সংকলন/ছিন্নপত্র
ছিন্নপত্র
দার্জিলিং-যাত্রা
দার্জিলিং, ১৮৮৭। এই তো দার্জিলিং এসে পড়লুম। পথে বেলা বড়ো একটা কাঁদে নি। খুব চেঁচামেচি গোলমালও করেছে, উলুও দিয়েছে, হাতও ঘুরিয়েছে এবং পাখিকে ডেকেছে, যদিও পাখি কোথায় দেখতে পাওয়া গেল না। সারাঘাটে ষ্টীমারে ওঠবার সময় মহা হাঙ্গামা। রাত্রি দশটা, জিনিসপত্র সহস্র, কুলি গোটাকতক, মেয়ে মানুষ পাঁচটা এবং পুরুষ মানুষ একটি মাত্র। নদী পেরিয়ে একটি ছোটো রেলগাড়িতে ওঠা গেল, তাতে চারটে করে শয্যা, আমরা ছটি মনিষ্যি। মেয়েদের এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ladies compartmentএ তোলা গেল, কথাটা শুনতে যত সংক্ষেপ হল কাজে ঠিক তেমনটা হয় নি। ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি ছুটোছুটি নিতান্ত অল্প হয় নি, তবু ন— বলেন আমি কিছুই করি নি, অর্থাৎ একখানা আস্ত মানুষ একেবারে আস্ত রকম খেপলে যে-রকমটা হয় সেই প্রকার মূর্তি ধারণ করলে ঠিক পুরুষ মানুষের উপযুক্ত হত। কিন্তু, এই দুদিনে আমি এত বাক্স খুলেছি এবং বন্ধ করেছি, এত বাক্স এবং পুঁটুলির পিছনে আমি ফিরেছি এবং এত বাক্স এবং পুঁটুলি আমার পিছনে অভিশাপের মতো ফিরেছে, এত হারিয়েছে এবং এত ফের পাওয়া গেছে এবং এত পাওয়া যায় নি এবং পাবার জন্যে এত চেষ্টা করা গেছে এবং যাচ্ছে যে, কোনো ছাব্বিশ বৎসর বয়সের ভদ্রসন্তানের অদৃষ্টে এমনটা ঘটে নি। আমার ঠিক বাক্স ফোবিয়া হয়েছে। বাক্স দেখলে আমার দাঁতে দাঁতে লাগে। যখন চারিদিকে চেয়ে দেখি বাক্স, কেবলই বাক্স, ছোটো বড়ো মাঝারি, হালকা এবং ভারি, কাঠের এবং টিনের এবং পশুচর্মের এবং কাপড়ের— নিচে একটা, উপরে একটা, পাশে একটা পিছনে একটা—তখন আমার ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি এবং ছুটোছুটি করবার স্বাভাবিক শক্তি একেবারে চলে যায় এবং তখন আমার শূন্য দৃষ্টি, শুষ্ক মুখ এবং দীনভাব দেখলে নিতান্ত কাপুরুষের মতো বোধ হয়।
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত ক্রমাগত স—র উচ্ছ্বাস-উক্তি। “ও মা”, “কী চমৎকার”, “কী আশ্চর্য”, “কী সুন্দর”— কেবলই আমাকে ঠেলে আর বলে “দেখো দেখো”। কী করি, যা দেখায় তা দেখতেই হয়— কখনো বা গাছ, কখনো বা মেঘ, কখনো বা একটা দুর্জয় খাঁদা-নাকওয়ালী পাহাড়ী মেয়ে—কখনো বা এমন কত কী যা দেখতে না-দেখতেই গাড়ি চলে যাচ্ছে, এবং স— দুঃখ করছে যে, র— দেখতে পেলে না। গাড়ি চলতে লাগল। ক্রমে ঠাণ্ডা, তার পরে মেঘ, তার পরে সর্দি, তার পরে হাঁচি, তার পরে শাল, কম্বল, বালাপোষ, মোটা মোজা, পা কন্কন্, হাত ঠাণ্ডা, মুখ নীল, গলা ভার ভার এবং ঠিক তার পরেই দার্জিলিং। আবার সেই বাক্স, সেই ব্যাগ, সেই বিছানা, সেই পুঁটুলি, মোটের উপর মোট, মুটের উপর মুটে। ব্রেক থেকে জিনিসপত্র দেখে নেওয়া, চিনে নেওয়া, মুটের মাথায় চাপানো, সাহেবকে রসিদ দেখানো, সাহেবের তর্ক বিতর্ক, জিনিস খুঁজে না পাওয়া এবং সেই হারানো জিনিস পুনরুদ্ধারের জন্য বিবিধ বন্দোবস্ত করা, তার পরে বাড়ি যাওয়া।
সূর্যাস্ত
