সময় অসময় নিঃসময়/নির্বাসিত বাংলার টুটোফাটা দর্পণ
নির্বাসিত বাংলার টুটোফাটা দর্পণ
‘মমতাবিহীন কালস্রোতে/বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে/নির্বাসিতা তুমি/সুন্দরী শ্রীভূমি’—একথা লিখেছিলেন সেই মানুষটি, বাংলা-সংক্রান্ত কোনো কিছু লিখতে গেলে যিনি অবধারিত ভাবে চলে আসেন কলমের ডগায়। তো, রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পূর্ববঙ্গ থেকে ঔপনিবেশিক চক্রান্তে বিচ্ছিন্ন শ্রীহট্ট বা সিলেটের কথা লিখেছিলেন। উনিশ শতকে আসামের সঙ্গে তাকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। আর ১৯৪৭-এর গণভোটের প্রহসনে আসাম থেকে সরে গিয়ে তা চলে গেল সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে। এখনকার বাংলাদেশ। কিন্তু উনিশ ও বিশ শতক ধরে সিলেট-সংলগ্ন কাছাড় জেলা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে হয়ে রইল বঙ্গীয় সংস্কৃতির পূর্বপ্রান্তিক শেষ জনপদ। মূল স্রোত থেকে সরে থাকার ফলে এখানে জন্ম নিয়েছে বদ্ধ জলরাশির অনিবার্য বিচ্ছিন্নতা ও সংকীর্ণতা, সকারণ ও অকারণ অভিমান, আপেক্ষিক স্বাতন্ত্রবোধ ও সীমাবদ্ধ পরিসরে বিচরণের অভ্যাস, আত্মতুষ্টি ও উদ্যমহীনতা। তার ওপর এখানকার মানুষদের সাংস্কৃতিক ও ভাষিক অভিজ্ঞান মুছে ফেলার জন্যে চক্রান্তে লিপ্ত আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদ। রাজধানী দিসপুরে যে-শাসকই থাকুক, বরাক উপত্যকার দুখিনী বর্ণমালা তাদের চক্ষুশূল। ছলে-বলে-কৌশলে অসমিয়াকরণ প্রক্রিয়া চাপিয়ে দেওয়াতে এরা বদ্ধপরিকর। বরাক উপত্যকার আধা-ঔপনিবেশিক অবস্থান ঘুচল না তাই।
আসলে বরাকের প্রান্তিক বাঙালিদের জন্যে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। আর্যাবর্তের মৌলবাদী রাজনীতি হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের নীতি নিয়ে নিকৃষ্ট না-সংস্কৃতির নোংরা এঁদো ডোবার জল গিলিয়ে দিচ্ছে অহরহ। ১৯৬১ সালের ১৯ মে এগারো শহিদ প্রাণ দিয়েছিল বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে। ১৯৭২-এর আরও একজন আর ১৯৮৬তে দুজন শহিদ হল। নিরবচ্ছিন্ন ভাষা-সংগ্রামের এই ভূমিতে অসমিয়াকরণ আর হিন্দিকরণ এখনও নির্বাধ। উপত্যকার তিনটি উচ্চতম শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান জন্ম নিয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের পরে। আসাম (অসম নয়) নামক প্রদেশের উপনিবেশ এই বরাক উপত্যকায় সমস্ত সংখ্যালঘু মানুষের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও শৈক্ষিক অস্তিত্ব রক্ষার অধিকার যে স্বতঃসিদ্ধ, এই বোধ শানিত করবে এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—এটাই ছিল কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু যার শিল তার নোড়া তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া’ নীতিতে কম -বেশি তিনটে প্রতিষ্ঠানেই বাঙালি সত্তা ও বাংলা ভাষার মর্যাদা অটুট রাখার জন্যে সংগ্রাম করতে হচ্ছে আজও-ইতিহাসের এ এক নিষ্ঠুর কৌতুক। আরও একটি বিচিত্র সমস্যা আছে বরাক উপত্যকার বাঙালিদের জন্য। পশ্চিমবাংলায় এবং বাংলাদেশে এখনও অনেকে জানেন না এবং জানবার জন্যে কোনও আগ্রহ দেখান না, যে, আসামের বরাক উপত্যকা ভাষাশহিদদের পবিত্র ভূমি। আর, রাজনৈতিক ইতিহাসের চক্রান্তে মূল বঙ্গভূমি থেকে বহিষ্কৃত ও দূরবর্তী হলেও এবং যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সিলেটি উপভাষা ব্যবহৃত হলেও, এরা শতকরা একশ’ ভাগ বাঙালি। নোয়াখালি-চট্টগ্রামের উপভাষা সবাই যেমন বুঝতে পারেন না (তেমনি বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার উপভাষাও), সিলেটিও তা-ই। কিন্তু উপভাষার এত বিপুল সমৃদ্ধি বাংলা ভাষারই গৌরব: এই মৌলিক কথা কলকাতার মহানাগরিক গ্রাম্যতায় বন্দী অনেক বাঙালি আজও অনুধাবন করেন না।
এক অদ্ভূত লড়াই আছে বরাক উপত্যকার বাঙালিদের জন্যে। সিলেটি উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক প্রভাবে মান্য চলিত ভাষা উচ্চারণে বেশ কিছুটা বৈচিত্র্য এসে যায়। অভিজ্ঞ কানে কিন্তু বীরভূম-কোচবিহার-মালদহ কিম্বা খুলনা-পাবনা-রংপুরের উচ্চারণগত বৈশিষ্ট্য ঠিক ধরা পড়ে। এইজন্যে অন্যান্য অঞ্চলের বাঙালিদের যদি আত্ম-পরিচয় ঝাপসা না হয় তাহলে এখানকার মানুষদের কেন ‘বাঙালি’ বলে নিজেদের প্রমাণ করতে হবে? এই প্রমাণ অন্য কোথাও পেশ করতে হয় না, কলকাতার কূপমণ্ডুক সাংস্কৃতির মনসবদারদের কাছে করতে হয়। এ যে কত বড়ো অপমান ও বেদনার বিষয়, তা শুধু বরাক উপত্যকার বাঙালিরাই বোঝেন। অথচ কলকাতার কাছে বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্ব তো পড়ে-পাওয়া চোদ্দ আনা মাত্র। ঘরে-বাইরে আক্রান্ত বাংলা ও বাঙালির জন্যে সামান্য সচেতনতাও কোথাও আছে বলে মনে হয় না। বস্তুত এই মুহূর্তে সাহিত্য ও সংস্কৃতির পতাকা যাঁদের শক্ত মুঠোয় ধরা রয়েছে, তারা কেউ প্রতিষ্ঠানের সেবাদাস নন। কিন্তু সে-কথা এখানে নয়। কোন বেদনায়-অভিমানে-ক্ষোভে বরাকের বাঙালি কবি দিলীপ কান্তি লস্করকে লিখতে হয় এরকম, বরং সেদিকে লক্ষ করা যাক:
‘আমি কোথেকে এসেছি, তার জবাবে যখন বললাম:
করিমগঞ্জ, আসাম;
তিনি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেন: বাঃ বেশ সুন্দর
বাংলা বলছেন তো!
