সময় অসময় নিঃসময়/আমাদের এই লিখনপ্রণালী

আমাদের এই লিখনপ্রণালী

 গৌরবার্থে বহুবচন রয়ে গেছে শিরোনামায়। আমাদের সর্বনামে প্রচ্ছন্ন রয়েছে অনেক বিচ্ছিন্ন কী ‘আমি’র সমাবেশ। অরণ্যে গাছের মতো পাশাপাশি, কাছাকাছি নয় তবু। ভাষাহীন নৈঃশব্দ্যে এক অপরের থেকে বিস্তৃত, সুদূর। অথচ লেখা গভীর এবং ব্যাপক সেতু হওয়ার কথা ছিল। নিজেরই ভেতরে কত অজানা চোরাবালি, কত কুশ্রী ফাটল, কত বিক্ষুব্ধ সমুদ্র, কত ঝড়ের আকাশ! লেখায় সেইসব ঝলসে ওঠার কথা। নিজেরই সময় ও পরিসরের দ্বিরালাপ থেকে লেখা জন্ম নেয়। কবিতার চিহ্নায়কে কখননা, আর কখনো বা আখ্যানের বয়নে। সমান্তরাল ভাবে বহমান একক ‘আমি’-দের আবর্ত থেকে লেখা ক্রমশ মূর্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছুতেই তবু লেখার আদল থেকে বিমূর্ত প্রবণতার ছায়া সরে যায় না। ব্যক্তিসত্তা আর সামাজিক সত্তার আততি লেখার প্রক্রিয়াকে জটিলতর করে তোলে কেবলই। লেখা আসলে এক আদ্যন্তহীন গ্রন্থনা। এর কোনো আরম্ভ নেই, কোনো সমাপ্তিও নেই। সুতরাং চিরাগত অভ্যাসে যাকে লেখকসত্তা বলে শনাক্ত করছি, তা আসলে সূত্রধারসত্তা। সুখে দুঃখে আনন্দে যন্ত্রণায় আশায় নৈরাশ্যে জীবনে মরণে—বহু ধরনের অজস্রতায় ওই সত্তা লালিত হচ্ছে অহরহ। সূত্রধারের কাজ শুধু একটাই। লেখাকে অনেকান্তিক দ্যোতনার বিচ্ছুরণে যুক্ত করে রাখা। এইটুকু নিশ্চিত করা, যেন, বিযুক্তি ঘটানোর আশঙ্কাজনক কৃৎকৌশলেও লেখার প্রক্রিয়া অবিন্যস্ত না হয়, পরাস্ত না হয়।

 লেখা মূলত আত্মখননের প্রণালী। একসময় ওই প্রণালীর শুরু হয়। তারপর কোনো-এক উপযুক্ত মুহূর্তে সূচনা হয়ে থাকে লেখার। প্রস্তুতিকে চিনতে পারি হয়তো, কিন্তু প্রস্তুতির ফসলটি উদগত হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণকে পাঁজিপুঁথির অঙ্ক কষে চেনাতে পারি না। শুধুমাত্র ওই আবশ্যিক প্রণালীকে অক্ষুন্ন রাখার জন্যে অধ্যবসায়ী হতে পারি। অথচ এই অধ্যবসায়ে ঘাটতি থেকে যায় সর্বদা। বিনা পরিশ্রমে শিরোমণি হয়ে ওঠার সাধ লালন করি বলে লেখা-লেখা খেলায় কুঁদ হয়ে থাকি। নিজের চোখে নিজেই ধুলো দিই এবং ঠুলি পরাই। কী চাই লেখায় মধ্য দিয়ে, নিজের কাছে তা স্পষ্ট হয় না কখননা। আত্মপ্রতারণার মাদক আচ্ছন্ন করে রাখে সকাল-সন্ধ্যা। পণ্যায়নের কুযুক্তিশৃঙ্খলায় বন্দী হয়ে যান সেইসব লিখিয়েরা, একদা যাঁরা বলেছিলেন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কথা, বলেছিলেন বিকল্প চেতনা বিকল্প নন্দন বিকল্প বয়নের কথা। বড়ো কিছু পাওয়ার জন্যে স্থলন ঘটে না। সাধারণত টুকিটাকি লোভ, নগদ বিদায়ের আকাঙ্ক্ষা, যূথবদ্ধতার নিরাপত্তা-এইসব এত বেশি চোখে পড়ে যে ‘দ্রষ্টা চক্ষু’র উদ্ভাসনের জন্যে দীর্ঘ প্রস্তুতি, তিতিক্ষা ও ধৈর্য সম্পর্কে অনীহা ক্রমশ প্রবলতর হয়ে ওঠে। সমকাল যদিও সমস্ত অর্জনের আধার, মনে রাখতে হয় একথাও যে বর্জ্য পদার্থও এই সমকালই উৎপাদন করে চলেছে। এ বড় সুখের সময় নয়, এ বড় আনন্দের সময় নয়—একথা লিখেছিলেন শক্তি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এও একরকম করে জানা যে এ সময় কেন্দ্রচ্যুতির, গতিহীন পরিক্রমার। যখন ‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে দেয়ালে দেয়াল কার্নিশে কার্নিশ ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে। এও একধরনের নিবিড় দেখা যে জুতো হাঁটছে। পা রয়েছে স্থির। সমস্ত কিছুকে এতোলবেলোল করে দেয় সত্তাশূন্য রিক্ত কাল, প্রতিবেদনের বয়নে অন্তর্বয়নে এর স্বীকারোক্তি থাকবেই।

 আবার, সত্য তো একান্তিক নয়। লেখা তো একবাচনিক নয় কখননা। সূত্রধার-সত্তার প্রবল শীৎকার যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি অনিবার্য সত্তার দ্রোহ ও ঘৃণায়-বিদ্রুপে-ক্ষোভে গড়ে-ওঠা বারুদ-প্রহর। তখন বাংলা পদ্যের এবং গদ্যের ধারণক্ষমতা শানিত হয়ে ওঠে আরও, সত্যের মুখখামুখি হওয়ার কৃৎকৌশল রপ্ত করে নেয় লেখা। আশপাশকে দেখে নেওয়ার জন্যে যতখানি শক্তি অর্জন করা আবশ্যিক, সে-সময় লেখায় তা জেগে ওঠে। সুবিমল মিশ্রের ভাষায়, তখন ‘নাঙা হাড় জেগে উঠছে’—এই বার্তা প্রচার করে লেখা। হয়ে ওঠে শক্তিশালী হাতুড়ির বিকল্প যা দিয়ে অচলায়তনের পাথুরে দেওয়াল ভেঙে ফেলা যায়। আলু-পটলের মতে, প্রসাধনসামগ্রীর মতো, স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো সাহিত্যকর্মকে হাটেবাজারে বিক্রি করার জন্যে চোখ-ধাঁধানোে বিজ্ঞাপনের জৌলুস তৈরি করা হচ্ছে যখন—সে-সময় তথাকথিত সাহিত্যের উল্টো মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকছে লেখা, আমাদের লিখনপ্রণালী। সুবিমল মিশ্র এই প্রণালীর চমৎকার উপস্থাপক। তিনি, সুবিমল মিশ্র, গত তিরিশ বছর ধরে প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তাশৃঙ্খলকে ভেঙে-ভেঙে ওই সাহিত্যকর্ম নামক কিংবদন্তিকে ধ্বস্ত করেছেন, স্বাধীন সূত্রধার-সত্তাকে দিয়ে প্রতাপের যাবতীয় চক্রান্ত মোকাবিলা করিয়েছেন। সমস্ত বহুত্বের দ্যোতনা জন্ম নিচ্ছে যে তীব্র বিস্ফোরক আঁতুড়ঘরে, তার নাম জীবন। আর, এই জীবনের দিকে খোলা চোখে তাকাতে-তাকাতে বিস্ময়ের, বেদনার, স্বপ্নের, আনন্দের, শৌর্যের আর শেষ নেই তার। গত তিরিশ বছর ধরে তার পরিক্রমা আসলে লেখার অবিরল প্রবাহ, পাঠকৃতির অর্থাৎ টেক্সটের বহুস্বরিক হওয়া আর হয়ে ওঠা। বিনির্মাণ আর পুনর্নির্মাণের এই যুগলবন্দিতে যতটুকু বদলে যাচ্ছে সূত্রধারসত্তা, ঠিক সেই পরিমাণে পুনর্বিন্যস্ত হচ্ছে জীবনবোধ।

