সংকলন/পাপের মার্জনা

পাপের মার্জনা

 আমাদের প্রার্থনা সকল সময়ে সত্য হয় না, অনেক সময়ে মুখের কথা হয়— কারণ, চারিদিকে অসত্যের দ্বারা পরিবৃত হয়ে থাকি বলে আমাদের বাণীতে সত্যের তেজ পৌঁছয় না। কিন্তু ইতিহাসের মধ্যে, জীবনের মধ্যে এমন এক-একটি দিন আসে, যখন সমস্ত মিথ্যা একমুহূর্তে দগ্ধ হয়ে গিয়ে এমনই একটি আলোক জেগে ওঠে যার সামনে সত্যকে অস্বীকার করবার উপায় থাকে না। তখনি এই কথাটি বারবার জাগ্রত হয়— বিশ্বানি দেব সবিতদুর্রিতানি পরাসুব। হে দেব, হে পিতা, বিশ্বপাপ মার্জনা করো।

 আমরা তাঁর কাছে এ প্রার্থনা করতে পারি না— আমাদের পাপ ক্ষমা করো; কারণ তিনি ক্ষমা করেন না, সহ্য করেন না। তাঁর কাছে এই প্রার্থনাই সত্য প্রার্থনা— তুমি মার্জনা করো। যেখানে যত-কিছু পাপ আছে, অকল্যাণ আছে, বারম্বার রক্তস্রোতের দ্বারা, অগ্নিবৃষ্টির দ্বারা সেখানে তিনি মার্জনা করেন। যে-প্রার্থনা ক্ষমা চায় সে দুর্বলের ভীরুর প্রার্থনা, সে প্রার্থনা তাঁর দ্বারে গিয়ে পৌঁছবে না।

 আজ এই যে যুদ্ধের আগুন জ্বলেছে, এর ভিতরে সমস্ত মানুষের প্রার্থনাই কেঁদে উঠেছে— বিশ্বানি দুরিতানি পরসুব— বিশ্বপাপ মার্জনা করো। আজ যে-রক্তস্রোত প্রবাহিত হয়েছে সে যেন ব্যর্থ না হয়, রক্তের বন্যায় যেন পুঞ্জীভূত পাপ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। যখনি পৃথিবীর পাপ স্তূপাকার হয়ে উঠে, তখনি তো তাঁর মার্জনার দিন আসে। আজ সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যে দহনযজ্ঞ হচ্ছে, তার রুদ্র আলোকে এই প্রার্থনা সত্য হোক— বিশ্বানি দুয়িতানি পরাসুব। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের মধ্যে আজ এই প্রার্থনা সত্য হয়ে উঠুক।

 আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্রে টেলিগ্রাফে যে একটু-আধটু খবর পাই, তার পশ্চাতে কী অসহ্য সব দুঃখ রয়েছে, আমরা কি তা চিন্তা করে দেখি। যে-হানাহানি হচ্ছে তার সমস্ত বেদনা কোন্‌খানে গিয়ে লাগছে। ভেবে দেখো, কত পিতামাতা তাদের একমাত্র ধনকে হারাচ্ছে, কত স্ত্রী স্বামীকে হারাচ্ছে, কত ভাই ভাইকে হারাচ্ছে। এইজন্যই তো পাপের আঘাত এত নিষ্ঠুর; কারণ যেখানে বেদনাবোধ সবচেয়ে বেশি, যেখানে প্রীতি সবচেয়ে গভীর, পাপের আঘাত সেইখানেই-যে গিয়ে বাজে। যার হৃদয় কঠিন, সে তো বেদনা অনুভব করে না। কারণ, সে যদি বেদনা পেত, তবে পাপ এমন নিদারুণ হতেই পারত না। যার হৃদয় কোমল, যার প্রেম গভীর, তাকেই সমস্ত বেদনা বইতে হবে। এইজন্য যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের রক্তপাত কঠিন নয়, রাজনৈতিকদের দুশ্চিন্তা কঠিন নয়, কিন্তু ঘরের কোণে যে-রমণী অশ্রুবিসর্জন করছে তারই আঘাত সবচেয়ে কঠিন।

 সেইজন্য এক-একসময় মন এই কথা জিজ্ঞাসা করে— যেখানে পাপ সেখানে কেন শাস্তি হয় না। সমস্ত বিশ্বে কেন পাপের বেদনা কম্পিত হয়ে ওঠে। কিন্তু, এই কথা জেনো যে, মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই— সমস্ত মানুষ-যে এক। সেইজন্য পিতার পাপ পুত্রকে বহন করতে হয়, বন্ধুর পাপের জন্য বন্ধুকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়, প্রবলের উৎপীড়ন দুর্বলকে সহ্য করতে হয়। মানুষের সমাজে একজনের পাপের ফলভোগ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়, কারণ অতীতে ভবিষ্যতে দূরে দূরান্তে হৃদয়ে হৃদয়ে মানুষ যে পরস্পরে গাঁথা হয়ে আছে।

