সংকলন/কাব্যের তাৎপর্য
কাব্যের তাৎপর্য
স্রোতস্বিনী আমাকে কহিলেন, “কচ-দেবযানী-সংবাদ সম্বন্ধে তুমি যে কবিতা লিখিয়াছ তাহা তোমার মুখে শুনিতে ইচ্ছা করি।”
শুনিয়া আমি মনে মনে কিঞ্চিৎ গর্ব অনুভব করিলাম, কিন্তু দর্পহারী মধুসূদন তখন সজাগ ছিলেন, তাই দীপ্তি অধীর হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “তুমি রাগ করিয়ো না, সে-কবিতার কোনো তাৎপর্য কিম্বা উদ্দেশ্য আমি তো কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। ও লেখাটা ভালো হয় নাই।”
আমি চুপ করিয়া রহিলাম। মনে মনে কহিলাম, আর-একটু বিনয়ের সহিত মত প্রকাশ করিলে সংসারের বিশেষ ক্ষতি অথবা সত্যের বিশেষ অপলাপ হইত না; কারণ, লেখার দোষ থাকাও যেমন আশ্চর্য নহে তেমনি পাঠকের কাব্যবোধশক্তির খর্বতাও নিতান্তই অসম্ভব বলিতে পারি না। মুখে বলিলাম, “যদিও নিজের রচনা সম্বন্ধে লেখকের মনে অনেক সময়ে অসন্দিগ্ধ মত থাকে তথাপি তাহা যে ভ্রান্ত হইতে পারে ইতিহাসে এমন অনেক প্রমাণ আছে— অপর পক্ষে সমালোচকসম্প্রদায়ও যে সম্পূর্ণ অভ্রান্ত নহে, ইতিহাসে সে-প্রমাণেরও কিছুমাত্র অসদ্ভাব নাই। অতএব, কেবল এইটুকু নিঃসংশয়ে বলা যাইতে পারে যে, আমার এ-লেখা ঠিক তোমার মনের মতো হয় নাই; সে নিশ্চয় আমার দুর্ভাগ্য— হয়তো তোমার দুর্ভাগ্যও হইতে পারে।”
দীপ্তি গম্ভীরমুখে অত্যন্ত সংক্ষেপে কহিলেন, “তা হইবে।” বলিয়া একখানা বই টানিয়া লইয়া পড়িতে লাগিলেন।
ইহার পরে স্রোতস্বিনী আমাকে সেই কবিতা পড়িবার জন্য আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ করিলেন না।
ব্যোম জানালার বাহিরের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া যেন সুদূর আকাশতলবর্তী কোনো এক কাল্পনিক পুরুষকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “যদি তাৎপর্যের কথা বলো, তোমার এবারকার কবিতার আমি একটা তৎপর্য গ্রহণ করিয়াছি।”
ক্ষিতি কহিল, “আগে বিষয়টা কী বলো দেখি। কবিতাটা পড়া হয় নাই, সে-কথাটা কবিবরের ভয়ে এতক্ষণ গোপন করিয়াছিলাম, এখন ফাঁস করিতে হইল।”
ব্যোম কহিল, “শুক্রাচার্যের নিকট হইতে সঞ্জীবনী-বিদ্যা শিখিবার নিমিত্ত বৃহস্পতির পুত্র কচকে দেবতারা দৈত্যগুরুর আশ্রমে প্রেরণ করেন। সেখানে কচ সহস্রবর্ষ নৃত্যগীতবাদ্য দ্বারা শুক্রতনয়া দেবযানীর মনোরঞ্জন করিয়া সঞ্জীবনী-বিদ্যা লাভ করিলেন। অবশেষে যখন বিদায়ের সময় উপস্থিত হইল তখন দেবযানী তাঁহাকে প্রেম জানাইয়া আশ্রম ত্যাগ করিয়া যাইতে নিষেধ করিলেন। দেবযানীর প্রতি অন্তরের আসক্তিসত্ত্বেও কচ নিষেধ না মানিয়া দেবলোকে গমন করিলেন। গল্পটুকু এই। মহাভারতের সহিত একটুখানি অনৈক্য আছে, কিন্তু সে সামান্য।”