পতিসর, ১৮৯১। আমার বোট কাছারির কাছ থেকে অনেক দূরে এনে একটি নিরিবিলি জায়গায় বেঁধেছি। আমি এখন যেখানে এসেছি এ জায়গায় অধিকন্তু মানুষের মুখ দেখা যায় না। চারিদিকে কেবল মাঠ ধূ ধূ করছে, মাঠের শস্য কেটে নিয়ে গেছে, কেবল কাটা ধানের গোড়াগুলিতে সমস্ত মাঠ আচ্ছন্ন। সমস্ত দিনের পর সূর্যাস্তের সময় এই মাঠে কাল একবার বেড়াতে বেরিয়েছিলুম। পূর্ব ক্রমেই রক্তবর্ণ হয়ে একেবারে পৃথিবীর শেষ রেখার অন্তরালে অন্তর্হিত হয়ে গেল। চারিদিকে কী যে সুন্দর হয়ে উঠল সে আর কী বলব। বহুদূরে একেবারে দিগন্তের শেষ প্রান্তে একটু গাছপালার ঘের দেওয়া ছিল। সেখানটা এমন মায়াময় হয়ে উঠল, নীলেতে লালেতে মিশে এমন আবছায়া হয়ে এল, মনে হল— ঐখানে যেন সন্ধ্যার বাড়ি, ঐখানে গিয়ে সে আপনার রাঙা আঁচলটি শিখিলভাবে এলিয়ে দেয়, আপনার সন্ধ্যাতারাটি যত্ন করে জ্বালিয়ে তোলে, আপন নিভৃত নির্জনতার মধ্যে সিঁদুর প’রে বধূর মতো কার প্রতীক্ষায় বসে থাকে এবং বসে বসে পা দুটি মেলে তারার মালা গাঁথে এবং গুন্ গুন্ স্বরে স্বপ্ন রচনা করে। সমস্ত অপার মাঠের উপর একটি ছায়া পড়েছে—একটি কোমল বিষাদ, ঠিক অশ্রুজল নয়, একটি নির্নিমেষ চোখের বড়ো বড়ো পল্লবের নিচে গভীর ছল্ছলে ভাবের মতো। আমার বাঁ-পাশে ছোট্টো নদীটি দুই ধারের উঁচু পাড়ের মধ্যে এঁকে-বেঁকে খুব অল্প দূরেই দৃষ্টিপথের বার হয়ে গেছে, জলে ঢেউয়ের রেখামাত্র ছিল না, কেবল সন্ধ্যার আভা অত্যন্ত মুমূর্ষু হাসির মতো খানিকক্ষণের জন্যে লেগে ছিল। যেমন প্রকাণ্ড মাঠ তেমনি প্রকাণ্ড নিস্তব্ধতা; কেবল একরকম পাখি আছে, তারা মাটিতে বাসা করে থাকে, সেই পাখি যত অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল তত আমাকে তার নিরালা বাসার কাছে ক্রমিক আনাগোনা করতে দেখে ব্যাকুল সন্দেহের স্বরে টী-টী করে ডাকতে লাগল। ক্রমে এখানকার কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলো ঈষৎ ফুটে উঠল।
পৃথিবী
কালীগ্রাম, জানুয়ারি ১৮৯১। ঐ-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে, ওটাকে এমন ভালোবাসি! ওর এই গাছপালা, নদী মাঠ, কোলাহল নিস্তব্ধতা, প্রভাত সন্ধ্যা, সমস্তটা-সুদ্ধ দু হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি, এমন কি কোনো স্বর্গ থেকে পেতুম। স্বর্গ আর কী দিত জানি নে, কিন্তু এমন কোমলতা-দুর্বলতা-ময় এমন সকরুণ-আশঙ্কা-ভরা অপরিণত এই মানুষগুলির মতো এমন আপনার ধন কোথা থেকে দিত। আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনাদের পৃথিবী এর সোনার শ্যক্ষেত্রে, এর স্নেহশালিনী নদীগুলির ধারে, এর সুখদুঃখময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে, এই সমস্ত দরিদ্র মর্ত্যহৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে। আমরা হতভাগ্যরা তাদের রাখতে পারি নে, বাঁচাতে পারি নে, নানা অদৃশ্য প্রবল শক্তি এসে বুকের কাছ থেকে তাদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়, কিন্তু বেচারা পৃথিবীর যতদূর সাধ্য সে করেছে। আমি এই পৃথিবীকে ভারি ভালোবাসি। এর মুখে ভারি একটি সুদরব্যাপী বিষাদ লেগে আছে; যেন এর মনে মনে আছে, “আমি দেবতার মেয়ে, কিন্তু দেবতার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ভালোবাসি, কিন্তু বক্ষা করতে পারি নে; আরম্ভ করি, সম্পূর্ণ করতে পারি নে; জন্ম দিই, মৃত্যুব হাত থেকে বাঁচাতে পারি নে।” এইজন্যে স্বর্গের উপব আড়ি ক’রে আমি আমার দরিদ্র মায়ের ঘর আরো বেশি ভালোবাসি; এত অসহায়, অসমর্থ, অসম্পূর্ণ, ভালোবাসার সহস্র আশঙ্কায় সর্বদা চিত্তাকাতর ব’লেই।
শীতের সকাল
