সময় অসময় নিঃসময়/বাংলা ভাষার বিপন্নতা

বাংলা ভাষার বিপন্নতা

 কেন এই শিরোনাম? একুশ শতকের গোড়ায় কি এমন কিছু নতুন ও জটিল সমস্যা তৈরি হয়েছে যে এবিষয়ে আরও একটি প্রতিবেদন জরুরি হয়ে পড়েছে। বিপন্নতা কি আলাদা ভাবে বাংলা অথবা যে-কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল-ভিত্তিক ভাষার অথবা বাঙালি জাতির? আরও একটি গোড়ার প্রশ্ন এসে যায়: বিপন্নতা কী এবং কেন! প্রতীত বাস্তবতা (Virtual reality)-র পর্যায়ে চিহ্নায়নের সন্ত্রাস যখন কার্যত নিশ্চিহ্নায়নের তোড়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে সব কিছু, একাকার হয়ে যাচ্ছে প্রাগ্রসর ও অতি-পশ্চাৎপর সামাজিক ও ভৌগোলিক পরিসর—সংযোগের প্রয়োজন ও তাৎপর্য পুরোপুরি উন্মুল হয়ে পড়ছে। তাহলে সংযোগের সবচেয়ে মৌলিক মাধ্যম ভাষায় কি অবান্তর হয়ে পড়ছে ভাষার সন্ততি চিহ্নের উদ্ধত আধিপত্যে? বিশ্ব জুড়ে অন্তর্জাল এখন বৈদ্যুতিন ইশারায় সংবাদ বিনিময়ে অভ্যস্ত করে তুলছে আমাদের। অকল্পনীয় দ্রুত গতিতে, কার্যত মুহূর্তের মধ্যে, সূচিমুখ জ্ঞাতব্য পৌছে দিচ্ছে যে-কোনো প্রান্তে। মেদহীন ভারহীন শাখা-প্রশাখাহীন তথ্যের বুদ্বুদ উন্মীলিত ও নিমীলিত হচ্ছে মুহূর্মুহ্। বাংলা ভাষা যারা ব্যবহার করেন, বিশ্বায়নের এই সাম্প্রতিকতম অভিঘাত বিপুল ও অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে তাদের ভাষা-চেতনায় অর্থাৎ বাচনিক লক্ষ্য- আধারআধেয়-কৃৎকৌশল-পরিধি-সম্ভাব্য বিচ্ছুরণ সম্পর্কিত ধারণায়। বিপন্নতা তৈরি হচ্ছে এইসব অনুষঙ্গে।

 এই পৃথিবীতে ছাব্বিশ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। বাংলাদেশ, পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লী, আন্দামান এবং ইংল্যাণ্ডে আমেরিকায় এঁদের বসবাস। স্বভাবত বাঙালি জাতিসত্তা সম্পর্কে সবাই সচেতন নন, কেউ কেউ আবার পুরোপুরি অনবহিত ইদানীং। তবু চান বা না চান, ভাষার মধ্য দিয়ে বহমান ঐতিহ্য এঁদের সবাইকে ঋদ্ধ করে। নিদালির ঘোরের মধ্যে সোনার কাঠির স্পর্শ যোগান দেয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহত্তম ও সমৃদ্ধতম জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি কেন জাতিসত্তার সম্ভাবনা সম্পর্কে উদাসীন এবং তার ভাষাচেতনা কেন কখনও কখনও আঁধিতে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে: এই প্রশ্ন মীমাংসা দাবি করে। ভারত রাষ্ট্রের লাগাম যাদেরই হাতের মুঠোয় থাকুক না কেন, হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের প্রবক্তারা উপনিবেশ কায়েম রাখতে চায় বাঙালির মনে এবং সুকৌশলে তাদের ভাষা-চেতনায় বেনোজল ঢুকিয়ে বিদূষণে অভ্যস্ত করে ফেলে। এর উৎকট দোসর ভাষিক সম্প্রসারণবাদ আসামে অসমিয়াকরণের মধ্যে কীভাবে সক্রিয়, তার খবর অনেকেই রাখেন না। গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত আসামের বাঙালিরা। সরকারি মদতে বেপরোয়া আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদীরা আসামের বহু ঐতিহ্যসম্পন্ন বাংলা-মাধ্যম বিদ্যালয়কে অসমিয়া-মাধ্যম বিদ্যালয়ে পাল্টে নিয়েছে। রাষ্ট্রবিপ্লবে ছিন্নমূল বাঙালিদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তাদের আদমসুমারিতে নব-অসমিয়া বলে দেখিয়েছে। একুশ শতকের প্রথম আদমসুমারিকে ওরা আরো বেপরোয়া ভাবে অসমিয়াকরণের কাজে লাগিয়েছে নাৎসি কায়দায়। বরাক উপত্যকার রক্তের মূল্যে বাঙালিরা মাতৃভাষার মর্যাদা আপাতত রক্ষা করতে পারছে। কিন্তু সেখানেও সরকারি মদতে খিড়কিদুয়ার দিয়ে অসমিয়া চাপানোর চেষ্টা চলছে; পাঠ্য বইগুলিতে সরকারি পুস্তক পর্ষদের ভাড়াটে কলমচিদের দিয়ে অসমিয়া শব্দ, বাকবিধি ও নিম্নমানের বিষয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ফলে বাঙালি শিশু-শিক্ষার্থীরা তাদের ভাষা-চেতনাকে ঠিকমতো বিকশিত করার সুযোগ পাচ্ছে না। বরং ভুল ভাষারীতি শিখছে বানানে। বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলার বদলে তাদের ভাষা-মনস্তত্ত্বকে পঙ্গু ও বিকৃত করে দেওয়া হচ্ছে।