ক্ষিতি কিঞ্চিৎ কাতরমুখে কহিল, “গল্পটি বারো হাত কাঁকুড়ের অপেক্ষা বড়ো হইবে না, কিন্তু আশঙ্কা করিতেছি, ইহা হইতে তেরো হাত পরিমাণের তাৎপর্য বাহির হইয়া পড়িবে।”
ব্যোম ক্ষিতির কথায় কর্ণপাত না করিয়া বলিয়া গেল, “কথাটা দেহ এবং আত্মা লইয়া।”
শুনিয়া সকলেই সশঙ্ক হইয়া উঠিল।
ক্ষিতি কহিল, “আমি এইবেলা আমার দেহ এবং আত্মা লইয়া মানে মানে বিদায় হইলাম।”
সমীর দুই হাতে তাহার জামা ধরিয়া টানিয়া বসাইয়া কহিল, “সংকটের সময় আমাদিগকে একলা ফেলিয়া যাও কোথায়।”
ব্যোম কহিল, “জীব স্বর্গ হইতে এই সংসারাশ্রমে আসিয়াছে। সে এখানকার সুখদুঃখ বিপদসম্পদ হইতে শিক্ষা লাভ করে। যতদিন ছাত্র অবস্থায় থাকে, ততদিন তাহাকে এই আশ্রমকন্যা দেহটার মন জোগাইয়া চলিতে হয়। মন জোগাইবার অপূর্ব বিদ্যা সে জানে। দেহের ইন্দ্রিয়বীণায় সে এমন স্বর্গীয় সংগীত বাজাইতে থাকে যে, ধরাতলে সৌন্দর্যের নন্দনমরীচিকা বিস্তারিত হইয়া যায় এবং সমুদয় শব্দ গন্ধ স্পর্শ আপন জড়শক্তির যন্ত্রনিয়ম পরিহারপূর্বক অপরূপ স্বর্গীয় নৃত্যে স্পন্দিত হইতে থাকে।”
বলিতে বলিতে স্বপ্নাবিষ্ট শূন্যদৃষ্টি ব্যোম উৎফুল্ল হইযা উঠিল, চৌকিতে সরল হইয়া উঠিয়া বসিয়া কহিল, “যদি এমনভাবে দেখো, তবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা অনন্তকালীন প্রেমাভিনয় দেখিতে পাইবে। জীব তাহার মূঢ় অবোধ নির্ভরপরায়ণা সঙ্গিনীটিকে কেমন করিয়া পাগল করিতেছে দেখো। দেহের প্রত্যেক পরমাণুর মধ্যে এমন একটি আকাঙ্ক্ষার সঞ্চার করিয়া দিতেছে, দেহধর্মের দ্বারা যে-আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি নাই। তাহার চক্ষে যে-সৌন্দর্য আনিয়া দিতেছে দৃষ্টিশক্তির দ্বারা তাহার সীমা পাওয়া যায় না, তাই সে বলিতেছে, ‘জনম অবধি হম রূপ নেহারনু নয়ন না তিরপিত ভেল’;—তাহার কর্ণে যে-সংগীত আনিয়া দিতেছে শ্রবণশক্তির দ্বারা তাহা আয়ত্ত হইতে পারে না, ভাই সে ব্যাকুল হইয়া বলিতেছে, ‘সোই মধুর বোল শ্রবণহি শুনলুঁ শ্রুতিপথে পরশ না গেল।’ আবার এই প্রাণপ্রদীপ্ত মূঢ় সঙ্গিনীটিও লতার ন্যায় সহস্র শাখা প্রশাখা বিস্তার করিয়া প্রেমপ্রতপ্ত সুকোমল আলিঙ্গনপাশে জীবকে আচ্ছন্ন প্রচ্ছন্ন করিয়া ধরে, অল্পে অল্পে তাহাকে মুগ্ধ করিয়া আনে, অশ্রান্ত যত্নে ছায়ার মতো সঙ্গে থাকিয়া বিবিধ উপচারে তাহার সেবা করে, প্রবাসকে যাহাতে প্রবাস জ্ঞান না হয়, যাহাতে আতিথ্যের ত্রুটি না হইতে পারে, সেজন্য সর্বদাই সে তাহার চক্ষুবর্ণ হস্তপদকে সতর্ক করিয়া রাখে। এত ভালোবাসার পরে তবু একদিন জীব এই চিরানুগতা অনন্যাসক্তা দেহলতাকে ধূলিশায়িনী করিয়া দিয়া চলিয়া যায়। বলে, ‘প্রিয়ে, তোমাকে আমি আত্মনির্বিশেষে ভালোবাসি, তবু আমি কেবল একটি দীর্ঘনিশ্বাসমাত্র ফেলিয়া তোমাকে ত্যাগ করিয়া যাইব।’ কায়া তখন তাহার চরণ জড়াইয়া বলে, ‘বন্ধু, অবশেষে আজ যদি আমাকে ধূলিতলে ধূলিমুষ্টির মতো ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যাইবে, তবে এতদিন তোমার প্রেমে কেন আমাকে এমন মহিমাশালিনী করিয়া তুলিয়াছিলে। হায়, আমি তোমার যোগ্য নই— কিন্তু তুমি কেন আমার এই প্রাণপ্রদীপদীপ্ত নিভৃত সোনার মন্দিরে একদা রহস্যান্ধকারনিশীথে অনন্ত সমুদ্র পার হইয়া অভিসারে আসিয়াছিলে। আমার কোন্ গুণে তোমাকে মুগ্ধ করিয়াছিল।’— এই করুণ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়া এই বিদেশী কোথায় চলিয়া যায় তাহা কেহ জানে না। সেই আজন্মমিলনবন্ধনের অবসান, সেই মাথুরযাত্রার বিদায়ের দিন, সেই কায়ার গঠিত কায়াধিরাজের শেষ সম্ভাষণ—তাহার মতো এমন শোচনীয় বিরহদৃশ্য কোন্ প্রেমকাব্যে বর্ণিত আছে।”
ক্ষিতির মুখভাব হইতে একটা আসন্ন পরিহাসের আশঙ্কা করিয়া ব্যোম কহিল, “তোমরা ইহাকে প্রেম বলিয়া মনে কর না; মনে করিতেছ, আমি কেবল রূপক অবলম্বনে কথা কহিতেছি। তাহা নহে। জগতে ইচাই সর্বপ্রথম প্রেম এবং জীবনের সর্বপ্রথম প্রেম সর্বাপেক্ষা যেমন প্রবল হইয়া থাকে, জগতের সর্বপ্রথম প্রেমও সেইরূপ সরল অথচ সেইরূপ প্রবল। এই আদি প্রেম, এই দেহের ভালোবাসা যখন সংসারে দেখা দিয়াছিল তখনও পৃথিবীতে জলে স্থলে বিভাগ হয় নাই— সেদিন কোনো কবি উপস্থিত ছিল না, কোনো ঐতিহাসিক জন্মগ্রহণ করে নাই, কিন্তু সেইদিন এই জলময় পঙ্কময় অপরিণত ধরাতলে প্রথম ঘোষিত হইল যে, এ-জগৎ যন্ত্রজগৎমাত্র নহে— প্রেম নামক এক অনির্বচনীয় আনন্দময় বেদনাময় ইচ্ছাশক্তি পঙ্কের মধ্য হইতে পঙ্কজবন জাগ্রত করিয়া তুলিতেছেন— এবং সেই পঙ্কজবনের উপরে আজ ভক্তের চক্ষে সৌন্দর্যরূপা লক্ষ্মী এবং ভাবরূপা সরস্বতীর অধিষ্ঠান হইয়াছে।”
