সটীক মেঘনাদবধ কাব্য/অষ্টম সর্গ
অষ্টম সর্গ
রাজকাজ সাধি যথা, বিরাম-মন্দিরে,
প্রবেশি, রাজেন্দ্র খুলি রাখেন যতনে
কিরীট; রাখিলা খুলি অস্তাচল—চূড়ে
দিনান্তে শিরের রত্ন তমোহা মিহিরে
দিনদেব। তারাদলে আইলা রজনী;
আইলা রজনীকান্ত শান্ত সুধানিধি।
শত শত অগ্নিরাশি জ্বলিল চৌদিকে
রণক্ষেত্রে। ভূপতিত যথায় সুরথী
সৌমিত্রি, বৈদেহীনাথ ভূপতিত তথা
নীরবে। নয়নজল, অবিরল বহি,
ভ্রাতৃলোহ সহ মিশি, তিতিছে মহীরে,
গিরিদেহে বহি যথা, মিশ্রিত গৈরিকে,
পড়ে তলে প্রস্রবণ। শূন্যমনাঃ খেদে
রঘুসৈন্য,—বিভীষণ বিভষণ রণে,
কুমুদ, অঙ্গদ, হনূ, নল, নীল, বলী,
শরভ, সুমালী, বীরকেশরী সুবাহু,
সুগ্রীব, বিষণ্ণ সবে প্রভুর বিষাদে।
চেতন পাইয়া নাথ কহিলা কাতরে;—
“রাজ্য ত্যজি, বনবাসে নিবাসিনু যবে,
লক্ষ্মণ, কুটীর—দ্বারে, আইলে যামিনী,
ধনু-করে হে সুধম্বি! জাগিতে সতত
রক্ষিতে আমায় তুমি; আজি রক্ষঃপুরে—
আজি এই রক্ষঃপুরে অরি মাঝে আমি,
বিপদ-সলিলে মগ্ন, তবুও ভুলিয়া
আমায়, হে মহাবাহো! লভিছ ভূতলে
বিরাম? রাখিবে আজি কে, কহ আমারে?
উঠ, বলি! করে তুমি বিরত পালিতে
ভ্রাতৃ-আজ্ঞা? তবে যদি মম ভাগ্যদোষে—
চিরভাগ্যহীন আমি— ত্যজিলা আমারে,
প্রাণাধিক, কহ শুনি, কোন্ অপরাধে
অপরাধী তব কাছে অভাগী-জানকী?
দেবর-লক্ষ্মণে স্মরি রক্ষঃকারাগারে
কাঁদিছে সে দিবানিশি। কেমনে ভুলিলে—
হে ভাই, কেমনে তুমি ভুলিলে হে আজি,
মাতৃসম নিত্য যারে সেবিতে আদরে?
হে রাঘবকুল-চূড়া! তব কুলবধূ,
রাখে বাঁধি পৌলস্ত্যেয়? না শান্তি সংগ্রামে
হেন দুষ্টমতি চোরে, উচিত কি তব
এ শয়ন—বীরবীর্য্যে সর্ব্বভুক্সম
দুর্ব্বার সংগ্রামে তুমি? উঠ ভীমবাহু,
রঘুকুলজয়কেতু! অসহায় আমি
তোমা বিনা, যথা রথী শূন্যচক্র রথে।
তোমার শয়নে হনূ বলহীন, বলি!
গুণহীন ধনু যথা; বিলাপে বিষাদে
অঙ্গদ; বিষণ্ণ মিতা সুগ্রীব সুমতি,
অধীর কর্ব্বুরোত্তম বিভীষণ রথী,
ব্যাকুল এ বলিদল। উঠ ত্বরা করি,
জুড়াও নয়ন, ভাই, নয়ন উন্মীলি!
“কিন্তু ক্লান্ত যদি তুমি এ দুরন্ত রণে,
ধনুর্দ্ধর! চল ফিরি যাই বনবাসে।
নাহি কাজ, প্রিয়তম, সীতায় উদ্ধারি,
অভাগিনী। নাহি কাজ বিনাশি রাক্ষসে
তনয়-বৎসলা যথা সুমিত্রা-জননী
কাঁদেন সরযূতীরে, কেমনে দেখাব
এ মুখ, লক্ষ্মণ! আমি, তুমি না ফিরিলে
সঙ্গে মোর? কি কহিব, সুধিবেন যবে
মাতা,—‘কোথা, রামভদ্র, নয়নের মণি
আমার, অনুজ তোর? কি ব’লে বুঝাব
ঊর্ম্মিলা বধূরে আমি, পুরবাসী জনে?
উঠ, বৎস! আজি কেন বিমুখ হে তুমি
সে ভ্রাতার অনুরোধে, যার প্রেমবশে,
রাজ্যভোগ ত্যজি তুমি পশিলা কাননে?
সমদুঃখে সদা তুমি কাঁদিতে হেরিলে
অশ্রুময় এ নয়ন; মুছিতে যতনে
অশ্রুধারা; তিতি এবে নয়নের জলে
আমি, তবু নাহি তুমি চাহ মোর পানে,
প্রাণাধিক? হে লক্ষ্মণ! এ আচার কভু
(সুভ্রাতৃবৎসল তুমি বিদিত জগতে!)
সাজে কি তোমারে, ভাই? চিরানন্দ তুমি
আমার। আজন্ম আমি ধর্ম্মে লক্ষ্য করি,
পূজিনু দেবতাকুলে,—দিলা কি দেবতা
এই ফল? হে রজনি! দয়াময়ী তুমি;
শিশির-আসারে নিত্য সরস কুসুমে,
নিদাঘার্ত্ত; প্রাণদান দেহ এ প্রসূনে!
সুধানিধি তুমি, দেব সুধাংশু! বিতর
জীবনদায়িনী সুধা, বাঁচাও লক্ষ্মণে—
বাঁচাও, করুণাময়! ভিখারী রাঘবে।”
এইরূপে বিলাপিলা রক্ষঃকুলরিপু
রণক্ষেত্রে, কোলে করি প্রিয়তমানুজে;
উচ্ছ্বাসিলা বীরবৃন্দ বিষাদে চৌদিকে,
মহীরুহব্যূহ যথা উচ্ছ্বাসে নিশীথে,
বহে যবে সমীরণ গহন-বিপিনে।
নিরানন্দ শৈলসুতা কৈলাস-আলয়ে
রঘুনন্দনের দুঃখে উৎসঙ্গ—প্রদেশে,
ধূর্জ্জটীর পাদপদ্মে পড়িছে সঘনে
অশ্রুবারি, শতদলে শিশির যেমতি
প্রত্যূষে! সুধিলা প্রভু;—“কি হেতু সুন্দরি!
কাতরা তুমি হে আজি, কহ তা আমারে?”
“কি না তুমি জান দেব?” উত্তরিলা দেবী
গৌরী;— “লক্ষ্মণের শোকে, স্বর্ণলঙ্কাপুরে,
আক্ষেপিছে রামচন্দ্র, শুন, সকরুণে!
অধীর হৃদয় মম রামের বিলাপে!
কে আর, হে বিশ্বনাথ! পূজিবে দাসীরে
এ বিশ্বে? বিষম লজ্জা দিলে, নাথ, আজি
আমায়; ডুবালে নাম কলঙ্ক-সলিলে।
তপোভঙ্গ-দোষে দাসী দোষী তব পদে,
তাপসেন্দ্র! তেঁই বুঝি, দণ্ডিলা এরূপে?
কুক্ষণে আইল ইন্দ্র আমার নিকটে।
কুক্ষণে মৈথিলীপতি পূজিল আমারে।”
নীরবিলা মহাদেবী কাঁদি অভিমানে।
হাসি উত্তরিলা শম্ভু,—“এ অল্প-বিষয়ে,
কেন নিরানন্দ তুমি, নগেন্দ্রনন্দিনি?