শিলাইদহ, ফেব্রুয়ারি ১৮৯১। কাছারির পরপারের নির্জন চরে বোট লাগিয়ে বেশ আরাম বোধ হচ্ছে। দিনটা এবং চারিদিকটা এমনি সুন্দর ঠেকছে, সে আর কী বলব। অনেক দিন পরে আবার এই বড়ো পৃথিবীটার সঙ্গে যেন দেখাসাক্ষাৎ হল। সেও বললে ‘এই যে’। আমিও বললুন ‘এই যে’। তার পরে দুজনে পাশাপাশি বসে আছি, আর কোনো কথাবার্তা নেই। জল ছলছল করছে, এবং তার উপরে রোদ্দুর চিক্চিক্ করছে, বালির চর ধুধু করছে, তার উপর ছোটো ছোটো বনঝাউ উঠেছে। জলের শব্দ, দুপুর-বেলাকার নিস্তব্ধতার ঝাঁঝাঁ, এবং ঝাউঝোপ থেকে দুটো-একটা পাখির চিক্চিক্ শব্দ, সবসুদ্ধ মিলে খুব একটা স্বপ্নাবিষ্ট ভাব। খুব লিখে যেতে ইচ্ছে করছে— কিন্তু আর-কিছু নিয়ে নয়, এই জলের শব্দ, এই রোদ্দুরের দিন, এই বালির চর। মনে হচ্ছে, রোজই ঘুরে ফিরে এই কথাই লিখতে হবে। কেননা আমার এই একই নেশা, আমি বার বার এই এক কথা নিয়েই বকি। বড়ো বড়ো নদী কাটিয়ে আমাদের বোটটা একটা ছোটো নদীর মুখে প্রবেশ করছে। দুই ধারে মেয়েরা স্নান করছে, কাপড় কাচছে এবং ভিজে কাপড়ে একমাথা ঘোমটা টেনে জলের কলসি নিয়ে ডান হাত দুলিয়ে ঘরে চলেছে; ছেলেরা কাদা মেখে, জল ছুঁড়ে মাতামাতি করছে; এবং একটা ছেলে বিনা সুরে গান গাচ্ছে— ‘একবার দাদা ব’লে ডাক রে লক্ষ্মণ’। উঁচু পাড়ের উপর দিয়ে অদূরবর্তী গ্রামের খড়ের চাল এবং বাঁশবনের ডগা দেখা যাচ্ছে। ছোটো নদীতে বড়ো বেশি নৌকো নেই; দুটো-একটা ছোটো ডিঙি শুকনো গাছের ডাল এবং কাটকুটো বোঝাই নিয়ে শ্রান্তভাবে ছপ্ছপ্ দাঁড় ফেলে চলেছে; ডাঙায় বাঁশের উপর জেলেদের জাল শুকোচ্ছে— পৃথিবীর সকালবেলার কাজকর্ম খানিকক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে আছে।
গ্রামের মেয়ে
শাজাদপুর, ৪ জুলাই ১৮৯১। আমাদের ঘাটে একটি নৌকো লেগে আছে, এবং এখানকার অনেকগুলি ‘জনপদবধূ’ তার সম্মুখে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। বোধ হয় একজন কে কোথায় যাচ্ছে এবং তাকে বিদায় দিতে সবাই এসেছে। অনেকগুলি কচি ছেলে অনেকগুলি ঘোমটা এবং অনেকগুলি পাকা চুল একত্র হয়েছে। কিন্তু, ওদের মধ্যে একটি মেয়ে আছে, তার প্রতিই আমার মনোযোগটা সর্বাপেক্ষা আকৃষ্ট হচ্ছে। বোধ হয় বয়সে বারো-তেরো হবে, কিন্তু একটু হৃষ্ট-পুষ্ট হওয়াতে চোদ্দো-পনেরো দেখাচ্ছে। বেশ কালো অথচ বেশ দেখতে। ছেলেদের মতো চুল ছাঁটা, তাতে মুখটি বেশ দেখাচ্ছে। এমন বুদ্ধিমান এবং সপ্রতিভ এবং পরিষ্কার সরল ভাব। একটা ছেলে কোলে ক’রে এমন নিঃসংকোচ কৌতূহলের সঙ্গে আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। তার মুখখানিতে কিছু যেন নির্বুদ্ধিতা কিম্বা অসরলতা কিম্বা অসম্পূর্ণতা নেই। বিশেষত আধা-ছেলে আধা-মেয়ের মতো হয়ে আরো একটু বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে। ছেলেদের মতো আত্মসম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন ভাব এবং তার সঙ্গে মাধুরী মিশে ভারি নতুনরকমের একটি মেয়ে তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে যে এরকম ছাঁদের ‘জনপদবধূ’ দেখা যাবে এমন প্রত্যাশা করি নি। অবশেষে যখন যাত্রার সময় হল তখন দেখলুম, আমার সেই চুল-ছাঁটা, গোলগাল হাতে-বালা-পরা, উজ্জ্বল-সরল-মুখশ্রী মেয়েটিকে নৌকোয় তুললে। বুঝলুম, বেচারা বোধ হয় বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর ঘরে যাচ্ছে; নৌকো