 বাঙালিরা পরস্পর সম্পর্কে যত উদাসীন, নিরাসক্ত ও আত্মঘাতী কুযুক্তিতে আস্থাশীল—তত আর কেউ নয়। ঐতিহাসিক কারণে দেশবিভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বলি বাঙালিরা শতচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে রুটি-মাখন নিয়ে ভাগ-বাঁটোয়ারার লড়াই হল, তার ফলে বহু লক্ষ বাঙালি সাত প্রজন্মের ঘর হারাল। ঘরের সঙ্গে হারাল সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের জমি ও আকাশ, বিশ্বাস-স্থৈর্য-সংলগ্নতাবোধের আলো-হাওয়া-রোদ। তবু, তখনও শেষ হল না স্রোতের শ্যাওলা হয়ে ভেসে যাওয়ার যন্ত্রণা। আসামে-আন্দামানে-দষ্কারণ্যে মেঘালয়ে-মরিচঝাপিতে-দিল্লিতে বারবার বাঙালিকেই কেন ধনে-জনে-প্রাণে বিপন্ন হতে হয়? শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলে, এই অপরাধে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীন পুলিশ বাহিনী নিছক অসমিয়া সম্প্রসারণবাদীদের প্ররোচনায়, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে সত্যাগ্রহরত তরুণ-তরুণীর উপর গুলিবর্ষণ করেছিল আসামের শিলচরে। ১১ জন শহিদ হয়েছে। মাতৃভাষার জন্যে, ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঘটনার পরে এই দ্বিতীয়বার। সেখানেই কিন্তু ইতিহাস থেমে যায় নি। বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জে ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট একজন এবং ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই আরও দুজন বাংলা ভাষার উপর নিগ্রহ রুখতে শহিদ হয়েছেন। তবু, হায়, বাঙালিদের মধ্যেই এমন অনেকে আছেন যাঁরা বরাক উপত্যকার আত্মিক অভিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানেন না, জানতে চান না। এ অঞ্চল যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের চক্রান্তে ১৮৭৪-এ এবং পরে ১৯৪৭-এর গণভোটে প্রভুত্ববাদীদের ধূর্ত কৌশলে বাংলার রাষ্ট্রসীমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল—তার প্রথমটার খবর রবীন্দ্রনাথ জানতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নামে অজ্ঞান হয়ে-যাওয়া বঙ্গজনেরা জানেন না। জোর করে বরাক উপত্যকাকে আসামের লেজুড় করে দেওয়া হলেও ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক-ভৌগোলিক-ভাষিক নিরিখে বরাক উপত্যকা বৃহত্তর বঙ্গভূমির (সাম্প্রতিক বিহার, পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে) অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতএব এখানকার বাঙালিদের মধ্যে বাংলা ভাষার বিপন্নতা তার ভাষিক-আস্তিত্বিক-রাজনৈতিক সত্তার সংকটেরও অভিব্যক্তি।