 প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যে এই নবায়ন ঘটে না, ঘটতে পারে না। সেখানে মলাট পালটে যায় মুহুর্মুহু কিন্তু ভেতরের শাঁস বা শাসহীনতা একই থেকে যায়। অথবা ভেতরের ওই শাঁসাভাসে যত পচন ধরতে থাকে, বাইরের মলাটে তত জটিল রঙ আর দামি এসেন্স যুক্ত হয়। কিন্তু পচাইয়েরও একটা নিজস্ব আমোদ থাকে যা কিনা ভয়াবহভাবে সংক্রামক। ওই সাহিত্যকর্মের বিপরীতে যারা স্পন্দনময় জীবনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, পণ্যায়নের সুবিধাবাদ প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে ও পারিপার্শ্বিককে অনবরত খুঁজতে খুঁজতে লেখা’ আবিষ্কার করেছেন—এমন কি, বানপ্রস্থকালীন সত্তর পেরিয়েও তাদের, হ্যা তাদেরও, স্থলন হতে পারে। বর্ণবোধের দিনগুলি থেকে যে অজগরটি তেড়ে আসছিল—সেই অজগরের মায়াবী গ্রাসে শেষ পর্যন্ত তাদেরও পড়া অসম্ভব নয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনা-নন্দন-বয়নের পক্ষে দাঁড়ানোর কথা বলা মানে আমৃত্যু লড়াইয়ের মধ্যে থাকা। এমন লড়াই, যাতে এক মুহূর্তের জন্যেও ঢাল এবং তরোয়াল হাত থেকে নামাননা চলে না। প্রশ্ন অবশ্য তবুও থেকে যায়। খড়ের পুতুল কত আর শক্ত মুঠোয় প্রহরণ ধরতে পারে? যাকে অবয়ব বলে ভাবছি, তা যদি পুরোদস্তুর মেকি হয়ে থাকে তাহলে তার ওপর কোনো দায়ই তো চাপানো যাবে না। যার অস্তিত্ব নিছক অবভাস, তাকে ঘিরে কোনো লেখার জগৎ পল্লবিত হবে কি? কিন্তু যাকে কখনো নিশানা ফলক ভেবেছি, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণা ভেবেছি—তার সমস্ত বাচন আজ যদি আমাদের বিদ্রুপ করতে আসে, তাহলে?

 আসলে, গত দশ-বারো বছরে আত্মপরীক্ষা কঠোরতর হয়েছে, এইমাত্র। এ কেবল স্মরণীয়ের স্থলন হয়েছে বলে নয়, এইজন্যেও নয় যে আশ্রয়ের ধারণাটিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। বরং পরীক্ষা দুরূহতর হয়েছে কেননা বিকল্প চেতনার প্রস্তাবকদের মধ্যে ব্যাপক আত্মবিদূষণের দুর্লক্ষণ দ্রুত প্রকট হয়ে পড়ছে। সহযাত্রী ও সহযোগী হওয়ার বদলে আমরা এখন অসুস্থ প্রতিযোগী ও অন্তর্ঘাতকের ভূমিকায় নেমে পড়েছি। অপ্রাতিষ্ঠানিক চর্যার আঁতুড়ঘরগুলিতে প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাসের বেনোজল ঢুকে পড়ছে। ফলে বন্যায় নালা-নদী-ডোবা একাকার হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। চারদিকে কেবল ‘আমাকে দেখুন আমাকে বুঝুন’ রব। দু-তিন বছর আগে যা ফিসফিস ছিল, এখন তা কোলাহল। খরিদ্দার নাই সকলেই বেচিতে চায়’ জাতীয় অবস্থা প্রায় এসে গেছে। এ সময়, এই পরিস্থিতিতে, কাঙ্ক্ষিত লেখা কি পক্ষাঘাতগ্রস্ত কলমে আসতে পারে? যাদের ওপর ভরসা ছিল, তারা ধাপে-ধাপে পণ্য-সাহিত্যের স্রোতে মিশে যাচ্ছেন। সূত্রধার-সত্তাকে গিলে খাচ্ছে সাহিত্যিকের নির্মাণ-প্রয়াস। ততক্ষণই লেখা যতক্ষণ নিয়মের খাঁচায় জীবন বন্দী নয়। কিন্তু যখন জীবনকে ময়নার মতো দাঁড়ে বসিয়ে ছোলা খাওয়াতে চাই, তার শেখানো বুলিতে আকাশের বার্তা ফুটবে না। এই মুহূর্তে অনিশ্চয়তার তাড়না লেখার প্রক্রিয়ায় ও পরিসরে অনুভব করছি কিনা, এই হল সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন। কেননা এই তাড়না সম্ভাবনাকেই কর্ষণ করে। গত দশকের দৃঢ় নিশ্চয়তা আজকের লিখিয়েদের মধ্যে অনুপস্থিত। যাঁরা দুই বা আড়াই দশক ধরে লিখছেন, তারাও আজ থমকে দাঁড়িয়েছেন যেন। কিছুটা কি বিভ্রান্ত নাকি চলতে চলতে হঠাৎই রসদ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন তারা?

 আসলে, শুরুতে নান্দনিক ও সামাজিক ভাবাদর্শ সম্পর্কে ঝাপসা হলেও খানিকটা ধারণা ছিল তাদের। অতি দ্রুত বিকাশমান যান্ত্রিক বিশ্বের সর্বশেষ অভিঘাত তাদের গভীর সংবেদনাকে শুষে নিচ্ছে। হঠাৎই মায়াবী সব পর্দা সরে গেছে। নিজেদের বিচূর্ণিত সত্তার মুখখামুখি হয়ে তারা আসলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। গতকাল ধূসর, আগামীকাল ধূসরতর; তাই মরিয়া হয়ে অনিশ্চিত বর্তমানকে গোগ্রাসে গিলতে চাইছেন তারা। এতে যে বর্তমানই তাদের হাড়মাসমজ্জা গিলে খাচ্ছে—একথা বুঝবার মতো ধৈর্য ও অবকাশ নেই। ফলে সাহিত্যের অলংকৃত বাক আর প্রাকরণিক বিন্যাস তারা আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। লেখার মধ্য দিয়ে জীবনের পুনর্বাসন ঘটানোর ভরসায় থাকতে পারছেন না নিষ্ঠুর বর্তমানের ভয়ে। নিজেকে পাঠকৃতি ভেবে ক্রমাগত অনুশীলন করছেন—এখন এমন বৃত্তান্ত নিতান্ত দুর্লভ।

