সটীক মেঘনাদবধ কাব্য/দ্বিতীয় সর্গ

দ্বিতীয় সর্গ

অস্তে গেলা দিনমণি; আইলা গোধুলি,—
একটী রতন ভালে। ফুটিলা কুমুদী;
মুদিলা সরসে আঁখি বিরসবদনা
নলিনী; কূজনি পাখী পশিল কূলায়ে।
গোষ্ঠ-গৃহে গাভীবৃন্দ ধায় হাম্বা রবে।
আইলা সুচারু-তারা শশীসহ হাসি,
শর্ব্বরী; সুগন্ধবহ বহিল চৌদিকে,
সুস্বনে সবার কাছে কহিয়া বিলাসী,
কোন্ কোন্ ফুল চুম্বি কি ধন পাইলা।
আইলেন নিদ্রা দেবী, ক্লান্ত শিশুকুল
জননীর ক্রোড়-নীড়ে লভয়ে যেমতি
বিরাম, ভূচরসহ জলচর-আদি
দেবীর চরণাশ্রমে বিশ্রাম লভিলা।
উতরিলা শশিপ্রিয়া ত্রিদশ-আলয়ে।
বসিলেন দেবপতি দেবসভা-মাঝে,
হৈমাসনে; বামে দেবী পুলোম-নন্দিনী
চারুনেত্রা। রাজছত্র, মণিময় আভা,
শোভিল দেবেন্দ্র-শিরে। রতনে খচিত
চামর যতনে ধরি, ঢুলায় চামরী।

আইলা সুসমীরণ, নন্দন কানন-
গন্ধ-মধু বহি রঙ্গে। বাজিল চৌদিকে
ত্রিদিব-বাদিত্র। ছয় রাগ, মুর্ত্তিমতী
ছত্রিশ রাগিণী সহ, আসি আরম্ভিলা
সঙ্গীত। উর্ব্বশী, রম্ভা সুচারুহাসিনী,
চিত্রলেখা, সুকেশিনী মিশ্রকেশী, আসি
নাচিলা, শিঞ্জিতে রঞ্জি দেব-কুল-মন!
যোগায় গন্ধর্ব্ব স্বর্ণ পাত্রে সুধারসে!
কেহ বা দেব-ওদন; কুঙ্কুম, কস্তুরী,
কেশর বহিছে কেহ; চন্দন কেহ বা;
সুগন্ধ মন্দার-দাম গাঁথি আনে কেহ!
বৈজয়ন্ত-ধামে সুখে ভাসেন বাসব
ত্রিদিব-নিবাসী সহ; হেনকালে তথা,
রূপের আভায় আলো করি সুর-পুরী,
রক্ষঃ-কুল-রাজলক্ষ্মী আসি উতরিলা।
সসম্ভ্রমে প্রণমিলা রমার চরণে
শচীকান্ত। আশীষিয়া হৈমাসনে বসি,
পদ্মাক্ষী পুণ্ডরীকাক্ষ-বক্ষোনিবাসিনী
কহিলা;—“হে সুরপতি, কেন যে আইনু
তোমার সভায় আজি, শুন মন দিয়া।”
উত্তর করিলা ইন্দ্র;—“হে বারীন্দ্রসুতে!
বিশ্বরমে, এ বিশ্বে ও রাঙা পা-দুখানি

বিশ্বের আকাঙ্ক্ষা মা গো! যার প্রতি তুমি,
রূপা করি, কৃপাদৃষ্টি কর, রূপাময়ি,
সফল জনম তার। কোন্ পুণ্যফলে,
লভিল এ সুখ দাস, কহ, মা, দাসেরে?”
কহিলেন পুনঃ রমা;—“বহুকালাবধি
আছি আমি, সুরনিধি, স্বর্ণলঙ্কাধামে।
বহুবিধ রত্নদানে, বহু যত্ন করি,
পূজে মোরে রক্ষোরাজ। হায়, এতদিনে
বাম তার প্রতি বিধি! নিজ কর্ম্ম-দোষে,
মজিছে সবংশে পাপী; তবুও তাহারে
না পারি ছাড়িতে, দেব! বন্দী যে, দেবেন্দ্র,
কারাগার-দ্বার নাহি খুলিলে কি কভু
পারে সে বাহির হ’তে? যতদিন বাঁচে
রাবণ, থাকিব আমি বাঁধা তার ঘরে।
মেঘনাদ নামে পুত্ত্র, হে বৃত্রবিজয়ি,
রাবণের, বিলক্ষণ জান তুমি তারে।
একমাত্র বীর সেই আছে লঙ্কাধামে
এবে, আর যত, হত এ সমরে।
বিক্রম-কেশরী শূর আক্রমিবে কালি
রামচন্দ্রে, পুনঃ তারে সেনাপতি-পদে
বরিয়াছে দশানন। দেব-কুল-প্রিয়
রাঘব; কেমনে তারে রাখিবে, তা দেখ।

নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ করি, আরম্ভিলে
যুদ্ধ দম্ভী মেঘনাদ, বিষম সঙ্কটে
ঠেকিবে বৈদেহীনাথ, কহিনু তোমারে।
অজেয় জগতে মন্দোদরীর নন্দন,
দেবেন্দ্র! বিহঙ্গকুলে বৈনতেয় যথা
বল-জ্যেষ্ঠ, রক্ষঃকুলশ্রেষ্ঠ শূরমণি।”
এতেক কহিয়া রমা কেশব-বাসনা
নীরবিলা; আহা মরি, নীরবে যেমতি
বীণা, চিত্ত বিনোদিয়া সুমধুর নাদে,
ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিণী আদি যত।
শুনি কমলার বাণী, ভুলিলা সকলে
স্বকর্ম্ম; বসন্তকালে পাখীকুল যথা,
মুঞ্জরিত কুঞ্জে, শুনি পিকবর ধ্বনি।
কহিলেন স্বরীশ্বর;—“এ ঘোর বিপদে,
বিশ্বনাথ বিনা, মাতঃ, কে আর রাখিবে
রাঘবে? দুর্ব্বার রণে রাবণ-নন্দন।
পন্নগ-অশনে নাগ নাহি ডরে যত,
ততোধিক ডরি তারে আমি। এ দম্ভোলি,
বৃত্রাসুর শিরঃ চূর্ণ যাহে, বিমুখয়ে
অস্ত্র-বলে মহাবলী; তেঁই এ জগতে
ইন্দ্রজিৎ নাম তার। সর্ব্বশুচি-বরে,
সর্ব্বজয়ী বীরবর। দেহ আজ্ঞা দাসে,

যাই আমি শীঘ্রগতি কৈলাস-সদনে।”
কহিলা উপেন্দ্র-প্রিয়া বারীন্দ্র-নন্দিনী;—
“যাও তবে, সুরনাথ যাও ত্বরা করি।
চন্দ্রশেখরের পদে, কৈলাস শিখরে,
নিবেদন কর, দেব, এ সব বারতা।
কহিও, সতত কাঁদে বসুন্ধরা-সতী,
না পারি সহিতে ভার; কহিও, অনন্ত
ক্লান্ত এবে। না হইলে নির্ম্মূল সমূলে
রক্ষঃপতি, ভবতল রসাতলে যাবে!
বড় ভাল বিরূপাক্ষ বাসেন লক্ষ্মীরে।
কহিও, বৈকুণ্ঠপুরী বহুদিন ছাড়ি
আছয়ে সে লঙ্কাপুরে, কত যে বিরলে
ভাবয়ে সে অবিরল, একবার তিনি,
কি দোষ দেখিয়া, তারে না ভাবেন মনে?
কোন্ পিতা দুহিতারে পতি-গৃহ হ’তে
রাখে দূরে—জিজ্ঞাসিও বিজ্ঞ জটাধরে?
ত্র্যম্বকে না পাও যদি, অম্বিকার পদে
কহিও এসব কথা।” এতেক কহিয়া,
বিদায় হইয়া চলি গেলা শশিমুখী
হরিপ্রিয়া। অনম্বর-পথে সুকেশিনী
কেশব-বাসনা দেবী গেলা অধোদেশে।
সোণার প্রতিমা যথা বিমল-সলিলে