প্রের রাঘবেন্দ্র-শূরে কৃতান্তনগরে
মায়াসহ; সশরীরে, আমার প্রসাদে,
প্রবেশিবে প্রেতদেশে দাশরথি—রথী।
পিতা রাজা দশরথ দিবে তারে ক’য়ে
কি উপায়ে ভাই তার জীবন লভিবে,
আবার; এ নিরানন্দ ত্যজ চন্দ্রাননে!
দেহ এ ত্রিশূল মম মায়ায় সুন্দরি!
তমোময় যমদেশে অগ্নিস্তম্ভসম
জ্বলি উজ্জ্বলিবে দেশ; পূজিবে ইহারে
প্রেতকুল; রাজদণ্ডে প্রজাকুল যথা।”
কৈলাসসদনে দুর্গা স্মরিলা মায়ারে।
অবিলম্বে কুহকিনী আসি প্রণমিলা
অম্বিকায়; মৃদুস্বরে কহিলা পার্ব্বতী;—
“যাও তুমি লঙ্কাধামে, বিশ্ববিমোহিনি!
কাঁদিছে মৈথিলীপতি সৌমিত্রির শোকে
আকুল; সম্বোধি তারে সুমধুরভাষে,
লহ সঙ্গে প্রেতপুরে; দশরথ পিতা,
আদেশিবে কি উপায়ে লভিবে সুমতি
সৌমিত্রি জীবন পুনঃ, আর যোধ যত,
হত এ নশ্বর-রণে! ধর পদ্মকরে
ত্রিশূলীর শূল, সতি! অগ্নিস্তম্ভসম
তমোময় যমদেশে জ্বলি উজ্জ্বলিবে
অস্ত্রবর।” প্রণমিয়া উমায় চলিলা
মায়া। ছায়াপথে ছায়া পলাইলা দূরে
রূপের ছটায় যেন মলিন! হাসিল
তারাবলী—মণিকুল সৌরকরে যথা।
পশ্চাতে খমুখে রাখি আলোকের রেখা,
সিন্ধুনীরে তরী যথা, চলিলা রূপসী
লঙ্কাপানে। কতক্ষণে উতরিলা দেবী
যথায় সসৈন্যে ক্ষুণ্ণ-রঘুকুলমণি।
পূরিল কনকলঙ্কা স্বর্গীয় সৌরভে।
রাঘবের কর্ণমূলে কহিলা জননী;—
“মুছ অশ্রুবারিধারা, দাশরথি রথি!
বাঁচিবে প্রাণের ভাই; সিন্ধুতীর্থজলে
করি স্নান, শীঘ্র তুমি চল মোর সাথে
যমালয়ে; সশরীরে পশিবে, সুমতি!
তুমি প্রেতপুরে আজি শিবের প্রসাদে।
পিতা দশরথ তব দিবেন কহিয়া,
কি উপায়ে সুলক্ষণ লক্ষ্মণ লভিবে
জীবন। হে ভীমবাহো! চল শীঘ্র করি।
সৃজিব সুরঙ্গ-পথ; নির্ভয়ে সুরথি!
পশ তাহে; যাব আমি পথ দেখাইয়া
তবাগ্রে। সুগ্রীব আদি নেতৃপতি যত,
কহ সবে, রক্ষা তারা করুক লক্ষ্মণে।”
সবিস্ময়ে রাঘবেন্দ্র সাবধানি যত
নেতৃনাথে সিন্ধুতীরে, চলিলা সুমতি—
মহাতীর্থ। অবগাহি পূতস্রোতে দেহ,
মহাভাগ, তুষি দেব-পিতৃলোক আদি
তর্পণে, শিবিরদ্বারে উতরিলা ত্বরা
একাকী। উজ্জ্বল এবে দেখিলা নৃমণি
দেবতেজঃপুঞ্জে গৃহ। কৃতাঞ্জলিপুটে,
পুষ্পাঞ্জলি দিয়া রথী পূজিলা দেবীরে।
ভূষিয়া, ভীষণ তনু সুবীর-ভূষণে
বীরেশ, সুড়ঙ্গপথে পশিলা সাহসে—
কি ভয় তাহারে, দেব সুপ্রসন্ন যারে?
চলিলা রাঘবশ্রেষ্ঠ, তিমির কানন—
পথে পথী চলে যথা, যবে নিশাভাগে
সুধাংশুর অংশু পশি হাসে সে কাননে।
আগে আগে মায়াদেবী চলিলা নীরবে।
কতক্ষণে রঘুবর শুনিলা চমকি
কল্লোল, সহস্র শত সাগর উথলি
রোষে কল্লোলিছে যেন! দেখিলা সভয়ে
অদূরে ভীষণ-পুরী, চিরনিশাবৃত;
বহিছে পরিখারূপে বৈতরণী-নদী
বজ্রনাদে;—রহি রহি উথলিছে বেগে
তরঙ্গ, উথলে যথা তপ্ত-পাত্রে পয়ঃ
উচ্ছ্বাসিয়া ধূমপুঞ্জ, ত্রস্ত অগ্নিতেজে!
নাহি শোভে দিনমণি সে আকাশদেশে;
কিম্বা চন্দ্র, কিম্বা তারা; ঘন ঘনাবলী,
উগরি পাবকরাশি, ভ্রমে শূন্যপথে
বাতগর্ভ, গর্জ্জি উচ্চে, প্রলয়ে যেমতি
পিনাকী, পিনাকে ইষু বসাইয়া রোষে।
সবিস্ময়ে রঘুনাথ নদীর উপরে
হেরিলা অদ্ভুত সেতু, অগ্নিময় কভু,
কভু ঘন-ধূমাবৃত, সুন্দর কভু বা
সুবর্ণে নির্ম্মিত যেন! ধাইছে সতত
সে সেতুর পানে প্রাণী লক্ষ লক্ষ কোটি—
হাহাকার নাদে কেহ; কেহ বা উল্লাসে!
সুধিলা বৈদেহীনাথ;—“কহ কৃপাময়ি!
কেন নানা—বেশ সেতু ধরিছে সতত?
কেন বা অগণ্য প্রাণী (অগ্নিশিখা হেরি
পতঙ্গের কুল যথা) ধায় সেতু পানে?”
উত্তরিলা মায়াদেবী;— “কামরূপী সেতু,
সীতানাথ; পাপীপক্ষে অগ্নিময় তেজে,
ধূমাবৃত; কিন্তু যবে আসে পুণ্যপ্রাণী,
প্রশস্ত, সুন্দর, স্বর্গের স্বর্ণপথ যথা।
ওই যে অগণ্য আত্মা দেখিছ নৃমণি,
ত্যজি দেহ ভবধামে, আসিছে সকলে
প্রেতপুরে, কর্ম্মফল ভুঞ্জিতে এ দেশে
ধর্ম্মপথগামী যারা যায় সেতুপথে
উত্তর, পশ্চিম, পূর্ব্বদ্বারে; পাপী যারা
সাঁতারিয়া নদী পার হয় দিবানিশি
মহাক্লেশে; যমদূত পীড়য়ে পুলিনে,
জলে জ্বলে পাপ-প্রাণ, তপ্ত তৈলে যেন!
চল মোর সাথে তুমি; হেরিবে সত্বরে
নরচক্ষু কভু নাহি হেরিয়াছে যাহা!”
ধীরে ধীরে রঘুবর চলিলা পশ্চাতে,
সুবর্ণ দেউটি সম অগ্রে কুহকিনী
উজ্জ্বলি বিকট দেশ। সেতুর নিকটে
সভয়ে হেরিলা রাম বিরাট-মূরতি
যমদূত দণ্ডপাণি। গর্জ্জি বজ্রনাদে
সুধিল কৃতান্তচর,—“কে তুমি? কি বলে,
সশরীরে, হে সাহসি! পশিলা এ দেশে
আত্মময়? কহ ত্বরা, নতুবা নাশিব
দণ্ডাঘাতে মুহূর্ত্তেকে।” হাসি মায়াদেবী
শিবের ত্রিশূল মাতা দেখাইলা দূতে।
নতভাবে নমি দূত কহিলা সতীরে;—
“কি সাধ্য আমার, সাধ্বি! রোধি আমি গতি
তোমার? আপনি সেতু স্বর্ণময় দেখ
উল্লাসে, আকাশ যথা ঊষার মিলনে!”