একজন শিক্ষিত তথা সাহিত্যিকের যখন এই ধারণা, তখন
আমি আর কী বলতে পারি।
ওঁকে ঠিক জায়গাটা ধরিয়ে দিতে গিয়ে বললাম:
বাংলা ভাষার তেরো শহিদের ভূমিতে আমার বাস।
তখন তিনি একেবারে আক্ষরিক অর্থেই আমাকে ভির্মি
খাইয়ে দিয়ে বললেন:
ও! বাংলাদেশ? তাই বলুন।
সম্প্রতি ‘দেশে’ সুনন্দ সান্যাল, তার মাতৃভাষা বিজ্ঞানের প্রবন্ধে বললেন:
‘আমাদের বহুভাষী দেশে রক্তমূল্যে মাতৃভাষা চেনার
ঘটনা ঘটেনি।’
পুরো বয়ান উদ্ধৃত করলাম। আশা করি এটা সবাই অনুধাবন করবেন যে, সাধারণ নির্মিতির অনেক বাইরে এর অবস্থান। আসলে এটা নির্মিতিই নয়, প্রত্যক্ষ অনুভূতির রক্তক্ষরণ থেকে সরাসরি উঠে-আসা আত্মভাষা। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির স্বনির্ধারিত অভিভাবকেরা যাকে, এমন কী পশ্চাৎভূমি বলেও, চেনেন না—সেই বরাক উপত্যকার বাঙালিরা মাতৃভাষার জন্যে রক্ত ঝরানোর পরেও ‘বেশি-বাঙালিদের কাছে বাঙালি হিসেবেই গৃহীত হন না! ইংরেজি ভাষায় লণ্ডনের কনি বুলি কিংবা অস্ট্রেলীয় বাচন অথবা ইয়াংকি বুলি নিয়ে কিন্তু সংশয় হয় না কারও। চীনা বা স্পেনীয় ভাষাতেও অজস্র বৈচিত্র্য স্বীকৃত। তাহলে বাংলার উপভাষাগত সমৃদ্ধিকে কেন্দ্রীয় অবস্থানের অহংকারে কেন অবহেলা ও তাচ্ছিল্য করা হয়? এই একই ঔদ্ধত্য থেকে কলকাতায় প্রাতিষ্ঠানিক পণ্য-সাহিত্যের বৃত্তে রচিত সাহিত্যকে সপ্রতিভ প্রচার-কুশলতা দিয়ে একমাত্র মান্য সাহিত্যসৃষ্টির শিরোপা দেওয়া হয়।
বাঁকুড়-পুরুলিয়ায় কিংবা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, ত্রিপুরায়, আসামের গৌহাটিতে ও বরাক উপত্যকায়, বিহারে এবং অবশ্যই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট পত্রিকার মধ্যে যাদের পাচ্ছি, তারা তাহলে কী? শুধু কী এই সান্ত্বনা পাওয়ার জন্যে লেখা-লেখা খেলায় মগ্ন তারা যে ‘they also serve who only stand and wait’! তাদের উদ্দেশে কলকাতা ও ঢাকার মহানাগরিক সাহিত্য-ব্যবসায়ীরা মাঝে-মাঝে প্রশংসার সিকি-আধুলি ছুঁড়ে দেবেন কিংবা পিঠ চাপড়ে দেবেন—এইজন্যে লেখেন মফঃস্বল’-এর কৃপাপ্রার্থী লেখকেরা? বরং তথাকথিত দূরপরিধির বাসিন্দা যারা, প্রতিষ্ঠান-পুষ্ট কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক প্রশ্রয়লোভী অভ্যাস-জর্জরিত ‘সাহিত্য’-এর চক্রব্যুহ থেকে বাইরে, তাদের ছোট পত্রিকার ওষধিমালা থেকে উৎসারিত লেখা’য় পাই জীবনের কথকতা। প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের নামে এঁরা মিথ্যার বেসাতি করেন না, কৃত্রিম চাকচিক্য দিয়ে চালাকি ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন না, ফাঁপা ইমারত গড়ে নিয়ে কেনাবেচার বাজার তৈরি করেন না, প্রতিজীবন ও প্রতিবাস্তবের বেপরোয়া নির্লজ্জ সমাবেশ তৈরি করেন না। বরং দূর ‘মফঃস্বল’-এর লেখায়, লোকায়ত পেশি ও লাবণ্য আর উপভাষার খর চলিষ্ণুতা ও সূক্ষ্ম কৌনিকতা নিয়ে, জীবনের যে-সব আশ্চর্য অনাবিষ্কৃত আয়তন উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে—সে-বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠুন নিবিষ্ট পড়ুয়ারা।
