মেঘদূত

 তার পাশেই আছি তবু নির্বাসন।

 বড়ো কাছে থাকার এই বিরহ, এত কাছে একজন আর-একজনকে সবটা দেখতে পায় না।

 মিলনের প্রথম দিনে বাঁশি কী বলেছিল।

 সে বলেছিল, “সেই মানুষ আমার কাছে এল যে-মানুষ আমার দূরের।”

 আর বাঁশি বলেছিল, “ধরলেও যাকে ধরা যায় না তাকে ধরেছি, পেলেও সকল পাওয়াকে যে ছাড়িয়ে যায় তাকে পাওয়া গেল।”

 তার পরে রোজ বাঁশি বাজে না কেন।

 কেননা, আধখানা কথা ভুলেছি। শুধু মনে রইল, সে কাছে; কিন্তু সে যে দূরেও তা খেয়াল রইল না।

 প্রেমের যে-আধখানায় মিলন সেইটেই দেখি, যে-আধখানায় বিরহ সে চোখে পড়ে না, তাই দূরের চিরতৃপ্তিহীন দেখাটা আর দেখা যায় না, কাছের পর্দা আড়াল করেছে।

 দুই মানুষের মাঝে যে অসীম আকাশ সেখানে সব চুপ, সেখানে কথা চলে না। সেই মস্ত চুপকে বাঁশির সুর দিয়ে ভরিয়ে দিতে হয়। অনন্ত আকাশের ফাঁক না পেলে বাঁশি বাজে না।

 সেই আমাদের মাঝের আকাশটি আঁধিতে ঢেকেছে, প্রতিদিনের কাজে কর্মে কথায় ভরে গিয়েছে, প্রতিদিনের ভয় ভাবনা কৃপণতায়।

 এক-একদিন জ্যোৎস্নারাত্রে হাওয়া দেয়; বিছানার ’পরে জেগে ব’সে বুক ব্যথিয়ে ওঠে। মনে পড়ে, এই পাশের লোকটিকে তো হারিয়েছি।

 এই বিরহ মিটবে কেমন ক’রে, আমার অনন্তের সঙ্গে তার অনন্তের বিরহ?

 দিনের শেষে কাজের থেকে ফিরে এসে যার সঙ্গে কথা বলি সে কে। সে তো সংসারের হাজার লোকের মধ্যে একজন, তাকে তো জানা হয়েছে, চেনা হয়েছে, সে তো ফুরিয়ে গেছে।

 কিন্তু, ওর মধ্যে কোথায় সেই আমার অফুরান একজন, সেই আমার একটিমাত্র? ওকে আবার নূতন ক’রে খুঁজে পাই কোন্ কূলহারা কামনার ধারে?

 ওর সঙ্গে আবার একবার কথা বলি সময়ের কোন্ ফাঁকে, বনমল্লিকার গন্ধে নিবিড় কোন্ কর্মহীন সন্ধ্যার অন্ধকারে?

 এমন সময়ে নববর্ষা ছায়া-উত্তরীয় উড়িয়ে পূর্বদিগন্তে এসে উপস্থিত। উজ্জয়িনীর করিব কথা মনে পড়ে গেল। প্রিয়ার কাছে দূত পাঠাই।

 আমার গান চলুক উড়ে, পাশে থাকার দূরদূর্গম নির্বাসন পার হয়ে যাক।

 কিন্তু, তাহলে তাকে যেতে হবে, কালের উজান পথ বেয়ে বাঁশির ব্যথায়-ভরা আমাদের প্রথম মিলনের দিনে— সেই আমাদের যে-দিনটি বিশ্বের চিরবর্ষা ও চিরবসন্তের সকল গন্ধে, সকল ক্রন্দনে জড়িয়ে রয়ে গেল, কেতকীবনের দীর্ঘনিশ্বাসে আর শালমঞ্জরীর উতলা আত্মনিবেদনে।

 নির্জন দিঘির ধারে নারিকেলবনের মর্মরমুখরিত বর্ষার আপন কথাটিকেই আমার কথা করে নিয়ে প্রিয়ার কানে পৌঁছিয়ে দিক, যেখানে সে তার এলোচুলে গ্রন্থি দিয়ে, আঁচল কোমবে বেঁধে, সংসারের কাজে ব্যস্ত।

8

 বহুদূরের অসীম আকাশ আজ বনরাজিনীলা পৃথিবীর শিয়রের কাছে নত হয়ে পড়ল। কানে-কানে বললে, “আমি তোমাই।”

 পৃথিবী বললে, “সে কেমন করে হবে। তুমি-যে অসীম, আমি যে ছোটো।”

 আকাশ বললে, “আমি তো চারদিকে আমার মেঘের সীমা টেনে দিয়েছি।”

 পৃথিবী বললে, “তোমার-যে কত জ্যোতিষ্কের সম্পদ, আমার তো আলোর সম্পদ নেই।”

 আকাশ বললে, “আজ আমি আমার চন্দ্র সূর্য তারা সব হারিয়ে ফেলে এসেছি, আজ আমার একমাত্র তুমি আছ।”

 পৃথিবী বললে, “আমার অশ্রুভরা হৃদয হাওয়ায় হাওয়ায় চঞ্চল হযে কাঁপে, তুমি-যে অবিচলিত।”

 আকাশ বললে, “আমার অশ্রুও আজ চঞ্চল হয়েছে, দেখতে কি পাওনি। আমার বক্ষ আজ শ্যামল হল তোমার ঐ শ্যামল হৃদয়টির মতো।”

 সে এই ব’লে আকাশপৃথিবীর মাঝখানকার চিরবিরহটাকে চোখের জলের গান দিয়ে ভরিয়ে দিলে।

 সেই আকাশপৃথিবীর বিবাহ-মন্ত্রগুঞ্জন নিয়ে নববর্ষা নামুক আমাদের বিচ্ছেদের ’পরে। প্রিয়ার মধ্যে যা অনির্বচনীয় তাই হঠাৎ-বেজে-ওঠা বীণার তারের মতো চকিত হয়ে উঠুক। সে আপন সিঁথির ’পরে তুলে দিক দূর বনান্তের রঙটির মতো রঙিন তার নীলাঞ্চল। তার কালো চোখের চাহনিতে মেঘমল্লারের সব মিড়গুলি আর্ত হয়ে উঠুক। সার্থক হোক বকুলমালা তার বেণীর বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে উঠে।

 যখন ঝিল্লির ঝংকারে বেণুবনের অন্ধকার থর্‌থর্ করছে, যখন বাদলহাওয়ায় দীপশিখা কেঁপে কেঁপে নিবে গেল, তখন সে তার অতিকাছের ঐ সংসারটাকে ছেড়ে দিয়ে আসুক ভিজে ঘাসের গন্ধে ভরা বনপথ দিয়ে আমার নিভৃত হৃদয়ের নিশীথরাত্রে।

 জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৬