সংকলন/কৌতুকহাস্যের মাত্রা

কৌতুকহাস্যের মাত্রা

 সেদিনকার ডায়ারিতে কৌতুকহাস্য সম্বন্ধে আমাদের আলোচনা পাঠ করিয়া শ্রীমতী দাপ্তি লিখিয়া পাঠাইয়াছেন, ‘একদিন প্রাতঃকালে স্রোতস্বিনীতে ও আমাতে মিলিয়া হাসিয়াছিলাম। ধন্য সেই প্রাতঃকাল এবং ধন্য দুই সখীর হাস্য। জগৎসৃষ্টি অবধি এমন চাপল্য অনেক রমণীই প্রকাশ করিয়াছে, এবং ইতিহাসে তাহার ফলাফল ভালো-মন্দ নানা আকারে স্থায়ী হইয়াছে। নারীর হাসি অকারণ হইতে পারে, কিন্তু তাহা অনেক মন্দাক্রান্তা, উপেন্দ্রবজ্র,, এমন কি, শার্দূলবিক্রীড়িতচ্ছন্দ, অনেক ত্রিপদী, চতুষ্পদী এবং চতুর্দশপদীর আদিকারণ হইয়াছে, এইরূপ শুনা যায়। রমণী তরলস্বভাববশত অনর্থক হাসে, মাঝের হইতে তাহা দেখিয়া অনেক পুরুষ অনর্থক কাঁদে, অনেক পুরুষ ছন্দ মিলাইতে বসে, অনেক পুরুষ গলায় দড়ি দিয়া মরে—আবার এইবার দেখিলাম, নারীর হাস্যে প্রবীন ফিলজফরের বিকন হই নির্ণর অপেক্ষ’ পূবেক্ত: বন্ধ বনগাঁ ও লম্বভাব অনর্থক অকে পুরুষ অনর্থক কঁদে, অনেক পুরুষ “গাষ পড়ি নিয়া মরে—আবার রাস্তা প্রণীত ফিলজফরের মাথায় নবীন ফিলজফি বিকশিত হইয়া উঠে। কিন্তু সত্য কথা বলিতেছি, তত্ত্ব-নির্ণয় অপেক্ষা পূর্বোক্ত তিন প্রকারের অবস্থাটা আমরা পছন্দ করি।’

 এই বলিয়া সেদিন আমরা হাস্য সম্বন্ধে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলাম শ্রীমতী দীপ্তি তাহাকে যুক্তিহীন অপ্রামাণিক বলিয়া প্রমাণ কবিয়াছেন।

 আমার কথা এই যে, আমাদের সেদিনকার তত্ত্বের মধ্যে যে যুক্তির প্রাবল্য ছিল না, সেজন্য শ্রীমতী দীপ্তির রাগ করা উচিত হয় না। কাবণ, নারীহাস্যে পৃথিবীতে যত প্রকার অনর্থপাত করে, তাহার মধ্যে বুদ্ধিমানের বুদ্ধিভ্রংশও একটি। যে-অবস্থায় আমাদের ফিলজফি প্রলাপ হইয়া উঠিয়াছিল, সে অবস্থায় নিশ্চয়ই মনে করিলেই কবিতা লিখিতেও পরিতাম, এবং গলায় দড়ি দেওয়াও অসম্ভব হইত না।

 যাহা হউক, সেদিন মোটের উপরে আমরা প্রশ্নটা এই তুলিয়াছিলাম যে, যেমন দুঃখের কান্না তেমনি সুখের হাসি আছে, কিন্তু, মাঝে হইতে কৌতুকের হাসিটা কোথা হইতে আসিল। কৌতুক জিনিসটা কিছু রহস্যময়। জন্তুরাও সুখ দুঃখ অনুভব করে, কিন্তু কৌতুক অনুভব করে না। অলংকারশাস্ত্রে যে-কটা রসের উল্লেখ আছে সব রসই জন্তুদের অপরিণত অপরিস্ফুট সাহিত্যের মধ্যে আছে, কেবল হাস্যরসটা নাই। হয়তো বানরের প্রকৃতির মধ্যে এই রসের কঞ্চিৎ আভাস দেখা যায়, কিন্তু বানরের সহিত মানুষের আরো অনেক বিষয়েই সাদৃশ্য আছে।