ডুবে তলে, জলরাশি উজলি স্বতেজে।
আনিলা মাতলি রথ; চাহি শচী-পানে
কহিলেন শচীকান্ত মধুর বচনে
একান্তে;—“চলহ, দেবি, মোর সঙ্গে তুমি;
পরিমল সুধাসহ পবন বহিলে,
দ্বিগুণ আদর তার! মৃণালের রুচি
বিকচ কমল গুণে, শুনলো ললনে!”
শুনি প্রণয়ীর বাণী, হাসি নিতম্বিনী,
ধরিয়া পতির কর, আরোহিলা রথে।
স্বর্গ-হৈম দ্বারে রথ উত্তরিল ত্বরা।
আপনি খুলিল দ্বার মধুর নিনাদে
অমনি! বাহিরি বেগে, শোভিল আকাশে
দেবযান; সচকিতে জগৎ জাগিলা,
ভাবি রবিদেব বুঝি উদয়-অচলে
উদিলা। ডাকিল ফিঙা, আর পাখী যত
পূরিল নিকুঞ্জ-পুঞ্জ প্রভাতী সঙ্গীতে।
বাসরে কুসুম-শয্যা ত্যজি লজ্জাশীলা
কুলবধূ, গৃহকার্য্য উঠিলা সাধিতে।
মানস-সকাশে শোভে কৈলাস-শিখরী
আভাময়; তার শিল্পে ভবের ভবন,
শিখি-পুচ্ছ-চূড়া যেন মাধবের শিরে!
সুশ্যামাঙ্গ শূলধর; স্বর্ণ-ফুল-শ্রেণী

শোভে তাহে, আহা মরি পীতধড়া যেন!
নির্ঝর-ঝরিতবারি-রাশি স্থানে স্থানে—
বিশদ চন্দনে যেন চর্চ্চিত সে বপু!
ত্যজি রথ, পদব্রজে, সহ স্বরীশ্বরী,
প্রবেশিলা স্বরীশ্বর আনন্দ-ভবনে।
রাজরাজেশ্বরীরূপে বসেন ঈশ্বরী
স্বর্ণাসনে, ঢুলাইছে চামর বিজয়া;
ধরে রাজচ্ছত্র জয়া। হায় রে, কেমনে,
ভব-ভবনের কবি বর্ণিবে বিভব!
দেখ, হে ভাবুক-জন, ভাবি মনে মনে।
পূজিলা শক্তির পদ মহাভক্তি-ভাবে
মহেন্দ্র ইন্দ্রাণী সহ। আশীষি অম্বিকা
জিজ্ঞাসিলা;—“কহ, দেব, কুশল-বারতা,—
কি কারণে হেথা আজি তোমা দুইজনে?”
করযোড়ে আরম্ভিলা দম্ভোলি-নিক্ষেপী;
“কি না তুমি জান, মাতঃ, অখিল জগতে?
দেবদ্রোহী লঙ্কাপতি, আকুল বিগ্রহে,
বরিয়াছে পুনঃ পুত্ত্র মেঘনাদে আজি
সেনাপতিপদে। কালি প্রভাতে কুমার
পরন্তপ প্রবেশিবে রণে, ইষ্টদেবে
পূজি, মনোনীত বর লভি তাঁর কাছে।
অবিদিত নহে মাতঃ, তার পরাক্রম।

রক্ষঃকুল-রাজলক্ষ্মী, বৈজয়ন্ত-ধামে
আসি, এ সংবাদ দাসে দিলা, ভগবতি!
কহিলেন হরিপ্রিয়া, কাঁদে বসুন্ধরা,
এ অসহ ভার সতী না পারি সহিতে;
ক্লান্ত বিশ্বধর শেষ; তিনিও আপনি
চঞ্চলা সতত এবে ছাড়িতে কনক
লঙ্কাপুরী। তব পদে এ সংবাদ দেবী
আদেশিলা নিবেদিতে দাসেরে, অন্নদে।
দেব-কুল-প্রিয় বীর রঘু-কুলমণি।
কিন্তু দেবকুলে হেন আছে কোন্ রথী,
যুঝিবে যে রণভূমে রাবণির সাথে?
বিশ্বনাশী কুলিশে, মা, নিস্তেজে সমরে
রাক্ষস, জগতে খ্যাত ইন্দ্রজিৎ নামে!
কি উপায়ে কাত্যায়নি, রক্ষিবে রাঘবে,
দেখ ভাবি। তুমি কৃপা না করিলে, কালি
অরাম করিবে তব দুরন্ত রাবণি।”
উত্তরিলা কাত্যায়নী—“শৈব-কুলোত্তম
নৈকষেয়; মহাস্নেহ করেন ত্রিশূলী
তার প্রতি; তার মন্দ, হে সুরেন্দ্র, কভু
সম্ভবে কি মোর হ’তে? তপে মগ্ন এবে
তাপসেন্দ্র, তেঁই, দেব, লঙ্কার এ গতি।”
কৃতাঞ্জলি-পুটে পুনঃ বাসব কহিলা;—

“পরম-অধর্ম্মাচারী নিশাচর-পতি—
দেব-দ্রোহী! আপনি, হে নগেন্দ্র-নন্দিনি!
দেখ বিবেচনা করি। দরিদ্রের ধন
হরে যে দুর্ম্মতি, তব কৃপা তার প্রতি
কভু কি উচিত, মাতঃ! সুশীল রাঘব,
পিতৃ-সত্য-রক্ষা-হেতু, সুখ-ভোগ ত্যজি
পশিল ভিখারী-বেশে নিবিড় কাননে!
একটি রতনমাত্র আছিল তাহার
অমূল্য; যতন কত করিত সে তারে,
কি আর কহিবে দাস? সে রতন, পাতি
মায়াজাল, হরে দুষ্ট! হায়, মা, স্মরিলে
কোপানলে দহে মন! ত্রিশূলীর বরে
বলী রক্ষঃ, তৃণজ্ঞান করে দেবগণে!
পর-ধন, পর-দারলোভে সদা লোভী
পামর। তবে যে কেন (বুঝিতে না পারি)
হেন মূঢ়ে দয়া তুমি কর, দয়াময়ি!”
নীরবিলা স্বরীশ্বর; কহিতে লাগিলা
বীণাবাণী স্বরীশ্বরী মধুর সুস্বরে;—
“বৈদেহীর দুঃখে, দেবি, কার না বিদরে
হৃদয়? অশোক-বনে বসি দিবানিশি,
(কুঞ্জবন-সখী পাখী পিঞ্জরে যেমতি)
কাঁদেন রূপসী শোকে! কি মনোবেদনা