 ইতিহাসের বয়নে নানা ধরনের অন্ধবিন্দু থাকে। কখনও তাদের প্রশ্রয় দিই আর কখনও এড়িয়ে চলি। বাংলা ভাষার আশ্চর্য স্থিতিস্থাপকতা যেভাবে গড়ে উঠেছে, তারও যথার্থ অনুশীলন করিনি আমরা। করলে হয়তো ওইসব অন্ধবিন্দু থেকে অন্তদৃষ্টির উদ্ভাসনে পৌছানো যেত। সমাজ-ভাষাতত্ত্ব বা ভাষামনস্তত্ত্ব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই এইজন্যে। দরকার বাঙালিত্ব সম্পর্কে অনুভূতির, বাঙালি হয়ে ওঠার দীর্ঘ ও উচ্চাবচতাময় ইতিহাসের তাৎপর্য বুঝে নিয়ে সেই অনুযায়ী নিজেদের গড়ে তোলার। চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, রাম পাঁচালী, ইউসুফ জুলেখা হয়ে রবীন্দ্রনাথ, লালন, মহাশ্বেতা, ইলিয়াসে বহমান ভাষাচেতনা স্বভাবে দ্বিবাচনিক ও অনেকান্তিক। নাগরিক বৈদগ্ধ্য ও গ্রামীন সজীবতায় বারবার যে বহুবাচনিক আদল ফুটে ওঠে, তাকে কোনো একটি নির্দিষ্ট নিরিখে ব্যাখ্যা করতে চাইলে মৌলবাদী ভাবনায় খপ্পরে গিয়ে পড়ব। হিন্দু ও মুসলমান, শহুরে ও লোকায়ত বর্গ মিলে একটাই ভাষাবিশ্ব বাঙালির। কয়েকটি শব্দ বা বাগবিধির প্রয়োগ বা অপ্রয়োগ হয়তো ভাষা-ব্যবহারের হিন্দুয়ানি বা মুসলমানি নির্দেশ করে। কিন্তু সমাজভাষাতাত্ত্বিক এইসব চিহ্নায়কের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করলে ভুলে যাব লোকায়ত মনীষার এই দির্শক উচ্চারণ: ‘নানান বরণ গাভীরে ভাই/একই বরণ দুধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক ঘটনাবলী থেকে মনে হয়, বাঙালির ভাষাপরিমণ্ডলে কোথাও নিম্নচাপ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। দমকা হাওয়ার দু-তিনটে ঝাপটা টের পাচ্ছি, হয়তো ঝড় উঠবে কিংবা তার আগেই দুর্যোগের ভিন্ন একটি রূপ দেখতে পাব আমরা। একদিকে বিশ্বায়নের নামে আধিপত্যবাদী সমগ্রায়ন অর্থাৎ তথ্য-বিনোদন প্রযুক্তির সর্বাত্মক সন্ত্রাসে বাঙালির ভাষাচেতনার বৈশিষ্ট্য ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে লোকায়ত পরিসরকে প্রান্তিকায়িত করে বকচ্ছপ ও হাঁসজারু প্রতিভাষাদের রমরমা দিনদিন নির্বাধ হয়ে উঠছে।

 হ্যাঁ, এটা শুধু বাংলা ভাষারই সমস্যা নয়। কিন্তু তবু আমাদের বিশেষ ভাবে চিন্তিত হতে হচ্ছে এইজন্যে যে কোনো আসন্ন বা চলমান যুদ্ধ থেকে অন্য কারও ভরসায় সরে থাকা যায় না। অন্য ভাষাভাষীদের একই যুদ্ধ হয়তো, কিন্তু তাদের যুদ্ধ থাকুন, আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে, কোনো অজুহাতেই তা মুলতুবি রাখা চলবে না।

