আমি-হারা।

পরাণের অন্ধকার অরণ্য মাঝারে
আমি মোর হারাল’ কোথায়?
ভ্রমিতেছি পথে পথে, খুঁজিতেছি তারে-
ডাকিতেছি, আয়, আয়, আয়,
আর কি সে আসিবেনা হায়!
আর কিরে পাবনা’ক তায়?
হৃদয়ের অন্ধকারে গভীর অরণ্য তলে
আমি মোর হারাল’ কোথায়?
দিবস শুধায় মোরে-রজনী শুধায়,
নিতি তারা অশ্রুবারি ফেলে,
শুধায় আকুল হ’য়ে চন্দ্র সূর্য্য তারা
“কোথা তুমি, কোথা তুমি গেলে!’

আঁধার হৃদয় হতে উঠিছে উত্তর
“মোরে কোথা ফেলেছি হারায়ে!”
হৃদয়ের হায় হায় হাহাকার ধ্বনি
ভ্রমিতেছে নিশীথের বায়ে!


হায় হায়!
জীবনের তরুণ বেলায়,
কে ছিলরে হৃদয় মাঝারে,
দুলিতরে অরুণ দোলায়!
হাসি তার ললাটে ফুটিত,
হাসি তার ভাসিত নয়নে,
হাসি তার ঘুমায়ে পড়িত
সুকোমল অধর শয়নে।
হাসি-শিশু আননে তাহার
খেলাইত চপল চরণে,
রবিকর খেলায় যেমন
তটিনীর নয়নে নয়নে।
ঘুমাইলে, নন্দন-বালিকা
গেঁথে দিত স্বপন-মালিকা,
জাগরণে, নয়নে তাহার
জাগরণে, নয়নে তাহার

ছায়াময় স্বপন জাগিত;
আশা তার পাখা প্রসারিয়া
উড়ে যেত উধাও হইয়া,
চাঁদের পায়ের কাছে গিয়ে
জোস্নাময় অমৃত মাগিত।
বনে সে তুলিত শুধু ফুল,
শিশির করিত শুধু পান,
প্রভাতের পাখীটির মত
হরষে করিত শুধু গান!
কে গো সেই, কে গো হায় হায়,
জীবনের তরুণ বেলায়
খেলাইত হৃদয় মাঝারে
দুলিতরে অরুণ-দোলায়?
সচেতন অরুণ কিরণ
কে সে প্রাণে এসেছিল নামি?
সে আমার শৈশবের কুঁড়ি,
সে আমার সুকুমার আমি!


প্রতিদিন বাড়িল আঁধার,
পথ মাঝে উড়িলরে ধূলি,

হৃদয়ের অরণ্য আঁধারে
দুজনে আইনু পথ ভুলি।
নয়নে পড়িছে তার রেণু,
শাখা বাজে সুকুমার কায়,
ঘন ঘন বহিছে নিঃশ্বাস
কাঁটা বিঁধে সুকোমল পায়!
ধূলায় মলিন হ’ল দেহ,
সভয়ে মলিন হ’ল মুখ,
কেঁদে সে চাহিল মুখ পানে
দেখে মোর ফেটে গেল বুক!
কেঁদে সে কহিল মুখ চাহি,
“ওগো মোরে আনিলে কোথায়?
পা'য় পা’য় বাজিতেছে বাধা,
তরু-শাখা লাগিছে মাথায়।
চারি দিকে মলিন, আঁধার,
কিছু হেথা নাহি যে সুন্দর,
কোথা গো শিশির-মাখা ফুল,
কোথা গো প্রভাত-রবিকর?”
কেঁদে কেঁদে সাথে সে চলিল,
কহিল সে সকরুণ স্বর,

“কোথা গো শিশির-মাখা ফুল,
কোথা গো প্রভাত রবি-কর।”
প্রতিদিন বাড়িল আঁধার,
পথ হল পঙ্কিল, মলিন,
মুখে তার কথাটিও নাই,
দেহ তার হ’ল বল হীন।
অবশেষে একদিন, কেমনে, কোথায়, কবে
কিছুই যে জানিনে গো হায়,
হারাইয়া গেল সে কোথায়!


রাখ’ দেব, রাখ’ মোরে রাখ,
তোমার স্নেহেতে মোরে ঢাক’,
আজি চারিদিকে মোর এ কি অন্ধকার ঘোর,
একবার নাম ধ’রে ডাক!
পারি না যে সামালিতে, কাঁদি গো আকুল চিতে,
কত রব’ মৃত্তিকা বহিয়া?
ধূলিময় দেহ মম ধূলায় আনিছে ডাকি
ধূলায় দিতেছে ঢাকি হিয়া!
মলিন দেহের ভারে হৃদয় চলিতে নারে
হৃদয় পড়িছে ভূমে লুটি,

বিমল হৃদয় মাঝে পড়িছে দেহের ছায়া,
দেহের কলঙ্ক উঠে ফুটি।
জড়ের সহিত রণে হারিবে হৃদয় মোর?
মৃত্তিকার দাসত্ব করিবে?
এক মুষ্টি ধূলি লেগে অনন্ত হৃদয় মোর
চিরস্থায়ী কলঙ্ক ধরিবে?
হৃদে লাগে মৃত্তিকার ছাপ,
এ কি নিদারুণ অভিশাপ।


হারায়েছি আমার আমারে,
আজ আমি ভ্রমি অন্ধকারে।
কখন বা সন্ধ্যাবেলা, আমার পুরাণ’ সাথী
মুহুর্ত্তের তরে আসে প্রাণে;
চারিদিক নিরখে নয়নে।
প্রণয়ীর শ্মশানেতে একেলা বিরলে আসি
প্রণয়ী যেমন কেঁদে যায়,
নিজের সমাধি পরে নিজে বসি উপছায়া
যেমন নিঃশ্বাস ফেলে হায়,
কুম শুকায়ে গেলে, যেমন সৌরভ তার
কাছে কাছে কাঁদিয়া বেড়ায়,

মুখ ফুরাইয়া গেলে একটি মলিন হাসি
অধরে বসিয়া কেঁদে চায়,
তেমনি সে আসে প্রাণে চায় চারিদিক পানে,
কাঁদে, আর কেঁদে চলে যায়!
বলে শুধু “কি ছিল, কি হল,
সে সব কোথায় চলে গেল!”
 * * * *
বহু দিন দেখি নাই তারে,
আসে নি এ হৃদয় মাঝারে।
মনে করি মনে আনি তার সেই মুখ খানি,
ভাল করে মনে পড়িছে না,
হৃদয়ে যে ছবি ছিল, ধুলায় মলিন হল,
আর তাহা নাহি যায় চেনা!
ভুলে গেছি কি খেলা খেলিত,
ভুলে গেছি কি কথা বলিত!
যে গান গাহিত সদা, সুর তার মনে আছে,
কথা তার নাহি পড়ে মনে।
যে আশা হৃদয়ে লয়ে উড়িত সে মেঘ চেয়ে
আর তাহা পড়ে না স্মরণে!
শুধু যবে হৃদি মাঝে চাই
মনে পড়ে—কি ছিল, কি নাই!