সহেন বিধুবদনা পতির বিহনে,
ও রাঙা-চরণে, মাতঃ, অবিদিত নতে।
আপনি না দিলে দণ্ড, কে দণ্ডিবে, দেবি,
এ পাষণ্ড রক্ষোনাথে? নাশি মেঘনাদে,
দেহ বৈদেহীরে পুনঃ বৈদেহী-রঞ্জনে;
দাসীর কলঙ্ক ভঞ্জ, শশাঙ্কধারিণি!
মরি, মা, শরমে আমি, শুনি লোকমুখে,
ত্রিদিব-ঈশ্বরে রক্ষঃ পরাভবে রণে!”
হাসিয়া কহিলা উমা;—“রাবণের প্রতি
দ্বেষ তব, জিষ্ণু! তুমি, হে মঞ্জুনাশিনী
শচি, তুমি ব্যগ্র ইন্দ্রজিতের নিধনে।
দুই জন অনুরোধ করিছ আমারে
নাশিতে কনক-লঙ্কা। মোর সাধ্য নহে
সাধিতে এ কার্য্য। বিরূপাক্ষের রক্ষিত
রক্ষঃ-কুল; তিনি বিনা তব এ বাসনা,
বাসব, কে পারে, কহ, পূর্ণিতে জগতে?
যোগে মগ্ন, দেবরাজ, বৃষধ্বজ আজি।
যোগাসননামে শৃঙ্গ মহাভয়ঙ্কর,
ঘন ঘনাবৃত, তথা বসেন বিরলে
যোগীন্দ্র, কেমনে যাবে তাঁহার সমীপে?
পক্ষীন্দ্র গরুড় সেথা উড়িতে অক্ষম!”
কহিলা বিনতভাবে অদিতিনন্দন;—

“তোমা বিনা কার শক্তি, হে মুক্তিদায়িনি
জগদম্বে, যায় যে সে যথা ত্রিপুরারি
ভৈরব? বিনাশি, দেবি, রক্ষঃকুল, রাখ
ত্রিভুবন; বৃদ্ধি কর ধর্ম্মের মহিমা;
হ্রাসো বসুধার ভার; বসুন্ধরা-ধর
বাসুকিরে কর স্থির; বাঁচাও রাঘবে।”
এইরূপে দৈত্যরিপু স্তুতিলা সতীরে।
হেনকালে গন্ধামোদে সহসা পূরিল
পুরী; শঙ্খঘণ্টাধ্বনি বাজিল চৌদিকে
মঙ্গল নিক্কণসহ, মৃদু যথা যবে
দূর কুঞ্জবনে গাহে পিক-কুল মিলি।
টলিল কনকাসন। বিজয়া সখীরে
সম্ভাষিয়া মধুস্বরে, ভবেশ-ভাবিনী
সুধিলা;—“লো বিধুমুখি, কহ শীঘ্র করি,
কে কোথা, কিহেতু মোরে পূজিছে অকালে?”
মন্ত্র পড়ি, খড়ি পাতি, গণিয়া গণনে,
নিবেদিলা হাসি সখী;—“হে নগনন্দিনি,
দাশরথি রথী তোমা, পূজে লঙ্কাপুরে।
বারি-সংঘটিত ঘটে, সুসিন্দুরে আঁকি
ও সুন্দর পদযুগ, পূজে রঘুপতি
নীলোৎপলাঞ্জলি দিয়া, দেখিমু গণনে।
অভয় প্রদান তারে কর গো, অভয়ে!

পরম ভকত তব কৌশল্যানন্দন
রঘুশ্রেষ্ঠ; তার তারে বিপদে, তারিণি!”
কাঞ্চন-আসন ত্যজি, রাজরাজেশ্বরী
উঠিয়া, কহিলা পুনঃ বিজয়ারে সতী;—
“দেব-দম্পতিরে তুমি সেব যথাবিধি,
বিজয়ে! যাইব আমি যথা যোগাসনে
(বিকটশিখর!) এবে বসেন ধূর্জ্জটি।
এতেক কহিয়া দুর্গা দ্বিরদ-গামিনী
প্রবেশিলা হৈমগেহে। দেবেন্দ্র বাসবে
ত্রিদিব-মহিষী সহ, সম্ভাষি আদরে,
স্বর্ণাসনে বসাইলা বিজয়া সুন্দরী।
পাইলা প্রসাদ দোঁহে পরম আহ্লাদে।
শচীর গলায় জয়া হাসি দোলাইলা
তারাকারা ফুলমালা; কবরী-বন্ধনে
বসাইলা চিররুচি, চির-বিকসিত
কুসুম-রতন-রাজী, বাজিল চৌদিকে
যন্ত্রদল, বামাদল গাইল নাচিয়া।
মোহিল কৈলাসপুরী; ত্রিলোক মোহিল!
স্বপনে শুনিয়া শিশু সে মধুর ধ্বনি,
হাসিল মায়ের কোলে, মুদিত নয়ন।
নিদ্রাহীন বিরহিণী চমকি উঠিলা,
ভাবি প্রিয়-পদ-শব্দ শুনিলা ললনা

দুয়ারে! কোকিলকুল নীরবিলা বনে।
উঠিলেন যোগিব্রজ, ভাবি ইষ্টদেব,
বর মাগ বলি, আসি দরশন দিলা।
প্রবেশি সুবর্ণ-গেহে, ভবেশ-ভাবিনী
ভাবিলা;—“কি ভাবে আজি ভেটিব ভবেশে?”
ক্ষণকাল চিন্তি সতী চিন্তিলা রতিরে।
যথায় মন্মথ-সাথে, মন্মথ-মোহিনী
বরাননা, কুঞ্জবনে বিহারিতেছিলা,
তথায় উমার ইচ্ছা, পরিমলময়-
বায়ু তরঙ্গিণীরূপে, বহিল নিমিষে।
নাচিল রতির হিয়া, বীণা-তার যথা
অঙ্গুলীর পরশনে। গেলা কামবধূ,
দ্রুতগতি বায়ু-পথে, কৈলাস-শিখরে।
সরসে নিশান্তে যথা ফুটি, সরোজিনী
নমে ত্বিষাম্পতি-দূতী ঊষার চরণে,
নমিলা মদন-প্রিয়া হর-প্রিয়া-পদে।
আশীষি রতিরে, হাসি কহিলা অম্বিকা;—
“যোগাসনে তপে মগ্ন যোগীন্দ্র; কেমনে
কোন্ রঙ্গে, ভঙ্গ করি তাঁহার সমাধি,
কহ মোরে, বিধুমুখি!” উত্তরিলা নমি
সুকেশিনী; “ধর, দেখি, মোহিনী-মূরতি।
দেহ আজ্ঞা, সাজাই ও বর-বপু, আনি

নানা আভরণ; হেরি যে সবে, পিণাকী
ভুলিবেন, ভুলে যথা ঋতুপতি, হেরি
মধুকালে বনস্থলী কুসুম-কুন্তলা।”
এতেক কহিয়া রতি, সুবাসিত তেলে
মাজি চুল, বিনাইলা মনোহর বেণী।
যোগাইলা আনি ধনী বিবিধ ভূষণে,
হীরক-মুকুতা-মণি-খচিত; আনিলা
চন্দন, কেশরসহ কুঙ্কুম কস্তুরী;
রত্ন-সঙ্কলিত-আভা কৌষেয় বসনে।
লাক্ষারসে পা-দুখানি চিত্রিলা হরসে
চারুনেত্রা। ধরি মূর্ত্তি ভুবনমোহিনী,
সাজিলা নগেন্দ্রবালা; রসানে মার্জ্জিত
হেম-কাস্তি-সম কান্তি দ্বিগুণ শোভিল!
হেরিলা দর্পণে দেবী ও চন্দ্র-আননে;
প্রফুল্ল-নলিনী যথা বিমল-সলিলে
নিজ বিকচিত রুচি। হাসিয়া কহিলা,
চাহি স্মর-হর-প্রিয়া স্মর-প্রিয়া পানে;—
“ডাক তব প্রাণনাথে।” অমনি ডাকিল,
(পিককুলেশ্বরী যথা ডাকে ঋতুবরে),
মদনে মদন-বাঞ্ছা। আইলা ধাইয়া
ফুল-ধনু, আসে যথা প্রবাসে প্রবাসী,
স্বদেশ-সঙ্গীত-ধ্বনি শুনি রে উল্লাসে!