 যাহা অসংগত, তাহাতে মানুষের দুঃখ পাওয়া উচিত ছিল, হাসি পাইবার কোনো অর্থই নাই। পশ্চাতে যখন চৌকি নাই তখন চৌকিতে বসিতেছি মনে করিয়া কেহ যদি মাটিতে পড়িয়া যায়, তবে তাহাতে দর্শকবৃন্দের সুখানুভব করিবার কোনো যুক্তিসংগত কারণ দেখা যায় না। এমন একটা উদাহরণ কেন, কৌতুকমাত্রেরই মধ্যে এমন একটা পদার্থ আছে যাহাতে মানুষের সুখ না হইয়া দুঃখ হওয়া উচিত।

 আমরা কথায় কথায় সেদিন ইহার একটা কারণ নির্দেশ করিয়াছিলাম। আমরা বলিয়াছিলাম, কৌতুকের হাসি এবং আমোদের হাসি একজাতীয়, উভয় হাস্যের মধ্যেই একটা প্রবলতা আছে। তাই আমাদের সন্দেহ হইয়াছিল যে, হয়তো আমোদ এবং কৌতুকের মধ্যে একটা প্রকৃতিগত সাদৃশ্য আছে; সেইটে বাহির করিতে পারিলেই কৌতুকহাস্যের রহস্যভেদ হইতে পারে।

 সাধারণভাবে সুখের সহিত আমোদের একটা প্রভেদ আছে। নিয়মভঙ্গে যে একটু পীড়া আছে, সেই পীড়াটুকু না থাকিলে আমোদ হইতে পারে না। আমোদ জিনিসটা নিত্যনৈমিত্তিক সহজ নিয়মসংগত নহে; তাহা মাঝে-মাঝে এক-একদিনের; তাহাতে প্রয়াসের আবশ্যক। সেই পীড়ন এবং প্রয়াসের সংঘর্ষে মনের যে একটা উত্তেজনা হয়, সেই উত্তেজনাই আমোদের প্রধান উপকরণ।

 আমর। বলিয়াছিলাম, কৌতুকের মধ্যেও নিয়মভঙ্গজনিত একটা পীড়া আছে; সেই পীড়াটা অতি অধিকমাত্রায় না গেলে আমাদের মনে যে একটা সুখকর উত্তেজনার উদ্রেক করে, সেই আকস্মিক উত্তেজনার আঘাতে আমরা হাসিয়া উঠি। যাহা সুসংগত তাহা চিরদিনের নিয়মসম্মত, যাহা অসংগত তাহা ক্ষণকালের নিয়মভঙ্গ। যেখানে যাহা হওয়া উচিত যেখানে তাহা হইলে, তাহাতে আমাদের মনের কোনো উত্তেজনা নাই; হঠাৎ না হইলে কিম্বা আর-একরূপ হইলে সেই আকস্মিক অনতিপ্রবল উৎপীড়নে মনটা একটা বিশেষ চেতনা অনুভব করিয়া সুখ পায় এবং আমরা হাসিয়া উঠি।

 সেদিন আমরা এই পর্যন্ত গিয়াছিলাম, আর বেশি দূর যাই নাই। কিন্তু তাই বলিয়া আর যে যাওয়া যায় না, তাহা নহে। আরো বলিবার কথা আছে।

 শ্রীমতী দীপ্তি প্রশ্ন করিয়াছেন যে, আমাদের চার পণ্ডিতের সিদ্ধান্ত যদি সত্য হয়, তবে চলিতে চলিতে হঠাৎ অল্প হুঁচট খাইলে কিম্বা রাস্তায় যাইতে অকস্মাৎ অল্পমাত্রায় দুর্গন্ধ নাকে আসিলে আমাদের হাসি পাওয়া, অন্তত উত্তেজনাজনিত সুখ অনুভব করা উচিত।

 এ প্রশ্নের দ্বারা আমাদের মীমাংসা খণ্ডিত হইতেছে না, সীমাবদ্ধ হইতেছে মাত্র। ইহাতে কেবল এইটুকু দেখা যাইতেছে যে, পীড়নমাত্রেই কৌতুকজনক উত্তেজনা জন্মায় না; অতএব, এক্ষণে দেখা আবশ্যক, কৌতুকপীড়নের বিশেষ উপকরণটা কী।

 জড়প্রকৃতির মধ্যে করুণরসও নাই, হাস্যরসও নাই। একটা বড়ো পাথর ছোটো পাথরকে গুঁড়াইয়া ফেলিলেও আমাদের চোখে জল আসে না, এবং সমতলক্ষেত্রের মধ্যে চলিতে চলিতে হঠাৎ একটা খাপছাড়া গিরিশৃঙ্গ দেখিতে পাইলে তাহাতে আমাদের হাসি পায় না। নদী নির্ঝর পর্বত সমুদ্রের মধ্যে মাঝে-মাঝে আকস্মিক অসামঞ্জস্য দেখিতে পাওয়া যায়— তাহা বাধাজনক, বিরক্তিজনক, পীড়াজনক হইতে পারে, কিন্তু কোনো স্থানেই কৌতুকজনক হয় না। সচেতন পদার্থ সম্বন্ধীয় খাপছাড়া ব্যাপার ব্যতীত, শুদ্ধ জড়পদার্থে আমাদের হাসি আনিতে পারে না।

