পাষাণী।

ঘৃণা হলাহল যদি পাই
ভালবাসা ক'রে বিনিময়,
বুক ফেটে অশ্রু পড়ে ঝরে,
বৃন্ত টুটে আশা যায় ম'রে,
তবুও তাহাও প্রাণে সয়;
যারে আমি হৃদয়েতে ধরি,
তারে আমি যাহা মনে করি
যদি দেখি সে জন তা' নয়;
দিন দিন শুভ্র জ্যোতি তার
একটু একটু যায় মিশে,
মুকুট হইতে মোতি তার,
একটি একটি পড়ে খ’সে,
শুকায়ে, টুটিয়া, ঝোরে,  সব যায় সোরে সোরে,
অবশেষে দেখিবারে পাই,— '
ভালবেসে এসেছি যাহারে
সেজন সমুখে মোর নাই!
মরীচিকা-মূর্তি সম  হৃদি মরু-স্থলে মম
প্রতিদিন তিল তিল কোরে

প্রণয়-প্রতিমা যায় সোরে;
প্রাণ মন ব্যাকুল হইয়া
পিছু পিছু যেতেছে ধাইয়া,
তৃষাতুর হরিণের মত
বহিছে অনলময় শ্বাস,
আগ্রহ-কাতর আঁখি দিয়া
ঠিকরিয়া পড়িছে হুতাশ,
সকাতর চোখের উপরে
পলে পলে তিল তিল করে
সে মূরতি মিশাইয়া যায়,
শূন্য প্রাণ কাতর নয়নে
একবার চারিদিকে চায়,
কাহারেও দেখিতে না পায়!
প্রাণ লয়ে মরীচিকা খেলা!
একি নিদারুণ খেলা হায়!

করুণার উপাসক আমি,
জগতে কি আছে তার চেয়ে!
আহা কি কোমল মুখখানি! -
আহা কি করুণ কচি মেয়ে!

উষার প্রথম হাসি-রেখা
অধরেতে মাখান তাহার,
কোমল বিমল শিশিরেতে
আঁখি দুটি ভাসে অনিবার।
জগতে যা কিছু শোভা আছে
পেয়েছে তা' করুণার কাছে!
জগতের বাতাস করুণা,
করুণা সে রবি শশিতারা,
জগতের শিশির করুণা,
জগতের বৃষ্টিবারি ধারা!
জননীর স্নেহধারা সম
এই যে জাহ্ণবী বহিতেছে,
মধুরে তটের কানে কানে
আশ্বাস-বচন কহিতেছে,—
এও সেই বিমল করুণা-
হৃদয় ঢালিয়া বোহে যায়,
জগতের তৃষা নিবারিয়া
গান গাহে করুণ ভাষায়!
কাননের ছায়া সে করুণা,
করুণা সে উষার কিরণ,

করুণা সে জননীর আঁখি,
করুণা সে প্রেমিকের মন; -
এমন যে মধুর করুণা,
এমন যে কোমল করুণা,
জগতের হৃদয়-জুড়ানো
এমন যে বিমল করুণা,
দিন দিন বুক ফেটে যায়,
দিন দিন দেখিবারে পাই-
যারে ভালবাসি প্রাণপণে
সে করুণা তার মনে নাই!
পরের নয়ন জলে  তার না হৃদয় গলে,
দুখেরে সে করে উপহাস,
দুখেরে সে করে অবিশ্বাস;
দেখিয়া হৃদয় মোর তরাসে শিহরি উঠে,
প্রেমের কোমল প্রাণে শত শত শেল ফুটে,
হৃদয় কাতর হয়ে নয়ন মুদিতে চায়,
কাঁদিয়া সে বলে “হায়! হায়,
এ ত নহে আমার দেবতা,
তবে কেন রয়েছে হেথায়?”

আমি যারে চাই, সে রমণী
করুণা-অমিয়াময় মন,
যেদিকে পড়িবে আঁখি তার
করুণা করিবে বিতরণ!
তুমি নও, সে জন ত নও,
তবে তুমি কোথা হতে এলে?
এলে যদি এস’ তবে কাছে,
এ হৃদয়ে যত অশ্রু আছে
একবার সব দিই ঢেলে,
তোমার সে কঠিন পরাণ
যদি তাহে এক তিল গলে,
কোমল হইয়া আসে মন
সিক্ত হয়ে অশ্রু জলে জলে!
কঁদিবারে শিখাই তোমায়,
পর-দুঃখে ফেলিতে নিশ্বাস,
করুণার সৌন্দর্য অতুল
ও নয়নে করে যেন বাস।
প্রতিদিন দেখিয়াছি আমি
করুণারে করেছ পীড়ন,
প্রতিদিন ওই মুখ হতে

ভেঙ্গে গেছে রূপের মোহন।
কুবলয় আঁখির মাঝারে
সৌন্দর্য্য পাইনা দেখিবারে,
হাসি তব আলোকের প্রায়,
কোমলতা নাহি যেন তায়,
তাই মন প্রতিদিন কহে,
“নহে, নহে, এ জন সে নহে।”

শোন বঁধু শোন, আমি করুণারে ভালবাসি,
সে যদি না থাকে তবে ধূলিময় রূপ রাশি।
তোমায়ে যে পূজা করি, তোমারে যে দিই ফুল,
ভালবাসি বলে যেন কখনো কোরনা ভূল!
যে জন দেবতা মোর কোথা সে আছে না জানি,
তুমিত কেবল তার পাষাণ-প্রতিমা খানি।
তোমার হৃদয় নাই, চোখে নাই অশ্রুধার,
কেবল রয়েছে তব, পাষাণ আকার তার!
তোমারে যখন পূজি কল্পনা করিয়া লই-
তোমারি মাঝারে আছে দেবী সে করুণাময়ী।
তাই এ মন্দির হতে রাখিতে পারিনে দূরে,
এখনো রয়েছ তাই হৃদয়ের সুর-পুরে,

কল্পনা মায়ের কোলে যে বালারে দেখেছিনু,
কল্পনার তুলি দিয়ে যে বালারে এঁকেছিনু,
তারি মত মুখ তব, তেমনি মধুর বাণী
থাক’ তবে থাক’ হেথা পাষাণ প্রতিমা খানি।