কহিলা শৈলেশসুতা;—“চল মোর সাথে,
হে মন্মথ, যাব আমি যথা যোগিপতি
যোগে মগ্ন এবে বাছা; চল ত্বরা করি।”
অভয়ার পদতলে মায়ার নন্দন,
মদন আনন্দময়, উত্তরিলা ভয়ে;—
“হেন আজ্ঞা কেন, দেবি! কর এ দাসেরে?
স্মরিলে পূর্ব্বের কথা, মরি, মা, তরাসে!
মূঢ় দক্ষ-দোষে যবে দেহ ছাড়ি, সতি,
হিমাদ্রির গৃহে জন্ম গ্রহিলা আপনি,
তোমার বিরহ-শোকে বিশ্ব-ভার ত্যজি
বিশ্বনাথ, আরম্ভিলা ধ্যান; দেবপতি
ইন্দ আদেশিলা দাসে, সে ধ্যান ভাঙ্গিতে!
কুলগ্নে গেনু মা! যথা মগ্ন বামদেব
তপে; ধরি ফুল-ধনু, হানিনু কুক্ষণে
ফুল-শর। যথা সিংহ সহসা আক্রমে
গজরাজে, পূরি বন ভীষণ গর্জ্জনে,
গ্রাসিলা দাসেরে আসি রোষে বিভাবসু,
বাস যাঁর, ভবেশ্বরি, ভবেশ্বর-ভালে।
হায়, মা, কত যে জ্বালা সহিনু, কেমনে
নিবেদি ও রাঙ্গা পায়ে? হাহাকার রবে,
ডাকিনু বাসবে, চন্দ্রে, পবনে, তপনে;
কেহ না আইল; ভস্ম হইনু সত্বরে!—

ভয়ে ভগ্নোদ্যম আমি ভাবিয়া ভবেশে;
ক্ষম দাসে, ক্ষেমঙ্করি! এ মিনতি পদে।”
আশ্বাসি মদনে, হাসি, কহিলা শঙ্করী;—
“চল রঙ্গে মোর সঙ্গে নির্ভয় হৃদয়ে
অনঙ্গ! আমার বরে চিরজয়ী তুমি।
যে অগ্নি কুলগ্নে তোমা পাইয়া স্বতেজে
জ্বালাইল, পূজা তব করিবে সে আজি;
ঔষধের গুণ ধরি, প্রাণনাশকারী
বিষ যথা রক্ষে প্রাণ বিদ্যার কৌশলে।”
প্রণমিয়া কাম তবে উমার চরণে,
কহিলা;—“অভয়দান কর যারে তুমি
অভয়ে, কি ভয় তার এ তিন ভুবনে?
কিন্তু নিবেদন করি ও কমল-পদে,—
কেমনে মন্দির হ’তে, নগেন্দ্রনন্দিনি,
বাহিরিবা, কহ দাসে, এ মোহিনীবেশে?
মুহূর্ত্তে মাতিবে, মাতঃ, জগৎ হেরিলে
ও রূপ-মাধুরী; সত্য কহিনু তোমারে।
হিতে বিপরীত, দেবি, সত্বরে ঘটিবে।
সুরাসুরবৃন্দ যবে মথি জলনাথে,
লভিলা অমৃত, দুষ্ট দিতিসুত যত
বিবাদিল দেবসহ সুধামধু-হেতু।
মোহিনী-মূরতি ধরি আইলা শ্রীপতি।

ছদ্মবেশী হৃষীকেশে ত্রিভুবন হেরি,
হারাইলা জ্ঞান সবে; এ দাসের শরে
অধর-অমৃত-আশে, ভুলিলা অমৃত
দেবদৈত্য; নাগদল নম্রশিরঃ লাজে,
হেরি পৃষ্ঠদেশে বেণী; মন্দর আপনি
অচল হইল হেরি উচ্চ কুচযুগে!
স্মরিলে সে কথা, সতি, হাসি আসে মুখে।
মলম্বা-অম্বরে তাম্র এত শোভা যদি
ধরে, দেবি, ভাবি দেখ, বিশুদ্ধ কাঞ্চন-
কান্তি কত মনোহর।” অমনি অম্বিকা,
সুবর্ণ-বরণ ঘন মায়ায় সৃজিয়া,
মায়াময়ী আবরিলা চারু অবয়বে।
হায় রে, নলিনী যেন দিবা-অবসানে
ঢাকিল বদন-শশী। কিম্বা অগ্নি-শিখা,
ভস্মরাশি-মাঝে পশি, হাসি লুকাইলা।
কিম্বা সুধা-ধন যেন, চক্র-প্রসরণে,
বেড়িলেন দেব-শত্রু সুধাংশুমণ্ডলে।
দ্বিরদ-রদ-নির্ম্মিত গৃহদ্বার দিয়া
বাহিরিলা সুহাসিনী, মেঘাবৃতা যেন
ঊষা! সাথে মন্মথ, হাতে ফুল-ধনু,
পৃষ্ঠে তুণ, খরতর ফুল-শরে ভরা—
কণ্টকময় মৃণালে ফুটিল নলিনী।

কৈলাস শিখরি-শিরে ভীষণ শিখর
ভৃগুমান্, যোগাসননামেতে বিখ্যাত
ভুবনে; তথায় দেবী ভুবনমোহিনী
উতরিলা গজগতি। অমনি চৌদিকে
গভীর গহ্বরে বদ্ধ, ভৈরব-নিনাদী
জলদল, নীরবিলা, জল-কান্ত যথা
শান্ত শান্তি-সমাগমে; পলাইল দূরে
মেঘদল, তমঃ যথা ঊষার হসনে!
দেখিলা সম্মুখে দেবী কপর্দ্দী তপস্বী,
বিভূতি ভূষিত দেহ, মুদিত নয়ন,
তপের সাগরে মগ্ন, বাহ্যজ্ঞানহত।
কহিলা মদনে হাসি সুচারুহাসিনী;—
“কি কাজ বিলম্বে আর, হে শঙ্কর-অরি!
হান তব ফুল-শর।” দেবীর আদেশে,
হাঁটু গাড়ি মীনধ্বজ, শিঞ্জিনী টঙ্কারি,
সম্মোহন-শরে শূর বিঁধিলা উমেশে!
শিহরিলা শূলপাণি; নড়িল মস্তকে
জটাজূট, তরুরাজী যথা গিরিশিরে
ঘোর মড় মড় রবে নড়ে ভূকম্পনে।
অধীর হইলা প্রভু! গরজিলা ভালে
চিত্রভানু, ধক্‌ধকি, উজ্জ্বল জ্বলনে!
ভয়াকুল ফুল-ধনু পশিলা অমনি

ভবানীর বক্ষঃস্থলে, পশয়ে যেমতি
কেশরি-কিশোর ত্রাসে, কেশরিণী-কোলে,
গম্ভীর নির্ঘোষে ঘোষে ঘনদল যবে,
বিজলী ঝলসে আঁখি কালানল তেজে!
উন্মীলি নয়ন এবে উঠিলা ধুর্জ্জটি!
মায়া-ঘন-আবরণ ত্যজিলা গিরিজা।
মোহিত মোহিনীরূপে, কহিলা হরষে
পশুপতি;—“কেন হেথা একাকিনী দেখি,
এ বিজন স্থলে, তোমা, গণেন্দ্রজননি?
কোথায় মৃগেন্দ্র তব কিঙ্কর, শঙ্করি?
কোথায় বিজয়া জয়া?” হাসি উত্তরিলা
সুচারুহাসিনী উমা;—“এ দাসীরে ভুলি,
হে যোগীন্দ্র, বহুদিন আছ এ বিরলে;
তেঁই আসিয়াছি, নাথ, দরশন-আশে
পা-দুখানি। যে রমণী পতিপরায়ণা,
সহচরীসহ সে কি যায় পতিপাশে?
একাকী প্রত্যুষে, প্রভু, যায় চক্রবাকী
যথা প্রাণকান্ত তার!” আদরে ঈশান,
ঈষৎ হাসিয়া দেব, অজিন-আসনে
বসাইলা ঈশানীরে। অমনি চৌদিকে
প্রফুল্লিল ফুলকুল; মকরন্দ-লোভে
মাতি শিলীমুখ-বৃন্দ আইল ধাইয়া,