যখন ছেড়ে দিলে মেয়েরা ডাঙায় দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল, দুই-একজন আঁচল দিয়ে ধীরে ধীরে নাক-চোখ মুছতে লাগল। একটি ছোটো মেয়ে, খুব এঁটে চুল বাঁধা, একটি বর্ষীয়সীর কোলে চ’ড়ে তার গলা জড়িয়ে তার কাঁধের উপর মাথাটি রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। যে গেল সে বোধ হয় এই বেচারির দিদিমণি। এর পুতুলখেলায় বোধ হয় মাঝে-মাঝে যোগ দিত, বোধ হয় দুষ্টমি করলে মাঝে-মাঝে সে একে ঢিপিয়ে দিত। সকালবেলাকার রৌদ্র এবং নদীতীর এবং সমস্ত এমন গভীর বিষাদে পূর্ণ বোধ হতে লাগল। সকালবেলাকার একটা অত্যন্ত হতাশ্বাস করুণ রাগিণীর মতো। মনে হল, সমস্ত পৃথিবীটা এমন সুন্দর অথচ এমন বেদনায় পরিপূর্ণ। এই অজ্ঞাত ছোটো মেয়েটির ইতিহাস আমার যেন অনেকটা পরিচিত হয়ে গেল। বিদায়কালে এই নৌকো ক’রে নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়ার মধ্যে যেন আরো একটু বেশি করুণা আছে। অনেকটা যেন মৃত্যুর মতো—তীর থেকে প্রবাহে ভেসে যাওয়া; যারা দাঁড়িয়ে থাকে তারা আবার চোখ মুছে ফিরে যায়, যে ভেসে গেল সে অদৃশ্য হয়ে গেল। জানি, এই গভীর বেদনাটুকু যারা রইল এবং যে গেল উভয়েই ভুলে যাবে, হয়তো এতক্ষণে অনেকটা লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। বেদনাটুকু ক্ষণিক এবং বিস্মৃতিই চিরস্থায়ী, কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে, এই বেদনাটুকুই বাস্তবিক সত্যি, বিস্মৃতি সত্য নয়। এক-একটা বিচ্ছেদ এবং এক-একটা মৃত্যুর সময় মানুষ সহসা জানতে পারে, এই ব্যথাটা কী ভয়ংকর সত্য। জানতে পারে যে, মানুষ কেবল ভ্রমক্রমেই নিশ্চিন্ত থাকে। কেউ থাকে না— এবং সেইটে মনে করলে মানুষ আরো ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কেবল যে থাকব না তা নয়, কারো মনেও থাকব না।
পোস্ট্মাস্টার
শাজাদপুর, ২৯ জুন ১৮৯২। কালকে চিঠিতে লিখেছিলুম আজ অপরাহ্ণ সাতটার সময় কবি কালিদাসের সঙ্গে একটা এন্গেজমেণ্ট করা যাবে। বাতিটি জ্বালিয়ে টেবিলের কাছে কেদারাটি টেনে, বইখানি হাতে, যখন বেশ প্রস্তুত হয়ে বসেছি হেনকালে কবি কালিদাসের পরিবর্তে এখানকার পোস্ট্মাস্টার এসে উপস্থিত। মৃত কবির চেয়ে একজন জীবিত পোস্ট্মাস্টারের দাবি ঢের বেশি। আমি তাঁকে বলতে পারলুম না, ‘আপনি এখন যান, কালিদাসের সঙ্গে আমার একটু বিশেষ প্রয়োজন আছে।’— বললেও সে লোকটি ভালো বুঝতে পারতেন না। অতএব পোস্ট্মাস্টারকে চৌকিটি ছেড়ে দিয়ে কালিদাসকে আস্তে আস্তে বিদায় নিতে হল। এই লোকটির সঙ্গে আমার একটু বিশেষ যোগ আছে। যখন আমাদের এই কুঠিবাড়ির একতলাতেই পোস্ট্ অফিস ছিল এবং আমি এঁকে প্রতিদিন দেখতে পেতুম, তখনই আমি একদিন দুপুরবেলায় এই দোতালায় বসে সেই পোস্ট্মাস্টারের গল্পটি লিখেছিলুম এবং সে গল্পটি যখন হিতবাদীতে বেরোল তখন আমাদের পোস্ট্মাস্টারবাবু তার উল্লেখ করে বিস্তর লজ্জামিশ্রিত হাস্য বিস্তার করেছিলেন। যাই হোক, এই লোকটিকে আমার বেশ লাগে। বেশ নানারকম গল্প করে যান, আমি চুপ করে বসে শুনি। ওরই মধ্যে ওঁর আবার বেশ একটু হাস্যরসও আছে।