 আসলে, স্বাধীনতার নামে দেশবিভাগ বাঙালি জাতির আদি পাপ। আর, সেই পাপের ছায়ায় আক্রান্ত বাংলা ভাষা।‘দিজ্জই কান্তা খা পুনবার পর্যায় কিংবা তারও আগে সুতনুকা প্রত্নলিপির সময় থেকে সূক্ষ্মভাবে ও বহুধা বিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষা যেভাবে বহতা নদীর মতো ক্রমশ নাব্য হয়ে উঠেছে-স্পন্দনময় লোকজীবনের ঐশ্বর্য স্বীকরণের প্রক্রিয়াই তাতে প্রমাণিত। ছোট-বড় পর্যায়ের মধ্য দিয়ে আর্য-অনার্য-লৌকিক উপকরণ আত্মস্থ ও পুনর্নির্মাণ করতে করতে বাংলা ভাষা আধুনিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সংশ্লেষণের এই প্রক্রিয়ায় আধিপত্যবাদী বর্গ মাঝে মাঝে হস্তক্ষেপ করতে চায়। প্রান্তিকায়িত নিম্নবর্গের ভাষাকে সাংস্কৃতিক রাজনীতিগত বাধ্যবাধকতায় সংশোধন করে নিতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে যদি নিম্নবর্গীয় চেতনার নিরিখে পুনঃপাঠ করি আজ, ভাষার সংগঠনে প্রতাপ ও অস্তেবাসীর দ্বন্দ্বের ইতিহাসও বুঝে নিতে পারব। নিঃসন্দেহে বিভিন্ন সময় আধিপত্যবাদের আগ্রাসী মনোভাব ভাষা-ব্যবহারকারীদের জন্যে বিপন্নতা তৈরি করেছে; কিন্তু সেই বিপন্নতার মোকাবিলা করেই এগিয়েছে বাংলা ভাষা। রণকৌশলগত কারণে কিছু কিছু পুরনো উপাদান বর্জন করতে হয়েছে, আবার কিছু কিছু নতুন প্রবণতা গ্রহণ করতে হয়েছে। যতদিন এই দ্বিবাচনিকতার অবকাশ থাকে, ততদিন ভাষা মরা নদীর সোঁতা হয় না। প্রাক্-ঔপনিবেশিক পর্যায়ে পারসিক উপকরণ বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধই করেছিল যদিও এইসব বিজাতীয় উপাদান মেনে নেওয়ার পেছনে সক্রিয় ছিল বৈষয়িক বুদ্ধি; ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকদের কাছাকাছি যাওয়ার মনস্তাত্ত্বিক তাড়না।

 ঔপনিবেশিক পর্যায়ে ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে মুৎসুদ্দি বর্গের পোয়াবারো হলেও তাদের নতু ভাষা-বিন্যাস অনিবার্য ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজের অন্যান্য অংশে। বাংলা ভাষার গ্রহিষ্ণুতা তার ধারণক্ষমতাকে কতদূর অবধি বাড়াতে পেরেছিল, উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বাংলা সাহিত্যের দুরন্ত গতিবৃদ্ধিতে তার প্রমাণ মেলে। প্রতীচ্য শিক্ষায় উদ্ভাসিত বৌদ্ধিক বর্গ যদিও প্রথম দিকে ইংরেজিকে বাংলার প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির করে মিথ্যা লড়াই লাগিয়ে দিয়েছিলেন, ক্রমশ মুষলের মতো ব্যবহার কমে গিয়ে তুলির মতো ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এতে শেষ পর্যন্ত লাভবান হল বাংলা ভাষা। তখনও কয়েক দশকের জন্যে বিপন্নতার ঘূর্ণিবার্তা তৈরি হয়েছিল; কিন্তু ধুলো ও আঁধি একসময় সরে গেল। তেমনই রাজনীতির ধর্মীয়করণের ফলে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষবাষ্প যখন ছড়াতে শুরু করল, ইসলামি বাংলা নামক কাঠালের আমসত্ত্ব দিয়ে ভাষার অন্য আরেক ধরনের বিপন্নতা সূচিত হল। এর আগে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র, উপনিবেশবাদ সংস্কৃত-পারসিক-ইংরেজি ভাষার প্রতাপমূলক উপস্থিতি দিয়ে যা করতে পারেনি, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তাই করতে সমর্থ হল। একটু আগে যাকে আদি পাপ বলেছি, সেই দ্বিজাতিতত্ত্ব-ভিত্তিক দেশবিভাগ বাংলা ভাষায় কার্যত অতলান্ত বিপন্নতার সূচনা করেছে। চর্যাপদেরও আগে থেকে যে-ভাষার বহুরৈখিক যাত্রা শুরু হয়েছিল, এবার সেই ভাষার ব্যবহারকারীদের মধ্যে তৈরি হল সংশোধনাতীত বিচ্ছেদের প্রাচীর।