 আজ আমরা যখন লেখা নিয়ে ভাবি, অসীম রায়-কমলকুমার মজুমদার-দেবেশ রায়-সুবিমল মিশ্র-বাসুদেব দাশগুপ্ত-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-সৈকত রক্ষিত-নবারুণ ভট্টাচার্য-এর মতো আরও কয়েকটি নাম ছাড়া সমস্ত কিছুই অলংকৃত সাহিত্যের ছায়ায় নীল হতে দেখি। আরম্ভ আর পরিণতির মধ্যে এত বেশি ফারাক চোখে পড়ে যে বিচ্যুতিকেই নিয়ম বলে মনে হয়। অতিবিশাল কৃষ্ণবিবরের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেখি একদা উচ্চারিত সংকল্প, জীবন-সংলগ্নতার প্রতিজ্ঞা আর ধারাবাহিকতার উপলব্ধিকে। প্রতিমূহূর্তে নতুন হয়ে-ওঠা লেখা কদাচিৎ চোখে পড়ে আজ। বরং গোলকধাঁধার সিঁড়িগুলি ঘুরতে ঘুরতে কোনো-এক অনির্দেশ্য অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে, এমন মনে হয়। ওইসব সিঁড়ির উপর শুনতে পাই অসংখ্য ধাবমান পদশব্দ। চিহ্নায়কশূন্য রিক্ততার গোল পিণ্ড গড়াতে গড়াতে সময়ের শীকারকে কেবল প্রবল থেকে প্রবলতর করে তুলছে। প্রতিমুহূর্তে নিজেকে অনুশীলন করার জন্যে কতখানি ভাঙতে রাজি হচ্ছি? সুখ আর দুঃখ, জয় আর পরাজয়, প্রতিষ্ঠা আর বিনাশ: এজাতীয় কিছু বিভাজন করে নিয়ে নিজেদের অনুভূতিকে পিঞ্জরায়িত করে তুলছি শুধু। ভান করছি। প্রতিবেদন রচনার। কবিতার বহিরঙ্গ ধরনকে মকসসা করে প্রতীক ও সংকেতের নামে নিরপেক্ষ, ধোঁয়াটে, বাচনশূন্য শব্দসজ্জার আড়ম্বর তৈরি করছি কখননা। আর কখনো কথকতার আভাসমাত্র সম্বল করে গল্পের, উপন্যাসের কাঠামো গড়ছি। এদের কোথাও আমি নেই তুমি নেই সেও নেই। কিন্তু জবরদস্ত সাহিত্য আছে। সেই সাহিত্যের চারপাশ নিয়ে আত্মমোহ আছে, প্রদর্শনী আছে, নগদ বিদায় নিয়ে ঈর্ষা-অসূয়া-আত্মপ্রচার আছে। এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্য জুড়ে চোরাবালির প্রসার, কেবলই সাহিত্যের ঢোলবাদ্য; কিন্তু লেখা নেই কোনোখানে: এই আশঙ্কা জাগে।

 নেই, কারণ জীবনের দ্বিরালাপ অস্বীকৃত। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যেন প্রশ্ন ফুরিয়ে গেছে। নানা অজুহাতে কেবলই মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া। সাহিত্যকর্ম এখন মাঝারিমাপের মানুষজনের, সাধারণভাবে যারা জীবমৃত, একচেটিয়া ভোগদখলের বস্তু। তাই গাণিতিক হিসাব-নিকাশ নিরঙ্কুশ। শিবির ভাঙা, শিবির গড়া, শিবির পুনর্বিন্যাস:একাজে প্রায় সবাই ব্যস্ত। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে তৎপর। স্বভাবত, এইসব লীলা সাম্প্রতিক সাহিত্যক্রিয়ার অপরিহার্য অংশ। লেখা নেই, অতএব প্রতিবেদনও নেই। জীবন-নিরপেক্ষ নির্মাণে মুছে যাচ্ছে সত্য। পুঞ্জীভূত হচ্ছে শুধু আবর্জনাস্থূপ। এই স্কুপ নিরাকার, কুৎসিত। তবু যত পুষ্পবৃষ্টি এর উপর, কাগুজে ফুলের মালা চড়ানোর প্রতিযোগিতা। অন্ধেরা আজ পথ দেখাচ্ছে মূক ও বধির জনতাকে। কেন এমন হল? সত্তরের জলবিভাজন রেখা পেরিয়ে এসে যাঁরা আশি জুড়ে পুষ্পিত হয়েছিলেন, প্রাকৃতায়নের স্পন্দনে যাঁরা বিকল্প নন্দন ও বিকল্প বয়নের প্রস্তাবনা করেছিলেন—পণ্য ও বিনোদনের বিশ্বায়নকে যাঁরা নব্বইয়ের গোড়ায় গ্রাহ্য করেননি, ক্রমশ কেন সর্ষের মধ্যেও ভূত ঢুকে পড়ল? সাহিত্যের রসুইঘরে শামিল হওয়ার জন্যে ব্যগ্র উৎকণ্ঠা হঠাৎ এত সংক্রামক হয়ে উঠল কেন? লিখন-প্রণালী থেকে কেন ঝরে যেতে লাগল দ্বিরালাপ, সাহস ও প্রত্যয়! নান্দনিক ও সামাজিক ভাবাদর্শের অন্বয়সূত্র আরও বেশি মাত্রায় খোঁজার বদলে কেন সমস্ত ধরনের গতি ও ঔৎসুক্য হারিয়ে গেল অবসাদে। সামনের পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার বদলে কেন পেছনের দিকে হাঁটার কসরত শুরু হল!