বৈতরণী-নদী পার হইলা উভয়ে।
লৌহময় পুরীদ্বার দেখিলা সম্মুখে
রঘুপতি; চক্রাকৃতি অগ্নি রাশি রাশি
ঘোরে অবিরামগতি চৌদিক উজলি!
আগ্নেয় অক্ষরে লেখা দেখিলা নৃমণি
ভীষণ তোরণ-মুখে;—“এই পথ দিয়া
যায় পাপী দুঃখদেশে চির-দুঃখ-ভোগে;—
হে প্রবেশি, ত্যজি স্পৃহা, প্রবেশ এ দেশে।”
অস্থিচর্ম্মসার দ্বারে দেখিলা সুরথী
জ্বর-রোগ। কভু শীতে কাঁপে ক্ষীণতনু
থর-থরি; ঘোর দাহে কভু বা দহিছে,
বাড়বাগ্নিতেজ যথা জলদলপতি।
পিত্ত, শ্লেষ্মা, বায়ু, বলে কভু আক্রমিছে
অপহরি, জ্ঞান তার। সে রোগের পাশে
বিশাল-উদর বসে উদরপরতা—
অজীর্ণ ভোজনদ্রব্য উগরি দুর্ম্মতি,
পুনঃ পুনঃ দুই হস্তে তুলিয়া গিলিছে
সুখাদ্য। তাহার পাশে প্রমত্তত্ব হাসে
ঢুলু ঢুলু ঢুলু আঁখি। নাচিছে, গাইছে
কভু, বিবাদিছে কভু, কাঁদিছে কভু বা।
সদা জ্ঞানশূন্য মূঢ়, জ্ঞানহর সদা!
তার পাশে দুষ্ট কাম, বিগলিত-দেহ
শব যথা, তবু পাপী রত গো সুরতে—
দহে হিয়া অহরহঃ কামানলতাপে।
তার পাশে বসি যক্ষ্মা শোণিত উগরে,
কাশি কাশি দিবানিশি; হাঁপায় হাঁপানি—
মহাপীড়া! বিসূচিকা, গতজ্যোতিঃ আঁখি;
মুখমলদ্বারে বহে লোহের লহরী
শুভ্রজলরয়রূপে। তৃষ্ণারূপে রিপু
আক্রমিছে মুহুর্ম্মুহুঃ; অঙ্গগ্রহ নামে
ভয়ঙ্কর যমচর গ্রহিছে প্রবলে
ক্ষীণ অঙ্গ, যথা ব্যাঘ্র, নাশি জীব বনে,
রহিয়া রহিয়া পড়ি কামড়ায় তারে
কৌতুকে। অদূরে বসে সে রোগের পাশে
উন্মত্তা— উগ্র কভু, আহুতি পাইলে
উগ্র অগ্নিশিখা যথা; কভু হীনবলা!
বিবিধ ভূষণে কভু ভূষিত; কভু বা
উলঙ্গ, সমর-রঙ্গে হরপ্রিয়া যথা
কালী। কভু গায় গীত করতালি দিয়া
উন্মদা; কভু বা কাঁদে; কভু হাসিরাশি
বিকট অধরে; কভু কাটে নিজ গলা
তীক্ষ্ণ-অস্ত্রে; গিলে বিষ; ডুবে জলাশয়ে;
গলে দড়ি। কভু, ধিক্! হাব-ভাব-আদি
বিভ্রমবিলাসে বামা আহ্বানে কামীরে
কামাতুরা। মল, মূত্র, না বিচারি কিছু,
অন্নসহ মাখি, হায়, খায় অনায়াসে।
কভু বা শৃঙ্খলাবদ্ধা, কভু ধীরা যথা
স্রোতোহীন প্রবাহিণী— পবন-বিহনে!
আর আর রোগ যত কে পারে বর্ণিতে?
দেখিলা রাঘব-রথী অগ্নিবর্ণ-রথে
(বসন শোণিতে আর্দ্র, খর অসি করে,)
রণে। রথমুখে বসে ক্রোধ সূতবেশে;
নরমুণ্ডমালা গলে, নরদেহরাশি
সন্মুখে। দেখিলা হত্যা, ভীম-খড়্গপাণি;—
ঊর্দ্ধবাহু সদা, হায়, নিধনসাধনে।
বৃক্ষশাখে গলে রজ্জু দুলিছে নীরবে
আত্মহত্যা, লোলজিহ্বা উন্মীলিত আঁখি
ভয়ঙ্কর! রাঘবেন্দ্র সম্ভাষি সুভাষে
কহিলেন মায়াদেবী;—“এই যে দেখিছ
বিকট-শমনদূত যত, রঘুরথি!
নানাবেশে এ সকলে ভ্রমে ভূমণ্ডলে
অবিশ্রাম, ঘোর-বনে কিরাত যেমতি
মৃগয়ার্থে। পশ তুমি কৃতান্তনগরে,
সীতাকান্ত! দেখাইব আজি হে তোমারে
কি দশায় আত্মকুল জীবে আত্মদেশে।
দক্ষিণ দুয়ার এই; চৌরাশী নরক—
কুণ্ড আছে এই দেশে। চল ত্বরা করি।”
পশিলা কৃতান্তপুরে সীতাকান্ত বলী,
দাবদগ্ধ-বনে, মরি, ঋতুরাজ যেন
বসন্ত, অমৃত কিম্বা জীবশূন্য-দেহে।
অন্ধকারময়-পুরী, উঠিছে চৌদিকে
আর্ত্তনাদ; ভূকম্পনে কাঁপিছে সঘনে
জল, স্থল; মেঘাবলী উগরিছে রোষে
কালাগ্নি; দুর্গন্ধময় সমীর বহিছে,
লক্ষ লক্ষ শব যেন পুড়িছে শ্মশানে।
কতক্ষণে রঘুশ্রেষ্ঠ দেখিলা সম্মুখে
মহাহ্রদ; জলরূপে বহিছে কল্লোলে
কালাগ্নি। ভাসিছে তাহে কোটি কোটি প্রাণী
ছটফটি হাহাকারে! “হায় রে বিধাতঃ
নির্দ্দয়! সৃজিলি কি রে, আমা সবাকারে
এই হেতু? হা দারুণ! কেন না মরিনু
জঠর-অনলে মোরা মায়ের উদরে?
কোথা তুমি দিনমণি? তুমি, নিশাপতি
সুধাংশু? আর কি কভু জুড়াইব আঁখি
হেরি তোমাদোঁহে, দেব? কোথা সুত, দারা,
আত্মবর্গ? কোথা, হায়, অর্থ, যার হেতু
বিবিধ কুপথে রত ছিনু রে সতত—
করিনু কুকর্ম্ম, ধর্ম্মে দিয়া জলাঞ্জলি?”
এইরূপে পাপিপ্রাণ বিলাপে সে হ্রদে
মুহুর্মুহুঃ। শূন্যদেশে অমনি উত্তরে
শূন্যদেশভবা বাণী ভৈরব-নিনাদে;—
“বৃথা কেন মূঢ়মতি! নিন্দিস্ বিধিরে
তোরা? স্বকরম-ফল ভুঞ্জিস্ এ দেশে!
পাপের ছলনে ধর্ম্মে ভুলিলি কি হেতু?
সুবিধি বিধির বিধি বিদিত জগতে!”
নীরবিলে দৈববাণী, ভীষণ-মূরতি
যমদূত হানে দণ্ড মস্তক—প্রদেশে;
কাটে কৃমি; বজ্রনখা, মাংসাহারী পাখী
উড়ি পড়ি ছায়াদেহে ছিঁড়ে নাড়ীভুঁড়ি
হুহুঙ্কারে। আর্ত্তনাদে পুরে দেশ পাপী!