বহিল মলয়-বায়ু; গাইল কোকিল;
নিশার শিশিরে ধৌত কুসুম-আসার
আচ্ছাদিল শৃঙ্গবরে। উমার উরসে
(কি আর আছেরে বাসা সাজে মনসিজে
ইহা হ’তে!) কুসুমেষু, বসি কুতূহলে
হানিলা, কুসুম-ধনু টঙ্কারি কৌতুকে
শর-জাল;—প্রেমামোদে মাতিলা ত্রিশূলী!
লজ্জাবেশে রাহু আসি গ্রাসিল চাঁদেরে,
হাসি ভস্মে লুকাইলা দেব বিভাবসু।
মোহন-মূরতি ধরি, মোহি মোহিনীরে,
কহিলা হাসিয়া দেব;—“জানি আমি, দেবি,
তোমার মনের কথা,—বাসব কি হেতু
শচীসহ আসিয়াছে কৈলাস-সদনে;
কেন বা অকালে তোমা পূজে রঘুমণি?
পরম-ভকত মম নিকষা-নন্দন;
কিন্তু নিজ কর্ম্মফলে মজে দুষ্টমতি।
বিদরে হৃদয় মম স্মরিলে সে কথা,
মহেশ্বরি! হায়, দেবি, দেবে কি মানবে,
কোথা হেন সাধ্য রোধে প্রাক্তনের গতি?
পাঠাও কামেরে, উমা, দেবেন্দ্র-সমীপে।
সত্বরে যাইতে তারে আদেশ, মহেশি!
মায়াদেবী নিকেতনে। মায়ার প্রসাদে,

বধিবে লক্ষ্মণ-শূর, মেঘনাদ-শূরে!”
চলি গেলা মীনধ্বজ, নীড় ছাড়ি উড়ে
বিহঙ্গম-রাজ যথা, মুহুর্মুহুঃ চাহি
সে সুখ-সদন পানে! ঘন রাশি রাশি,
স্বর্ণবর্ণ, সুবাসিত বাস শ্বাসি ঘন,
বরষি প্রসূনাসার—কমল, কুমুদী,
মালতী, সেঁউতি, জাতি, পারিজাত আদি
মন্দ-সমীরণ-প্রিয়া—ঘিরিল চৌদিকে
দেবদেব মহাদেবে মহাদেবীসহ।
দ্বিরদ-রদ-নির্ম্মিত হৈমময় দ্বারে
দাঁড়াইলা বিধুমুখী মদনমোহিনী,
অশ্রুময় আঁখি, আহা! পতিয় বিহনে!
হেনকালে মধুসখা উত্তরিলা তথা।
অমনি পসারি বাহু, উল্লাসে মন্মথ
আলিঙ্গন-পাশে বাঁধি তুষিলা ললনে
প্রেমালাপে। শুকাইল অশ্রুবিন্দু, যথা
শিশির-নীরের বিন্দু শতদল-দলে,
দরশন দিলে ভানু উদয়-শিখরে।
পাই প্রাণধনে ধনী, মুখে মুখ দিয়া,
(সরস বসন্তকালে সারী-শুক যথা)
কহিলেন প্রিয়ভাষে;—“বাঁচালে দাসীরে
আশু আসি তার পাশে, হে রতিরঞ্জন!

কত যে ভাবিতেছিনু, কহিব কাহারে?
বামদেবনামে, নাথ, সদা কাঁপি আমি,
স্মরি পূর্ব্বকথা যত! দুরন্ত হিংসক
শূলপাণি! যেয়ো না গো আর তাঁর কাছে,
মোর কিরে প্রাণেশ্বর!” সুমধুর হাসে
উত্তরিলা পঞ্চশর;—“ছায়ার আশ্রমে,
কে কবে ভাস্কর-করে ডরায় সুন্দরি!
চল এবে যাই যথা দেব-কুলপতি।”
সুবর্ণ-আসনে যথা বসেন বাসব,
উতরি মন্মথ তথা, নিবেদিলা নমি
বারতা। আরোহি রথে দেবরাজ রথী
চলি গেলা দ্রুতগতি মায়ার সদনে।
অগ্নিময়তেজঃ বাজী ধাইল অম্বরে,
অকম্প চামর শিরে; গম্ভীর নির্ঘোষে
ঘোষিল রথের চক্র, চূর্ণি মেঘদলে।
কতক্ষণে সহস্রাক্ষ উত্তরিলা বলী
যথা বিরাজেন মায়া। ত্যজি রথবরে,
সুরকুল-রথিবর পশিলা দেউলে।
কত যে দেখিলা দেব কে পারে বর্ণিতে!
সৌর খরতর-কর-জাল সঙ্কলিত-
আভাময় স্বর্ণাসনে বসি, কুহকিনী
শক্তীশ্বরী। করযোড়ে বাসব প্রণমি

কহিলা—“আশীষ দাসে, বিশ্ব-বিমোহিনি!”
আশীষি সুধিলা দেবী;—কহ, কি কারণে
গতি হে আজি তব, অদিতিনন্দন!”
উত্তরিলা দেবপতি;—“শিবের আদেশে,
মহামায়া, অসিয়াছি তোমার সদনে।
কহ দাসে, কি কৌশলে, সৌমিত্রি জিনিবে
দশানন-পুত্ত্রে কালি? তোমার প্রসাদে
(কহিলেন বিরূপাক্ষ) ঘোরতর রণে
নাশিবে লক্ষ্মণ-শূর, মেঘনাদ-শূরে।”
ক্ষণকাল চিন্তি দেবী কহিলা বাসবে;—
“দুরন্ত তারকাসুর, সুর-কুলপতি,
কাড়ি নিল স্বর্গ যবে তোমারে বিমুখি
সমরে; কৃত্তিকাকুল-বল্লভ সেনানী,
পার্ব্বতীর গর্ভে জন্ম লভিলা তৎকালে।
বধিতে দানবরাজে সাজাইলা বীরে
আপনি বৃষধ্বজ, সৃজি রুদ্রতেজে
অস্ত্র। এই দেখ, দেব, ফলক, মণ্ডিত
সুবর্ণে; ওই যে অসি, নিবাসে উহাতে
আপনি কৃতান্ত; ওই দেখ, সুনাসীর!
ভয়ঙ্কর তূণীরে, অক্ষয়, পূর্ণ শরে,
বিষাকর ফণি-পূর্ণ নাগলোক যথা!
ওই দেখ ধনু, দেব!” কহিলা হাসিয়া,

হেরি সে ধনুর কান্তি, শচীকান্ত বলী;—
“কি ছার ইহার কাছে দাসের এ ধনু
রত্নময়। দিবাকর-পরিধি যেমতি,
জ্বলিছে ফলকবর—ধাঁধিয়া নয়নে!
অগ্নিশিখাসম অসি মহাতেজস্কর!
হেন তূণ আর মাতঃ, আছে কি জগতে?
“শুন দেব” (কহিলেন পুনঃ মায়াদেবী)
ওই সব অস্ত্রবলে নাশিলা তারকে
ষড়ানন। ওই সব অস্ত্রবলে, বলি,
মেঘনাদ-মৃত্যু, কহিনু তোমারে।
কিন্তু হেন বীর নাহি এ তিন ভুবনে,
দেব কি মানব, ন্যায়যুদ্ধে যে বধিবে
রাবণিরে। প্রের তুমি অস্ত্র রামানুজে,
আপনি যাইব আমি কালি লঙ্কাপুরে;
রক্ষিব লক্ষ্মণে, দেব, রাক্ষস-সংগ্রামে।
যাও চলি সুরদেশে, সুরদলনিধি!
ফুলকুল-সখী ঊষা যখন খুলিবে
পূর্ব্বাশার হৈমদ্বারে পদ্ম-কর দিয়া
কালি, তব চির-ত্রাস, বীরেন্দ্র-কেশরী,
ইন্দ্রজিৎ-ত্রাসহীন করিবে তোমারে—
লঙ্কার পঙ্কজরবি যাবে অন্তচলে!”
মহানন্দে দেব-ইন্দ্র বন্দিয়া দেরীরে,