 ‘সংশোধনাতীত’ বলছি এইজন্যে যে বাঙালি আর নিজেকে একই জাতি-গোষ্ঠীর আবেগ-সিঞ্চিত অনুভূতি-নিবিড় অবস্থানে দেখতে পাচ্ছে না। সহস্রাধিক বছরের চলমান ঐতিহ্যবোধে হস্তক্ষেপ করল ধর্ম। হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান—এই দুটি অভিজ্ঞানে কোথাও কাহ্নপা নেই, চণ্ডীদাস নেই, মধুসূদন নেই, জীবনানন্দ নেই, ওয়ালীউল্লাহ নেই, অবন ঠাকুর নেই, সুনীতি চাটুজ্জে নেই, শহীদুল্লাহ নেই। পাকিস্তানের পাঁজর থেকে বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার পরেও আদিপাপ ঘুচল না। হাসান আজিজুল হক-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সত্ত্বেও নয়। নইলে একুশ শতকের গোড়ায় বাংলাদেশের মুখে আবারও পাকিস্তানি মুখোসের উকিঝুঁকি দেখতে পেতাম না। যতদিন বাঙালি হিন্দু বাঙালি আর মুসলমান বাঙালি হয়ে থাকবে, শুধু বাঙালি হতে শিখবে না—ততদিন বাংলা ভাষার বিপন্নতা কাটবে না। প্রাগুক্ত ওই আদি-পাপ শুধু বাঙালির ভূমি, মনন ও হৃদয়কে দ্বিখণ্ডিত করেনি, তথাকথিত হিন্দুস্তানের বাঙালিদের বহুধা-বিচ্ছিন্ন করেছে। ছিন্নমূল বাঙালির প্রব্রজন শুরু হয়েছে ধিক্কার-গ্লানি-লাঞ্ছনা-অপমানের বিস্তারের মধ্য দিয়ে। পশ্চিম বাংলা পর্যন্ত টলোমলো, তার মানচিত্র যে-কোনো দিন বদলে যেতে পারে। বহু বাংলাভাষী পণ্ডিত এখন বাংলা ও বাঙালির ‘সংকীর্ণ’ পরিচয়ে বাঁচতে নারাজ। হিন্দুত্ববাদীরা (প্রচ্ছন্ন বা প্রকট) যে আর্যাবর্তের প্রভুত্ব কায়েম করতে চায়, এই সত্য আজ অন্ধের কাছেও স্পষ্ট। অথচ ওই পণ্ডিতেরা দেখেও দেখেন না, বুঝেও বোঝেন না যে আজকের ভারতবর্ষে শাসকশক্তি অভ্যন্তরীন উপনিবেশবাদের প্রতিনিধি।