একুশ শতকের সূচনাপর্বে বরং অপর পরিসরের লিখন-যোদ্ধারা একটি নতুন পর্যায় ও পদ্ধতির সূত্রপাত করুন। প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্রিকতার বাইরে, কলকাতার উদ্ধত নাগরিক গ্রাম্যতার সংক্রমণ থেকে মুক্ত, যে-সব ছোট পত্রিকা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রচার-যন্ত্রের অভাবে একে অন্যের কাছে অপরিচিত—তারা সবাই নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে সমাবেশ করুক। সুচিন্তিত কর্মসূচির ভিত্তিতে পরস্পরের কাছাকাছি এসে সমস্ত সহযাত্রীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের ব্যবস্থা করুক। এই পারস্পরিক জানা-শোনা সংহত হয়ে উঠলে, রণকৌশলগত কারণে কলকাতায় মিলিত হোন লিখন-যোদ্ধারা। অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনা-বিশ্বাস-ভাবাদর্শ এইসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাঁদেরই সুপরীক্ষিত হবে, তারাই বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত জীবনঘনিষ্ঠ ও চিরসজীব ধারা প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে এগিয়ে যেতে পারবেন। হ্যাঁ, এটা যুদ্ধই, যদিও অসম যুদ্ধ। একদিকে সর্বগ্রাসী বিদূষণের স্নায়ুকেন্দ্র ও প্রসারণশীল পরিধি নির্মাতা বৃহৎ পুঁজি এবং তার আন্তর্জাতিক মোড়লপ্রভুর জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে ব্যাপ্ত মগজ-ধোলাইয়ের ব্যবস্থা, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক রাজনীতির বহুস্বরিক বিচ্ছুরণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল লিখনযোদ্ধারা। যুদ্ধটা কঠিন, সত্যিই কঠিন। কারণ, ওই যোদ্ধাদের মধ্যেও কেউ কেউ লোভ ও অবসাদের হাতছানিতে কিংবা নান্দনিক ও সামাজিক ভাবাদর্শের ভিত্তিগত শৈথিল্যে যুদ্ধ আরম্ভ করেও শেষ রক্ষা করতে পারেন না। পিছিয়ে পড়তে-পড়তে একসময় চলাটা-ই থামিয়ে দেন। নয়তো শিবির পালটে ভিড়ের দৃশ্যে ঢুকে পড়েন। ফলে যাদের মশালচি হওয়ার কথা ছিল,তারা স্থিতাবস্থাপন্থীদের ঢোল-শোহরতে মৃদঙ্গবাদক হয়ে পড়ে।
বরাক উপত্যকার লিখিয়েদের যুদ্ধ আরও একটু কঠিন এইজন্যে, যে, প্রাক্-আধুনিক। ও অবক্ষয়ী আধুনিক, সামন্তবাদ ও মুৎসুদ্দি পুঁজিতন্ত্র এখানে সহাবস্থান করে। ফলে স্ববিরোধিতা ও অনন্বয় এখানকার মূলত মধ্যস্বত্বভোগী সমাজে এবং ব্যক্তি-অস্তিত্বে সবচেয়ে প্রবল। এই সব কিছুর মোকাবিলা করে প্রতিকূল পরিবেশে লেখার স্থাপত্য গড়ে তুলতে হয়। ছোট পত্রিকার সলতে যত পোড়ে, আগুন তত জ্বলে না। এক দশকের অনেক আগেই দল ভেঙে যায় এখানে। সাম্প্রতিক সময়-স্বভাব সম্পর্কে অন্ধতা যাতে সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে, মৌলবাদ ও আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদ সেই চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখে না। আধা-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে জীবিকার ক্ষেত্রগুলি ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। এই সমাজ থেকে উঠে-আসা লিখিয়েদের এমন আত্মক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় যে তারা চাইলেও সব-সময়ের-লিখিয়ে হতে পারেন না। অথচ আংশিক সময়ের লিখিয়ে হয়ে থাকায় ঈপ্সিত মাত্রায় যুদ্ধে যোগও দিতে পারেন না। অনতিক্রম্য এই কূটাভাস থেকে মুক্ত হতে-না-পেরে কেউ কেউ বহু হাত-ফেরতা ছদ্ম-আধুনিকতার রঙিন মুখোশ পরে নেন। অন্য অঞ্চলের লিখন-যোদ্ধাদের এত জটিলতার মুখোমুখি হতে হয় কি? তবু এখানে চার দশক ধরে ‘সাহিত্য পত্রিকা নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধ চালিয়ে যায়। অতন্দ্র-শতক্রতু-ইত্যাদি-প্রতিস্রোত-শরিক এর মতো ছোট পত্রিকা কীভাবে যেন ধারাবাহিকতা বজায় রাখে! মশাল মিছিলে পুরনো কিছু অবয়ব ঝাপসা হয়ে গেলেও নতুন-নতুন অবয়ব অন্ধকার চিরে এগিয়ে যায়, এখনও!