অস্ত্র ল’য়ে গেলা চলি ত্রিদশ-আলয়ে।
বসি দেব সভাতলে, কনক আসনে
বাসব, কহিলা শূর, চিত্ররথ শূরে;—
“যতনে লইয়া অস্ত্র যাও মহাবলি!
স্বর্ণ-লঙ্কাধামে তুমি। সৌমিত্রি-কেশরী
মায়ার প্রসাদে কালি বধিবে সমরে
মেঘনাদে। কেমনে, তা দিবেন কহিয়া
মহাদেবী মায়া তারে। কহিও রাঘবে,
হে গন্ধর্ব্ব-কুলপতি, ত্রিদিব-নিবাসী
মঙ্গল-আকাঙ্ক্ষী তার; পার্ব্বতী আপনি
হরপ্রিয়া, সুপ্রসন্ন তার প্রতি আজি।
অভয় প্রদান তারে করিও সুমতি!
মরিলে রাবণি রণে, অবশ্য মরিবে
রাবণ; লভিবে পুনঃ বৈদেহী সতীরে
বৈদেহী-মনোরঞ্জন রঘুকুলমণি।
মোর রথে, রথিবর, আরোহণ করি
যাও চলি। পাছে তোমা হেরি লঙ্কাপুরে,
বাধায় বিবাদ রক্ষঃ; মেঘদলে আমি
আদেশিব আবরিতে গগন; ডাকিয়া
প্রভঞ্জনে দিব আজ্ঞা, ক্ষণ ছাড়ি দিতে
বায়ুকুলে; বাহিরিয়া নাচিবে চপলা;
দম্ভোলি-গম্ভীর-নাদে পূরিব জগতে।”

প্রণমি দেবেন্দ্র পদে, সাবধানে লয়ে
অস্ত্র, চলি গেলা মর্ত্যে চিত্ররথ রথী।
তবে দেবকুলনাথ, ডাকি প্রভঞ্জনে
কহিলা;—“প্রলয় ঝড় উঠাও সত্বরে
লঙ্কাপুরে, বায়ুপতি! শীঘ্র দেহ ছাড়ি
কারাবদ্ধ বায়ুদলে; লহ মেঘদলে;
দ্বন্দ্ব ক্ষণকাল, বৈরী বারিনাথ-সনে
নির্ঘোষে!” উল্লাসে দেব চলিলা অমনি,
ভাঙ্গিলে শৃঙ্খল, লম্ফী কেশরী যেমতি,
যথায় তিমিরাগারে রুদ্ধ বায়ু যত
গিরিগর্ভে। কত দূরে শুনিলা পবন
ঘোর কোলাহলে; গিরি (দেখিলা) নড়িছে
অন্তরিত পরাক্রমে, অসমর্থ যেন
রোধিতে প্রবল বায়ু আপনার বলে।
শিলাময় দ্বার দেব, খুলিলা পরশে।
হুহুঙ্কারি বায়ুকুল বাহিরিল বেগে
যথা অম্বুরাশি, যবে ভাঙ্গে আচম্বিতে
জাঙ্গাল। কাঁপিল মহী; গর্জ্জিল জলধি!
তুঙ্গ-শৃঙ্গধরাকারে তরঙ্গ-আবলী
কল্লোলিল, বায়ুসঙ্গে রণরঙ্গে মাতি!
ধাইল চৌদিকে মন্দ্রে জীমুত; হাসিল
ক্ষণপ্রভা; কড়মড়ে নাদিল দম্ভোলি।

পলাইলা তারানাথ তারাদলে লয়ে।
ছাইল লঙ্কায় মেঘ, পাবক উগারি
রাশি রাশি; বনে বৃক্ষ পড়িল উপাড়ি
মড়মডে, মহাঝড় বহিল আকাশে;
বর্ষিল আসার যেন সৃষ্টি ডুবাইতে
প্রলয়ে। বৃষ্টিল শিলা তড়তড় তড়ে।
পশিল আতঙ্কে রক্ষঃ যে যাহার ঘরে।
যথায় শিবিরমাঝে বিরাজেন বলী
রাঘবেন্দ্র, আচম্বিতে উত্তরিলা রথী
চিত্ররথ, দিবাকর যেন অংশুমালী,
রাজ-আভরণ দেহে! শোভে কটিদেশে
সারসন, রাশিচক্রসম তেজোরাশি,
ঝোলে তাহে অসিবর—ঝল ঝল ঝলে!
কেমনে বর্ণিবে কবি দেবতূণ, ধনু,
চর্ম্ম, বর্ম্ম, শূল, সৌর-কিরীটের আভা
স্বর্ণময়ী! দৈববিভা ধাঁধিল নয়নে;
স্বর্গীয় সৌরভে দেশ পুরিল সহসা।
সসম্ভ্রমে প্রণমিয়া, দেবদূতপদে
রঘুরর, জিজ্ঞাসিলা;— “হে ত্রিদিববাসি!
ত্রিদিব ব্যতীত, আহা, কোন্ দেশ সাজে
এ হেন মহিমা, রূপে?—কেন হেথা আজি
নন্দন কানন ত্যজি, কহ এ দাসেরে?

নাহি স্বর্ণাসন, দেব, কি দিব বসিতে?
তবে যদি কৃপা, প্রভু, থাকে দাসপ্রতি,
পাদ্য, অর্ঘ্য লয়ে বসো এই কুশাসনে।
ভিখারী রাঘব, হায়!” আশীষিয়া রথী
কুশাসনে বসি, তবে কহিলা সুস্বরে;
“চিত্ররথ নাম মম, শুন দাশরথি!
চির-অনুচর আমি সেবি অহরহঃ
দেবেন্দ্রে; গন্ধর্ব্বকুল আমার অধীনে।
আইনু এ পুরে আমি ইন্দ্রের আদেশে।
তোমার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী দেবকুলসহ
দেবেশ। এই যে অস্ত্র দেখিছ নৃমণি!
দিয়াছেন পাঠাইয়া তোমার অনুজে
দেবরাজ। আবির্ভাবি মায়া-মহাদেবী
প্রভাতে, দিবেন কহি, কি কৌশলে কালি
নাশিবে লক্ষ্মণশূর মেঘনাদ-শূরে।
দেবকুলপ্রিয় তুমি, রঘুকুলমণি!
সুপ্রসন্ন তব প্রতি আপনি অভয়া।”
কহিলা রঘুনন্দন;—“আনন্দ সাগরে
ভাসিনু, গন্ধর্ব্বশ্রেষ্ঠ! এ শুভ-সংবাদে।
অজ্ঞ নয় আমি; হায়, কেমনে দেখাব
কৃতজ্ঞতা? এই কথা জিজ্ঞাসি তোমারে।”
হাসিয়া কহিলা দূত;—“শুন, রঘুমণি!

