের এ গরিবদের দুঃখু আর কে বোঝে বল। তা যাও, আর দেরী করো না। মুখুয্যেদের যে এমন ব্যাভার, তা এতদিন জানতাম না।”
শ্যামা ঠাকুরাণী এ কথার কোন উত্তর না দিয়াই অগ্রসর হইলেন। একটু যাইতেই রাস্তার বাম পার্শ্বে রামতারক ভট্টাচার্যোর বাড়ী। শ্যামা ঠাকুরাণীর মনে পড়িল, তারকের ছেলেকে ত কাল দেখা হয় নাই। অমনি রাস্তা ছাড়িয়া তিনি ভট্টাচার্য্য বাড়ীর দিকে গেলেন। বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া উঠানে দাঁড়াইয়াই বলিলেন “ওগো বৌমা, ছেলেটা কা’ল কেমন ছিল? কা’ল আর আসতে পারি নি; সারাদিনটা মুখুয্যে বাড়ীর ব্যাপারে ছিলাম; ছেলেটার কথা আর মনে হয় নাই। নিয়ে এস ত দেখি? কা’ল ক’বার দাস্ত হয়েছিল?”
রামতারকের স্ত্রী তাড়াতাড়ি ছেলে কোলে লইয়া উঠানে আসিয়া বলিল “কা’ল একটু ভালই ছিল। পেটের বেদনাও একটু কম, দাস্তও এই পাঁচ ছয়বার হয়েছিল। তা মা, আসন এনে দিই, একটু বোসো।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “না মা, আমার কি বস্বার সময় আছে। ভয় নেই, আমাশয় কি না, সারতে একটু সময় নেবে। ঐ যে শিকড় তোমাকে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছি, আজও তারই রস একটু আদার রসের সঙ্গে খাইয়ে দিও। আর দুই-একদিন সাবধানে রেখো, ছেলে সেরে উঠ্বে। কোন অত্যাচার করে না বৌমা! কৈ, তারক কৈ? তাকে ত দেখ্ছিনে?
তারকের স্ত্রী বলিল “সকালে উঠেই তিনি মুখুয্যে-বাড়ী গিয়েছেন। হ্যাঁ মা, মুখুয্যে-বাড়ী কি হয়েছে? ওঁকে জিজ্ঞাসা করতে উনি বল্লেন, সে সব শুনে কাজ নেই। কোন খুন-খরাবৎ হয় নি ত!”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “বৌমা, সে সব কথা আর তোমার শুনে কাজ নেই। তোমরা বৌ-মানুষ, সে কথা শুন্লে লজ্জায় তোমাদের মাথা হেঁট হবে। আশীর্ব্বাদ করি, স্বামীপুত্র নিয়ে সুখে থাক, পরের কথার মধ্যে যেও না।”
তারকের স্ত্রী তখন নতজানু হইয়া শ্যামা ঠাকুরাণীর পদধূলি লইয়া প্রথমে ছেলের মাথায় দিল, তাহার পর নিজের মাথায় লইয়া বলিল “সেই আশীর্ব্বাদই কর মা! তাই যেন হয়। ফিরে যাবার সময় আর একবার থোকাকে দেখে যাবে ত। আমি এখনই ওষুধ এনে খাইয়ে দিচ্ছি।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “আর ত ভয়ের কিছু নেই। দেখি, ফিরবার সময় যদি পারি ত একবার খোঁজ নিয়ে যাব। আমার কি মা, সোয়াস্তি আছে, না অবসর আছে। এই গায়ের দশ তাল নিয়েই আমি আছি।”
তারকের স্ত্রী বলিল, “তাই থাক মা, তাই থাক। তুমি আছ, তাই বিপদ-আপদে ভয় হয় না; ডাক্লেই তুমি এসে উপস্থিত হও। কত যে বল ভরসা তোমার করি মা, তা এক মুখে বল্তে পারিনে।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “আর দেরী করতে পারছিনে। দেরী করে গেলে সবাই একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠ্বে। তাই দেখ বাছা, তোরা আছিস্ গ্রামের পুরুষ-মানুষ; তোরা লেখাপড়া জানিস; তোদেরও বুদ্ধি-বিবেচনা আছে; কিন্তু যে কাজটী পড়বে, অমনি ডাক্ এই শ্যামা বামণীকে। এক কাল ছিল, যখন এসব পেরে উঠতাম; এখন বয়সও হয়েছে, এখন কোথায় বসে ঠাকুর দেবতার নাম করব, না কে কোন্ মুখুয্যে তার ভাই বৌয়ের উপর অত্যাচার করল, এখন চললাম তার সালিস্ করতে।”