পোস্ট্মাস্টার চলে গেলে সেইরাত্রে আবার রঘুবংশ নিয়ে পড়লুম। ইন্দুমতীর স্বয়ম্বর পড়ছিলুম। সভায় সিংহাসনের উপর সারি সাবি সুসজ্জিত, সুন্দর চেহারা, রাজারা বসে গেছেন— এমন সময় শঙ্খ এবং তুরীধ্বনির মধ্যে বিবাহবেশ প’রে সুনন্দার হাত ধরে ইন্দুমতী তাঁদের মাঝখানের সভাপথে এসে দাঁড়ালেন। ছবিটি মনে করতে এমনি সুন্দর লাগে। তার পরে সুনন্দা এক-একজনের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে আর ইন্দুমতী অনুরাগহীন এক-একটি প্রণাম করে চলে যাচ্ছেন। এই প্রণাম করাটি কেমন সুন্দর। যাকে ত্যাগ করছেন তাকে যে নম্রভাবে সম্মান করে যাচ্ছেন এতে কতটা মানিয়ে যাচ্ছে। সকলেই রাজা, সকলেই তার চেয়ে বয়সে বড়ো; ইন্দুমতী একটি বালিকা, সে-যে তাঁদের একে-একে অতিক্রম করে যাচ্ছে, এই অবশ্যরূঢ়তাটুকু যদি একটি-একটি সুন্দর সবিনয় প্রণাম দিয়ে না মুছে দিয়ে যেত তাহলে এই দৃশ্যের সৌন্দর্য থাকত না।
বর্ষার নদী
শিলাইদা, ২১ জুলাই ১৮৯২। কাল বিকেলে শিলাইদহে পৌঁছেছিলুম, আজ সকালে আবার পাবনায় চলেছি। নদীর যে রোখ। যেন লেজ-দোলানো কেশর-ফোলানো তাজা বুনো ঘোড়ার মতো। গতিগর্বে ঢেউ তুলে ফুলে ফুলে চলেছে— এই খেপা নদীর উপর চড়ে আমরা দুলতে দুলতে চলেছি। ওর মধ্যে ভারি একটা উল্লাস আছে। এই ভরা নদীর যে কলরব সে কী আর বলব। ছল্ছল্ খল্খল্ করে কিছুতে যেন আর ক্ষান্ত হতে পারছে না, ভারি একটা যৌবনের মত্ততার ভাব। এ তবু গড়ই নদী, এখান থেকে আবার পদ্মায় গিয়ে পড়তে হবে; তার বোধ হয় আর কূল-কিনারা দেখবার জো নেই; সে মেয়ে বোধ হয় একেবারে উন্মাদ হয়ে খেপে নেচে বেরিয়ে চলেছে, সে আর কিছুর মধ্যেই থাকতে চায় না। তাকে মনে করলে আমার কালীর মূর্তি মনে হয়—নৃত্য করছে, ভাঙছে, এবং চুল এলিয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে। মাঝিরা বলছিল, নূতন বর্ষায় পদ্মার খুব ‘ধার’ হয়েছে। ‘ধার’ কথাটা ঠিক; তীব্রস্রোত যেন চক্চকে খড়্গের মতো— পাতলা ইস্পাতের মতো একেবারে কেটে চলে যায়, প্রাচীন ব্রিটনদের যুদ্ধরথের চাকায় যেমন কুঠার বাঁধা, দুইধারের তীর একেবারে অবহেলে ছারখার করে দিয়ে চলেছে।
পৃথিবীর টান
শিলাইদা, ২০ আগস্ট ১৮৯২। রোজ সকালে চোখ চেয়েই আমার বাঁ দিকে জল এবং ডান দিকে নদীতীর সূর্যকিরণে প্লাবিত দেখতে পাই। এখানকার রৌদ্রে আমার মন ভারি উদাসীন হয়ে যায়। এর-যে কী মানে ঠিক ধরতে পারি নে, এর সঙ্গে-যে কী একটা আকাঙ্ক্ষা জড়িত আছে ঠিক বুঝতে পারি নে। এ যেন এই বৃহৎ ধরণীর প্রতি একটা নাড়ীর টান। এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলুম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যকিরণে আমার সুদূরবিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধি-উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত— আমি কত দূরদূরান্তর কত দেশদেশান্তরের জলস্থলপর্বত ব্যাপ্ত ক’রে উজ্জ্বল আকাশের নিচে নিস্তব্ধভাবে শুয়ে পড়ে থাকতুম, তখন শরৎ-সূর্যালোকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে-একটি আনন্দরস, একটি জীবনীশক্তি অত্যন্ত অব্যক্ত অর্ধচেতন এবং অত্যন্ত প্রকাণ্ডভাবে সঞ্চারিত হতে থাকত তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে। আমার এই-যে মনের ভাব এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূর্যসনাথা আদিম পৃথিবীর ভাব। যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে—সমস্ত শস্যক্ষেত্র রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে, এবং নারকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের আবেগে থর্থর্ করে কাঁপছে। এই পৃথিবীর উপর আমার যে একটি আন্তরিক আত্মীয়বৎসলতার ভাব আছে, ইচ্ছা করে সেটা ভালো ক’রে প্রকাশ করতে, কিন্তু ওটা বোধ হয় অনেকেই ঠিকটি বুঝতে পারবে না। কী একটা কিম্ভূত রকমের মনে করবে।
