উপহার।



অয়ি সন্ধ্যে,
অনন্ত আকাশ তলে বসি একাকিনী,
কেশ এলাইয়া,
নত করি স্নেহময় মোহময় মুখ
জগতেরে কোলেতে লইয়া,
মৃদু মৃদু ওকি কথা  কহিস আপন মনে
মৃদু মৃদু গান গেয়ে গেয়ে,
জগতের মুখ পানে চেয়ে!

প্রতিদিন শুনিয়াছি  আজো তোর ওই কথা
নারিনু বুঝিতে!
প্রতিদিন শুনিয়াছি  আজো তোর ওই গান
নারিনু শিখিতে!
চোখে শুধু লাগে ঘুমঘোর,
প্রাণ শুধু ভাবে হয় ভোর!
হৃদয়ের অতি দূর-দূর—দূরান্তরে
মিলাইয়া কণ্ঠস্বর তোর কণ্ঠস্বরে

কে জানেরে কোথাকার  উদাসী প্রবাসী যেন
তোর সাথে তােরি গান করে।
অয়ি সন্ধ্যা, তােরি যেন  স্বদেশের প্রতিবেশী
তােরি যেন আপনার ভাই,
প্রাণের প্রবাসে মাের দিশা হারাইয়া
কেঁদে কেঁদে বেড়ায় সদাই!
যখনি শুনে সে তাের স্বর
শােনে যেন স্বদেশের গান,
সহসা সুদূর হতে  অমনি সে দেয় সাড়া,
অমনি সে খুলে দেয় প্রাণ!
চারিদিকে চেয়ে দেখে—আকুল ব্যাকুল হয়ে
খুঁজিয়ে বেড়ায় যেন তােরে
ডাকে যেন তাের নাম ধরে।
যেন তার কতশত  পুরাণ সাধের স্মৃতি
জাগিয়া উঠেরে ওই গানে!
ওই তারকার মাঝে  যেন তার গৃহ ছিল,
হাসিত কাঁদিত ওই খানে!
বিজন গভীর রাতে  ওই তারকার মাঝে
বসিয়া গাহিত যেন গান,
ওই খান হতে যেন  জগতের চারিদিক

দেখিত সে মেলিয়া নয়ান!
সেই সব পড়ে বুঝি মনে,
অশ্রুবারি ঝরে দু নয়নে।
কতআশা, কত সখা,  প্রাণের প্রেয়সী তার
হােথা বুঝি ফেলে আসিয়াছে,
প্রাণ বুঝি তাহাদের কাছে
আর বার ফিরে যেতে চায়
পথ তবু খুঁজিয়া না পায়!

কত না পুরাণ’ কথা,  কত না হারান’ গান,
কত না প্রাণের দীর্ঘশ্বাস,
সরমের আধ হাসি  সােহাগের আধ বাণী
প্রণয়ের আধ মৃদু ভাষ
সন্ধ্যা, তাের ওই অন্ধকারে
হারাইয়া গেছে একেবারে!
পূর্ণ করি অন্ধকার তাের
তা’রা সবে ভাসিয়া বেড়ায়,
যুগান্তের প্রশান্ত হৃদয়ে
ভাঙ্গাচোরা জগতের প্রায়!
যবে এই নদী তীরে  বসি তোর পদতলে,

তা’রা সবে দলে দলে আসে,
প্রাণেরে ঘেরিয়া চারি পাশে;
হয়ত একটি কথা,  একটি আধেক বাণী,
চারিদিক হতে বারে বার
শ্রবণেতে পশে অনিবার।
হয়ত একটি হাসি,  একটি আধেক হাসি,
সমুখেতে ভাসিয়া বেড়ায়,
কভু ফোটে, কভুবা মিলায়!
হয়ত একটি ছায়া,  একটি মুখের ছায়া
আমার মুখের পানে চায়,
চাহিয়া নীরবে চলে যায়!
অয়ি সন্ধ্যা, স্নেহময়ী,  তোর স্বপ্নময় কোলে
তাই আমি আসি নিতি নিতি,
স্নেহের আঁচল দিয়ে  প্রাণ মাের দিস ঢেকে,
এনে দিস্ অতীতের স্মৃতি!

আজ আসিয়াছি সন্ধ্যা,-বসি তাের অন্ধকারে
মুদিয়া নয়ান,
সাধ গেছে গাহিবারে-মৃদু স্বরে শুনাবারে
দু চারিটি গান।

সে গান না শোনে কেহ যদি,
যদি তারা হারাইয়া যায়,
সন্ধ্যা, তুই সযতনে  গােপনে বিজনে অতি
ঢেকে দিস্ আঁধারের ছায়।
যেথায় পুরাণ’ গান,  যেথায় হারান’ হাসি,
যেথা আছে বিস্মৃত স্বপন,
সেই খানে সযতনে  রেখে দিস গান গুলি
রচে দিস্ সমাধি-শয়ন!
জানি সন্ধ্যা, জানি তাের স্নেহ,
গোপনে ঢাকিবি তার দেহ,
বসিয়া সমাধি পরে,  নিষ্ঠর কৌতুক ভরে
দেখিস হাসে না যেন কেহ!
ধীরে শুধু ঝরিবে শিশির,
মৃদু শ্বাস ফেলিবে সমীর।
স্তব্ধতা কপােল হাত দিয়ে
একা সেথা রহিবে বসিয়া,
মাঝে মাঝে দুয়েকটি তারা
সেথা আসি পড়িবে খসিয়া!