কহিলা বিষাদে মায়া রাঘবে সম্ভাষি
“রৌরব এ হ্রদ-নাম, শুন, রঘুমণি!
অগ্নিময়; পরধন হরে যে দুর্ম্মতি,
তার চিরবাস হেথা; বিচারী যদ্যপি
অবিচারে রত, সেও পড়ে এই হ্রদে;
আর আর প্রাণী যত, মহাপাপে পাপী।
না নিবে পাবক হেথা, সদা কীট কাটে।
নহে সাধারণ অগ্নি কহিনু তোমারে,
জ্বলে যাহে প্রেতকুল এ ঘোর-নরকে,
রঘুবর! অগ্নিরূপে বিধিরোষ হেথা
জ্বলে নিত্য। চল রথি, চল দেখাইব
কুম্ভীপাকে; তপ্ত-তৈলে যমদূতে ভাজে
পাপীবৃন্দে যে নরকে। ওই শুন, বলি!
অদূরে ক্রন্দনধ্বনি। মায়াবলে আমি
রোধিয়াছি নাসাপথ তোমার, নহিলে
নারিতে তিষ্ঠিতে হেথা, রঘুশ্রেষ্ঠ–রথি।
কিম্বা চল যাই, যথা অন্ধতমকূপে
কাঁদিছে আত্মহা পাপী হাহাকার-রবে
চিরবন্দী।” করপুটে কহিলা নৃপতি;—
“ক্ষম ক্ষেমঙ্করি, দাসে। মরিব এখনি
পরদুঃখে, আর যদি দেখি দুঃখ আমি
এইরূপ। হায়, মাতঃ! এ ভবমণ্ডলে
স্বেচ্ছায় কে গ্রহে জন্ম, এই দশা যদি
পরে? অসহায় নর; কলুষকুহকে
পারে কি গো নিবারিতে?” উত্তরিলা মায়া;—
“নাহি বিষ, মহেশ্বাস এ বিপুল-ভবে,
না দমে ঔষধে যারে। তবে যদি কেহ
অবহেলে সে ঔষধে, কে বাঁচায় তারে?
কর্ম্মক্ষেত্রে পাপসহ রণে যে সুমতি,
দেবকুল অনুকূল তার প্রতি সদা;—
অভেদ্য-কবচে ধর্ম্ম আবরেন তারে।
এ সকল দণ্ডস্থল দেখিতে যদ্যপি,
হে রথি! বিরত তুমি, চল এই পথে।”
কতদূরে সীতাকান্ত পশিলা কান্তারে—
নীরব, অসীম, দীর্ঘ; নাহি ডাকে পাখী
নাহি বহে সমীরণ সে ভীষণ বনে,
না ফোটে কুসুমাবলী—বন-সুশোভিনী।
স্থানে স্থানে পত্রপুঞ্জে ছেদি প্রবেশিছে
রশ্মি, তেজোহীন কিন্তু রোগিহাস্য যথা।
লক্ষ লক্ষ লক্ষ প্রাণী সহসা বেড়িল
সবিস্ময়ে রঘুনাথে, মধুভাণ্ডে যথা
মক্ষিকা। সুধিলা কেহ সকরুণ–স্বরে;—
“কে তুমি শরীরি? কহ, কি গুণে আইলা
এ স্থলে? দেব কি নর, কহ শীঘ্র করি?
কহ কথা; আমা সবে তোষ, গুণনিধি,
বাক্য-সুধা-বরিষণে। যে দিন হরিল
পাপপ্রাণ যমদূত, সে দিন অবধি
রসনা-জনিত ধ্বনি বঞ্চিত আমরা।
জুড়াল নয়ন হেরি অঙ্গ তব, রথি,
বরাঙ্গ, এ কর্ণদ্বয়ে জুড়াও বচনে।”
উত্তরিলা রক্ষোরিপু;—“রঘুকুলোদ্ভব
এ দাস, হে প্রেতকুল! দশরথ রথী
পিতা, পাটেশ্বরী দেবী কৌশল্যা জননী;
রামনাম ধরে দাস; হায়, বনবাসী
ভাগ্যদোষে! ত্রিশূলীর আদেশে ভেটিব
পিতায়, তেঁই গো আজি এ কৃতান্তপুরে।”
উত্তরিলা প্রেত এক; “জানি আমি তোমা
শূরেন্দ্র! তোমার শরে শরীর ত্যজিনু
পঞ্চবটী বনে আমি।” দেখিলা নৃমণি
চমকি মারীচ রক্ষে—দেহহীন এবে!
জিজ্ঞাসিলা রামচন্দ্র; “কি পাপে আইলা
এ ভীষণ-বনে, রক্ষঃ, কহ তা আমারে?”
“এ শাস্তির হেতু, হায়,পৌলস্ত্য়-দুর্ম্মতি,
রঘুরাজ।” উত্তরিলা শূন্যদেহ-প্রাণী;—
“সাধিতে তাহার কার্য্য বঞ্চিনু তোমারে,
তেঁই এ দুর্গতি মম।” আইল দূষণ–
সহ খর (খর যথা তীক্ষ্ণতর অসি
সমরে, সজীব যবে) হেরি রঘুনাথে,
রোষে, অভিমানে দোঁহে চলি গেলা দূরে,
বিষদন্ত-হীন অহি হেরিলে নকুলে
বিষাদে লুকায় যথা। সহসা পূরিল
ভৈরব-আরবে বন, পলাইল রড়ে
ভূতকুল শুষ্ক পত্র উড়ি যায় যথা,
বহিলে প্রবল ঝড়। কহিলা শূরেশে
মায়া;—“প্রেতকুল শুন রঘুমণি!
নানাকুণ্ডে করে বাস, কভু কভু আসি
ভ্রমে এ বিলাপ-বনে, বিলাপি নীরবে।
ওই দেখ যমদূত খেদাইছে রোষে
নিজ নিজ স্থানে সবে।” দেখিলা বৈদেহী—
হৃদয়কমলরবি, ভূত পালে পালে,
পশ্চাতে ভীষণ-মূর্ত্তি যমদূত; বেগে
ধাইছে নিনাদি ভূত, মৃগপাল যথা
ধায় বেগে ক্ষুধাতুর সিংহের তাড়নে
ঊর্দ্ধশ্বাস! মায়া সহ চলিলা বিষাদে,
দয়াসিন্ধু রামচন্দ্র সজল-নয়নে।
কতক্ষণে আর্ত্তনাদ শুনিলা সুরথী
শিহরি। দেখিলা দূরে লক্ষ লক্ষ নারী,
আভাহীন, দিবাভাগে শশিকলা যথা
আকাশে। কেহ বা ছিঁড়ি দীর্ঘ-কেশাবলী
কহিছে;—“চিকণি তোরে বাঁধিতাম সদা,
বাঁধিতে কামীর মন, ধর্ম্ম-কর্ম্ম ভুলি,
উন্মদা যৌবনমদে!” কেহ বিদরিছে
নখে বক্ষঃ, কহি;— “হায়, হীরা-মুক্তা-ফলে
বিফলে কাটানু দিন সাজাইয়া তোরে;
কি ফল ফলিল পরে!” কোন নারী খেদে
কুড়িছে নয়নদ্বয়, (নির্দ্দয় শকুনি
মৃতজীব-আঁখি যথা) কহিয়া, “অঞ্জনে
রঞ্জি তোরে, পাপচক্ষু, হানিতাম হাসি
চৌদিকে কটাক্ষশর; সুদর্পণে হেরি
বিভা তোর, ঘৃণিতাম কুরঙ্গনয়নে।
গরিমার পুরস্কার এই কি রে শেষে?”