তারকের স্ত্রী বলিল “তা হলে কথাটা সত্যি না কি? ও মা, কি ঘেন্না, কি লজ্জা! আমি অমনি একটু আভাস পেয়েছিলাম। তা যাক্গে, তুমি ঠিক্ বলেছ, ও-সব লজ্জার কথা, কলঙ্কের কথা গেরস্তর বৌদের না শোনাই ভাল! কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাক্বে মা, তাড়াতাড়ি যদি না থাকে ত আসন এনে দিই, একটু বোসো।”
“না, না, আর বস্বার সময় নেই” বলিয়া শ্যামা ঠাকুরাণী ভট্টাচার্য্য-বাড়ী হইতে বাহির হইলেন। সদর রাস্তায় উঠিবার সময়ই দেখিলেন, মুখুয্যেপাড়ার দিক হইতে হরিশ গাঙ্গুলীর ছেলে মহিম আসিতেছে। তাহাকে দেখিয়াই শ্যামা ঠাকুরাণী রাস্তার পার্শ্বে ই দাঁড়াইলেন। মহিম তাঁহাকে দূর হইতেই দেখিয়াই একটু দ্রুতগতিতে আসিয়া বলিল “পিসিমা, আমি যে তোমার বাড়ীতেই যাচ্ছিলাম।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “আমার বাড়ীতে! কেন, তোর কিছু দরকার আছে না কি?” এই বলিয়াই তিনি নিজের বাড়ীর দিকে মুখ ফিরাইলেন, যেন বাড়ীর দিকেই যাইবেন।
মহিম বলিল “বাবা পাঠিয়ে দিলেন তোমাকে ডাক্তে। এখনই একবার চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে যেতে হবে। পাড়ার সকলেই তোমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করছেন।”
শ্যামা ঠাকুরাণী একটু অভিমানের সুরে বলিলেন “আমার জন্য অপেক্ষা, কেন? আমি গরিব বামুণের বিধবা মানুষ; গায়ের এক কোণে পড়ে আছি; আমার আর তত্ত্বতলাসের দরকার কি? হাঁ, যদি রমার মত জমিদার হতাম, তা হোলে তোরাই দিনের মধ্যে পচিশ-বার খোজ নিতি। বল্গে যা, আমার এখন সময় নেই। আমার যাবারই বা দরকার কি? তারকের ছেলেটার অসুখ, তাই দেখ্তে এসেছিলাম। আমি যেতে পাচ্ছিনে। তোরাই আছিস্, তোরাই এখন গাঁয়ের প্রধান হয়েছিস্। তোরাই যা হয় কর গিয়ে, আমার খোজ কেন?” এই বলিয়া শ্যামা ঠাকুরাণী নিজ গৃহের দিকে দুই তিন পা বাড়াইলেন।
মহিম বলিল “ও কি কথা বল্ছ পিসিমা! তুমি না হ’লে কি আমাদের চলে। কা’ল রাত্রিতেই যখন পাড়ার সকলে একত্র হলেন, তখন আমিই বলেছিলাম, এখনই শ্যামা পিসিকে খবর দেওয়া হোক্। তাতে সকলেই বল্লেন যে, বুড়ো মানুষ, এই সারাদিন খেটেখুটে সন্ধ্যার সময় ক্লান্ত হয়ে বাড়ী গিয়েছেন, এখন আর তাঁকে কষ্ট দিয়ে কাজ নেই। কা’ল সকালে তাঁকে ডেকে এনে একটা ব্যবস্থা করলেই হবে। তাইতেই ত তোমাকে তাঁরা ডাক্তে পাঠিয়েছেন।”
“হ্যাঁরে, শুন্লাম না কি বৌটাকে আর তার মেয়েটাকে রমা। নিয়ে গিয়েছে?”
মহিম বলিল “হ্যাঁ, আজ ভোরে তাঁরা চলে গিয়েছেন।” “চলে যদি গিয়ে থাকে, তোরা যদি যেতে দিয়ে থাকিস্, তা হ’লে এখন আবার তার ব্যবস্থা কি?”
“আমরা কি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আজ ভোরেই তাঁরা যাবেন। কা’ল রাত্রিতে ঐ রকম একটা কথা উঠেছিল, এই মাত্র। তাই যে হবে, তা আমরা জান্তাম না, বুঝতেও পারি নাই।”
“তা হ’লে বল্, কাউকে জিজ্ঞাসা না করে চণ্ডী মুখুয্যে এই কাজ করেছে? এর একটা ব্যবস্থা করা চাই। চণ্ডী মুখুয্যে কেমন ছেলে, তা দেখ্তে হবে। মনে করেছিলাম, এ সবের মধ্যে যাব না; কিন্তু চণ্ডী মুখুয্যের এত বড় বাড় বাড়ন্ত কেমন করে হোলো, সেটা বুঝতে হবে। চল্, যাই দেখি।” এই বলিয়া শ্যামা ঠাকুরাণী বাড়ীর দিক হইতে ফিরিয়া মুখুয্যে-পাড়ার দিকে চলিলেন। মহিম আর বাক্যব্যয় না করিয়া তাঁহার অনুগমন করিল।