 মানুষের এই ঐক্যবোধের মধ্যে যে-গৌরব আছে তাকে ভুললে চলবে না। এইজন্যই আমাদের সকলকে দুঃখভোগ করবার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। তা না হলে প্রায়শ্চিত্ত হয় না— সমস্ত মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত সকলকেই করতে হবে। যে-হৃদয় প্রীতিতে কোমল, দুঃখের আগুন তাকেই আগে দগ্ধ করবে। তার চক্ষে নিদ্রা থাকবে না। সে চেয়ে দেখবে, দুর্যোগের রাত্রে দূর দিগন্তে মশাল জ্বলে উঠেছে, বেদনায় মেদিনী কম্পিত করে রুদ্র আসছেন— সেই বেদনার আঘাতে তার হৃদয়ের সমস্ত নাড়ী ছিন্ন হয়ে যাবে। যার চিত্ততন্ত্রীতে আঘাত করলে সবচেয়ে বেশি বাজে, পৃথিবীর সমস্ত বেদনা তাকেই সবচেয়ে বেশি ক’রে বাজবে।

 তাই বলছি যে, সমস্ত মানুষের সুখদুঃখকে এক করে যে-একটি পরম বেদনা, পরম প্রেম আছেন, তিনি যদি শূন্য কথার-কথা মাত্র হতেন, তবে বেদনার এই গতি কখনোই এমন বেগবান হতে পারত না। ধনীদরিদ্র, জ্ঞানী-অজ্ঞানী, সকলকে নিয়ে সেই এক পরম, প্রেম চিরজাগ্রত আছেন ব’লেই এক জায়গার বেদনা সকল জায়গায় কেঁপে উঠছে। এই কথাটি আজ বিশেষভাবে অনুভব করো।

 তাই এ কথা আজ বলবার কথা নয় যে, অন্যের কর্মের ফল আমি কেন ভোগ করব। হাঁ, আমিই ভোগ করব, আমি নিজে একাকী ভোগ করব, এই কথা বলে প্রস্তুত হও। নিজের জীবনকে শুচি করো, তপস্যা করো, দুঃখকে গ্রহণ করো। তোমাকে যে নিজের পাপের সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধ করতে হবে, নিজের রক্তপাত করতে হবে, দুঃখে দগ্ধ হয়ে হয়তো মরতে হবে। কারণ, তোমার নিজের জীবনকে যদি পরিপূর্ণরূপে উৎসর্গ না কর তবে পৃথিবীর জীবনের ধারা নির্মল থাকবে কেমন করে, প্রাণবান হয়ে উঠবে কেমন করে। ওরে তপস্বী, তপস্যায় প্রবৃত্ত হতে হবে, সমস্ত জীবনকে আহুতি দিতে হবে, তবেই যদ্‌ভদ্রং তৎ— যা ভদ্র তাই আসবে। ওরে তপস্বী, দুঃসহ দুর্ভর দুঃখভারে তোমার হৃদয় একেবারে নত হয়ে যাক, তাঁর চরণে গিয়ে পৌঁছোক। নমস্তেঽস্তু। বলো, পিতা তুমি যে আছ সে-কথা এমনি আঘাতের মধ্য দিয়ে প্রচার করো। তোমার প্রেম নিষ্ঠুর; সেই নিষ্ঠুর প্রেম তোমার জাগ্রত হয়ে সব অপরাধ দলন করুক। পিতা নো বোধি—আজই তো সেই উদ্‌বোধনের দিন। আজ পৃথিবীর প্রলয়দাহের রুদ্র আলোকে, পিতা, তুমি দাঁড়িয়ে আছ। প্রলয়হাহাকারের ঊর্ধ্বে স্তূপাকার পাপকে দগ্ধ করে সেই দহনদীপ্তিতে তুমি প্রকাশ পাচ্ছ, তুমি জেগে রয়েছ। তুমি আজ ঘুমতে দেবে না; তুমি আঘাত করছ প্রত্যেকের জীবনে কঠিন আঘাত। যেখানে প্রেম আছে জাগুক, যেখানে কল্যাণের বোধ আছে জাগুক; সকলে আজ তোমার বোধে উদ্‌বোধিত হয়ে উঠুক। এই এক প্রচণ্ড আঘাতের দ্বারা তুমি সকল আঘাতকে নিরস্ত করো। সমস্ত বিশ্বের পাপ হৃদয়ে হৃদয়ে ঘরে ঘরে দেশে দেশে পুঞ্জীভূত; তুমি আজ সেই পাপ মার্জনা করো। দুঃখের দ্বারা মার্জনা করো, রক্তস্রোতের দ্বারা মার্জনা করো, অগ্নিবৃষ্টির দ্বারা মার্জনা করো।

 এই প্রার্থনা, সমস্ত মানবচিত্তের এই প্রার্থনা আজ আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে জাগ্রত হোক। বিশ্বানি দুবিতানি পরাসুব। বিশ্বপাপ মার্জনা করো। এই প্রার্থনাকে সত্য করতে হবে, শুচি হতে হবে, সমস্ত হৃদয়কে মার্জনা করতে হবে। আজ সেই তপস্যার আসনে, পূজার আসনে উপবিষ্ট হও। যে-পিতা সমস্ত মানবসন্তানের দুঃখ গ্রহণ করছেন, যাঁর বেদনার অন্ত নেই, প্রেমের অন্ত নেই, যাঁর প্রেমের বেদনা উদ্‌বেল হয়ে উঠেছে, তাঁর সম্মুখে উপবিষ্ট হয়ে সেই তাঁর প্রেমের বেদনাকে আমরা সকলে মিলে গ্রহণ করি।

 ৯ ভাদ্র, ১৩২১