ক্ষিতি কহিল, “আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে যে এমন একটা বৃহৎ কাব্যকাণ্ড চলিতেছে শুনিয়া পুলকিত হইলাম— কিন্তু সরলা কায়াটির প্রতি চঞ্চলস্বভাব আত্মাটার ব্যবহার সন্তোষজনক নহে, ইহা স্বীকার করিতেই হইবে। আমি একান্তমনে আশা করি যেন আমার জীবাত্মা এরূপ চপলতা প্রকাশ না করিয়া অন্তত কিছু দীর্ঘকাল দেহ-দেবযানীর আশ্রমে স্থায়ীভাবে বাস করে। তোমরাও সেই আশীর্বাদ করো।”
ব্যোম চৌকিতে ঠেসান দিয়া বসিয়া জানালার উপর দুই পা তুলিয়া দিল। ক্ষিতি কহিল, “যদি অবসর পাই তবে আমিও একটা তাৎপর্য শুনাইতে পারি। আমি দেখিতেছি এভোল্যুশন্ থিয়োরি অর্থাৎ অভিব্যক্তিবাদের মোট কথাটা এই কবিতার মধ্যে রহিয়া গিয়াছে। সঞ্জীবনীবিদ্যাটার অর্থ, বাঁচিয়া থাকিবার বিদ্যা। সংসারে স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, একটা লোক সেই বিদ্যাটা অহরহ অভ্যাস করিতেছে— সহস্র বৎসর কেন, লক্ষসহস্র বৎসর ধরিয়া। কিন্তু যাহাকে অবলম্বন করিয়া সে সেই বিদ্যা অভ্যাস করিতেছে, সেই প্রাণীবংশের প্রতি তাহার কেবল ক্ষণিক প্রেম দেখা যায়। যেই একটা পরিচ্ছেদ সমাপ্ত হইয়া যায় অমনি নিষ্ঠুর প্রেমিক চঞ্চল অতিথি তাহাকে অকাতরে ধ্বংসের মুখে ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যায়। পৃথিবীর স্তরে স্তরে এই নির্দয় বিদায়ের বিলাপগান প্রস্তরপটে অঙ্কিত রহিয়াছে—”
দীপ্তি ক্ষিতির কথা শেষ হইতে না হইতেই বিরক্ত হইয়া কহিল, “তোমরা এমন করিয়া যদি তাৎপর্য বাহির করিতে থাক তাহা হইলে তাৎপর্যের সীমা থাকে না। কাঠকে দগ্ধ করিয়া দিয়া অগ্নির বিদায়গ্রহণ, গুটি কাটিয়া ফেলিয়া প্রজাপতির পলায়ন, ফুলকে বিশীর্ণ করিয়া ফলের বহিরাগমন, বীজকে বিদীর্ণ করিয়া অঙ্কুরের উদ্গম, এমন রাশি রাশি তাৎপর্য স্তূপাকার করা যাইতে পারে।”
ব্যোম গম্ভীরভাবে কহিতে লাগিল, “ঠিক বটে। ওগুলা তাৎপর্য নহে, দৃষ্টান্ত মাত্র। উহাদের ভিতরকার আসল কথাটা এই, সংসারে আমরা অন্তত দুই পা ব্যবহার না করিয়া চলিতে পারি না। বাম পদ যখন পশ্চাতে আবদ্ধ থাকে দক্ষিণ পদ সম্মুখে অগ্রসর হইয়া যায়, আবার দক্ষিণ পদ সম্মুখে আবদ্ধ হইলে পর বাম পদ আপন বন্ধন ছেদন করিয়া অগ্রে ধাবিত হয়। আমরা একবার করিয়া আপনাকে বাঁধি, আবার পরক্ষণেই সেই বন্ধন ছেদন করি। আমাদিগকে ভালোবাসিতেও হইবে এবং