বরাক উপত্যকার বাঙালি লিখিয়ের পক্ষে লেখা বেঁচে থাকার ঘোষণা, স্বতন্ত্র অস্তিত্বের অভিজ্ঞান; এ কোনো অবকাশ বিনোদন বা খামখেয়ালি কাজ নয়। তাই নিজেকে বঙ্গীয় ভুবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রমাণ করতে লেখেন কবি ও গল্পকারেরা। কোথাও প্রকাশন সংস্থার সমর্থন নেই, দুয়োরানির ছেলে-মেয়েদের প্রতি সুয়োরানির ছেলে-মেয়েদের নিষ্ঠুর ঔদাসীন্য ও তাচ্ছিল্য আছে বরং। তাই নির্বাসিত ঈশান বাংলার সমান্তরাল অপর অস্তিত্বের বেদনা ও অভিমান অতি সম্প্রতি অসাধারণ কথায়-সুরে-গায়কিতে ব্যক্ত হয়েছে—
এপার বাংলা ওপার বাংলা
মধ্যে জলধি নদী
নির্বাসিতা নদীর বুকে
বাংলায় গান বাঁধি।
আরো একবার ফিরে যাই দিলীপ লস্করের কবিতায়। আত্মগাথা’ নামক বয়ানের প্রথম নটি পঙক্তি এরকম:
‘যে নদীর পারে আমার ঘর
তার নাম কুশিয়ারা।
আমরা আখকে কুশিয়ার বলি,
ভাষাটা বরাকী নয়, বাংলা উপভাষা
আমরা কথা বলি মাত্রাবৃত্তে, সমিল পয়ারে,
পয়ারকে ডিটান বলি
ডিটানে ডিটানে শ্রুতিকাব্য গড়ে ওঠে’
এত সব সত্ত্বেও মৌলিক এই প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হয় বরাক উপত্যকায় এবং বাইরে: বাংলা সাহিত্যের সর্বজনমান্য মানদণ্ড অনুযায়ী এখানকার কজন লিখিয়ে মর্যাদার দাবিদার হতে পেরেছেন? সাহিত্য-কেন্দ্রের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় থাকার সুবাদে অবরে-সবরে দুচারটে নাম উচ্চারিত হওয়াকে কি মর্যাদা’ বলব! সামন্তপ্রভুরা মাঝে-মাঝে নিজেদের দূরের জায়গিরে গিয়ে, পরিতৃপ্তির মাশুল হিসেবে, সেইসব নাম নিয়ে আসবেন: এই কি ‘পরিচয়’ এর ব্যাকরণ? তবু বলব ‘সাহিত্যের নামে কলকাতার রঙমহলে পাসপোর্ট-ভিসা যোগাড় করছে কেউ কেউ’,—এই ভাবনা নিতান্ত ন্যক্কারজনক। কেননা লেখার শক্তিতে, দীর্ঘমেয়াদি অধ্যবসায়ের জোরে, বরাক উপত্যকার কোনো কোনো কবি ও গল্পকার বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করতে পেরেছেন। শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য, শঙ্করজ্যোতি দেব, বিজয়কুমার ভট্টাচার্য, মনোতোষ চক্রবর্তী, স্বর্ণালি বিশ্বাস, দেবাশিস তরফদার কবি হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালি পাঠকদের কাছে কম-বেশি পরিচিত এখন। তবে ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যে যে-লড়াইতা আংশিক সময়ের লিখনকর্মীদের পক্ষে অব্যাহত রাখা অসম্ভব। মিথিলেশ ভট্টাচার্য, রণবীর পুরকায়স্থ, শেখর দাশ, বদরুজ্জামান চৌধুরী, সুব্রত কুমার রায়, মলয়কান্তি দে—গল্পকার হিসেবে নিজেদের চেনাতে পেরেছেন। তবে যেহেতু এঁরা কেউই সব-সময়ের লিখনযোদ্ধা নন, তিনজন ছাড়া অন্য কারও গল্পসংকলনও নেই—এদের কণ্ঠস্বর বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যে তেমনভাবে পৌছায় না। ‘একটু উঠে একটু নেমে আমার কাছে দাঁড়াতে হয়’—কবির বাচন হিসেবে চমৎকার; কিন্তু রচয়িতা-গ্রহীতার মধ্যে কে কেন উঠবে বা নামবে, এর মীমাংসা সহজ নয়। দূরতম ‘মফঃস্বল’ এর বাঙালি কবি-লেখক বলে শক্তিপদ-বিজিৎ-অমিতাভ কিংবা রণবীর-শেখর-সুব্রত নির্বাসিত ভূখণ্ড থেকে ছুটে ছুটে যাবেন চোখ-ধাঁধানোে মন-মজাননা প্রতিষ্ঠাকেন্দ্রের দিকে: এটা হতেই পারে না। অতিসরলীকরণের এই পাটিগণিত এখন পুরোপুরি অচল।
বরাক উপত্যকায় প্রায় চার দশক ধরে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করে যিনি বিকল্প সাহিত্যের আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় উত্তীর্ণ করেছেন, তিনি সাহিত্য সম্পাদক বিজিকুমার ভট্টাচার্য। কোনো বিজ্ঞাপন নেই, অনুকূল সমাজের সমর্থন নেই, বিশেষ কোনো পৃষ্ঠপোষকতাও নেই। অথচ ‘সাহিত্য পরপর বেরিয়েই চলেছে। এই নিরিখে জামশেদপুরের ‘কৌরব’ কিংবা কলকাতার কবিতা পাক্ষিক’ এর সঙ্গে তুলনীয় নয়। কারণ, এদের প্রধান ভরসা বৌদ্ধিক ও আর্থিক সমর্থনের নিশ্চয়তা। হাইলাকান্দির ‘সাহিত্য’ তা কখনও