চলি গেলা বামাদল কাঁদিয়া কাঁদিয়া।
পশ্চাতে কৃতান্তদূতী কুন্তল প্রদেশে
স্বনিছে ভীষণ সর্প; নথ অসিসম;
রক্তাক্ত অধর ওষ্ঠ; দুলিছে সঘনে
কদাকার স্তনযুগ ঝুলি নাভিতলে;
নাসাপথে অগ্নিশিখা জ্বলি বাহিরিছে
ধক্ধকি; নয়নাগ্নি মিশিছে তা সহ।
সম্ভাষি রাঘবে মায়া কহিলা,—“এই যে
নারীকুল, রঘুমণি! দেখিছ সম্মুখে,
বেশভূষাসক্তা সবে ছিল মহীতলে।
সাজিত সতত দুষ্টা, বসন্তে যেমতি
বনস্থলী, কামিমন মজাতে বিভ্রমে
কামাতুরা। এবে কোথা সে রূপমাধুরী,
সে যৌবনধন, হায়!” অমনি বাজিল
প্রতিধ্বনি;—“এবে কোথা সে রূপমাধুরী,
সে যৌবনধন, হায়!” কাঁদি ঘোর-রোলে,
চলি গেলা বামাকুল যে যার নরকে।
আবার কহিলা মায়া;—“পুনঃ দেখ চেয়ে
সম্মুখে, হে রক্ষোরিপু!” দেখিলা নৃমণি
আর এক বামাদল সম্মোহনরূপে।
পরিমলময় ফুলে মণ্ডিত-কবরী,
কামাগ্নির তেজোরাশি কুরঙ্গ-নয়নে,
মিষ্টতর সুধা-রসমধুর অধরে।
দেবরাজ-কম্বুসম মণ্ডিত রতনে
গ্রীবাদেশ; সূক্ষ্ম স্বর্ণসূতার কাঁচলী
আচ্ছাদন-ছলে ঢাকে কেবল দেখাতে
কুচ-রুচি, কাম-ক্ষুধা বাড়য়ে হৃদয়ে
কামীর! সুক্ষীণ কটি; নীল পট্টবাসে,
(সূক্ষ্ম অতি) গুরু ঊরু যেন ঘৃণা করি
আবরণ, রম্ভা-কান্তি দেখায় কৌতুকে,
উলঙ্গ বরাঙ্গ যথা মানসের জলে
অপ্সরীর, জল—কেলি করে তারা যবে।
বাজিছে নূপুর পায়ে, নিতম্বে মেখলা;
মৃদঙ্গের রঙ্গে, বীণা, রবাব, মন্দিরা
আনন্দে সারঙ্গ সবে মন্দে মিলাইছে।
সঙ্গীত তরঙ্গে রঙ্গে ভাসিছে অঙ্গনা।
রূপস-পুরুষদল আর এক পাশে
বাহিরিল মৃদু হাসি; সুন্দর যেমতি
কৃত্তিকাবল্লভ দেব- কার্ত্তিকেয় বলী,
কিম্বা, রতি! মনমথ-মনোরথ তব।
হেরি সে পুরুষ দলে কামমদে মাতি
কপটে কটাক্ষ-শর হানিলা রমণী,—
কঙ্কণ বাজিল হাতে শিঞ্জিনীর বোলে!
তপ্ত-শ্বাসে উড়ি রজঃ কুসুমের দামে
ধূলারূপে জ্ঞান-রবি আশু আবরিল।
হারিল পুরুষ রণে; হেন রণে কোথা
জিনিতে পুরুষদলে আছে হে শকতি?
বিহঙ্গ-বিহঙ্গী যথা প্রেম-রঙ্গে মজি
করে কেলি যথা তথা—রসিক-নাগরে
ধরি, পশে বন-মাঝে রসিকা নাগরী—
কি মানসে নয়ন তা কহিল নয়নে।
সহসা পূরিল বন হাহাকার-রবে।
বিস্ময়ে দেখিলা রাম করি জড়াজড়ি,
গড়াইছে ভূমিতলে নাগর-নাগরী
কামড়ি আঁচড়ি, মারি হস্ত-পদাঘাতে,
ছিঁড়ি চুল, কুড়ি আঁখি, নাক-মুখ চিরি
বজ্রনখে। রক্তস্রোতে তিতিলা ধরণী।
যুঝিল উভয়ে ঘোরে, যুঝিল যেমতি
কীচকের সহ ভীম নারী–বেশ ধরি
বিরাটে। উতরি তথা যমদূত যত
লৌহের মুদ্গর মারি আশু তাড়াইলা
দুই দলে। মৃদুভাষে কহিলা সুন্দরী
মায়া, রঘুকুলানন্দ রাঘবনন্দনে;—
জীবনে কামের দাস, শুন, বাছা, ছিল
পুরুষ; কামের দাসী রমণী-মণ্ডলী।
কাম-ক্ষুধা পূরাইল দোঁহে অবিরামে
বিসর্জ্জি ধর্ম্মেরে, হায়, অধর্ম্মের জলে,
বিসর্জ্জি লজ্জা;—দণ্ড এবে এই যমপুরে!
ছলে যথা মরীচিকা তৃষাতুর-জনে,
মরুভূমে: স্বর্ণকান্তি-মাখাল যেমতি
মোহে ক্ষুধাতুর প্রাণে; সেই দশা ঘটে
এ সঙ্গমে; মনোরথ বৃথা দুই দলে।
আর কি কহিব, বাছা! বুঝি দেখ তুমি।
এ দুর্ভোগ হে সুভগ! ভোগে বহু পাপী
মরুভূমে নরকাগ্রে; বিধির এ বিধি—
যৌবনে অন্যায় ব্যয় বয়সে কাঙ্গালী।
অনির্ব্বেয় কামানল পোড়ায় হৃদয়ে;
অনির্ব্বেয় বিধি-রোষ কামানল-রূপে
দহে দেহ, মহাবাহো! কহিনু তোমারে—
এ পাপি-দলের এই পুরস্কার শেষে!”
মায়ার চরণে নমি কহিলা নৃমণি;—
“কত যে অদ্ভুত-কাণ্ড দেখিনু এ পুরে,
তোমার প্রসাদে, মাতঃ! কে পারে বর্ণিতে?
কিন্তু কোথা রাজ-ঋষি? লইব মাগিয়া
কিশোর লক্ষ্মণে ভিক্ষা তাঁহার চরণে—
লহ দাসে সে সুধামে, এ মম মিনতি।”
হাসিয়া কহিলা মায়া;— “অসীম এ পুরী
রাঘব! কিঞ্চিৎ মাত্র দেখানু তোমারে।
দ্বাদশ বৎসর যদি নিরন্তর ভ্রমি
কৃতান্ত-নগরে, শূর! আমা দোঁহে, তবু
না হেরিব সর্ব্বভাগ। পূর্ব্বদ্বারে সুখে
পতিসহ করে বাস পতিপরায়ণা
সাধ্বীকুল; স্বর্গে, মর্ত্যে অতুল এ পুরী
সে ভাগে; সুরম্য হর্ম্ম সুকানন-মাঝে,
সুসরসী সুকমলে পরিপূর্ণ সদা,
বসন্ত-সমীর চির বহিছে সুস্বনে,
গাহিছে সুপিকপুঞ্জ সদা পঞ্চস্বরে।
আপনি বাজিছে বীণা, আপনি বাজিছে
মুরজ, মন্দিরা, বাঁশী, মধু সপ্তস্বরা;
দধি, দুগ্ধ, ঘৃত উৎসে উথলিছে সদা
চৌদিকে, অমৃতফল ফলিছে কাননে;
প্রদানেন পরমান্ন আপনি অন্নদা।
চর্ব্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয়, যা কিছু যে চাহে,
অমনি পায় সে তারে কামধুকে যথা
কামলতা, মহেষ্বাস, সদ্যফলবতী!
নাহি কাজ যাই তথা; উত্তর-দুয়ারে
চল, বলি! ক্ষণকাল ভ্রম সে সুদেশে।
অবিলম্বে পিতৃ-পদ হেরিবে, নৃমণি!”