সে-ভালোবাসা কার্টিতেও হইবে,— সংসারের এই মহত্তম দুঃখ, এবং এই মহৎ দুঃখের মধ্য দিয়াই আমাগিকে অগ্রসর হইতে হয়। সমাজ সম্বন্ধেও এ-কথা খাটে। নূতন নিয়ম যখন কালক্রমে প্রাচীন প্রথারূপে আমাদিগকে একস্থানে আবদ্ধ করে, তখন সমাজবিপ্লব আসিয়া তাহাকে উৎপাটনপূর্বক আমাদিগকে মুক্তি দান করে। যে-পা ফেলি সে-পা পরক্ষণে তুলিয়া লইতে হয়, নতুবা চলা হয় না—অতএব অগ্রসর হওয়ার মধ্যে পদে পদে বিচ্ছেদবেদনা—ইহা বিধাতার বিধান।”
সমীর কহিল, “গল্পটার সর্বশেষে যে একটি অভিশাপ আছে তোমরা কেহ সেটার উল্লেখ করো নাই। কচ যখন বিদ্যা লাভ করিয়া দেবযানীর প্রেমবন্ধন বিচ্ছিন্ন করিয়া যাত্রা করেন তখন দেবযানী তাঁহাকে অভিশাপ দিলেন যে, তুমি যে-বিদ্যা শিক্ষা করিলে সে-বিদ্যা অন্যকে শিক্ষা দিতে পারিবে কিন্তু নিজে ব্যবহার করিতে পারিবে না;— আমি সেই অভিশাপ-সমেত একটা তাৎপর্য বাহির করিয়াছি, যদি ধৈর্য থাকে তো বলি।”
ক্ষিতি কহিল, “ধৈর্য থাকিবে কি না পূর্বে হইতে বলিতে পারি না, প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিয়া শেষে প্রতিজ্ঞা রক্ষা না হইতেও পারে। তুমি তো আরম্ভ করিয়া দাও, শেষে যদি অবস্থা বুঝিয়া তোমার দয়ার সঞ্চার হয় থামিয়া গেলেই হইবে।
সমীর কহিল, “ভালো করিয়া জীবনধারণ করিবার বিদ্যাকে সঞ্জীবনী-বিদ্যা বলা যাক। মনে করা যাক, কোনো কবি সেই বিদ্যা নিজে শিখিয়া অন্যকে দান করিবার জন্য জগতে আসিয়াছে। সে তাহার সহজ স্বর্গীয় ক্ষমতায় সংসারকে বিমুগ্ধ করিয়া সংসারের কাছ হইতে সেই বিদ্যা উদ্ধার করিয়া লইল। সে যে সংসারকে ভালোবাসিল না তাহা নহে, কিন্তু সংসার যখন তাহাকে বলিল, তুমি আমার বন্ধনে ধরা দাও,—সে কহিল, ধরা যদি দিই, তোমার আবর্তের মধ্যে যদি আকৃষ্ট হই, তাহা হইলে এ সঞ্জীবনী-বিদ্যা আমি শিখাইতে পারিব না; সংসারের সকলের মধ্যে থাকিয়াও আপনাকে বিচ্ছিন্ন রাখিতে হইবে। তখন সংসার তাহাকে অভিশাপ দিল, তুমি যে-বিদ্যা আমার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছ সে-বিদ্যা অন্যকে দান করিতে পারিবে, কিন্তু নিজে ব্যবহার করিতে পারিবে না।— সংসারের এই অভিশাপ থাকাতে প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় যে, গুরুর শিক্ষা ছাত্রের কাজে লাগিতেছে, কিন্তু সংসারজ্ঞান নিজের জীবনে ব্যবহার করিতে তিনি বালকের ন্যায় অপটু। তাহার কারণ, নির্লিপ্তভাবে বাহির হইতে বিদ্য শিখিলে বিদ্যাটা ভালো করিয়া পাওয়া যাইতে পারে, কিন্তু সর্বদা কাজের মধ্যে লিপ্ত হইয়া না থাকিলে তাহার প্রয়োগ শিক্ষা হয় না।