 প্রথম ধাপে স্তব্ধতা, দ্বিতীয় ধাপে আত্ম-পুনরাবৃত্তি, তৃতীয় আত্মপ্রতারণা এবং চতুর্থে আত্মবিনাশ। এইসব পর্যায়ে কেবল সাহিত্যের তন্তুবয়ন, অভ্যাসের পরম্পরা চালাকি দিয়ে ঢেকে রাখার কৌশল অর্জন। জীবন থেকে আশ্চর্যকে মন্থন করতে পারে না এই প্রকরণ! পারে না, কারণ আঙ্গিক ও অন্তর্বস্তুর গ্রন্থনাকে নির্মম ভাবে ভাঙার কথা তা। দূরতম কল্পনাতেও আনতে পারে না। যা পারে তাকেই বলছি লেখা। কিন্তু সেই ঈপ্সিত লিখন প্রণালী তো ভীরু ও লোভীদের জন্যে নয়। জীবনের পরম প্রাপ্তির জন্যেই যে জীবনের শীর্ণ-ক্লিষ্ট গণ্ডিকে পেরিয়ে যেতে দ্বিধা করে না, লেখা কেবল তার জন্যে। নানা ধরনের গণ্ডি তো আগেও ছিল। গত দু-তিন বছরে কেন তবে এত বিস্তার ঘটল বদ্ধতার, অন্তঃসারশূন্যতার? বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যাওয়ার বার্তা শঙ্খ যদিও দিয়েছিলেন দুই দশক আগে, সাম্প্রতিক পর্বে এই বার্তার অন্তর্বর্তী সংকট ও তীব্র বিপন্নতা যেন আমাদের বিদ্ধ করছে। ছোট ছোট বৃত্তে আমাদের জীবনকে ভাগবাটোয়ারা করে থেমে থাকছি না, ইতিহাসের যাবতীয় মানবিক উপাদান শুষে নিয়ে ঘৃণা, বিদ্বেষ আর বিচ্ছিন্নতার পাথুরে দেওয়াল গড়ে তুলছি। অপব্যাখ্যা করছি সমস্ত কিছুর। প্রতিষ্ঠার চুড়োয় উঠার সহজ পথে যেহেতু বহুজনের পদচারণা, নিজস্ব গোষ্ঠীতে যুথপতি হওয়ার জন্যে মুখোসের শিল্পিত বিন্যাসে নিজের অক্ষমতাকে আড়াল করে নিচ্ছি। যদি শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে শেষ হত অধ্যবসায়, কথা ছিল না। হীনমন্যতা-ঘৃণা-বিদ্বেষ সম্বল করে লোককথার শেয়াল পণ্ডিতের মতো একটা কুমিরের বাচ্চাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছি। গোটা মানুষের অবয়ব কেউ চায় না; যে-সমস্ত সমস্যা এই তৃতীয় সহস্রাব্দের বিহানবেলায় কারও চিন্তার মধ্যেও নেই, তাদের কবর খুঁড়ে তুলে এনে কেবলমাত্র জাতপাত আর অস্তিত্বহীন বর্ণব্যবস্থার দোহাই দিয়ে সমাজ-পরিবেশকে কলুষিত করছি। এতে কেউ কেউ যূথপতি হতে পারছেন বটে অতি দ্রুত, কিন্তু বহুধাবিভক্ত আধা-ঔপনিবেশিক সমাজে প্রতিক্রিয়াশীল প্রতাপের তাতে পোয়াবারো। বর্ণলিঙ্গবর্গবাদী ইতিহাস থেকে প্রান্তিকায়িত জনের উচ্চারণকে যদি সমগ্রতার দ্যোতনায় পুনরাবিষ্কার করতে হয়, ঘৃণাকে যুক্তির একমাত্র আধার ও আধেয় করলে মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যাবে। বিশেষত আজকের এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের অভূতপূর্ব সন্ত্রাস যখন বিশ্বপুঁজিবাদের আধুনিকোত্তর পর্যায়কে আধা-ঔপনিবেশিক সমাজের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে—সে-সময় বর্ণবাদের পুনরুত্থান মূল লড়াইকে পিছিয়ে দেবে। নয়াবর্ণবাদী গোষ্ঠী ঘৃণাকে মৌল উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে যে-ধরনের সাহিত্যবোধকে উসকানি দিয়ে চলেছে, তাতে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের বারুদ যেমন নুলো-খোঁড়া-অন্ধ-বধিরদের মধ্যে হারিয়ে যাবে—তেমনি ভূলুণ্ঠিত হবে লেখার পতাকা।

 সন্দেহ নেই যে বিপন্ন এ সময়। নইলে মানুষের দুনিয়া কেন বল্মীকের স্তুপ হয়ে যাচ্ছে। কেন এত সংশয়ের কুয়াশা, এত গণ্ডির পরে গণ্ডি! যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ কেন চোখে দ্যাখে তারা? শুধু কেন গণ্ডির গাথারচনা আর মানুষকে নানা ছলে নানা অজুহাতে কেবলই টুকরো করে আনার আয়োজন। সাহিত্যের নামে অচলায়তন আর চক্রব্যুহ গড়ে তোলা হয়েছিল বলেই তো লেখাকে আয়ুধ হিসেবে তুলে নিয়েছিলেন সত্তার উপাসকেরা। একদিকে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের অজস্রতার দাপটে লেখার প্রক্রিয়াকে ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা এবং অন্যদিকে লেখার গ্রহীতাদের মধ্যে বিপুল বিভ্রান্তি তৈরির প্রয়াস। আয়ুধে যদি মরচে ধরিয়ে দেওয়া যায় কিংবা লক্ষ্যভ্রষ্ট করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায়—তাহলে বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতে-দেওয়া আধিপত্যবাদীদের আর পায় কে? নগদবিদায়ের লোভে যত বেশি ছোট্ট ছোট্ট বৃত্ত মেনে নিচ্ছেন লিখিয়েরা, তত বেশি লেখার তাৎপর্য মুছে যাচ্ছে। স্বপ্ন নেই, কল্পনা নেই, আত্মবিনির্মাণ। নেই। স্বপ্নশূন্য জীবনে লেখা হয় না, হতে পারে না। কারা কীভাবে স্বপ্নকে শুষে নিচ্ছে অহরহ, সেকথা যতক্ষণ বুঝতে না পারছি অন্তত ততক্ষণ জীবনের পাঠকৃতি তৈরি হবে না। আবার পাঠকৃতি মানে পাঠক। যত পাঠক তত পাঠ অর্থাৎ তত লেখার বিচিত্র বিন্যাস। এই পাঠকসত্তার উপর যদি আক্রমণ নেমে আসে, লেখাও অবধারিত ভাবে নিরালম্ব হয়ে পড়বে। একটু আগে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের দাপটের কথা লিখেছি যাতে যাবতীয় সামাজিক সময় ও পরিসর মুছে যাচ্ছে। কাঁঠালের রসে আটকে যাওয়া মাছির মততা, পিঁপড়ের মতো মানুষ আজ বিনোদনের নেশায় বন্দী। কোথাও আজ পড়ার অবকাশ নেই, তাই পাঠকসত্তাও বিকশিত হতে পারছে না।

 অথচ সম্ভাব্য পাঠকের উদ্দেশে চিরকাল লিখিয়েরা তাদের যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা নিবেদন করেছেন। সুতরাং গত দু-তিন বছরে ওই পাঠকসত্তার অস্তিত্ব যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, লেখা থেকে তত ঝরে যেতে বসেছে আলো ও গতির সম্ভাবনা। মূল লড়াই যদিও পণ্যায়ন ও বিনোদনের সঙ্গে, সেকথা ভুলে গিয়ে আত্মহননের মাদকে রপ্ত হতে চাইছেন কোনো কোনো একদা-যোদ্ধা। বানিয়ে-তোলা পাঠকের আদলে। খুঁজতে চেয়েছেন আত্মরক্ষার প্রকরণ। কিন্তু সত্যভ্রম যেমন সত্যকে আড়াল করে, তেমনি পাঠভ্রম ঝাপসা করে দেয় পাঠকসত্তাকে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাসের ফাঁদে রুদ্ধ হয়ে পড়ে লিখনপ্রণালী। বিনোদনের সঙ্গে সামান্য আপস করতে চাইলেও লেখা পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য। সন্দেহ নেই, এই মুহূর্তে দুরূহতম সংকটের মোকাবিলা করতে হচ্ছে লিখিয়েদের। সমস্ত প্রচলিত বিধিবিন্যাস ও আকরণ ভেঙে নিজের লিখনবিশ্ব নিজেরাই যদি তৈরি করতে না পারেন, তাহলে পাঠভ্রমে আত্মবিস্মৃত হওয়াই ভবিতব্য। অতএব প্রতিটি পরবর্তী মুহূর্তকে চিনে নিতে হচ্ছে পূর্ববর্তী মুহূর্তের সঙ্গে দ্বিরালাপে; বয়নে-অন্তর্বয়নে সময় ও পরিসরকে গেঁথে নিতে হচ্ছে নিরন্তর প্রশ্নের উত্থাপন করে। প্রতাপের কৃৎকৌশলকে প্রতিহত করার জন্যে যিনি নিয়ত প্রস্তুত নন—তাকে সাম্প্রতিক বারুদপ্রহরে লিখিয়ের পদবি দেওয়া যায় না।