পায় না; অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত সবটাই তার যুদ্ধ। রূপক এবং আক্ষরিক দুই অর্থেই। বিজিৎ ‘সুরক্ষিত বন্দিশালা’নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ছাব্বিশ বছর আগে। যারা অপর পরিসরের বাসিন্দা হিসেবে অকারণ হীনমন্যতার শিকার, ওই প্রবন্ধটি তারা এখনও পড়তে পারেন। নিছক মফঃস্বলবাসীর বেদনা বলে তার বয়ানকে লঘু করতে নয়, নির্বাসিত ঈশান বাংলার প্রান্তিকায়িত পরিসর থেকে উৎসারিত উচ্চারণ হিসেবে আত্মমর্যাদার ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করতে।
বিজিৎ লিখেছিলেন: ‘একথা আজকাল প্রায় সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক পাঠক—অর্থাৎ সাহিত্য-বিচারে যাঁদের ভোটাধিকার অর্জিত হয়েছে—জেনে গেছেন যে বর্তমান বাংলা কবিতার যা মূল্যবান অংশ তার অর্ধেকটা (হয়ত বেশি-ই বলা হলো) যদি বা কলকাতার বহু-পরিচিত কবিদের রচনা, বাকি অর্ধেক নিশ্চিতই রচিত হচ্ছে এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু অখ্যাত অথবা অল্পখ্যাত কবিদের হাতে।
বিজিৎ-এর মন্তব্যের পরিধি একটু সম্প্রসারিত করে বলব, ‘অল্পখ্যাত’ কিংবা ‘অখ্যাত’ গল্পকারদের মধ্যেও বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত জীবন্ত ধারাগুলিকে শনাক্ত করা সম্ভব। তুলনামূলক ভাবে অনেক কম সংখ্যায় হলেও একথা প্রাবন্ধিক এবং ঔপন্যাসিকদের সম্পর্কেও প্রযোজ্য। প্রাতিষ্ঠানিক পণ্য-সাহিত্যের গৎবাঁধা পথে যাঁরা চলেন, ছোট পত্রিকা থেকে তারা অবধারিত ভাবেই ছিটকে বেরিয়ে যান। এদের কথা বিজিৎ ভাবেননি, আমরাও ভাবছি না। পেশাদার সাহিত্যিকদের কিংবদন্তিতুল্য ভাবমূর্তি। কিংবা জীবনযাপন মফঃস্বলের তরুণদের আচ্ছন্ন করে, এটা ঠিক। কিন্তু অমুক চন্দ্র তমুকের মতো লিখতে যারা সচেতন বা অবচেতন ভাবে প্ররোচিত হয়, ভরাডুবিই তাদের নিয়তি। বরাক উপত্যকার শক্তিপদ বা শেখর নিজস্ব কাব্যভাষা বা গল্পভাষা যদি আবিষ্কার করতে না পারতেন, নির্মম সময় তাদের কবেই পথপ্রান্তে ফেলে রেখে যেত। লেখার জগতে কোনো মমতা, সহানুভূতি, পক্ষপাতিত্ব অচল। প্রতিইঞ্চি জমি প্রণালীবদ্ধ মেধাবী অধ্যবসায় দিয়ে অর্জন করতে হয়। বিজিং ‘সাহিত্য পত্রিকায় তা করেছেন। আর তাই তাঁকে নিছক বরাক উপত্যকার পরিধিতে বিচার করা চলে না। বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষিতে বালুরঘাটের ‘মধুপণী’ সম্পাদক অজিতেশ ভট্টাচার্য, মেদিনীপুরের ‘অমৃতলোক’ সম্পাদক সমীরণ মজুমদার, বগুড়ার ‘নিসর্গ’ সম্পাদক সরকার আশরাফ, গৌহাটির ‘একা এবং কয়েকজন’সম্পাদক উদয়ন বিশ্বাস ও পূর্বদেশ’ সম্পাদক অখিল দত্ত, ঢাকার ‘একবিংশ’ সম্পাদক খোলকার আশরাফ হোসেন, কলকাতার এবং মুশায়েরা’ সম্পাদক সুবল সামন্ত, ‘তমসুক’ সম্পাদক সমীর চট্টোপাধ্যায় এবং এরকম আরো কয়েকজনের গৌরবময় অভিযাত্রায় তিনি সংশ্লিষ্ট হয়ে যান।
বিভিন্ন পর্যায়ে বরাক উপত্যকার ছোট পত্রিকার জগৎ থেকেই তো পেয়েছি উদয়ন ঘোষ, রুচিরা শ্যাম, শান্তনু ঘোষ এবং বিশেষত রণজিৎ দাশের মতো কবিকে। প্রথম তিনজন সূচনাপর্বে চোখ ধাঁধিয়েও আংশিক সময়ের লিখনকর্মী হওয়াতে সৃষ্টি-প্রকল্প থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ালেন। কিন্তু রণজিৎ নিজেকে মুহুর্মুহু বিনির্মাণ করে বাংলা কবিতার আবহমণ্ডলে অন্যতম প্রধান জ্যোতিষ্ক হয়ে উঠতে পারলেন। শান্তনু নিজের জন্যে আয়না আনতে আনতে মাঝপথেই গুড়িয়ে দিয়েছিলেন; আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে সাহিত্য পরিত্যক্ত হল বলে এই বাচনও কোথাও পৌছাল না। প্রান্তিক মানুষের উচ্চারণে সময়ও পরিসরের অনন্বয় কত নতুন তাৎপর্য এবং অভিনব উপস্থাপনা-পদ্ধতির উৎস হয়ে উঠতে পারে, তাও জানা হল না। এ কেবল ব্যক্তিগত অবসাদের বৃত্তান্ত নয়, প্রান্তিক পরিসরের মধ্যবিত্তবর্গীয় বৌদ্ধিক অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা এভাবে চিহ্নায়িত হল