 অত্যন্ত চতুরভাবে এই প্রভুত্ববাদী শক্তি সমস্ত ধরনের গণমাধ্যমকে কজায় নিয়ে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়া চালু করেছে। বাংলা ভাষার ঘোর শত্রু এরা। কার্যত ঘোষিতভাবেই বহুধা-বিচ্ছিন্ন বাঙালির নিজস্ব ভূগোল নেই। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদেশি খেদাও মানে বাঙালি খেদাও। আমাদের পণ্ডিতেরা এবিষয়ে এথনিসিটি’ ‘ডায়াসপোরা’ ‘সোস্যাল টেনশন ইত্যাদি লক্ষ্য করে আপ্লুত হন; কিন্তু কোদালকে সোজাসুজি কোদাল কখনো বলেন না। এঁদের বাঙালিত্ব যেহেতু বাস্তব জীবনে অপ্রতিষ্ঠিত (কেননা এঁদের ঘর নেই, আছে তবু অন্তরে বাহিরে), বাংলা ভাষার তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক পরিসরে দেখতে পাই অদ্ভুত অনিশ্চয়তা ও লক্ষ্যহীনতা। যখন বাংলা ভাষার বিপন্নতা নিয়ে ভাবি, নিজস্ব ভূগোলবিহীন এইসব বাঙালিদের বাচনিক অভিজ্ঞতাকে কি বাদ দেব প্রত্যাখ্যাত, অপ্রয়োজনীয় ও ফালতু ‘অপর পরিসর’ বলে? এঁদের দৈনন্দিন ব্যবহার এবং সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োগে কোনো ধরনের কৌনিকতা ও উচ্চাবচতা খুঁজব কিনা—এ সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য চাই। অথবা খণ্ডিত বাঙালি সত্তার ভাষা-ব্যবহার, তার সংকট ও সম্ভাবনা বা সম্ভাবনা-শূন্যতা নিয়ে বয়ান তৈরি করে ভাবতে হবে যে এটাই ব্যতিক্রমহীন সর্বজনীন সত্য। তবে বাংলা ভাষার প্রাণকেন্দ্র বলে কলকাতা মহানগরকে যদি ধরে নিই, সেখানে কি বয়ে চলেছে শুধুই সুপবন? প্রচুর বাংলা বই বেরোচ্ছে, ঢাউস পত্রিকা বিনোদন-পণ্য হয়ে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে, লিটিল ম্যাগের টেবিলগুলিতে তুফান উঠছে। কোথাও কোনো সমস্যার ছায়া নেই, যথাপূর্ব তথাপরম্। বিপন্নতা কি তবে কেন্দ্রচ্যুত ও কেন্দ্রবহির্ভূত ভাষা-ব্যবহারকারীদের?

 লাগাতার কয়েক বছর কলকাতা বইমেলার দম-আটকানো ধুলো-ছিটোনো ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে, এত লাখ-লাখ যদি ক্রেতা-পাঠক, তাহলে ছোট পত্রিকাগুলোর নুন আনতে পান্তা ফুরোয় কেন? কেন স্ট্যাণ্ড প্যাভিলিয়নে আর টেবিলে-টেবিলে অক্রেতা আড্ডাবাজদের ছেঁড়াখোঁড়া জমায়েত শুধু? ‘সারী, তুমি কার’? ‘ওগো বাংলা ভাষা, তুমি কার?’মনে আসে বিকের সেই মৃত্যুহীন এপিটাফের দুটিপঙক্তি: Rose oh the pure contradiction, delight!/Of being no ones sleep under so many lids.' মনে হয়, ইউরেকা, এই তো পেয়ে গেছি বাংলা ভাষারও চমৎকার লাগসই এপিটাফ। ‘প্রত্যেকের চোখের পাতায়, তবু কারও নিদ্রা নও তুমি!’ কারা যেন সেদিন আক্ষেপ করছিলেন, ইংরেজি-মাধ্যম ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, থুড়ি শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে বাচ্চারা বাংলায় কথা বললে মা-বাবারা ‘আনকালচার্ড’ বলে প্রমাণিত হয়। এই লজ্জা পাওয়ার ভয়ে এখনকার সচেতন মা-বাবারা সদাসতর্ক। তবে আর বাংলা বই কে পড়বে, সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর, শিবরামের ওপর ধুলো জমবে। জমুক। সার্ক অ্যাক্সেল হ্যায় না’ গোছের ভঙ্গিতে দেখিয়ে দেওয়া যাবে ঝুড়ি-ঝুড়ি কমিক্স। না, হল। কম্পিউটার গেমস আর কেবল এনিমেশনস। তাই কফি হাউসে হোক আর বইমেলার টেবিলে হোক, তিরিশ-পঁয়তিরিশের নিচে কাউকে তীর্থের কাক হতে দেখি। ভাষার দোকানদারি এখনও করছেন মধ্যবয়স্ক ও প্রৌঢ় জনেরা।