উত্তরাভিমুখে দোঁহে চলিলা সত্বরে।
দেখিলা বৈদেহীনাথ গিরি শত শত
বন্ধ্য, দগ্ধ আহা, যেন দেবরোষানলে!
তুঙ্গশৃঙ্গশিরে কেহ ধরে রাশি রাশি
তুষার; কেহ বা গর্জ্জি উগরিছে মুহুঃ
অগ্নি, দ্রবি শিলাকুলে অগ্নিময় স্রোতে,
আবরি গগন ভস্মে, পূরি কোলাহলে
চৌদিক্! দেখিলা প্রভু মরুক্ষেত্র শত
অসীম, উত্তপ্ত বায়ু বহি নিরবধি
তাড়াইছে বালিবৃন্দে ঊর্ম্মিদলে যেন!
দেখিলা তড়াগ বলী সাগর-সদৃশ
অকূল; কোথায় ঝড়ে হুঙ্কারি উথলে
তরঙ্গ পর্ব্বতাকৃতি; কোথায় পচিছে
গতিহীন জলরাশি; করে কেলি তাহে
ভীষণ-মূরতি ভেক, চীৎকারি গম্ভীরে!
ভাসে মহোরগবৃন্দ, অশেষ-শরীরী
শেষ যথা; হলাহল জ্বলে কোন স্থলে;
(সাগর-মন্থনকালে সাগরে যেমতি)।
এ সকল দেশে পাপী ভ্রমে, হাহারবে
বিলাপি! দংশিছে সর্প, বৃশ্চিক কামড়ে,
ভীষণদশন কীট। আগুন ভূতলে,
শূন্যদেশে ঘোর শীত! হায় রে, কে কবে
লভয়ে বিরাম ক্ষণ এ উত্তর-দ্বারে?
দ্রুতগতি মায়াসহ চলিলা সুরথী।
নিকটয়ে তট যবে, যতনে কাণ্ডারী
দিয়া পাড়ী জলারণ্যে, আশু ভেটে তারে
কুসুমবনজনিত পরিমলসখা
সমীর; জুড়ায় কাণ শুনি বহুদিনে
পিককুল-কলরব, জনরব-সহ—
ভাসে সে কাণ্ডারী এবে আনন্দ-সলিলে।
সেইরূপে রঘুবর শুনিল অদূরে
বাদ্যধ্বনি! চারিদিকে হেরিলা সুমতি
সবিস্ময়ে স্বর্ণসৌধ, সুকাননরাজী
কনক-প্রসূন-পূর্ণ;—সুদীর্ঘ সরসী,
নবকুবলয়ধাম! কহিলা সুস্বরে
মায়া;—“এই দ্বারে, বীর! সম্মুখসংগ্রামে
পড়ি, চিরসুখ ভুঞ্জে মহারথী যত।
অশেষ, হে মহাভাগ! সম্ভোগ এ ভাগে
সুখের। কানন-পথে চল ভীমবাহো!
দেখিবে যশস্বীজনে, সঞ্জীবনী-পুরী
যা সবার যশে পূর্ণ, নিকুঞ্জ যেমতি
সৌরভে। এ পুণ্যভূমে বিধাতার হাসি
চন্দ্র-সূর্য্য-তারারূপে দীপে, অহরহঃ
উজ্জ্বলে!” কৌতুকে রথী চলিলা সত্বরে,
অগ্রে শূলহস্তে মায়া। কতক্ষণে বলী
দেখিলা সম্মুখে ক্ষেত্র—রঙ্গভূমিরূপে
কোন স্থলে শূলকুল শালবন যথা
বিশাল; কোথায় হ্রেষে তুরঙ্গমরাজী
মণ্ডিত রণভূষণে; কোথায় গরজে
গজেন্দ্র। খেলিছে চর্ম্মী অসি চর্ম্ম ধরি;
কোথায় যুঝিছে মল্ল ক্ষিতি টলমলি;
উড়িছে পতাকাচয় রণানন্দে যেন।
কুসুম-আসনে বসি, স্বর্ণ-বীণা-করে;
কোথায় গাইছে কবি, মোহি শ্রোতাকুলে
বীরকুলসংকীর্ত্তনে। মাতি সে সঙ্গীতে,
হুঙ্কারিছে বীরদল; বর্ষিছে চৌদিকে,
না জানি কে, পারিজাতফুল রাশি রাশি,
সুসৌরভে পূরি দেশ। নাচিছে অপ্সরা;
গাইছে কিন্নরকুল, ত্রিদিবে যেমতি।
কহিলা রাঘবে মায়া;— “সত্যযুগ-রণে
সম্মুখ–সমরে হত রথীশ্বর যত,
দেখ, এই ক্ষেত্রে আজি, ক্ষত্ত্র-চূড়ামণি!
কাঞ্চনশরীর যথা হেমকূট, দেখ
নিশুম্ভে; কিরীট-আভা উঠিছে গগনে—
মহাবীর্য্যবান্ রথী। দেবতেজোদ্ভবা
চণ্ডী ঘোরতর রণে নাশিলা শূরেশে।
দেখ শুম্ভে,শূলীশম্ভুনিভ পরাক্রমে;
ভীষণ মহিষাসুরে, তুরঙ্গমদমী;
ত্রিপুরারি-অরি শূর সুরথী ত্রিপুরে;
বৃত্র-আদি দৈত্য যত, বিখ্যাত জগতে।
সুন্দ উপসুন্দ দেখ, আনন্দে ভাসিছে
ভ্রাতৃ-প্রেম-নীরে পুনঃ।” সুধিলা সুমতি
রাঘব;— “কেন না হেরি, কহ দয়াময়ি!
কুম্ভকর্ণ, অতিকায়, নরান্তক (রণে
নরান্তক) ইন্দ্রজিৎ আদি রক্ষঃশূরে?”
উত্তরিলা কুহকিনী;— “অন্ত্যেষ্টিব্যতীত
নাহি গতি এ নগরে, হে বৈদেহীপতি!
নগর-বাহিরে দেশ, ভ্রমে তথা প্রাণী,
যতদিন প্রেতক্রিয়া না সাধে বান্ধবে
যতনে;—বিধির বিধি কহিনু তোমারে।
চেয়ে দেখ, বীরবর! আসিছে এ দিকে
সুবীর; অদৃশ্যভাবে থাকিব, নৃমণি!
তব সঙ্গে; মিষ্টালাপ কর রঙ্গে তুমি।”
এতেক কহিয়া মাতা অদৃশ্য হইলা।
সবিস্ময়ে রঘুবর দেখিলা বীরেশে
তেজস্বী; কিরীট চূড়ে খেলে সৌদামিনী,
ঝল ঝলে মহাকাশে, নয়ন ঝলসি,
আভরণ! করে শূল, গজপতিগতি।
অগ্রসরি শূরেশ্বর সম্ভাষি রামেরে,
সুধিলা; “কি হেতু হেথা সশরীরে আজি,
রঘুকুলচূড়ামণি? অন্যায়, সমরে
সংহারিলে মোরে তুমি তুষিতে সুগ্রীবে;
কিন্তু দূর কর ভয়; এ কৃতান্তপুরে
নাহি জানি ক্রোধ মোরা, জিতেন্দ্রিয় সবে।
মানব-জীবন-স্রোতঃ পৃথিবী-মণ্ডলে,
পঙ্কিল, বিমল র’য়ে বহে সে এ দেশে।
আমি বালি।” সলজ্জায় চিনিলা নৃমণি
রথীন্দ্র কিষ্কিন্ধ্যানাথে। কহিলা হাসিয়া
বালি;—“চল মোর সাথে, দাশরথি রথি!