 কিন্তু এতে কি জোরালো কূটাভাস তেরি হল না? ছোট-সেজো-মেজো-বড় প্রকাশনাসংস্থা থেকে ফিবছর গদ্যে-পদ্যে এত হরেকরকম বই বেরোচ্ছে যখন, সাহিত্যের হাটে তো পশরার বাড়বাড়ন্ত। বিচিত্র হরফে বিচিত্র বিষয় ঝলমল করছে; শহরে নগরে বইমেলায় ভিড়ও তো উপচে পড়ছে। বছর বছর পুরস্কার শিরোপা বিলি হচ্ছে। খেলার নিয়ম অনুযায়ী সাহিত্যের গ্রিনরুমে অঢেল ব্যস্ততা এখন, ফলে মূল মঞ্চে কুশীলবদের আনাগোনা যন্ত্রবৎ। সাহিত্য যেন বাজিকরের পুতুলখেলা। কেবল প্রতিযোগিতার রীতিমাফিক পোেষাক পাল্টানো আর শরীর মোচড়ানো চলছে। সংখ্যার বিচারে নির্ধারিত হচ্ছে উৎকর্ষ। বিজ্ঞাপনে-বিজ্ঞাপনে ক্রেতাদের বিভ্রান্ত করে বাজার ফুলে-ফেঁপে উঠছে। পাঠক হয়ে পড়ছেন বিমূর্তায়িত। একটি পাঠে ফুরিয়ে যাচ্ছে প্রয়োজন কেননা বিনোদনের ধর্মই এমন। তাৎক্ষণিক দাবি মেটানোর পরে তার দাম কানাকড়িও নয়। কিন্তু বাজার সচল রাখার জন্যে সর্বদা বর্তমান কালে থাকতে হয় পণ্যের যোগানদারদের। কেননা অতীত হওয়া মানে সর্বনাশ, দৃশ্যের অতীত মানে মনোেযোগের বাইরে চলে যাওয়া। ভোক্তাদের সঙ্গে চিরকাল অবিশ্বাস ও অনাস্থার সম্পর্ক যোগানদারের। দৃঢ় ভিত্তিতে সম্বন্ধ গড়ে ওঠে না বলে ডোক্তাও অনবরত বাহারে নতুন খোঁজে। যোগানে ঘাটতি হলে তার অভ্যাসে ছেদ পড়ে, তখন সে যায় অন্য চটকদার বিপণিতে। এমন পরিস্থিতিতে সাহিত্যিক হয়ে পড়েন দক্ষ ফেরিওয়ালা, নিজেকে সওদা করে বেড়ান তিনি এক হাট থেকে অন্য হাটে। স্বভাবত সেখানে টেক্সট নেই, নেই কনটেক্সট, নেই টেক্সচ্যুয়ালিটি। নেই পাঠ, নেই পাঠকসত্তা। এই যখন সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিকতা, কেনাবেচার নিয়মতন্ত্রে বাঁধা রচনাকুশলতা-পরিশীলন মানে মিথ্যার বুদ্বুদপুঞ্জ। সুতরাং নিয়মের জাল ছিড়েই কেবল জেগে উঠতে পারে জীবন-ঘনিষ্ঠ লিখনপ্রণালী। এমন লেখা চাই আমাদের যা প্রতাপের কুটিকে মেনে নেয় না, পণ্যায়ন ও বিনোদনের মাদককে যা হেলায় প্রত্যাখ্যান করে।

 কোথায় পাব তারে, সেই মনের মতো লেখাকে, যা চালাকি দিয়ে ভোলাতে চাইবে! আধুনিক কিম্বা আধুনিকোত্তর প্যাচ-পয়জার দিয়ে যা জীবনবাসনায় অন্তর্ঘাত করবে। জ্ঞানপাপীদের ভিড় যখন প্রগলভ হয়ে ওঠে, বয়ান তখন জেনে-শুনে আত্মহননের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যায়। কীভাবে এই ক্ষতিকর প্রবণতার বিরুদ্ধে গভীর প্রতিরোধ জাগিয়ে রাখা সম্ভব, তা হাতে-কলমে দেখিয়ে গেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। আপাত-বন্ধুত্বের দাবিতে যাঁরা তাঁকে ‘মধুর অবসাদের ক্লান্তি’ বা ‘নির্জনতম কবি'র খাঁচায় বন্দী করতে চেয়েছিলেন তাদের হতচকিত ও বিক্ষুব্ধ করে জীবনানন্দ ওই খাঁচা ভেঙে ফেলেছেন। সাতটি তারার তিমির’ পর্যায় থেকে নিরন্তর আত্মবিনির্মাণ করে তিনি কবিতার প্রতিবেদনকে সমস্ত সাহিত্যিক চাতুর্য ও পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত থেকে মুক্তি দিয়েছেন। বাঙালি পাঠকের জন্যে এই জরুরি সংকেত তিনি পৌছে দিয়েছেন যে লেখা প্রতিটি মুহূর্তে সজীব ও নতুন কারণ তা অনায়াসে আত্মগত অভ্যাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু জীবনানন্দ-পরবর্তী কবিদের মধ্যে সূচনার বিনির্মাণ প্রবণতা ক্রমশ পুনরাবৃত্তির চোরাবালিতে তলিয়ে গেছে। কেননা বিশেষ প্রকরণ ব্যবহার করে পাঠকদের মধ্যে গৃহীত হওয়ার পরেই অবধারিত ভাবে কবিদের মধ্যে দেখা গেছে অভ্যাস-ভাঙার অনীহা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বর্ণনার মতো বিশদ বেঁধানো সাতপাকে’ সেইসব কাব্যপ্রয়াস থেকে অগোচরে নির্বাসিত হয়েছে কবিতা। কৃত্তিবাস-পর্যায়ে তাই প্রতিশ্রুতির অভাব নেই; কিন্তু অভ্যাসের প্রাতিষ্ঠানিকতা শেষ পর্যন্ত সমস্ত কিছুকে পণ্যলোভন করে তুলেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, তারাপদ রায়দের ব্যবসায়িক সাফল্যে তারতম্য থাকলেও তাদের লিখনপ্রণালীর জ্যামিতিক ছক অনুসরণ করতে গিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে উত্তর-প্রজন্ম। উৎপলকুমার বসু, বিনয় মুজমদার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ এঁদের চেয়ে ভিন্নপথগামী যেহেতু সাহিত্যকর্ম ও জীবন্ত লেখার স্পন্দন সম্পর্কে তাদের প্রখর সচেতনতা রয়েছে। আবার কৃত্তিবাস ঘরানার ঠিক পরবর্তী পর্যায়ের কবিরা সুচিন্তিতভাবে কবিতার প্রাকরণিক ও অন্তর্বস্তুগত শৃঙ্খল ভাঙতে চাইলেন। কিন্তু শামসের আনোয়ার-ভাস্কর চক্রবর্তী-দেবারতি মিত্রদের কোনো নির্দিষ্ট ভাবকেন্দ্র ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত নেতির রিক্ততা তাদের লেখাকে গ্রাস করেছে। সত্তরের জলবিভাজন রেখা পেরিয়ে এসে কবিতার প্রতিবেদনে যাঁরা সময়ের সূক্ষ্ম ও তীব্র দ্যুতিময় অবয়ব ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন, তাঁদেরও কারো কারো রৈখিক ভাঙার আয়োজন মাঝপথে শিথিল হয়ে গেল। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, মৃদুল দাশগুপ্ত, রণজিৎ দাশ, অমিতাভ গুপ্তদের লিখনপ্রণালীতে মহানাগরিক দ্বিধা, সংশয়, আত্মদ্রোহ, প্রাকৃতায়ন অসামান্য বহুস্বরিকতার সম্ভাবনা জাগিয়েও তাই ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়েছে।