গ্রাম্য সাহিত্য
পতিসর, ১১ আগস্ট ১৮৯৩। অনেকগুলো বড়ো বড়ো বিলের মধ্যে দিয়ে আসতে হয়েছে। এই বিলগুলো ভারি অদ্ভুত— কোনো আকার আয়তন নেই, জলে স্থলে একাকার, পৃথিবী সমুদ্রগর্ভ থেকে নতুন জেগে ওঠবার সময় যেমন ছিল। কোথাও কিছু কিনারা নেই— খানিকটা জল, খানিকটা মগ্নপ্রায় ধানখেতের মাথা, খানিকটা শেওলা এবং জলজ উদ্ভিদ ভাসছে— পানকৌড়ি সাঁতার দিচ্ছে, জাল ফেলবার জন্যে বড়ো বড়ো বাঁশ পোঁতা, তারই উপর কটা রঙের বড়ো বড়ো চিল বসে আছে। দ্বীপের মতো অতিদূরে গ্রামের রেখা দেখা যাচ্ছে। যেতে যেতে হঠাৎ আবার খানিকটা নদী। দু ধারে গ্রাম, পাটের খেত এবং বাঁশের ঝাড়, আবার কখন-যে সেটা বিস্তৃত বিলের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে বোঝবার জো নেই।
ঠিক সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময় যখন একটি গ্রাম পেরিয়ে আসছিলুম, একটা লম্বা নৌকোয় অনেকগুলি ছোকরা ঝপ্ ঝপ্ ক’রে দাঁড় ফেলছিল এবং সেই তালে গান গাচ্ছিল—
যোবতি, ক্যান্ বা কর মন ভারি।
পাবনা থাক্যে আন্যে দেব ট্যাকা দামের মোটরি।
স্থানীয় কবিটি যে-ভাব অবলম্বন ক’রে সংগীত রচনা করেছেন আমরাও ও-ভাবের ঢের লিখেছি, কিন্তু ইতরবিশেষ আছে। আমাদের যুবতী মন ভারি করলে তৎক্ষণাৎ জীবনটা কিম্বা নন্দনকানন থেকে পারিজাতটা এনে দিতে প্রস্তুত হই। কিন্তু এ অঞ্চলের লোক খুব সুখে আছে বলতে হবে, অল্প ত্যাগস্বীকারেই যুবতীর মন পায়। মোটরি জিনিসটি কী তা বলা আমার সাধ্য নয়; কিন্তু তার দামটাও নাকি পার্শ্বেই উল্লেখ করা আছে; তাতেই বোঝা যাচ্ছে, খুব বেশি দুর্মূল্য নয়, এবং নিতান্ত অগম্য স্থান থেকেও আনতে হয় না। গানটা শুনে বেশ মজার লাগল—যুবতীর মন ভারি হলে জগতে যে আন্দোলন উপস্থিত হয় এই বিলের প্রান্তেও তার একটা সংবাদ পাওয়া গেল। এ গানটি কেবল অস্থানেই হাস্যজনক কিন্তু দেশকালপাত্রবিশেষে এর যথেষ্ট সৌন্দর্য আছে; আমার অজ্ঞাতনামা গ্রাম্য কবিভ্রাতার রচনাগুলিও এই গ্রামের লোকের সুখদুঃখের পক্ষে নিতান্ত আবশ্যক— আমার গানগুলি সেখানে কম হাস্যজনক নয়।
হাতি
পতিসর, ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৪। যে পারে বোট লাগিয়েছি এ পারে খুব নির্জন। গ্রাম নেই, বসতি নেই, চষা মাঠ ধূ ধূ করছে, নদীর ধারে ধারে খানিকটা ক’রে শুকনো ঘাসের মতো আছে—সেই ঘাসগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে গোটাকতক মোষ চ’রে বেড়াচ্ছে। আর আমাদের দুটো হাতি আছে, তারাও এ পারে চরতে আসে। তাদের দেখতে বেশ মজা লাগে, একটা পা উঠিয়ে ঘাসের গোড়ায় দুচার বার একটু-একটু ঠোকর মারে, তার পরে শুঁড় দিয়ে টান মারতেই বড়ো বড়ো ঘাসের চাপড়া একেবারে মাটিশুদ্ধ উঠে আসে, সেই চাপডাগুলো শুঁড়ে ক’রে দুলিয়ে দুলিয়ে ঝাড়ে, তার মাটিগুলো ঝরে ঝরে পড়ে যায়, তার পরে মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে খেয়ে ফেলে। আবার এক-এক সময় খেয়াল যায়, খানিকটা ধুলো গুঁড়ে ক’রে নিয়ে ফুঁ দিয়ে নিজের পেটে পিঠে সর্বাঙ্গে হুস করে ছড়িয়ে