 অতএব ভাষার ভবিষ্যৎ থাক, ভবিষ্যৎ অতীত নিয়ে কথা বলাই সমীচীন। অন্তর্জালের নব্যসংযোগ প্রকরণে সমস্তই অধিপরিসর, প্রতীত বাস্তবে ভাষাও প্রতীত। চিহ্নায়ন প্রকরণের বুদ্বুদ। ইংরেজি-মাধ্যমে যাঁরা কোনো-এক ভবিষ্যতের জন্যে মুদ্রা-উৎপাদক মানবযন্ত্রদের জড়ো করছেন আজ, ইংরেজি ভাষা নিয়েও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ইংরেজিটা সাহেবসুবোরা বলে, ওটা স্ট্যাটাস-সিম্বল তাই। ইউরোপ-আমেরিকায় সেটেন্ করার জন্যে ‘স্পোকেন ইংলিশ’-এ রপ্ত হওয়া চাই। নইলে হিব্রু-জাপানিও চলত। বাংলা মানে ‘হোপলেস’দের ভাষা, তা পড়েই বা কে, লেখে-ই বা কে! ট্যাগোর-সঙ দিয়ে সাহেব-সুবোদের মধ্যে যদি ‘এলিট’ হওয়া যায়, মন্দ কী! নোবেল প্রাইজ পেয়েছিল যখন, বাংলা ভাষার মতো ‘ফানি’ ল্যাঙ্গুয়েজে লিখলেও ট্যাগোর একেবারে যা-তা ছিল না বোধহয়! এই তো বাংলা ভাষার বর্তমান হাল-হকিকৎ, তার ভবিষ্যৎ অতীত নির্ধারিত হবে আত্মঘাতী বাতুলতার নিরিখে। আর, যাঁরা প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছেন ভাষার বহমান ধারাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে, গত তিন দশকে মহামারীর মতো ব্যাপ্ত হয়ে-যাওয়া সমবেত আত্মহনন সম্পর্কেও তাদের ভাবতে হবে এখন। বাংলার প্রতি উপেক্ষা হয়ে-যাওয়া সমবেত আত্মহনন সম্পর্কেও তাদের ভাবতে হবে এখন। বাংলার প্রতি উপেক্ষা এবং ইংরেজি-কেন্দ্রিকতার প্রতি লোলুপতা মূলত সময়ের অসুখের অভিব্যক্তি। সর্বত্র ব্যাপ্ত প্রতাপের ফড়ে হওয়ার জন্যেই ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে সব নীতিবোধ ত্যাগ করে ক্যাবারে নর্তকীদের মতো নগ্ন হয়ে পড়েছে এই প্রজন্ম। স্পিলবার্গের ছবির শিশু ডায়নোসোরদের মতো পিল পিল করে অধিপরিসরের খোলা ভেঙে, শূন্য থেকে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার জন্যে, বেরিয়ে আসছে কালচারাল বাসটার্ডেরা।

 ফলে প্রশ্নটা আর বাংলা ভাষায় সীমিত নেই। প্রশ্নটা এখন নির্মানবায়ন নিয়ে। মাতৃভাষার বিপন্নতা তাই কুলশীলগোত্রহীন সময়ের বিপন্নতা। এ সময় সাংস্কৃতিক, এ সময় রাজনৈতিক। ভারতীয় উপমহাদেশে অতিদ্রুত থাবা বসিয়েছে যে বিশ্বআধিপত্যবাদের উলঙ্গ রাজার দল, তাদের কাছে ভাষা-চেতনা মূল্যবোধ কিছু ভাঙা কাচের টুকরো মাত্র। আর, তাদের পার্যদেরা নিয়েছে ধূর্ত বিদূষকের ভূমিকা। যখন ভাষা-নীতি-ধর্ম-সংস্কৃতি-ভাবাদর্শ: সমস্তই আপেক্ষিকতার বুদ্বুদ এবং অধিপরিসরে প্রতীত ধারণামাত্র, সেই আধুনিকোত্তর প্রতিভার পর্যায়ে বাংলা ভাষাকে মানবিক স্বভাবে দীপ্যমান থাকার জন্যে নতুন লড়াই শুরু করতে হচ্ছে। এ সময় যারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মতন্ত্রের জিগির তোলে, তারা কুচক্রী। ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালিরা বাংলা ভাষায় জীবনস্পন্দন অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে ওই লড়াই শুরু করুক ওই কুচক্রীদের জমায়েতের বিরুদ্ধে। এছাড়া অন্য পথ নেই কোনো।

