সচিত্র রেল অবতার/রুইমাছের মাথা
রেলস্টেশনে অনেক লোকের আড্ডা। রেলের কি মোহিনী মায়া আছে জানি না, তবে ষ্টেশন-মাষ্টার একটু ভদ্র ও সামাজিক হইলে, অনেক ভদ্রলোকই ষ্টেশনে আপনাদের অবসর কাটাইতে ভালবাসেন। মফঃস্বলের জেলা ও মহকুমার উকীল, মোক্তার, ডাক্তার প্রভৃতি ব্যবহারিকের দল, সন্ধ্যার সময় স্টেশনের দিকে হাওয়া খাইতে আসেন—পান তামাক খান্—গল্প গুজব করেন—আর কখনও বা তাস পাশা পিটিয়া একটু রাত্রি হইলে বাড়ী ফিরিয়া যান। ইহাতে ষ্টেশন-মাষ্টারের লাভ এই যে, সারাদিন খাটনির পর আর তাঁহাকে পরের বাড়ী বাড়ী মেলামেশা করিতে যাইতে হয় না; একই জায়গায় বসিয়া সকলের সহবাস সুখ লাভ করিতে পারেন।
উকীল রমেশ বাবুর বাসা ষ্টেশনের খুব কাছেই। তিনি ষ্টেশনের একজন প্রধান আড্ডাধারী। আজ তাঁর বাসায় সান্ধ্য-ভোজন হইবে। সন্ধ্যা ৫টার গাড়ীতে একটি বৃহৎ রোহিত মৎস্য আসিবার কথা; তিনি তাহারই আগমন প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। বলা বাহুল্য, এ নিমন্ত্রণে কেবল রেলের বাবুরাই আহুত হইয়াছিলেন।
৫টার গাড়ী আসিলে কয়েক ঝুড়ি মাছ ও অন্যান্য দ্রব্যাদি নামিল। উকীল বাবুর মাছ আসিল না। তিনি বিব্রত হইয়া পড়িলেন। ষ্টেশন-মাষ্টারকে বলিলেন “মাষ্টার, এ ট্রেণে আমার মাছ না আসার কারণ ত আমি কিছুই বুঝ্তে পারছি না। নগেন বাবু চিঠি দিয়েছিলেন—এ ট্রেণে মাছ নিশ্চয়ই আস্বে। সেই ভরসাতেই আমি আপনাদি’কে নিমন্ত্রণ করেছি। এখন মাছ না এলে আমি যে কি কর্ব্ব, তা বুঝে উঠ্তে পারছি না।”
ষ্টেশন-মাষ্টার বলিলেন—“মাছটা না আসা একটু ভাবনার কথা বটে—তবে আমার বোধ হয়, ট্রেণ ছাড়বার পূর্ব্বে মাছটা ষ্টেশনে এনে পৌঁছে দিতে পারে নাই; তাই এ গাড়ীতে এল না। ৭টা ৫ মিনিটের ট্রেণে নিশ্চয়ই এসে পৌঁছুবে। এ ট্রেণে এলে একটু সুবিধা হতো বটে—না হয়, আহারাদি একটু রাত্রিতেই হবে।”
একটু চিন্তিত হ’য়ে উকীল বাবু বলিলেন—“না মশায়, রাত্রি অনেক হ’য়ে যাবে। মাছটা এলে তবে রান্না আরম্ভ হবে। মাংসের ব্যবস্থা হয় নাই—মাছ দিয়েই সব হবে। কাজেই খাওয়া দাওয়া একটার কম হবে না। আর যদি মাছ নাই আসে—সেই ভাবনাই আমি আরও ভাব্ছি। সকালবেলা হলে, আপনাকে বল্লে, অন্ততঃ ছোট মাছও দু চারটে পেতে পারতুম। এখন যে তারও জো নাই।”
ষ্টেশন মাষ্টার। হাঁ, সকালবেলা হ’লে ত কথাই ছিল না। আমরা মেছোদের কাছ থেকে ঝুড়ি পেছু যে একটা করে মাছ পেয়ে থাকি, তাই আদায় করে আপনাকে দিলে, আপনার কাজ বেশ চলে যেত—একটাও পয়সা খরচ হ’ত না।
এ্যাঁ, এই রুই মাছটার মাথা গেল কোথা? তা, আপনি যে খাওয়াবেন সে কথাওত আমাকে কিছু বলেন নি। আমার কি দোষ বলুন?