দেয়— এইরকম তো হাতির প্রসাধনক্রিয়া। বৃহৎ শরীর, বিপুল বল, শ্রীহীন আয়তন, অত্যন্ত নিরীহ— এই প্রকাণ্ড জন্তুটাকে দেখতে আমার বেশ লাগে। এর এই প্রকাণ্ডত্ব এবং বিশ্রীত্ব-র জন্যই যেন এর প্রতি একটা কী বিশেষ স্নেহের উদ্রেক হয়— এর সর্বাঙ্গের অসৌষ্ঠব থেকে এ-কে একটা মস্ত শিশুর মতো মনে হয়। তা ছাড়া জন্তুটা বড়ো উদার প্রকৃতির, শিব ভোলানাথের মতো, যখন খেপে তখন খুব খেপে, যখন ঠাণ্ডা হয় তখন অগাধ শান্তি। বড়োত্বর সঙ্গে সঙ্গে যে একরকম শ্রীহীনত্ব আছে তাতে অন্তরকে বিমুখ করে না, বরঞ্চ আকর্ষণ করে আনে। আমার ঘরে যে বেঠোভেনের ছবি আছে অনেক সুন্দর মুখের সঙ্গে তুলনা করলে তাকে দর্শনযোগ্য মনে না হতে পারে, কিন্তু আমি যখন তার দিকে চাই, সে আমাকে খুব টেনে নিয়ে যায়— ঐ উস্কোখুস্কো মাথাটার ভিতরে কতো বড়ো একটা শব্দহীন শব্দজগৎ। এবং কী একটা বেদনাময় অশান্ত ক্লিষ্ট প্রতিভা রুদ্ধঝড়ের মতো ঐ লোকটার ভিতর ঘূর্ণমান হত।
শুকতারা
পতিসর, ২৫ মার্চ ১৮৯৪। আজকাল ভোরের বেলায় চোখ মেলেই ঠিক আমার খোলা জানলার সামনেই শুকতারা দেখতে পাই—তাকে আমার ভারি মিষ্টি লাগে, সেও আমার দিকে চেয়ে থাকে, যেন বহুকালের আমার আপনার লোক। মনে আছে, যখন শিলাইদহে কাছারি করে সন্ধ্যাবেলায় নৌকো করে নদী পার হতুম, এবং রোজ আকাশে সন্ধ্যাতারা দেখতে পেতুম, আমার ভারি একটা সান্ত্বনা বোধ হত। ঠিক মনে হত, আমার নদীটি যেন আমার ঘরসংসার এবং আমার সন্ধ্যাতারাটি আমার এই ঘরের গৃহলক্ষ্মী— আমি কখন কাছারি থেকে ফিরে আসব এইজন্য সে উজ্জ্বল হয়ে সেজে বসে আছে। তার কাছ থেকে এমন একটি স্নেহস্পর্শ পেতুম। তখন নদীটি নিস্তব্ধ হয়ে থাকত, বাতাসটি ঠাণ্ডা, কোথাও কিছু শব্দ নেই, ভারি যেন একটা ঘনিষ্ঠতার ভাবে আমার সেই প্রশান্ত সংসারটি পরিপূর্ণ হয়ে থাকত। আমার সেই শিলাইদহে প্রতি সন্ধ্যায় নিস্তব্ধ অন্ধকারে নদী পার হওয়াটা খুব স্পষ্টরূপে প্রায়ই মনে পড়ে। ভোরের বেলায় প্রথম দৃষ্টিপাতেই শুকতারাটি দেখে, তাকে আমার একটি বহুপরিচিত সহাস্য সহচরী না মনে করে থাকতে পারি নে। সে যেন একটি চিরজাগ্রত কল্যাণকামনার মতো ঠিক আমার নিদ্রিত মুখের উপর প্রফুল্ল স্নেহ বিক্রিরণ করতে থাকে।
মেঘ ও রৌদ্র
শিলাইদা, ২৭ জুন ১৮৯৪। গল্প লেখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রের সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধ ঘরের সংকীর্ণতা দূর করবে, এবং রৌদ্রের সময় পদ্মাতীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের ’পরে বেড়িয়ে বেড়াবে। আজ সকালবেলায় তাই গিরিবালানাম্নী উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ একটি ছোটো অভিমানী মেয়েকে আমার কল্পনারাজ্যে অবতারণ করা গেছে। সবেমাত্র পাঁচটি লাইন লিখেছি এবং সে পাঁচ লাইনে কেবল এই কথা বলেছি যে, কাল বৃষ্টি হয়ে গেছে, আজ বর্ষণ অন্তে চঞ্চল মেঘ এবং চঞ্চল রৌদ্রের পরস্পর শিকার চলছে। হেনকালে পূর্বসঞ্চিত বিন্দুবিন্দু বারিশীকরবর্ষী তরুতলে গ্রামপথে উক্ত গিরিবালার আসা উচিত ছিল; তা না হয়ে আমার বোটে আমলাবর্গের সমাগম হল, তাতে করে সম্প্রতি গিরিবালাকে কিছুক্ষণের জন্যে অপেক্ষা করতে হল। তা হোক, তবু সে মনের মধ্যে আছে। আজ গিরিবালা অনাহূত এসে উপস্থিত হয়েছেন; কাল বড়ো আবশ্যকের সময় তাঁর দোদুল্যমান বেণীর সুচ্যগ্রভাগটুকুও দেখা যাবে না। কিন্তু, সে-কথা নিয়ে আজ আন্দোলনের দরকার নেই। শ্রীমতী গিরিবালার তিরোধানসম্ভাবনা থাকে তো থাক্, আজ যখন তাঁর শুভাগমন হয়েছে তখন সেটা আনন্দের বিষয় সন্দেহ নেই।