 কেন, তাহা ঠিক করিয়া বলা শক্ত; কিন্তু আলোচনা করিয়া দেখিতে দোষ নাই।

 আমাদের ভাষায় কৌতুক এবং কৌতূহল শব্দের অর্থের যোগ আছে। সংস্কৃত সাহিত্যে অনেক স্থলে একই অর্থে বিকল্পে উভয় শব্দেরই প্রয়োগ হইয়া থাকে। ইহা হইতে অনুমান করি, কৌতূহলবৃত্তির সহিত কৌতুকের বিশেষ সম্বন্ধ আছে।

 কৌতূহলের একটা প্রধান অঙ্গ নূতনত্বের লালসা, কৌতুকেরও একটা প্রধান উপাদান নূতনত্ব। অসংগতের মধ্যে যেমন নিছক বিশুদ্ধ নূতনত্ব আছে, সংগতের মধ্যে তেমন নাই।

 কিন্তু প্রকৃত অসংগতি ইচ্ছাশক্তির সহিত জড়িত, তাহা জড় পদার্থের মধ্যে নাই। আমি যদি পরিষ্কার পথে চলিতে চলিতে হঠাৎ দুর্গন্ধ পাই তবে আমি নিশ্চয় জানি, নিকটে কোথাও এক জায়গায় দুর্গন্ধ বস্তু আছে, তাই এইরূপ ঘটিল; ইহাতে কোনোরূপ নিয়মের ব্যতিক্রম নাই, ইহা অবশ্যম্ভাবী। জড়প্রকৃতিতে যে কারণে যাহা হইতেছে তাহা ছাড়া আর কিছু হইবার জো নাই, ইহা নিশ্চয়।

 কিন্তু পথে চলিতে চলিতে যদি হঠাৎ দেখি, একজন মান্য বৃদ্ধ ব্যক্তি খেমটা-নাচ নাচিতেছে, তবে সেটা প্রকৃতই অসংগত ঠেকে; কারণ, তাহা অনিবার্য নিয়মসংগত নহে। আমরা বৃদ্ধের নিকট কিছুতেই এরূপ আচরণ প্রত্যাশা করি না, কারণ, সে ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন লোক; সে ইচ্ছা করিয়া নাচিতেছে, ইচ্ছা করিলে না নাচিতে পারিত। জড়ের নাকি নিজের ইচ্ছামতো কিছু হয় না, এইজন্য জড়ের পক্ষে কিছুই অসংগত কৌতুকাবহ হইতে পারে না। এইজন্য অনপেক্ষিত হঁচট বা দুর্গন্ধ হাস্যজনক নহে। চায়ের চামচ যদি দৈবাৎ চায়ের পেয়ালা হইতে চ্যুত হইয়া দোয়াতের কালির মধ্যে পড়িয়া যায় তবে সেটা চামচের পক্ষে হাস্যকর নহে— ভারাকর্ষণের নিয়ম তাহার লঙ্ঘন করিবার জো নাই; কিন্তু অন্যমনস্ক লেখক যদি তাঁহার চায়ের চামচ দোয়াতের মধ্যে ডুবাইযা চা খাইবার চেষ্টা করেন, তবে সেটা কৌতুকের বিষয় বটে। ধর্মনীতি যেমন জড়ে নাই, অসংগতিও সেইরূপ জড়ে নাই। মনঃপদার্থ প্রবেশ করিয়া যেখানে দ্বিধা জন্মাইয়া দিয়াছে, সেইখানেই উচিত এবং অনুচিত, সংগত এবং অদ্ভূত।

 কৌতুহল জিনিসটা অনেক স্থলে নিষ্ঠুর, কৌতুকের মধ্যেও নিষ্ঠুরতা আছে। সিরাজদ্দৌলা দুইজনের দাড়িতে দাড়িতে বাঁধিয়া উভয়ের নাকে নস্য পুরিয়া দিতেন। এইরূপ প্রবাদ শুনা যায়— উভয়ে যখন হাঁচিতে আরম্ভ করিত তখন সিরাজদ্দৌলা আমোদ অনুভব করিতেন। ইহার মধ্যে অসংগতি কোন্‌খানে। নাকে নস্য দিলে তো হাঁচি আসিবারই কথা। কিন্তু এখানেও ইচ্ছার সহিত কার্যের অসংগতি। যাহাদের নাকে নস্য দেওয়া হইতেছে তাহাদের ইচ্ছা নয় যে তাহারা হাঁচে, কারণ, হাঁচিলেই তাহাদের দাড়িতে অকস্মাৎ টান পড়িবে; কিন্তু তথাপি তাহাদিগকে হাঁচিতেই হইতেছে।