ওই যে উদ্যান, দেব! দেখিছ অদূরে
সুবর্ণ কুসুমময়, বিহারেন সদা
ও বনে জটায়ু-রথী পিতৃসখা তব।
পরম পীরিতি রথী, পাইবেন হেরি
তোমায়! জীবনদান দিলা মহামতি
ধর্মকর্ম্মে—সতী–নারী রাখিতে বিপদে;
অসীম গৌরব তেঁই! চল ত্বরা করি।”
জিজ্ঞাসিলা রক্ষোরিপু;—“কহ কৃপা করি,
হে সুরথি! সমসুখী এ দেশে কি তোমা
সকলে?” “খনির গর্ভে” উত্তরিলা বালি,—
“জনমে সহস্র মণি রাঘব; কিরণে
নহে সমতুল সবে, কহিনু তোমারে;
তবু আভাহীন কেবা, কহ রঘুমণি?
এইরূপে মিষ্টালাপে চলিলা দুজনে।
রম্যবনে বহে যথা পীযূষসলিলা
নদী সদা কলকলে, দেখিলা নৃমণি,
জটায়ু গরুড়পুত্ত্রে, দেবাকৃতি রথী,
দ্বিরদ-রদ-নির্ম্মিত, বিবিধ রতনে
খচিত আসনাসীন! উথলে চৌদিকে
বীণাধ্বনি। পদ্মপর্ণবর্ণ বিভারাশি
উজ্জ্বলে সে বনরাজী, চন্দ্রাতপে ভেদি
সৌরকরপুঞ্জ যথা উৎসব আলয়ে!
চিরপরিমলময় সমীর বহিছে
বসন্ত! আদরে বীর কহিলা রাঘবে;—
“জুড়ালে নয়ন আজি, নরকুলমণি
মিত্র পুত্ত্র; ধন্য তুমি! ধরিলা তোমারে
শুভক্ষণে গর্ভ, শুভ, তোমার জননী।
ধন্য দশরথ সখা, জন্মদাতা তব।
দেবকুলপ্রিয় তুমি, তেঁই সে আইলে
সশরীরে এ নগরে। কহ, বৎস! শুনি,
রণ-বার্ত্তা। প’ড়েছে কি সমরে দুর্ম্মতি
রাবণ?” প্রণমি প্রভু কহিলা সুস্বরে;—
“ও পদ-প্রসাদে তাত! তুমুল-সংগ্রামে
বিনাশিনু বহু-রক্ষে; রক্ষঃকুলপতি
রাবণ একাকী বীর এবে রক্ষঃপুরে।
তার শরে হতজীব লক্ষ্মণ-সুমতি
অনুজ; আইল দাস এ দুর্গম দেশে,
শিবের আদেশে আজি। কহ, কৃপা করি,
কহ দাসে কোথা পিতা, সখা তব, রথি?”
কহিলা জটায়ু বলী—পশ্চিম-দুয়ারে
বিরাজেন রাজ-ঋষি রাজ-ঋষিদলে।
নাহি মানা মোর প্রতি ভ্রমিতে সে দেশে;
যাইব তোমার সঙ্গে, চল রিপুদমি।”
বহুবিধ রম্যদেশ দেখিলা সুমতি,
বহু স্বর্ণ-অট্টালিকা; দেবাকৃতি বহু
রথী; সরোবর-কূলে, কুসুমকাননে,
কেলিছে হরষে প্রাণী, মধুকালে যথা
গুঞ্জরে ভ্রমরকুল সুনিকুঞ্জ বনে;
কিম্বা নিশাভাগে যথা খাদ্যোৎ, উজলি
দশদিশ। দ্রুতগতি চলিলা দুজনে।
লক্ষ লক্ষ লক্ষ প্রাণী বেড়িল রাঘবে।
কহিলা জটায়ু-বলী;—“রঘুকুলোদ্ভব
এ সুরথী! সশরীরে শিবের আদেশে,
আইলা এ প্রেতপুরে, দরশন-হেতু
পিতৃপদ; আশীর্ব্বাদি যাহ সবে চলি
নিজস্থানে, প্রাণিদল।” গেলা চলি সবে
আশীর্ব্বাদি। মহানন্দে চলিলা দুজনে।
কোথায় হেমাঙ্গগিরি উঠিছে আকাশে
বৃক্ষচূড়, জটাচূড় যথা জটাধারী
কপর্দ্দী। বহিছে কলে প্রবাহিণী ঝরি।
হীরা, মণি, মুক্তাফল ফলে স্বচ্ছ-জলে।
কোথায় বা নীচ দেশে শোভিছে কুসুমে
শ্যাম-ভূমি; তাহে সরঃ, খচিত কমলে।
নিরন্তর পিকবর কুহরিছে বনে।
বিনতানন্দনাত্মজ কহিলা সম্ভাষি
রাঘবে;— “পশ্চিমদ্বার দেখ রঘুমণি!
হিরণ্ময়; এ সুদেশে হীরক নির্ম্মিত
গৃহাবলী। দেখ চেয়ে, স্বর্ণবৃক্ষমূলে,
মরকতপত্রছত্র দীর্ঘশিরোপরি,
কনক-আসনে বসি দিলীপ-নৃমণি,
সঙ্গে সুদক্ষিণা সাধ্বী। পূজ ভক্তিভাবে
বংশের নিদান তব। বসেন এ দেশে
অগণ্য রাজর্ষিগণ;—ইক্ষ্বাকু, মান্ধাতা,
নহুষ প্রভৃতি সবে বিখ্যাত জগতে।
অগ্রসরি পিতামহে পূজ, মহাবাহো!
অগ্রসরি রথীশ্বর সাষ্টাঙ্গে নমিলা
দম্পতির পদতলে; সুধিলা আশীষি
দিলীপ;—“কে তুমি? কহ, কেমনে আইলা
সশরীরে প্রেতদেশে, দেখাকৃতি রথি?
তব চন্দ্রানন হেরি আনন্দ-সলিলে
ভাসিল হৃদয় মম।” কহিলা সুস্বরে
সুদক্ষিণা;—“হে সুভগ, কহ ত্বরা করি,
কে তুমি? বিদেশে যথা স্বদেশীয় জনে
হেরিলে জুড়ায় আঁখি, তেমনি জুড়াল
আঁখি মম, হেরি তোমা। কোন্ সাধ্বী নারী
শুভক্ষণে গর্ভে তোমা ধরিল, সুমতি?
দেবকুলোদ্ভব যদি, দেবাকৃতি তুমি,
কেন বন্দ আমা দোঁহে? দেব যদি নহ,
কোন্ কুল উজ্জ্বলিলা নরদেবরূপে?”
উত্তরিলা দাশরথি কৃতাঞ্জলিপুটে;—
“ভুবনবিখ্যাত পুত্ত্র রঘুনামে তব
রাজর্ষি! ভুবন যিনি জিনিলা স্ববলে
দিগ্বিজয়ী, অজ নামে তাঁর জনমিলা
তনয়—বসুধাপাল; বরিলা অজেরে
ইন্দুমতি; তাঁর গর্ভে জনম লভিলা
দশরথ মহামতি; তাঁর পাটেশ্বরী
কৌশল্যা; দাসের জন্ম তাঁহার উদরে।
সুমিত্রা-জননীপুত্ত্র লক্ষ্মণ-কেশরী,
শত্রুঘ্ন—শত্রুঘ্নরণে! কৈকেয়ী-জননী
ভরত ভ্রাতারে, প্রভু, ধরিলা গরভে।”
উত্তরিলা রাজ-ঋষি;—“রামচন্দ্র তুমি,
ইক্ষ্বাকুকুলশেখর, আশীষি তোমারে।
নিত্য নিত্য কীর্ত্তি তব ঘোষিবে জগতে,
যতদিন চন্দ্র সূর্য্য উদিবে আকাশে,
কীর্ত্তিমান্! বংশ মম উজ্জ্বল ভূতলে
তব গুণে, গুণিশ্রেষ্ঠ! ওই যে দেখিছ
স্বর্ণগিরি, তার কাছে বিখ্যাত এ পুরে,
অক্ষয় নামেতে বট বৈতরণী-তটে।
বৃক্ষমূলে পিতা তব পূজেন সতত
ধর্ম্মরাজে, তব হেতু; যাও মহাবাহু,
রঘুকুল-অলঙ্কার! তাঁহার সমীপে।
কাতর তোমার দুঃখে দশরথ রথী।”
বন্দি চরণারবিন্দ আনন্দে নৃমণি
বিদায়ি জটায়ু-শূরে, চলিলা একাকী
(অন্তরীক্ষে সঙ্গে মায়া) স্বর্ণগিরি–দেশে
সুরম্য, অক্ষয়-বৃক্ষে হেরিলা সুরথী
বৈতরণী নদীতীরে পীযূষ-সলিলা
এ ভূমে; সুবর্ণ-শাখা, মরকত-পাতা, ·
ফল, হায়, ফলছটা কে পারে বর্ণিতে?