দেব প্রতি কৃতজ্ঞতা, দরিদ্র-পালন,
ইন্দ্রিয়-দমন, ধর্ম্ম-পথে সদা গতি;
নিত্য সত্য-দেবী-সেবা; চন্দন, কুসুম,
নৈবেদ্য, কৌষিক-বস্ত্র আদি বলি যত,
অবহেলা করে দেব, দাতা যে যদ্যপি
অসৎ! এ সার কথা কহিনু তোমারে!”
প্রণমিলা রামচন্দ্র; আশীষিয়া রথী
চিত্ররথ, দেবরথে গেলা দেবপুরে।
থামিল তুমুল ঝড়; শান্তিলা জলধি;
হেরিয়া শশাঙ্কে পুনঃ তারাদল-সহ,
হাসিলা কনকলঙ্কা। তরল-সলিলে
পশি, কৌমুদিনী পুনঃ অবগাহে দেহ
রজোময়, কুমুদিনী হাসিল কৌতুকে।
আইল ধাইয়া পুনঃ রণ-ক্ষেত্রে, শিবা
শবাহারী; পালে পালে গৃধিনী, শকুনি,
পিশাচ! রাক্ষসদল বাহিরিল পুনঃ
ভীম-প্রহরণ-ধারী—মত্ত বীরমদে।

ইতি শ্রীমেঘনাদবধকাব্যে অভিষেকো নাম

দ্বিতীয়ঃ সর্গঃ।


দ্বিতীয় সর্গ।

গোধূলি—twilight.
একটী রতন ভালে—with a gem on the forehead i.e. with the evening star.
কুমুদী—is water lily. The Moon is poetically called the husband of the water lily.
নলিনী—is lotus. The sun is poetically called the husband of the lotus.
কূলায়—a nest.
গোষ্ঠ গৃহে—in the enclosure for cows.
সুচারুতারা—adj. qualifying শর্ব্বরী, with beautiful stars; having beautiful stars. বহুব্রীহি সমাস।
শর্ব্বরী—night.
ত্রিদশ-আলয়; the abode of gods.
ত্রিদশ—is a god.
পুলোমনন্দিনী—The daughter of the sage Pulome i.e. Sachi, the consort of Indra.
চামরী—one who fans a chowry.
নন্দনকানন গন্ধমধু—the fragrance and the honey of the Nandan Garden. ত্রিদিব—Heaven.
বাদিত্র—a musical instrument.
ওদন—an eatable; food.
দেব-ওদন—food for gods.
কুঙ্কুম—saffron. কস্তুরী—musk.
কেশর—the filament of a flower.
পুণ্ডরীকাক্ষ—Vishnu who has lotus-like eyes.
পুণ্ডরীক—a lotus.
বৃত্রবিজয়ী—The conqueror of Vritrasura i.e. Indra.
বিক্রমকেশরী—a lion in courage.
কেশরী—a lion who has a mane.
বৈনতেয়—the son of Vinata i.e. Garuda.
বলজ্যেষ্ঠ—supreme in strength.
শূরমণি—the jewel among the heroes.
কেশববাসনা—The desire of Kesava. Lakshmi is so called.
মুঞ্জুরিত—adorned with buds of flowers.
পিকবর—the best of the cuckoos.
পরগ-অশন—Garuda whose অশন or food is পরগ or snake.
দম্ভোলি—বজ্র; thunder.
সর্ব্বশুচি—The God of fire who purifies everything. সর্ব্বজয়ী—conqueror of all.
চন্দ্রশেখর—Siva who has the moon upon his forehead.
বিরূপাক্ষ—Siva. জটাধর—Siva.
ত্র্যম্বক—Siva who has got three eyes.
অম্বক—means an eyes.
অম্বিকা—is a name of Parvati.
অনম্বরপথ—the path of the sky.
মাতলি—the Charioteer of Indra.
একান্তে—aside. পরিমল—sweet fragrance.
পরিমল সুধা—the nectar of sweet fragrance.
মানস-সকাশে—near the Manasasarwar.
শিখরী—পর্ব্বত; hill or mountain which has a শিখর or peak. তব— i.e. Siva.
শিখি-পুচ্ছ-চূড়া; the top made of a peacock tail.
নির্ঝর-ঝরিত-বারি—water issuing from a fountain.  বিভব—wealth.
দম্ভোলিনিক্ষেপী—the thrower of the thunder; Indra.
পরন্তপ—the tormentor of পর or enemy.
অসহ—unbearable. শেষ—অনন্ত, বাসুকি।
শৈব—the worshipper of Siva.
তাপসেন্দ্র—the greatest of the hermits.