রমেশ বাবু। আপনাকে কি দোষ দিচ্ছি? তা—নয়। তবে কি জানেন—আপনার কাছ থেকে বিনি পয়সায় মাছ নিয়ে আপনাদি’কে খাওয়ান কেমন কেমন দেখায়, তাই আপনাকে অনুরোধ করি নাই। আপনি ত প্রায়ই মাছ আমার বাসায় পাঠিয়ে দেন, আমি কি তা কখনও ফিরিয়ে দিয়েছি? আপনারা আছেন বলেই ত শাকটা, পানটা, মাছটা এক-রকম না কিনেই আমার চলে যায়। এবারকার কথা হচ্ছে স্বতন্ত্র!
ষ্টেশন-মাষ্টার। যাক্—ভেবে চিন্তে আর কি হবে বলুন। আমাদের বরাতে থাকলে মাছ নিশ্চয়ই এসে পড়্বে।
উকীলবাবু একটু আশ্বস্ত হইলেন বটে, কিন্তু ভাবনাটা একেবারে গেলনা। তিনি পান ও তামাক মুহুর্মুহু চালাইতে লাগিলেন।
৭ টা ৫ মিনিটের ট্রেণ আধ ঘণ্টা দেরীতে আসিল। ট্রেণের বিলম্ব দেখিয়া, উকীলবাবু ছট্ফট করিতেছিলেন। গাড়ী আসিলে, মাছ আসিয়াছে কি না দেখিবার জন্য, গার্ডের গাড়ীর দিকে গেলেন। সেই ট্রেণ হইতে একটী বড় রকমের রুইমাছ নামিয়াছিল, কিন্তু তাহার মাথা ছিলনা। লেবেল মিলাইয়া দেখা গেল—সেইটাই উকীল বাবুর।
উকীলবাবু বিস্ময়ের সহিত বলিলেন—“একি, মাছটার মাথা গেল কোথা?”
মাষ্টারমহাশয় বলিলেন—“তাইত! গার্ডকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখি।”
গার্ড বলিল, সে যেরূপ পাইয়াছে সেইরূপই আনিয়াছে। ষ্টেশন-মাষ্টারের সন্দেহ থাকিলে, তিনি Received without head—“মস্তকহীন মৎস্য” বলিয়া মন্তব্য প্রকাশ করিয়া লিখিয়া দিতে পারেন।
স্টেশন-মাষ্টার অগত্যা তাহাই করিলেন।
মাছের বিশেষ দরকার ছিল বলিয়াই, উকীলবাবু মাছটা ডেলিভারী লইতে আপত্তি করিলেন না। কিন্তু মাষ্টারকে বলিলেন—“দেখুন, মাছটার মাথা কেটে সেখান থেকে যে পাঠিয়ে দিয়েছে, এ আমার কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। মাছটা এখনও বেশ টাট্কা আছে—তার মাথাশুদ্ধ পাঠিয়ে দিলে কখনই খারাপ হয়ে যেত না। এ নিশ্চয়ই আপনাদের রেল বাবুদের কাজ। মুড়োটা খাবে বলে, চালাকী করে, ৫টার ট্রেণে না পাঠিয়ে, এই সন্ধ্যা ৭টার গাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমিও উকীল—সহজে ছাড়্ছিনে। যিনি খেয়েছেন—তাঁর বদহজম করিয়ে ছাড়বই ছাড়ব। আপনি এক কাজ করুন। মাছটা আস্ত বুক হয়েছিল কি না, আর এমনটি সেখান থেকে পাঠিয়েছিল কি না—তারে তার খবরটা নেন্। পাকাপাকি জেনে দরখাস্তটা করলে, তবে রেলের লোকের শিক্ষা হবে।”
মাষ্টারমশায় আর কি বলিবেন?—তিনি তখনই তার পাঠাইলেন; রাত্রি দশটার মধ্যেই খবর আসিল “(Fish Correctly sent Complete) অর্থাৎ গােটা মাছই পাঠান হইয়াছে।”