এবারকার পত্রে অবগত হওয়া গেল যে, আমার ঘরের ক্ষুদ্রতমাটি ক্ষুদ্র ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করতে শিখেছে। আমি সে চিত্র বেশ দেখতে পাচ্ছি। তার সেই নরম নরম মুঠোর আঁচড়ের জন্যে আমার মুখটা নাকটা তৃষার্ত হয়ে আছে। সে যেখানে সেখানে আমাকে মুঠো করে ধরে টল্মলে মাথাটা নিয়ে হাম্ করে খেতে আসত এবং খুদে খুদে আঙুলগুলোর মধ্যে আমার চশমার হারটা জড়িয়ে নিতান্ত নির্বোধ নিশ্চিন্ত গম্ভীরভাবে গাল ফুলিয়ে চেয়ে থাকত, সেই কথাটা মনে পড়ছে।
ইচ্ছামতী
পাবনা-পথে, ৯ জুলাই ১৮৯৫। আঁকাবাকা ইচ্ছামতী নদীর ভিতর দিয়ে চলেছি। এই ছোটো খামখেয়ালি বর্ষাকালের নদীটি, এই যে দুই ধারে সবুজ ঢালু ঘাট, দীর্ঘ ঘন কাশবন, পাটের খেত, আখের খেত, আর সারিসারি গ্রাম— এ যেন একই কবিতার কয়েকটা লাইন, আমি বার বার আবৃত্তি করে যাচ্ছি এবং বারবারই ভালো লাগছে। পদ্মার মতো বড়ো নদী এতই বড়ো যে, সে যেন ঠিক মুখস্থ করে নেওয়া যায় না, আর, এই কেবল কটি বর্ষামাসের দ্বারা অক্ষরগোনা ছোটো বাঁকা নদীটি যেন বিশেষ করে আমার হয়ে যাচ্ছে।
পদ্মানদীর কাছে মানুষের লোকালয় তুচ্ছ কিন্তু ইচ্ছামতী মানুষঘেঁষা নদী; তার শান্ত জলপ্রবাহের সঙ্গে মানুষের কর্মপ্রবাহের স্রোত মিশে যাচ্ছে। সে ছেলেদের মাছ ধরবার এবং মেয়েদের স্নান করবার নদী। স্নানের সময় মেয়েরা যে-সমস্ত গল্পগুজব নিয়ে আসে সেগুলি এই নদীটির হাস্যময় কলধ্বনির সঙ্গে এক সুরে মিলে যায়। আশ্বিন মাসে মেনকার ঘরের পার্বতী যেমন কৈলাসশিখর ছেড়ে একবার তাঁর বাপের বাড়ি দেখেশুনে যান, ইচ্ছামতী তেমনি সম্বৎসর অদর্শন থেকে বর্ষার কয়েকমাস আনন্দহাস্য করতে করতে তার আত্মীয় লোকালয়গুলির তত্ত্ব নিতে আসে। তার পরে ঘাটে ঘাটে মেয়েদের কাছে প্রত্যেক গ্রামের সমস্ত নূতন খবর শুনে নিয়ে তাদের সঙ্গে মাখামাখি সখিত্ব করে আবার চলে যায়।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আকাশ মেঘে অন্ধকার; গুরুগুরু মেঘ ডাকছে, এবং ঝোড়ো হাওয়ায় তীরের বনঝাউগুলো দুলে উঠছে। বাঁশঝাড়ের মধ্যে ঘন কালির মতো অন্ধকার এবং জলের উপর গোধূলির একটা বিবর্ণ ধূসর আলো প’ড়ে একটা অস্বাভাবিক উত্তেজনার মতো দেখতে হয়েছে।
সন্ধ্যা
নাগরনদীর ঘাট, ১৬ ডিসেম্বর ১৮৯৫। কাল অনেকদিন পরে সূর্যাস্তের পর ওপারের পাড়ের উপর বেড়াতে গিয়েছিলুম। সেখানে উঠেই হঠাৎ যেন এই প্রথম দেখলুম, আকাশের আদি-অন্ত নেই— জনহীন মাঠ দিগ্দিগন্ত ব্যাপ্ত ক’রে হা হা করছে— কোথায় দুটি ক্ষুদ্র গ্রাম, কোথায় এক প্রান্তে সংকীর্ণ একটু জলের রেখা। কেবল নীল আকাশ এবং ধূসর পৃথিবী, আর তারই মাঝখানে একটি সঙ্গীহীন গৃহহীন অসীম সন্ধ্যা, মনে হয়, যেন একটি সোনার চেলি-পরা বধূ অনন্ত প্রান্তরের মধ্যে মাথায় একটুখানি ঘোমটা টেনে একলা চলেছে; ধীরে ধীরে কত শত সহস্র গ্রাম নদী প্রান্তর পর্বত নগর বনের উপর দিয়ে যুগযুগান্তরকাল সমস্ত পৃথিবীমণ্ডলকে একাকিনী ম্লাননেত্রে, মৌনমুখে, শ্রান্তপদে প্রদক্ষিণ করে আসছে। তার বর যদি কোথাও নেই তবে তাকে এমন সোনার বিবাহবেশে কে সাজিয়ে দিলে। কোন্ অন্তহীন পশ্চিমের দিকে তার পতিগৃহ।