যেন। বৃত্তবন্দী কক্ষপথ চূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি জাগিয়েও শুধুমাত্র যথাপ্রাপ্ত অবস্থানের অন্ধবিন্দুর দুর্মর উপস্থিতি কল্পনাপ্রতিভাকে শুষে নেয়—এই বার্তা কেবল বরাক উপত্যকার পক্ষে প্রাসঙ্গিক নয়। সমস্ত প্রান্তিক পরিসরের সৃষ্টি-প্রয়াসীদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কীকরণও। আর, পাশাপাশি,বৃত্তবন্দিত্ব থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন বলে রণজিৎ তারুণ্যের অহংকারে যেমন লিখেছিলেন (রোম থেকে শিলচর একটানা রেলপথ হবে)—সেই চিহ্নায়িত সার্থক হয়ে উঠল। ঘটাকাশ মিশে গেল মহাকাশে। বরাক উপত্যকায় যারা জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে রয়ে গেলেন, তাঁদের পক্ষে শান্তনু ও রণজিৎ যেন দুই মেরুর দুটি সংকেত হয়ে উঠলেন। যাঁরা বহুমাত্রিক ভাবে মহাকাশের বার্তা ধারণ করতে পারলেন পরিসর-লালিত আধারে, তারাই বাংলা ভাষার আঞ্চলিক লাবণ্যের প্রতিমা গড়তে পারলেন। কেউ বা মনোযোগী হলেন লোকায়ত চালচিত্রে, কেউ বা চালচিত্রে সময়ানুভবের আন্তর্জাতিক চিহ্নায়ক মুদ্রিত করতে চাইলেন।
প্রতিবেশী ত্রিপুরায় ছোটগল্প ও উপন্যাস যেমন অপর পরিসরের সমান্তরাল অস্তিত্বকে কিছু কিছু সার্থক পাঠকৃতিতে রূপান্তরিত করে চলেছে, সেই মাত্রায় -হলেও বরাক উপত্যকায় অনিশ-শতক্রতু-অক্ষরবৃত্ত-প্রতিস্রোত-সাহিত্যকে কেন্দ্র করে কথাসাহিত্যের লক্ষণীয় বিন্যাস-প্রতিন্যাস গড়ে উঠেছে। শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী-মিথিলেশ ভট্টাচার্য-বদরুজ্জামান চৌধুরী-অরিজিৎ চৌধুরী-দেবব্রত চৌধুরী-মলয়কান্তি দের-র মতো গল্পকারদের নিজস্ব গল্পসংকলন আজও প্রকাশিত হল না—এ কোনো বিস্ময় নয়। অনীহা ও উদ্যমহীনতার হিমানী সম্প্রপাতে নিঃশব্দে ডুবে যায় সব অধ্যবসায়। বরাক উপত্যকার নির্বাচিত গল্প কিংবা উত্তরপূর্বাঞ্চলের গল্প: এই দুটি সংকলন এখানকার সবেধন নীলমণি। আবারও লিখতে হচ্ছে, আংশিক সময়ের লেখক হয়ে থাকতে থাকতে এখানকার গল্পকারদের মধ্যে কুয়োবাসীর যাবতীয় ভনিতা পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। শেখর দাশের ‘কোষাগার’, রণবীর পুরকায়স্থের ‘বোকা কাশীরাম কথা’, সুব্রত কুমার রায়ের ‘আরশিনগরের রূপকথা’, অমিতাভ দেবচৌধুরীর ‘বাজে খাতা’ রয়েছে এই প্রবণতার বিপ্রতীপে। এই সংকলনগুলি বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের পুড়ুয়াদের হাতে যদি ঠিকমতো পৌছাত, নিঃসন্দেহে এই সত্য প্রমাণিত হত যে এপার বাংলা ওপার বাংলা ছাড়াও রয়েছে নির্বাসিত অপর বাংলা। তার লেখাপত্রে জীবনের মননের উপলব্ধিতে ভিন্নতর মাত্রা নান্দনিক বিচারেই সহযাত্রীর মর্যাদা পেতে পারে। এদের না-জেনে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা অপরাধ।
‘গল্পপঞ্চদশী' নামে লেখিকাদের একটি সংকলনও রয়েছে। নারী-পরিসর এতে কতখানি উপস্থিত, তা হয়তো তর্কের বিষয়। কিন্তু জীবনের ভেতরে রয়েছে আরেক জীবন, সেদিকে আমরা তাকাই কিন্তু দেখি না তাদের—এই বার্তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এইসব গল্পকারদের বয়ান থেকে। ঝুমুর পাণ্ডে এই জগৎ-অন্তবর্তী জগতের সবচেয়ে জোরালো প্রতিনিধি।‘গেরাম থানের মেয়েটি ও দুলিয়া’ নামক গল্পসংকলনে বরাকের স্বল্প-আলোকিত সামাজিক পরিসরের টুকরো-ছবি পাওয়া যায়। এবছর শারদীয় দৃষ্টিপাত পত্রিকায় তাঁর উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। ঝুমুরের বিপরীত মেরুতে রয়েছে। স্বপ্না ভট্টাচার্যের ছোটগল্প। নারী-পরিসরের উন্মোচনে সচেষ্ট তিনি। বরাক উপত্যকার কথাসাহিত্য ক্রমশ পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠছে এঁদের সমবায়ী উপস্থিতিতে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এখানে অবতারণা করা যায়। দেশবিভাগের রক্তাক্ত ক্ষত এবং সেই ক্ষত নিরাময়ের ব্যর্থ চেষ্টা: শুধুমাত্র এই