বীণাবাণী—having বাণী or words as sweet as the sound of a বীণা or harp.
স্বরীশ্বরী—the ঈশ্বরী or mistress of স্বর্ or Heaven.
কুঞ্জবনসখী—the companion of a grove.
বৈদেহীরঞ্জন—the রঞ্জন or lover of বৈদেহী or Sita.
শশাঙ্কধারিণী—Bearing the moon on the head.
শশাঙ্ক—Moon, having অঙ্ক or spots resembling a শশ or a hare.
শরম—Shame. জিষ্ণু—Indra.
মঞ্জুনাশিনী—the destroyer of the pride of beautiful ladies. মঞ্জু—সুন্দর; beautiful.
বৃষধ্বজ—Siva whose ধ্বজ or symbol is a বৃষ or a bull.
ভৈরর—dreadful. বসুন্ধরাধর—the Bearer of the Earth.  নিক্কণ—Sound.
ভবেশভাবিনী—Uma who thinks of Bhabesha.
বারিসংঘটিত—quite filled up with water.
নীলোৎপলাঞ্জলি—the offerings of blue lotuses.
তার—ত্রাণ কর; Save. দ্বিরদগামিনী—having a gait like that of an elephant. দ্বিরদ—is an elephant who has two রদ or tusks.
তারাকারা—Having the shape of stars.
চিররুচি—ever-beautiful.
বিকট শিখর—ভীষণ শৃঙ্গ—the Dreadful Peak. Siva practised Yoga on the Peak. Hence its name was Yogeswara.
যোগিব্রজ—the group of hermits.
ইষ্টদেব—tutelary deity. ভেটিব—shall meet.
নিমিষে—in a moment. হিয়া—Heart.
কামবধূ—The wife of Kama
ত্বিষাপতি—The Lord of light, i.e. the sun.
দূতী—messenger. আশীষি—Blessing.
সমাধি—Meditation.
পিনাকী—Siva who is armed with পিনাক; The
ঋতুপতি—Spring, the lord of the seasons.
মধুকালে—in the spring seasons.
বনস্থলী—woodland.
কুসুমকুন্তলা—adorned with flowers as her lock of hair.
রত্নসঙ্কলিত আভা—having a splendour derived from jewels.
কৌষেয়—silken; made of silk.
লাক্ষারসে—with the red dye. চিত্রিলা—painted.
রসান—paint. বিমল সলিল—transparent water.
বিকচিত—opened. রুচি—beauty.
স্মর—is Kama or Madana.
স্মরহর—is Siva the destroyer of Kama.
স্মররহর-প্রিয়া—is Parvati.
ফুলধনু—Madana armed with a bow of flowers. It is here a proper name.
কুলগ্নে—in an inauspicious hour.
বামদেব—is Siva. হানিনু—cast, threw.
বিভাবসু—the sun or the fire. Here the fire.
ভবেশ্বর-ভালে—on the brow or fore-head of Siva.
ক্ষেমঙ্করি—() Producer of good.
মথি—churning. জলনাথ—the sea.
দিতিসুত—the sons of Diti are the Daityas, and the sons of Aditi are the Adityas আদিত্য।
বিবাদিল—Quarrelled.
শ্রীপতি—The Husband of শ্রী or লক্ষ্মী, viz. Vishnu.
মন্দর আপনি—even the Mandar mountain which became the churning rod মদনদণ্ড at the time of churning the sea.
অচল—motionless.
মলম্বা-অম্বর—an অম্বর or a piece of cloth made of মলম্বা or a gold layer. মলম্বা—is a gold layer on a copper plate.
মলম্বা-অম্বর—is the disguise of a female.
তাম্র—is vishnu who is a male.
বিশুদ্ধ কাঞ্চন—is Parvati who is herself a female.
ঘন—cloud.
মলম্বা অম্বার etc.—If Vishnu who is a male appeared so beautiful, imagine how very beautiful will you who are a female will appear.
দ্বিরদরদনির্ম্মিত—made of the tusk of an elephant.
কণ্টকময় মৃণালে ফুটিল নলিনী—Durga is নলিনী, Madana behind Her is মৃণাল, His arrows are the কণ্টক।
ভৃগুমান—precipitous. ভৃগু—precipice.
গজগতি—having a gait of an elephant.
ভৈরবনিনাদী—making a dreadful thundering sound. জলকান্ত—the sea.
শান্তি সমাগমে—on the arrival of the goddess of peace i.e. on the disappearance of storms and tempests. কপর্দ্দী—Siva.
বিভূতিভূষিত—(1) adorned with ashes. (2) adorned with splendour or majesty.
বাহ্যজ্ঞানহত—destitute of the conciousness of external things; devoid of the powers of the external senses.
শম্বর—the name of a Daitya slain by Madana.
মীনধ্বজ—Madana who is carried by fish.
জটাজূট—the জূট—or cluster of জটা or matted hair. চিত্রভানু—(1) fire (2) the sun; here, the fire.
কেশরিকিশোর—the cub of a lion.
মায়াঘন আবরণ—the cover of the magical cloud.
গণেন্দ্রজননী—the mother of Ganesha.
ঈশান—Siva.
অজিন আসন—the seat made of অজিন or deer-skin. প্রফুল্লিল— bloomed.
মকরন্দ—honey. শিলীমুখ—Bee.
মলয়—is a range of mountains—the Western ghats where sandalwood is abundant.
মলয় বায়ু—a fragrant wind blowing from the Malaya Mountains; Southern wind.
কুসুম-আসার—showers of flowers.
কি আর আছেরে... ইহা হ’তে—what else is the abode that is more suitable for Manasija (Madana) than this?
কুসুমেষু—Madan whose ইষু or arrow is the flower.
লজ্জাবেশে—in the guise of bashfulness. Bashfulness is here compared to রাহু।
লজ্জাবেশে...চাঁদেরে—the Moon on the forehead of Siva was swallowed by the Rahu, bashfulness. The Moon became bashful to see Siva so much captivated with the beauty of Parvati.
হাসি ভস্মে লুকাইল দেব বিভাবসু—The fire on the forehead too smiled and hid himself in the ashes. প্রাক্তন—নিয়তি; fate.
ধন রাশি রাশি— স্বর্ণবর্ণ মেঘপুঞ্জ সুরভিরায়ু স্বরূপ নিশ্বাস ত্যাগ এবং নানাপ্রকার সুগন্ধি পুষ্পবৃষ্টি করিয়া মহাদেবকে ও মহাদেবীকে বেষ্টন করিল—Masses of golden clouds breathing the fragrant air as their breath and casting various flowers as showers of rain surrounded Siva and Sivani.
মন্দ-সমীরণপ্রিয়া—the flowers are spoken of as the wives of the soft breeze.
পঞ্চশর— Madan is so called as he has got five arrow’s. ভাস্কর-কর—the rays of the sun.
বাজী—Horse. অকম্প—firm; unmoved.
চামর—manes.
সহস্রাক্ষ—Indra is so called as he has got thousand eyes. দেউল—temple.
সৌর খরতরকরজাল-সঙ্কলিত আভাময় স্বর্ণাসন—A throne of gold bright with a splendou like that of the mass of the bright ray of the sun. সঙ্কলিত—gathered; acquired.
কৃত্তিকাকুল বল্লভসেনানী—The commander who was dear to the race of nymphs called Krittikas. Karttikeya, son of Durga was brought up by these nymphs. Hence he is said to be dear (বল্লভ) to them. Here বল্লভ does not mean “Husband”. The nymphs were the foster-mothers of Karttikeya, and he was their forster-son.
নিবাসে—lives.
আপনি কৃতান্ত—Yama himself. কৃতান্ত means literally “one by whom অন্ত or end or death is কৃত or brought about or performed.”
সুনাসীর—Indra. ফলক—shield.
বিষাকর—the mine of poison.
দিবাকর-পরিধি—The circle of the sun.
পরিধি—is circumference, but here it is the circle. ধাঁধিয়া—Dazzling.
বলি—case of address from the base বলিন্, one who has strength.
সুরদল-নিধি—the jewel of gods.
ফুলকুল-সখী—the companion of flowers.
পূর্ব্বাশা—পূর্ব্বদিক; The east.
পদ্মকর—lotus-like palm.
চিরত্রাস—The cause of ever lasting fear.
বীরেন্দ্র কেশরী—is Lakshman.
ইন্দ্রজিৎ-ত্রাস হীন করিবে—will free you from the dread of Indrajit.
লঙ্কারপঙ্কজরবি—The sun of the lotuses of Lanka. The lotuses of Lanka are the so many heroes of Lanka. Meghanada was to the heroes of Lanka as the sun is to the lotuses. As there can be no lotus without the sun, so there can be no hero in Lanka in the absence of Meghanada.
সৌমিত্রিকেশরী—the lion-like Soumitri or Lakshmana. চপলা—Lightning.
দ্বন্দ্ব যুদ্ধ কর; light. লম্ফী—Springing.
অন্তরিত-পরাক্রম—পরাক্রমী বায়ুদল তাহার অন্তরে অর্থাৎ গর্ভদেশে আবদ্ধ আছে। এজন্য অন্তরিত পরাক্রম বলা হইতেছে। অন্তরিত-পরাক্রম—Strength or power confined within. আচম্বিতে—Suddenly:
জাঙ্গাল—embankment. তুঙ্গ—high.
শৃঙ্গধর—mountain or hill.
তুঙ্গ শৃঙ্গ ধরাকারে—like high mountains.
তরঙ্গ আবলী—series of waves.
মন্দ্রে—with roars. জীমূত—cloud.
ক্ষণপ্রভা—Lightning.
তারানাথ—The Lord of stars i.e. the Moon.
উগারি—vomiting; expelling from the stomach.
প্রলয়—Destruction.
বৃষ্টিল শিলা—শিলা বৃষ্টি হইল; There was a hail storm.
রাজ আভরণ দেহে—with kingly ornaments on.
সারসন—belt. রাশিচক্র সম—like the zodiac.
সৌর কিরীট—a crown bright as the sun.
দৈববিভা—godly splendour.
হে ত্রিদিববাসি—O dweller in Heaven.
ত্রিদিব ব্যতীত...... রূপে?—ত্রিদিব ব্যতীত কোন্ দেশ এ হেন মহিমায় ও রূপে সাজে? what region other than the Heaven is adorned with such a splendour and beauty?
এ হেন মহিমা, রূপে—এ হেন মহিমায় ও রূপে; with such a splendour and beauty?
পাদ্য—water to wash পাদ or the feet.
অর্ঘ্য—an offer of green grass, rice etc. made in worshipping God or a Brahmin.
দেবপ্রতি কৃতজ্ঞতা...... সত্যসেবী সেবা—দরিদ্রপালন ও ইন্দ্রিয় দমন করিলে, সদা ধর্ম্ম পথে থাকিলে ও সর্ব্বদা সত্য দেবীর সেবা করিলেই দেবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা হইল। The protection of the poor, the control of the senses, a constant course in the path of virtue and worship of the goddess of Truth amount to gratitude to gods.
নৈবেদ্য—an ablation; an offering.
বলি—পূজোপহার—offerings made in worshipping a god.
দাতা যে যদ্যপি অসৎ—If the giver of these offerings is dishonest. কৌমুদিনী—is moonlight.
রজোময়—full of flower-dust.
কুমুদিনী—is water lily. শিবা—jackal.
শবাহারী—the eater of dead bodies.
ভীম প্রহরণধারী—armed with dreadful weapons.
বীরমদ—heroic pride.