 প্রশ্ন হল, কেন? যাঁদের নাম লিখেছি এবং যাদের নাম লেখা হয়নি—এঁদের দ্বারা জীবনানন্দের আত্মবিনির্মাণ কেন ঈপ্সিত মাত্রায় গৃহীত ও ব্যাখ্যাত হল না? জনপ্রিয়তার সহজ পথ এড়িয়ে, এমন কি, প্রতিকূল পাঠ-পরিবেশ সত্ত্বেও, যিনি দুর্মূল্য ভাবমূর্তির অধিকারী হয়েছিলেন—সেই কবি কত অক্লেশে ওই ভাবমূর্তি নিজেই ভেঙে দিলেন। এর মানে আত্মপ্রতিষ্ঠানে হাতুড়ির প্রথম আঘাতটি স্বয়ং কবিকে করতে হয়। সাহিত্যের জটাজাল ভেদ করে লেখার গঙ্গা কেবলমাত্র তখনই নেমে আসে তৃষ্ণার্ত জমিতে। এরই অন্য নাম হল নিরবচ্ছিন্ন বিনির্মাণ। এই প্রক্রিয়া যখন সচল থাকে, মনের উপনিবেশীকরণ কার্যকরী প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। তৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দা হিসেবে মৃত্যুশাসিত জীবন থেকে আমাদের পাঠকৃতি আহরণ করতে হয় বলে প্রতিটি পর্যায়ে বাস্তবকে রূপক আর রূপককে বাস্তব হয়ে উঠতে দেখি। এই দেখা যার মধ্য দিয়ে জেগে ওঠে, তাকেই বলি লেখা। এই দেখাতে পাঠকের সঙ্গে লিখিয়ের মনোমৈত্রী গড়ে ওঠে। তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিকায়িত মানুষ এই মৈত্রী সংগঠনের জন্যে যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাস বিনির্মাণ করে। যিনি কবিতায় ও আখ্যানে এই প্রক্রিয়ার প্রতিবেদনকে তুলে ধরেন, তিনি আসলে সাংস্কৃতিক রাজনীতির আয়ুধ শানিত করে তোলেন। অতএব কোনো প্রচলিত বান্ধ বা উচ্চারণকে অস্বীকার করা মানে ধারণাগত অভ্যাস প্রত্যাখ্যান করে সজীব নতুনের প্রতিষ্ঠা। অজিত চৌধুরীর সাম্প্রতিক দেরিদা-ভাষ্যে তৃতীয় বিশ্বের বৌদ্ধিক দৃষ্টিকোন ব্যক্ত হয়েছে তাই: ‘deconstruction is production of meanings out of meanings by inverting the hierarchy of words/concepts within a text—its interior inaudible voice made loud.’ (১৯৯৭: ৪)। শুধু লক্ষ রাখতে হয় এইটুকু, প্রতিবেদন থেকে কোনো অজুহাতেই যেন মানুষ নির্বাসিত না হয়। সময়ের উত্তাপে কবিতার ভাষা, আখ্যানের অন্তর্বয়ন ঝলসে যেতেই পারে। নন্দনের মাত্রাবোধও রূপান্তরিত হতে পারে মুহুর্মুহু। কিন্তু তাতে লেখার সজীবতাই তো আরও তীক্ষ্ণ হওয়ার কথা; সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রকে প্রত্যাঘাত করার কথা। উল্টো ঘটনা যদি ঘটে, বুঝতে হবে, গোড়ায় গলদ রয়ে গেছে কোথাও।

 সময় অবিভাজ্য। তবু বর্তমানের সত্তাতত্ত্ব আর জ্ঞান ও প্রতাপের যুগলবন্দি ওই সময় থেকে নানা তাৎপর্য নিঙড়ে নিচ্ছে। লেখা ততক্ষণ জীবন্ত থাকে যতক্ষণ তাৎপর্য সন্ধানের জন্যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগোয়। জয় গোস্বামীর উচ্চারণে ‘আমরা যা করি ব্রহ্ম তা-ই আজ ব্রহ্ম তা-ই আজ ব্রহ্ম তা-ই’ আসলে সময়মথিত উচ্চারণ। তার ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ বা ‘ভূতুম ভগবান’-এর মধ্যে আত্মবিনির্মাণের তাগিদ প্রবল বলেই বাচনের প্রাতিষ্ঠানিকতা ভেঙে দিতে পেরেছিল ওই সংকলন দুটি। কিন্তু স্বরচিত অভ্যাসের মোহিনী মায়া অনতিক্রম্য হয়ে রইল বলে ‘আজ যদি আমাকে জিগ্যেস কর’ গেছে লেখার বিপ্রতীপে। জয়দেব বসু বা সুবোধ সরকারের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। রাহুল পুরকায়স্থ বা তরুণতর কবিদের মধ্যে কজন সাহিত্যের সর্বগ্রাসী মায়াবী ফাদ থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারছেন? কজন লিখতে পারছেন: ‘ভাঙন পিছন থাক, সম্মুখে নির্মাণ’? বাংলার বিপুল লিখনবিশ্বে শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ-রফিক আজাদ-মোহম্মদ রফিক-নির্মলেন্দু গুণদের মধ্যেও কি অভ্যাসের প্রাতিষ্ঠানিকতা তাঁদের বৈচিত্র্য ও অগ্রগতিকে স্তিমিত করে দেয়নি? খোন্দকার আশরাফ হোসেন-ফরিদ কবির-জিললুর রহমান-মাসুদ খান-তুষার গায়েন-মোস্তাক আহমেদ দীন-দের মতো আরও কিছু তরুণতর কবিদের মধ্যে যদি লেখার বিদ্যুৎচমক লক্ষ করি, তাহলে, বুঝতে হবে, এঁরা আত্মবিনির্মাণে তৎপর রয়েছেন। কথাকারদের মধ্যে কমলকুমার মজুমদার একথা সবচেয়ে ভালো জানতেন বলে ভাষাকে আক্রমণ করেই ভাষাকে বাঁচাতে চেয়েছেন। তৃতীয় বিশ্বের সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে সংগঠিত তার লিখনবিশ্ব; অতীত ও বর্তমানের প্রতিবেদনকে তাই বারবার পুনর্গঠন করেছেন তিনি। অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘খেলার প্রতিভায় বিচূর্ণিত হয়েছে সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক আয়তন, দ্যুতিমান হয়ে উঠেছে লেখার আকাশ ও জমি।