“তোমরা যে-সকল কথা তুলিয়াছিলে সেগুলা বড়ো বেশি সাধারণ কথা। মনে করো যদি বলা যায়, রামায়ণের তাৎপর্য এই যে, রাজার গৃহে জন্মিয়াও অনেকে দুঃখ ভোগ করিয়া থাকে, অথবা শকুন্তলার তাৎপর্য এই যে, উপযুক্ত অবসরে স্ত্রীপুরুষের চিত্তে পরস্পরের প্রতি প্রেমের সঞ্চার হওয়া অসম্ভব নহে, তবে সেটাকে একটা নূতন শিক্ষা বা বিশেষ বার্তা বলা যায় না।”
স্রোতস্বিনী কিঞ্চিৎ ইতস্তত করিয়া কহিল, “আমার তো মনে হয়, সেই-সকল সাধারণ কথাই কবিতার কথা। রাজগৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াও, সর্বপ্রকার সুখের সম্ভাবনা সত্ত্বেও, আমৃত্যুকাল অসীম দুঃখ রাম ও সীতাকে সংকট হইতে সংকটান্তরে ব্যাধের ন্যায় অনুসরণ করিয়া ফিরিয়াছে; সংসারের এই অত্যন্ত সম্ভবপর, মানবাদৃষ্টের এই অত্যন্ত পুরাতন দুঃখকাহিনীতেই পাঠকের চিত্র আকৃষ্ট এবং আর্দ্র হইয়াছে। শকুন্তলার প্রেমদৃশ্যের মধ্যে বাস্তবিকই কোনো নূতন শিক্ষা বা বিশেষ বার্তা নাই, কেবল এই নিরতিশয় প্রাচীন এবং সাধারণ কথাটি আছে যে, শুভ অথবা অশুভ অবসরে প্রেম অলক্ষিতে অনিবার্যবেগে আসিয়া দৃঢ়বন্ধনে স্ত্রীপুরুষের হৃদয় এক করিয়া দেয়। এই অত্যন্ত সাধারণ কথা থাকাতেই সর্বসাধারণে উহার রসভোগ করিয়া আসিতেছে। কেহ কেহ বলিতে পারেন, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের বিশেষ অর্থ এই যে, মৃত্যু এই জীবজন্তু-তরুলতাতৃণাচ্ছাদিত বসুমতীর বস্ত্র আকর্ষণ করিতেছে, কিন্তু বিধাতার আশীর্বাদে কোনোকালে তাহার বসনাঞ্চলের অন্ত হইতেছে না— চিরদিনিই সে প্রাণময় সৌন্দর্যময় নববস্ত্রে ভূষিত থাকিতেছে। কিন্তু সভাপর্বে যেখানে আমাদের হৃৎপিণ্ডের রক্ত তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়াছিল এবং অবশেষে সংকটাপন্ন ভক্তের প্রতি দেবতার কৃপায় দুই চক্ষু অশ্রুজলে প্লাবিত হইয়াছিল, সে কি এই নূতন এবং বিশেষ অর্থ গ্রহণ করিয়া। না, অত্যাচারপীড়িত রমণীর লজ্জা ও সেই লজ্জানিবারণ-নামক অত্যন্ত সাধারণ, স্বাভাবিক এবং পুরাতন কথায়? কচ-দেবযানী-সংবাদেও মানবহৃদয়ের এক অতি চিরন্তন এবং সাধারণ বিষাদকাহিনী বিবৃত আছে, সেটাকে যাঁহারা অকিঞ্চিৎকর জ্ঞান করেন এবং বিশেষ তত্ত্বকেই প্রাধান্য দেন তাঁহারা কাব্যরসের অধিকারী নহেন।”