 বিশ শতকেও বাংলা ভাষার একটা লড়াই ছিল। বস্তুত ছিল উনিশ শতকেও। কিংবা, আঠারো ও অন্যান্য শতকে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে এর স্বরূপ আলাদা। সমাজের বিয়োগ পরিস্থিতি যেমন বিপন্নতার স্রষ্টা, তেমনই নিষ্ক্রমণের তাগিদও সমাজের মধ্যে তৈরি হয়। ভাষা-প্রয়োগের ধরন বদলে যায় কখনও, নতুন উপকরণ যুক্ত হয় কখনও বা। সর্বদা এই রূপান্তর দৃশ্যগ্রাহ্য হয় না কেননা ভাষার ছায়াতপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। সবচেয়ে বড় কথা, অর্থবোধ হওয়ার পদ্ধতিও বিনির্মিত হয় মূলত ভাষার সংযোগ সম্ভাবনাকে আরও শানিত ও প্রসারিত করার জন্যে। সংযোগ-ক্ষমতা শিথিল বা রহিত হওয়ার আশঙ্কাই তো ভাষার সবচেয়ে বড়ো বিপন্নতা। কখনো ভেতরে কখনো বাইরে আর কখনো একসঙ্গে ভেতরে ও বাইরে ওই বিপন্নতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা তাই স্বতশ্চলভাবে ভাষায় শুরু হয়। বিশ শতকের ঔপনিবেশিক আধুনিকতা তুঙ্গ মুহূর্তে পৌছাল, তারপর ক্রমশ দেখা গেল তার অবক্ষয়ী প্রবণতা। বাংলা ভাষার প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ নন শুধু, আরও বেশ কয়েকজন বাচনিক স্রষ্টার অসামান্য দক্ষতা দেখতে পেলাম তখন। দেখলাম বৃত্তবন্দিত্ব আর অবসাদও।

 এবার বিশ্বায়নের সূত্রে এসেছে নতুন প্রত্যাহ্বান, নতুন বিপন্নতা। একটু আগে যেমন লিখেছি, বাংলা ভাষাকে এদের মোকাবিলা করার জন্যে শক্তি সংগ্রহ করতে হবে নিজেরই মধ্যে। একটুখানি কি ঔচিত্যের স্বর এসে গেল? সম্ভবত ভাষাপ্রয়োগের নিরন্তর পুনর্বিন্যাসে অনিবার্য তার উপস্থিতি। মানববিশ্ব অভূতপূর্ব আক্রমণের মুখোমুখি বলেই ভাষা দিয়ে নির্মানবায়নের সন্ত্রাসকে প্রতিহত করতে হবে এখন। চতুর শত্রু তাই আমাদের নিরস্ত্র করতে চাইছে ভাষা-স্বভাবকে ধ্বংস করে দিয়ে। সর্বগ্রাসী বিয়োগপর্বের সাম্প্রতিক এই গোলকধাঁধায় নিক্ষিপ্ত হয়েও বলব, ভাষা অদাহ্য, অনির্বাণ। যখন পুরনো সব সংকেত ভোতা হয়ে যায়, ভাষা নিজেই নিজের কোরকগুলি মুকুলিত করে। একুশ শতকের অধিপরিসরে হয়তো তার আত্মখননের পদ্ধতি অভাবনীয় হতে পারে, এইমাত্র।

 বিপন্নতার নতুন নতুন ধরন দেখা দিচ্ছে, দিক। মানুষের নির্যাসবাহী ভাষা পাল্লা দিক তার সঙ্গে, হয়ে উঠুক সেরা অস্ত্র, যা একই সঙ্গে লক্ষ্যসন্ধানী ও লক্ষ্যভেদী।