আহারাদির সময়—রেলে যে এমন দিনে-ডাকাতি হতে পারে—এই নিয়ে, গরম হয়ে, উকীল বাবু অনেক কথা শুনাইয়া দিতে ছাড়িলেন না। মাছটার মাথা ছিল না বলিয়া, মুড়িঘণ্ট ইত্যাদি খাবার জুত্ হইল না। অনেক গুলাে অপ্রিয় কথাও মাষ্টার মহাশয় ও আর আর রেলবাবুদিগকে শুনিতে হইল। মােটকথা, খাওয়াটা কাহারও সুখের হইল না।
* * *
একদিন পরে উকীল বাবু রেল কর্তৃপক্ষকে এই নিয়া একটা দরখাস্ত করিলেন। এমন দিনে-ডাকাতি যে ইংরাজ চালিত রেলে সম্ভব হইয়াছে—ইহা বলিয়া মহা আক্ষেপ করিতেও ছাড়িলেন না। দরখাস্তটিতে, রােহিত মৎস্যের মাথাটাই যে ফস্-ফোরাসে ভরা ও বিশেষ মূল্যবান, তাহাও লিখিয়া দেওয়া হইল।
কিছুদিন পরে রেলের ইন্সপেক্টার সাহেব তদন্তে আসিলেন। মাছটার সংক্রান্তে কাগজপত্র সব আসিল। উকীল বাবু, আপনার বক্তব্য উকীলি বুদ্ধিতে ও উকীলি ভাষায় বলিলেন।
অনেক কথাই হইল। শেষে ইনসপেক্টার বলিলেন—“দেখুন উকীল বাবু, আপনার মাছটার মাথা খােওয়া গেছে বলে যে বিশেষ দুঃখিত হয়েছি তার কোন সন্দেহ নাই। তবে তর্কের খাতিরে বল্তে হয় যে, রেল কোম্পানী আপনাকে ক্ষতি পূরণ দিতে বাধ্য নয়। মাছটা—মাছ বলেই বুক্ হয়েছিল। তার মুড়ো ছিল কিন্তু ল্যাজ ছিল না—কিম্বা, ল্যাজ ছিল কিন্তু মুড়াে ছিল না—এটা বিশদভাবে বুঝতে পারা যায় না। আপনি একটা মাছ পাবেন বইত নয়?—তা’তো পেয়েছেনই।”
উকীলবাবু কথাটা শুনিয়া, অবাক্ হইয়া ইনস্পেক্টার সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। ইনস্পেক্টার সাহেবের বুদ্ধি—উকীল বাবুর অপেক্ষাও সেরা।
* * *
দুই তিন দিন পরে D.T.S. আফিস হইতে চিঠি আসিল। উকীল বাবু,ফলটা কি হ’য়েছে দেখিবার জন্য উদগ্রীব হইয়া চিঠিটা খুলিয়া ফেলিলেন। দেখলেন—ইন্সপেক্টার সাহেবের পরিপক্ক বুদ্ধিটাই চিঠিতে স্থান পাইয়াছে। বড়সাহেব ক্ষতিপূরণ দিতে স্বীকার হন নাই—তবে এ গােলমালটা হবার জন্য ভারী হা হুতাশ করিয়াছেন মাত্র। আর লিখিয়াছেন “ভবিষ্যতে যা’তে এরূপ গােলমাল না হয়, তার জন্য তিনি ইনস্পেক্টার সাহেবের পরামর্শমত, রেলকর্ম্মচারীদিগকে আদেশ দিয়াছেন যে, অতঃপর যে কোন মাছ ঝুড়ির ভিতর না দিয়া আলাহিদা ভাবে বুক হইবে, তাহা সম্পূর্ণ গােটা কি না, চালানে ভাল করিয়া লিখিয়া দিতে হইবে।
এখন এইভাবেই কাজ চলিয়া আসিতেছে—যথা “One fish complete-একটী সম্পূর্ণ মৎস্য!”