 এইরূপ ইচ্ছার সহিত অবস্থার অসংগতি, উদ্দেশ্যের সহিত উপায়ের অসংগতি, কথার সহিত কার্যের অসংগতি, এগুলোর মধ্যে নিষ্ঠুরতা আছে। অনেক সময় আমরা যাহাকে লইয়া হাসি সে নিজের অবস্থাকে হাস্যের বিষয় জ্ঞান করে না। এইজন্যই পাঞ্চভৌতিক সভায় ব্যোম বলিয়াছিলেন যে, কমেডি এবং ট্র্যাজেডি কেবল পীড়নের মাত্রাভেদ। কমেডিতে যতটুকু নিষ্ঠুরতা প্রকাশ হয় তাহাতে আমাদের হাসি পায় এবং ট্র্যাজেডিতে যতদূর পর্যন্ত যায় তাহাতে আমাদের চোখে জল আসে। গর্দভের নিকট অনেক টাইটিনিয়া অপূর্ব মোহবশত যে আত্মবিসর্জন করিয়া থাকে, তাহা মাত্রাভেদে এবং পাত্রভেদে মর্মভেদী শোকের কারণ হইয়া উঠে।

 অসংগতি কমেডিরও বিষয়, অসংগতি ট্র্যাজেডিরও বিষয়। কমেডিতেও ইচ্ছার সহিত অবস্থার অসংগতি প্রকাশ পায়। ফল্‌স্টাফ উইণ্ড্‌সর-বাসিনী রঙ্গিণীর প্রেমলালসায় বিশ্বস্তচিত্তে অগ্রসর হইলেন, কিন্তু দুর্গতির একশেষ লাভ করিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। রামচন্দ্র যখন রাবণবধ করিয়া, বনবাস-প্রতিজ্ঞা পূরণ করিয়া, রাজ্যে ফিরিয়া আসিয়া দাম্পত্যসুখের চরমশিখরে আরোহণ করিয়াছেন, এমন সময় অকস্মাৎ বিনা মেঘে বজ্রাঘাত হইল, গর্ভবর্তী সীতাকে অরণ্যে নির্বাসিত করিতে বাধ্য হইলেন। উভয় স্থলেই আশার সহিত ফলের, ইচ্ছার সহিত অবস্থার অসংগতি প্রকাশ পাইতেছে। অতএব স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, অসংগতি দুই শ্রেণীর আছে; একটা হাস্যজনক, আর-একটা দুঃখজনক। বিরক্তিজনক, বিস্ময়জনক, রোষজনককেও আমরা শেষ শ্রেণীতে ফেলিতেছি।

 অর্থাৎ, অসংগতি যখন আমাদের মনের অনতিগভীর স্তরে আঘাত করে তখনই আমাদের কৌতুক বোধ হয়, গভীর স্তরে আঘাত করিলে আমাদের দুঃখ বোধ হয়। শিকারী যখন অনেকক্ষণ অনেক তাক করিয়া হংসভ্রমে একটা দূরস্থ শ্বেত পদার্থের প্রতি গুলি বর্ষণ করে এবং ছুটিয়া কাছে গিয়া দেখে সেটা ছিন্ন বস্ত্রখণ্ড, তখন তাহার সেই নৈরাশ্যে আমাদের হাসি পায়; কিন্তু কোনো লোক যাহাকে আপন জীবনের পরম পদার্থ মনে করিয়া একাগ্রচিত্তে একান্ত চেষ্টায় আজন্মকাল তাহার অনুসরণ করিয়াছে এবং অবশেষে সিদ্ধকাম হইয়া তাহাকে হাতে লইয়া দেখিয়াছে, সে তুচ্ছ প্রবঞ্চনামাত্র, তখন তাহার সেই নৈরাশ্যে অন্তঃকরণ ব্যথিত হয়।

 স্থূল কথাটা এই যে, অসংগতির তার অল্প অল্পে চড়াইতে চড়াইতে বিস্ময় ক্রমে হাস্যে এবং হাস্য ক্রমে অশ্রুজলে পরিণত হইতে থাকে।

 ফাল্গুন ১৩০১