দেবারাধ্য তরুরাজ, মুকতিপ্রদায়ী।
হেরি দূরে পুত্ত্র বরে রাজর্ষি, প্রসারি
বাহুযুগ, (বক্ষঃস্থল আর্দ্র অশ্রুজলে)
কহিলা;—“আইলি কি রে এ দুর্গম দেশে
এতদিনে, প্রাণাধিক, দেবের প্রসাদে,
জুড়াতে এ চক্ষুর্দ্বয়? পাইনু কি আজি
তোরে, হারাধান মোর? হায় রে, কত যে
সহিনু বিহনে তোর, কহিব কেমনে
রামভদ্র? লৌহ যথা গলে অগ্নিতেজে,
তোর শোকে দেহত্যাগ করিনু অকালে।
মুদিনু নয়ন, হায়, হৃদয়-জ্বলনে।
নিদারুণ বিধি, বৎস! মম কর্ম্মদোষে
লিখিলা আয়াস, মরি, তোর ও কপালে,
ধর্ম্মপথগামী তুই। তেঁই সে ঘটিল
এ ঘটনা! তেঁই, হায় দলিলা কৈকেয়ী
জীবন-কানন-শোভা আশালতা মম
মত্তমাতঙ্গিনীরূপে।” বিলাপিলা বলী
দশরথ; দাশরথি কাঁদিলা নীরবে।
কহিলা রাঘবশ্রেষ্ঠ;—“অকূল-সাগরে
ভাসে দাস, তাত, এবে; কে তারে রক্ষিবে
এ বিপদে? এ নগরে বিদিত যদ্যপি
ঘটে যা ভমণ্ডলে, তবে ও চরণে
অবিদিত নহে, কেন অইল এ দেশে
কিঙ্কর! অকালে, হায়, ঘোরতর রণে,
হত প্রিয়ানুজ আজি!— না পাইলে তারে,
আর না ফিরিব, যথা শোভে দিনমণি,
চন্দ্র, তারা। আজ্ঞা দেহ এখনি মরিব,
হে তাত, চরণতলে। না পারি ধরিতে
তাহার বিরহে প্রাণ।” কাঁদিলা নৃমণি
পিতৃপদে; পুত্ত্রদুঃখে কাতর, কহিলা
দশরথ -“জানি আমি কি কারণে তুমি
আইলে এ পুরে, পুত্ত্র! সদা আমি পূজি
ধর্ম্মরাজে, জলাঞ্জলি দিয়া সুখভোগে,
তোমার মঙ্গলহেতু। পাইবে লক্ষ্মণে,
সুলক্ষণ! প্রাণ তার এখনও দেহে
বদ্ধ, ভগ্ন-কারাগারে বদ্ধ বন্দী যথা।
সুগন্ধমাদন গিরি, তার শৃঙ্গদেশে
ফলে মহৌষধ, বৎস! বিশল্যকরণী,
হেমলতা; আনি তাহা বাঁচাও অনুজে।
আপনি প্রসন্নভাবে যমরাজ আজি
দিলা এ উপায় কহি। অনুচর তব
আশুগতি পুত্ত্র হনূ, আশুগতি-গতি;
প্রের তারে; মুহূর্ত্তেকে আনিবে ঔষধে
ভীম-পরাক্রম বলী প্রভঞ্জন-সম।
নাশিবে সমরে তুমি বিষম-সংগ্রামে
রাবণে; সবংশে নষ্ট হবে দুষ্টমতি
তব শরে; রঘুকুললক্ষ্মী পুত্ত্রবধূ,
রঘুগৃহ পুনঃ মাতা ফিরি উজ্জ্বলিবে,—
কিন্তু সুখভোগ ভাগ্যে নাহি, বৎস! তব।
পুড়ি ধূপদানে, হায়, গন্ধরস যথা
সুগন্ধে আমোদে দেশ, বহুক্লেশ সহি,
পূরিবে ভারত-ভূমি, যশস্বি! সুযশে।
মম পাপহেতু বিধি দণ্ডিলা তোমারে;—
স্ব-পাপে মরিনু আমি তোমার বিচ্ছেদে।
“অর্দ্ধগত নিশামাত্র এবে ভূমণ্ডলে
দেববলে বলী তুমি; যাও শীঘ্র ফিরি
লঙ্কাধামে; প্রের ত্বরা বীর হনূমানে;
আনি মহৌষধ, বৎস! বাঁচাও অনুজে;
রজনী থাকিতে যেন আনে সে ঔষধে!”
আশীষিলা, দশরথ দাশরথি-শূরে।
পিতৃ-পদধূলি পুত্ত্র লইবার আশে,
অর্পিলা চরণপদ্মে করপদ্ম; বৃথা!
নারিল স্পর্শিতে পদ। কহিলা সুস্বরে
রঘুজ-অজ-অঙ্গজ দশরথাত্মজে;—
“নহে ভূতপূর্ব্ব দেহ, এবে যা দেখিছ,
প্রাণাধিক! ছায়ামাত্র! কেমনে ছুঁইবে
এ ছায়া, শরীরী তুমি? দর্পণে যেমতি
প্রতিবিম্ব, কিম্বা জলে, এ শরীর মম।—
অবিলম্বে, প্রিয়তম! যাও লঙ্কাধামে।”
প্রণমি বিস্ময়ে পদে চলিলা সুমতি,
সঙ্গে মায়া! কতক্ষণে উতরিলা বলী
যথায় পতিত ক্ষেত্রে লক্ষ্মণ সুরথী;
চারিদিকে বীরবৃন্দ নিদ্রাহীন শোকে।
ইতি শ্রীমেঘনাদবধ কাব্যে প্রেতপুরী নাম অষ্টমঃ সর্গঃ।
অষ্টম সর্গ।
গৈরিক—red chalk. The blood of Lakshmana has the colour of the red chalk.
বৈদেহীহৃদয়-কমলরবি—Rama who is, as it were, the sun in relation to the lotus of the heart of Sita.
নির্দ্দয় শকুনি মৃতজীব-আঁখি যথা—as the merciless vulture draws out the eyes of the dead. রক্তাক্ত—blood-stained.
সূক্ষ্ম স্বর্ণসূতার কাঁচলী—a covering for the breast, made of fine gold threads.
তপ্তশ্বাসে উড়ি...... আশু আবরিল—the heated breaths of the women maddened with desire blew away the pollens of the flowers of garlands. These pollens darkened the good sense of the men and women, as dusts darken the sun. These pollens made them mad with carnal desires.
কি মানসে ......নয়নে—the eyes of the males told the eyes of the females with what object in view they entered into the woods.
মনোরথ বৃথা দুই দলে—the punishment of these males and females consists in the fact that each of the parties is unable to gratify the carnal desire of the other. Both the parties are beautiful and charming to look at. Their beauty excites their carnality. But, alas, they are impotent to satisfy the desire.
যৌবনে অন্যায়......কাঙ্গালী—the excesses in the youth make a person impotent in an advanced age.
অনির্ব্বেয়—that cannot be extinguished or satisfied. কামধুক—Heaven, which satisfies all good desires.
কুসুমবনজনিত পরিমলসখা সমীর—the air, companion of fragrance, proceeding from a flower garden.