 পণ্যসাহিত্যের উদ্ধত সন্ত্রাসকে যাঁরা হেলায় তুচ্ছ করেছেন, তাঁরাই বাচনিক সংস্কারের ঘেরাটোপ ভেঙে হয়ে উঠেছেন প্রতিস্রোতপন্থী। হয়তো তৃতীয় বিশ্বের সাংস্কৃতিক রাজনীতি তাদের বিনির্মাণে সর্বদা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। তবু প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের বিপরীত মেরু আবিষ্কার করার চেষ্টা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, অমিয়ভূষণ মজুমদার, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, অসীম রায়, সুবিমল মিশ্র, রমানাথ রায়, সুবিমল বসাক, দেবেশ রায়, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সৈকত রক্ষিত, নবারুণ ভট্টাচার্য, রবিশংকর বল, কাজল শাহনেওয়াজ—এইসব নাম প্রমাণ করে যে সাহিত্যের কোলাহলমুখর হাটের একচেটিয়া আধিপত্য সত্ত্বেও এবং প্রতিস্রোতের মধ্যে নানা দুর্বলতা এবং স্ববিরোধিতা-কূটাভাস থাকলেও লেখা জীবন্ত আছে, জীবন্ত থাকবেও। এর কারণ,প্রতাপের দ্রুকুটি দিয়ে সাহিত্য নামক অচলায়তন যখন পরাজিত ও টুকরো মানুষের সমাবেশকে নিরঙ্কুশ করে তুলছে—সে-সময় লেখা বয়ে যাচ্ছে নতুন খাতে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভাত নেই পাথর রয়েছে’ সংকলনে ‘সময় হয়েছে’ কবিতাটি ওই নতুন খাতের সংকেতে ঋদ্ধ। কবি সেখানে লিখছেন:

‘সুন্দরের হাত পড়ে অগ্নি ও সমিধে
তার সবই চাই
সে হাত বাড়ায় চারিদিকে
লোপ অগ্নির মতো সে হাত বাড়ায় চারিদিকে
হাতে ও জিহ্বায় চায় বাগানের ফুল
গভীর, বিষন্ন, কালো-মানুষের ফুল
সমস্ত, সমস্ত, সব!’

 এই ব্যাখ্যাতীত বাচন (যেমন:‘সমস্ত, সমস্ত, সব’) অশ্মীভূত সাহিত্যে সম্ভব নয়, রক্তপ্রবাহে স্পন্দিত লেখায় সম্ভব। দৃষ্টান্ত আরও অনেক তুলে ধরা যায়। তবে শক্তির উদাহরণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ; কারণ, আলো ও ছায়া, গতি ও স্থিতির দ্বন্দ্বে আকীর্ণতার কবিসত্তা। যখনই প্রাতিষ্ঠানিক রচনা-অভ্যাসে তিনি পিছলে পড়েছেন, পুনরাবৃত্তির চোরাবালি তাকে গ্রাস করেছে। কবিত্বের শশাচনীয় অবসাদ শক্তিকে আক্রমণ করেনি কেবল, তার সমসাময়িক ও পরবর্তী কবিদের ধারাবাহিকভাবে সংক্রামিত করেছে। প্রতিষ্ঠানের বিষবীজাণু সাফল্যের ডেলিরিয়ামে তাদের আচ্ছন্ন করেছে যত, ততই তারা লেখার সজীবতা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে উঠেছেন। ফলে অন্ধের দ্বারা নীয়মান অন্ধের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে কেবলই। কৃত্তিবাস-পরবর্তী কবিদের মধ্যে ভাস্কর চক্রবর্তী আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। যতক্ষণ দ্রষ্টা চক্ষুর অবিরল উন্মোচন, ততক্ষণই কবিতার শিল্পসংবিদ অক্ষুন্ন। যে-মুহূর্তে নিজস্ব বান্ধের মায়ায় নিজেই মুগ্ধ হতে শুরু করেছেন, লেখায় ফুটে উঠেছে অবসাদের চিহ্ন। ’রাস্তায় আবার’ সংকলনে ‘হে জীবন’ কবিতায় ভাস্কর যেন বুঝিয়ে দিয়েছেন, কত সাবলীলভাবে জন্ম নেয় লেখা:

‘ছুঁয়ে যাই দগ্ধ বাড়িগুলো
ছুঁয়ে যাই মানুষের মুখ
ছুঁয়ে যাই শান্ত ঘণ্টাধ্বনি
ছুঁয়ে যাই সহস্র অসুখ।
... ... ...
ছুঁয়ে যাই তোমার দুচোখ
ছুঁয়ে যাই হারমোনিয়াম
ছুঁয়ে যাই ব্যর্থ এ জীবন
হে জীবন তোমাকে প্রণাম!’

 তবে, সময়ের লেখা ও সাহিত্যের টানাপোড়েন এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানের কাছে লিখিয়ের আত্মসমর্পণে সাহিত্যিকের কিংবদন্তিতুল্য উত্থান সবচেয়ে ভালো ধরা পড়েছে জয় গোস্বামীর মধ্যে। এমন সম্ভাবনা যেমন বিরল ছিল, তেমনি এমন বিপুল অপচয়ও দেখা যায় না। বহু স্মরণীয় লেখার উদগাতা হয়েও জয়, নিজেরই কবিতার ভাষায়, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতাপের সংঘে ‘দুগ্ধপোষ্য’ সাহিত্যিকে পরিণত হয়েছেন। তার সাম্প্রতিক রচনাপুঞ্জ অপচয়ের অভ্রান্ত দৃষ্টান্ত। অথচ ‘উন্মাদের পাঠক্রম’-এর ‘সৎকার গাথা’র মতো অসামান্য লেখা জয়ের কাছেই পেয়েছি আমরা:

‘আমরা সেদিন আগুনের নদী থেকে
তুলে আনলাম মা-র ভেসে যাওয়া দেহ
সারা গা জ্বলছে বোন তোর মনে আছে
প্রতিবেশীদের চোখে ছিল সন্দেহ?

দীর্ঘ চক্ষু, রোঁয়া-ওঠা ঘাড় তুলে
এগিয়ে এসেছে অভিজ্ঞ মোড়লেরা
বলেছে—‘এ সভা বিধান দিচ্ছে, শোনো—
দাহ করবার অধিকারী নয় এরা।’

সেই রাত্রেই পালিয়েছি গ্রাম ছেড়ে
কাঁধ মা-র দেহ, উপরে জ্বলছে চাঁদ
পথে পড়েছিল বিষাক্ত জলাভূমি
পথে পড়েছিল চুন লবণের খাদ

আমার আঙুল খসে গেছে, তোর বুক
শুকিয়ে গিয়েছে তীব্র চুনের ঝাঁঝে
আহার ছিল না, শৌচ ছিল না কারো
আমরা ছিলাম শববাহনের কাজে

পূর্বদিকে সাদা করােটি রঙের আলাে
পিছনে নামছে সন্ধ্যার মতাে ঘাের
পৃথিবীর শেষ শ্মশানের মাঝখানে
বসে আছি শুধু দুই মৃতদেহ চোর’

 পাঠকের দুর্ভাগ্য, জয় এখন সর্বার্থসাধক সাহিত্যিক হওয়ার জন্যে পণ্যায়নের বিধিবিধান মেনে নিয়েছেন।

 বস্তুত ঠগ বাছতে গেলে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। ভারতীয় উপমহাদেশ যখন তার সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক পিছুটান ও আধা-ঔপনিবেশিক প্রাপ্তির লােভ নিয়ে পুঁজিবাদী রূপান্তরের গন্তব্যহীন যাত্রায় প্ররােচিত হচ্ছে—বাঙালি লিখিয়েদের কাছে অপ্রতিরােধ্য হয়ে উঠেছে প্রতাপের স্নেহধন্য হওয়ার বাসনা। ‘পাখিতীর্থদিনে’ সংকলনে গ্রথিত ‘মানুষ’ কবিতায় মাসুদ এই বাস্তবের প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন এভাবে:

‘প্রভুর সর্বশেষ মুখভঙ্গি
নিরিবিলি উঞ্ছজীবিকার স্মৃতি।
খুব ম্রিয়মান হয়ে ধরা দেয় প্রভুর দূরনিয়ন্ত্রণী সংকেত
এখন এতােটা দূরেও প্রাক্তন।’

 স্বাধীন অস্তিত্ববিহীন মানুষ কবির কাছে প্রতিভাত হয় প্রাণিশূন্য নদীচরে নির্বাসিত একটি বেড়াল। কালাে ও নিঃসঙ্গ’ হিসেবে। দূরনিয়ন্ত্রণী সংকেতে তার যাবতীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নির্ধারিত হচ্ছে। সুতরাং আজকের লেখা এই নয়া-ঔপনিবেশিক বিপন্নতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায় গ্রহণ না করে পারে না। রণজিৎ দাশ, মৃদুল দাশগুপ্তের লেখা এই দায়িত্ব বহন করে বলে সাহিত্যিক অভ্যাস ও আকরণকে সার্থক প্রতিস্পর্ধা জানাতে পারছে। পাঠকের কাছে পৌছে দিচ্ছে অজেয় চেতনা ও বিকল্প গ্রন্থনার সংকেত। মাসুদ খানের ‘টানেল’ কবিতায়ও তেমনি সংকেত পাই যা কিনা লেখার গৌরব সম্পর্কে নতুন ভাবে আমাদের অবহিত করে তােলে:

‘টানেল যে হল বিকল্প মৃত্যুর
হারানাে মানুষ টানেল লুকিয়ে ফেলে;
ঈশ্বর নেবে গণিতের আশ্রয়
সবাই ফিরেছে, ফেরেনি একটি ছেলে।

টানেল জানে না এসব কাহিনী হাবা
বােঝে না যে গতি, রক্তের চলাচল
শুনছাে টানেল, ভূতলপৃষ্ঠে জাগে
লুপ্ত মানুষ খুঁজবার কোলাহল।

মৃত্যুতে নয়, টানেলে ঢুকবে এক
স্মরণকালের বিব্রত মৌমাছি

আগুন অসুখ দুই হাতে সব খায়
পাক থেকে ওঠা, ক্ষিপ্ত সব্যসাচী।’

 এই যে ‘লুপ্ত মানুষ খুঁজবার কোলাহল’, তা প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যে নেই; মৃত্যু থেকে জীবনে পৌঁছানোর জন্যে কোনো গোপন সুড়ঙ্গপথ আবিষ্কার করার তাগিদও তার থাকে না। এই পথের পাথেয় সংগ্রহ করে শুধুমাত্র লেখা।

 এই নিবন্ধের সূচনায় আত্মদ্রোহের প্রদর্শনীতে কণ্টকিত বাংলা সাহিত্য জুড়ে লক্ষ করেছিলাম চোরাবালির প্রসার আর ঢোলবাদ্যের কসরত। আশঙ্কা জেগেছিল, লেখা হয়তো নেই কোনোখানে। কেননা প্রাতিষ্ঠানিক ঔদ্ধত্য সত্য উৎপাদন করে না কেবল, ভালো-মন্দ সার্থক-ব্যর্থ প্রচারযোগ্য-হননযোগ্য ইত্যাদি লেবেলও এঁটে দেয়। কিন্তু এই স্বৈরতন্ত্রী পীড়ন যদি শেষ সত্য হয়, পূর্ববর্ত্ত অনুচ্ছেদের বক্তব্যকে ফাপা আশাবাদ ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। কিন্তু তা তো নয়। সমান্তরাল অপর হিসেবে লেখার অস্তিত্ব ছিল, আছে এবং থাকবে। কেননা পীড়ন যেখানে বেশি তীব্র, প্রতিরোধও সেখানে তত অনিবার্যভাবে উপস্থিত। এমন যদি না হত, ‘মানুষ’ কথাটা চিরদিনের মতো অর্থহীন হয়ে পড়ত। তবে, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে লেখাকে কেবল সারস্বত আকাঙ্ক্ষা বা বৌদ্ধিক চর্যা হয়ে থাকলে চলবে না। আক্রমণ যখন সার্বিক, প্রতিরক্ষা ও প্রত্যাঘাতকে একই ভাবে সার্বিক হতে হচ্ছে। কোনো আভিজাত্য অর্জনের জন্যে নয়, লেখাকে প্রস্তুত হতে হচ্ছে অসম যুদ্ধে নেমে পড়ার জন্যে। চক্রব্যুহে অভিমন্যু যতখানি একাকী ছিল, তার চেয়ে বেশি নিঃসঙ্গ আজকের লিখিয়ে-যোদ্ধা। কারণ, ভাষা-প্রকরণ ভাষা-চরিত্র ভাষা-অনুষঙ্গ—সব কিছুকে সন্দেহ করে, পরখ করে, অন্তর্ঘাত করে সমাপ্তিবিহীন সম্ভাবনার উপকূল খুঁজে চলেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে সুবিমল মিশ্র ‘সত্য উৎপাদিত হয়’-এর প্রতিবেদনে (১৯৯৭: ২১) খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন: ‘গেরিলা শব্দ প্রয়োগ একজন লেখক-কর্মীকে প্রলেতারিয়েত করে তোলে এবং অবশ্যই পরিমাণগত ভাবে, ইনটেলেকচুয়াল আভিজাত্যের বিলোপ সাধন করে। কেননা সে মনে করে হিংসা, অপরাধ ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এসব আসলে এখনকার এই পৃথিবীতে শান্তি শৃংখলা এবং স্বাভাবিকতার সমার্থক শব্দ। আস্তে আস্তে সে এইভাবে ফাস করে দিতে তাকে এই সভ্যতার লগ্নি ও সঞ্চয়ের লুকানো খেলাগুলি, আপাতভাবে...’!

 লেখা তাহলে গেরিলাযুদ্ধ। হ্যাঁ, নিশ্চয় তাই। কারণ, স্থিতাবস্থার শৃঙ্খলকে পোক্ত করার যাবতীয় আয়োজন যখন করতে থাকে সাহিত্যের ছদ্মবেশে আবৃত উৎপীড়ক প্রাতিষ্ঠানিকতা, তখন অবক্ষয় ও বিকারের বিপক্ষে স্পষ্ট দাঁড়াতে পারাই মনুষ্যত্বের অভিজ্ঞান। কোনো সংশয় নেই যে ভয়াবহ ও নির্লজ্জ এই ‘বাণিজ্যযুগে ভাষার রহস্যময়তাও পণ্য আর পণ্যধর্মিতায় আর যাই থাক, কোনো রহস্য থাকে না’। অতএব কবিতায়, আখ্যানে বাণিজ্যিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মানে সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে আধিপত্যবাদীদের চক্রান্ত প্রত্যাখ্যান করা। ভেড়ার পালের মতো ভিড়ে মিশে না গিয়ে মেরুদণ্ডী প্রাণী হিসেবে মিথ্যা ও প্রতারণার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। এর নাম লেখা, এর নাম তাৎপর্যের জন্যে যুদ্ধ।