সমীর হাসিয়া আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “শ্রীমতী স্রোতস্বিনী আমাদিগকে কাব্যরসের অধিকারসীমা হইতে একেবারে নির্বাসিত করিয়া দিলেন, এক্ষণে স্বয়ং কবি কী বিচার করেন একবার শুনা যাক।”
স্রোতস্বিনী অত্যন্ত লজ্জিত ও অনুতপ্ত হইয়া বারংবার এই অপবাদের প্রতিবাদ করিলেন।
আমি কহিলাম, “এই পর্যন্ত বলিতে পারি যখন কবিতাটা লিখিতে বসিয়াছিলাম তখন কোনো অর্থই মাথায় ছিল না, তোমাদের কল্যাণে এখন দেখিতেছি লেখাটা বড়ো নিরর্থক হয় নাই, অর্থ অভিধানে কুলাইয়া উঠিতেছে না। কাব্যের একটা গুণ এই যে, কবির রচনাশক্তি পাঠকের রচনাশক্তি উদ্রেক করিয়া দেয়; তখন স্ব স্ব প্রকৃতি অনুসারে কেহ-বা সৌন্দর্য, কেহ-বা নীতি, কেহ-বা তত্ত্ব সৃজন করিতে থাকেন। এ যেন আতশবাজিতে আগুন ধরাইয়া দেওয়া— কাব্য সেই অগ্নিশিখা, পাঠকদের মন ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের আতশবাজি। আগুন ধবিবামাত্র কেহ-বা হাউইয়ের মতো একেবারে আকাশে উড়িয়া যায়, কেহ-বা তুবড়ির মতো উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, কেহ-বা বোমার মতো আওয়াজ করিতে থাকে। তথাপি মোটের উপর শ্রীমতী স্রোতস্বিনীর সহিত আমার মতবিরোধ দেখিতেছি না। অনেকে বলেন, আঁঠিই ফলে প্রধান অংশ এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা তাহার প্রমাণ করাও যায়। কিন্তু, তথাপি অনেক রসজ্ঞ ব্যক্তি ফলের শস্যটি খাইয়া তাহার আঁঠি ফেলিয়া দেন। তেমনি কোনো কাব্যের মধ্যে যদি বা কোনো বিশেষ শিক্ষা থাকে, তথাপি কাব্যরসজ্ঞ ব্যক্তি তাহার রসপূর্ণ কাব্যাংশটুক লইয়া শিক্ষাংশটুকু ফেলিয়া দিলে কেহ তাহাকে দোষ দিতে পারে না। কিন্তু যাঁহারা আগ্রহসহকারে কেবল ঐ শিক্ষাংশটুকুই বাহির করিতে চাহেন, আশীর্বাদ করি তাঁহারাও সফল হউন এবং সুখে থাকুন। আনন্দ কাহাকেও বলপূর্বক দেওয়া যায় না। কুসুমফুল হইতে কেহ-বা তাহার রঙ বাহির করে, কেহ-বা তৈলের জন্য তাহার বীজ বাহির করে, কেহ-বা মুগ্ধনেত্রে তাহার শোভা দেখে। কাব্য হইতে কেহ-বা ইতিহাস আকর্ষণ করেন, কেহ-বা দর্শন উৎপাটন করেন, কেহ-বা নীতি, কেহ-বা বিষয়জ্ঞান উদ্ঘাটন করিয়া থাকেন— আবার কেহ-বা কাব্য হইতে কাব্য ছাড়া আর কিছুই বাহির করিতে পারেন না। যিনি যাহা পাইলেন তাহাই লইয়া সন্তুষ্টচিত্তে ঘরে ফিরিতে পারেন, কাহারও সহিত বিরোধের আবশ্যক দেখি না,—বিরোধে ফলও নাই।”