বিষয়টি থেকে অসামান্য কিছু উপন্যাস রচিত হতে পারত এখানে। ছিন্নমূল মানুষের ঢল নেমেছিল এই উপত্যকায়; পূর্বপাকিস্তান থেকে এবং পরে আসামের ভাষাদাঙ্গায় দ্বিতীয়বার উদ্বাস্তু-হওয়া মানুষেরা এসেছিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে। পায়ের নিচে জমি খুঁজে পাওয়ার লড়াই চালাতে গিয়ে উদ্বাস্তু-প্রজন্ম উৎখাত হল নৈতিকতার বোধ থেকেই। আধা-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে আপসের হাজার পথ খুলে যায়, ভাবাদর্শ অবান্তর হয়ে পড়ে। একদিকে পরিকল্পনাশূন্য নগরায়নের চাপ, অন্যদিকে সুবিধাবাদিতা ও সার্বিক অবক্ষয়ের চোরাবালি: ব্যক্তি-অস্তিত্বে না আছে কেন্দ্র, না আছে পরিধি। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসে যেমন আদি পাপ, ছিন্নমূল প্রজন্মগুলির জন্যে তেমনি দ্বিজাতিতত্ত্ব ও তজ্জনিত দেশবিভাগ। আজও মাথার উপর আকাশ নেই। তাই, পায়ের নিচে নেই জমি। ব্যক্তির বিচূর্ণায়ন এবং তার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়ার দৃশ্য ও অদৃশ্য সংগ্রাম মহাকাব্যিক উপন্যাসের বিষয় হতে পারত।
কেন হল না এতদিন: এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে শেখর দাশ লিখেছেন তিনটে উপন্যাস; মোহনা, বিন্দু বিন্দু জল, রাঙামাটি। এদের মধ্যে ‘বিন্দু বিন্দু জল’-এ দেশবিভাগ ও উদ্বাস্তু-প্রজন্মের সার্বিক ক্ষয় উপন্যাসীকৃত হয়েছে। এর আগে কিছু কিছু বড়ো গল্পে উপন্যাসায়নের বিচ্ছিন্ন কিছু চেষ্টা হয়েছিল। মিথিলেশ ভট্টাচার্য, বদরুজ্জামান চৌধুরী, শেখর দাশ তা করেছিলেন। অতি সম্প্রতি অমিতাভ দেবচৌধুরীর উপন্যাসের খোজে’ প্রব্রজনের বহুমাত্রিক তাৎপর্যকে উপন্যাসের পদবি দিতে চেয়েছে। যেহেতু রচনা মাত্রেই লেখা’ নয়, দু-একজন পূর্বসূরির প্রয়াসকে এই বর্গের অন্তর্ভুক্ত করছি না। তবু এইসব দৃষ্টান্ত থেকে এটা নিশ্চয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বরাক উপত্যকার সৃষ্টিশীল মন অপর পরিসরের সত্তাতাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রকল্প দিয়েই লিখনবিশ্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করে গেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনা আর বিকল্প বয়ান বিকল্প বীক্ষণ এই চেষ্টার মৌল চালিকাশক্তি। আধিপত্যবাদী ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা জানাতেই লেখা, বেঁচে থাকা, হয়ে ওঠা। বাংলার, বাঙালির অতি উদ্ভাসিত অবয়ব যে কুহকমাত্র, এই জেনে সেই কুহক নিরাকরণ করতে লেখেন শক্তিপদ, শেখর। যতক্ষণ এই সত্য জানতে পারছি না, ততক্ষণ কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের মরীচিকায় বুদ হয়ে থাকছি। চিত্রভানু ভৌমিক, শেখর দেবরায়, প্রদীপ নাথ, দেবব্রত চৌধুরী, আশুতোষ দাস-এর মতো নাট্যকার এই বরাক উপত্যকার জীবনে ব্যাপ্ত বিচিত্র লীলাভঙ্গ থেকে অবক্ষয়ী আধুনিকতাবাদের বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর বয়ান খুঁজে নিচ্ছেন—এও কম তাৎপর্যবহ নয়। প্রতীচ্যের আধুনিকোত্তর প্রবণতার উল্টো মেরুতে গিয়ে আবহমান দেশজ সংস্কৃতির জমিতে উত্তরায়ণমনস্ক উত্তর আধুনিক চেতনার বিশল্যকরণী নিয়ে আসছেন যাঁরা নাট্যপাঠকৃতিতে, তাদের সঙ্গে চিত্রভানুদের আত্মীয়তা এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
তুলনামূলক ভাবে প্রবন্ধে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে বরাক উপত্যকা। সুজিৎ চৌধুরী, অমলেন্দু ভট্টাচার্য, সঞ্জীব দেবলস্কর: সামগ্রিক প্রেক্ষিতের নিরিখে এই তিনজন উল্লেখনীয় কেবল। কেননা সাধারণ আলোচনা আর প্রবন্ধ এক কথা নয়—এ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এখনও প্রকট। অবশ্য এটা কেবল বরাক উপত্যকার বিশেষত্ব নয়; সাধারণ ভাবে সমগ্র বাংলা সাহিত্য এবং ছোট পত্রিকার অণুবিশ্বও একই দোষে ভুগছে। পিটুলিগোলা জল আর দুধ একাকার হয়ে যাচ্ছে প্রায় সর্বত্র। প্রবন্ধ লেখার জন্যে যে দীর্ঘমেয়াদি অধ্যবসায়, ধৈর্য, পরিশ্রম ও অন্তর্দীপ্ত বিশ্লেষণ-নৈপুণ্য চাই, তা একদিনে তৈরি হয় না। তাছাড়া চাই বিকল্প ভাববিশ্ব ও বিকল্প বয়নপদ্ধতি সম্পর্কে গভীর মননজাত প্রস্তুতি। অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনার ক্রমিক উন্মোচন যেখানে প্রত্যাশিত, সেই ছোট পত্রিকাই শমীগর্ভে আগুন ধারণ করতে পারে। বরাক উপত্যকায় ছোট পত্রিকার ধারাবাহিক প্রকাশনা না-থাকার ফলেই সম্ভাব্য প্রাবন্ধিকদের দেখা মেলে নি।
এবার ফিরে যেতে পারি বিজিৎকুমারের প্রাগুক্ত প্রবন্ধে। তিনি নতুন সাহিত্য-চিন্তা, আদর্শগত প্রতিজ্ঞা ও সৃষ্টিধর্মী তন্নিষ্ঠ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। ছোট পত্রিকার লেখকদের এইসব অভিজ্ঞান ছাব্বিশ বছর আগে যতখানি সত্য ছিল, এখনও ততটুকু সত্য। বিজিৎ লিখেছেন: ‘লিটিল ম্যাগাজিনগুলোর জন্ম হয় কোনো একটা আদর্শগত প্রতিজ্ঞা নিয়ে, সমাজ সচেতনতা নিয়ে ভাঙচুর, বিদ্রোহ, আন্দোলন—মোট কথা সাহিত্যে একটা নতুন ভাবনা চিন্তা নিয়ে আসা, একটা সর্বাঙ্গীণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রকাশিত হয় লিটিল ম্যাগাজিনগুলো। এদের পাঠক নির্বাচিত এবং প্রাপ্তবয়স্ক। সুতরাং আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ, বেঁচে থাকা অনিশ্চিত, অকালমৃত্যুর হার খুব বেশি। তবু একটার পর একটা জন্ম চলছেই নতুন সাহিত্য-ভাবনা নিয়ে, রিলে রেসের মতো এক হাত থেকে অন্য হাত হয়ে এগিয়ে চলেছে বর্তমান বাংলা সাহিত্যের যা কিছু গৌরবের ধন।’ ওই শেষের কথাতেই রয়েছে অপর পরিসরের লিখনবিশ্বের অন্তঃসার। বরাক উপত্যকার বাংলা লেখালেখিও অন্যান্য অপর পরিসরের সহযাত্রী লিখন-যোদ্ধাদের জীবনশস্যের মতো সমগ্র বাংলা সাহিত্যের গৌরব ভাণ্ডারকে অনবরত ঋদ্ধতর করে চলেছে। বিজিৎ-এর বয়ানের প্রতিধ্বনি করে লিখতে চাই: ‘আসলে সাহিত্য প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন এবং এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ সঠিকভাবে করতে পারলে একটি পেশাদার পত্রিকা কিংবা একটি বিশেষ প্রকাশনা সংস্থার মৃত্যু যদি বা ঘটানো যায় সেখানে আরো দশটি নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তবুও থেকে যাবে। সুতরাং মূল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটাকেই চিনতে হবে, চেনাতে হবে।...বর্তমানের সুরক্ষিত বন্দিশালা ভেঙে গুড়িয়ে বাংলা সাহিত্যকে স্বাধীন এবং সাহসী করার দায় সেইসব অগ্রসর লেখকদের হাতে যারা একান্তভাবেই লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বহু সৎ লিটিল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের জগতে একটা চোরাস্রোতের মতো কাজ চলছে—এখন প্রয়োজন সেই স্নোতকে প্রবলতর করা।’
হ্যাঁ, নিশ্চয়। স্বাধীন’ এবং ‘সাহসী’ সেইসব লিখিয়েরা রয়েছেন অপর পরিসরেই, বিশেষত বরাক উপত্যকার মতো প্রান্তিকায়িত নির্বাসিত বাংলায়, যাদের কাছে আজ ‘বাংলা অভিধাই পরকীয়া হয়ে গেছে। তবে ‘চোরাস্রোত’ নয়; কেননা গত ছাব্বিশ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক পণ্য সাহিত্য গজভুক্ত কপিখবৎ খোসামাত্রসারে রূপান্তরিত হয়েছে। ইতিহাসের দান যারা উল্টে দিয়েছে, অপর পরিসরের সেইসব লিখনযোদ্ধাদের এখন নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে হবে। আর দেরি নয়। এখনই শুরু হোক বাংলা সাহিত্যের বিকল্প ইতিহাস রচনার কাজ। তথাকথিত পরিধির পাঠকৃতি ছদ্ম-কেন্দ্রের ভ্রমপাঠের কালো মুকুট খসিয়ে দিক। বরাক উপত্যকার পদাতিকেরা সাংস্কৃতিক রাজনীতির ধূর্ত কৌশলকে নানাভাবে চিনেছেন। এবার সংকোচের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে ওই চেতনার বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে দিন তারা। ভাঙন পিছনে থাক, সম্মুখে নির্মাণ। তাই, আসন্ন ওই শুশ্রুষার বার্তা।