সমালোচনা/ডি প্রোফণ্ডিস্

ডি প্রোফণ্ডিস্।

 টেনিসনের রচিত উক্ত কবিতাটির যথেষ্ট আদর হয় নাই। কোন কোন ইংরাজ সমালোচক ইহাকে টেনিসনের অযোগ্য বলিয়া মনে করেন, অনেক বাঙ্গালী পাঠক ইংরাজ সমালোচকদের ছাড়াইয়া উঠেন। ইংলণ্ডের হাস্যরসাত্মক সাপ্তাহিক পত্র “পঞ্চে” এই কবিতাটিকে বিদ্রুপ করিয়া De-Rotundis নামক একটি পদ্য প্রকাশিত হয়। আমরা এরূপ বিদ্রূপ কোনোমতেই অনুমোদন করি না। এরূপ ভাব ইংরাজদের ভাব। কোনো একটি বিখ্যাত মহান্‌ ভাবের কবিতাকে বিদ্রূপ করা তাঁহারা আমোদের মনে করেন। তাঁহাদের কেহ কেহ বলেন যে, কোনো কবির সম্ভ্রান্ত পূজনীয় কবিতাকে অঙ্গহীন করিয়া, রঙ চং মাখাইয়া ভাঁড় সাজাইয়া,রাস্তায় দাঁড় করাইয়া, দশ জন অলস লঘুহৃদয় পথিকের দুই পাটি দাঁত বাহির করাইলে সে কবির পক্ষে অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়, ইহাতে ইংরাজ হৃদয়ের এক অংশের শোচনীয় অঙ্গহীনতা প্রকাশ পায়। আমাদের জাতীয় ভাব এরূপ নহে। যদি একজন বৃদ্ধ পূজনীয় ব্যক্তিকে অপদস্ত করিবার জন্য সভামধ্যে কেহ তাঁহার হৃদয়-নিঃসৃত কথাগুলি বিকৃত স্বরে উচ্চারণ করিয়া মুখভঙ্গি করিতে থাকে, তবে তাহাকে দেখিয়া রসিক পুরুষ মনে করিয়া যাহারা হাসে তাহাদের ধোবা নাপিত বন্ধ করিয়া দেওয়া উচিত।

 টেনিসনের De Profundis কবিতাটি যে সমাদৃত হয় নাই তাহার একটা কারণ, বিষয়টি অত্যন্ত গভীর, গুরুতর। আর একটা কারণ, ইহাতে এমন কতকগুলি ভাব আছে যাহা সাধারণত ইংরাজেরা বুঝিতে পারেন না, আমরাই সে-সকল ভাব যথার্থ বুঝিবার উপযুক্ত। ইংরাজিবাগীশ শিক্ষিত বাঙালীদের অনেকে ইংরাজি কাব্য দিশী ভাবে সমালোচনা করিতে ভয় পান। তাঁহারা বলেন, যদি ইংরাজ সমালোচকদের উক্তির সহিত দৈবাৎ অমিল হইয়া যায়! না হয় তাহা হইল। ইংরাজ সমালোচকের কথা ইংরাজী হিসাবে যেরূপ সত্য, আমাদের দেশীয় সমালোচকের কথা আমাদের দেশী হিসাবে তেমনি সত্য; উভয়ই বিভিন্ন অথচ উভয়ই সত্য হইতে পারে। গোলাপ ফুল যদি তাহার প্রতিবেশী পাতাকে সূর্যকিরণে সবুজ হইতে দেখিয়া মনে করে, সূর্যকিরণে আমারও সবুজ হওয়া উচিত ও সবুজ হইয়া উঠাই যদি তাহার জীবনের একমাত্র ব্রত হয়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই ফুলমণ্ডলী তাহাকে পাগল বলিয়া আশঙ্কা করে।

 De Profundis কবিতাটি কবির সন্তানের জন্মোপলক্ষে লিখিত। সন্তানের জন্মোপলক্ষে লিখিত কবিতা সাধারণত লোকে যে ভাবে পড়িতে যায়, এই কবিতায় সহসা তাহাতে বাধা পায়। কচি মুখ, মিষ্ট হাসি, আধ-আধ কথা ইহার বিষয় নহে। একটি ক্ষুদ্রকায়া সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে মিষ্টভাব কচিভাব ব্যতীত আরেকটি ভাব প্রচ্ছন্ন আছে, তাহা সকলের চোখে পড়ে না কিন্তু তাহা ভাবুক কবির চক্ষে পড়ে। সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে একটি অপরিসীম মহান্‌ ভাব, অপরিমেয় রহস্য আবদ্ধ আছে, টেনিস্‌ন্‌ তাহাই প্রকাশ করিয়াছেন, সাধারণ পাঠকেরা তাহা বুঝিতে পারিতেছে না অথবা এই অচেনা ভাব হৃদয়ের মধ্যে আয়ত্ত করিতে পারিতেছে না।

 Tennyson এই কবিতাটিকে “The Two Greetings” কহিয়াছেন। অর্থাৎ, ইহাতে তাঁহার সন্তানটিকে দুই ভাবে তিনি সম্ভাষণ করিয়াছেন। প্রথমত, তাঁহার নিজের সন্তান বলিয়া; দ্বিতীয়ত, তাঁহার আপনাকে তফাত করিয়া। এক, তাহার মর্ত জীবন ধরিয়া, আর-এক তাহার অস্তিত্ব ধরিয়া। একটিতে, তাহাকে আংশিক ভাবে দেখিয়া, আর একটিতে তাহাকে সর্বতোভাবে দেখিয়া। তাঁহার সন্তানের মধ্যে তিনি দুইটি ভাগ দেখিতে পাইয়াছেন; একটি ভাগকে তিনি স্নেহ করেন, আর একটি ভাগকে তিনি ভক্তি করেন। প্রথম সম্ভাষণ স্নেহের সম্ভাষণ, দ্বিতীয় সম্ভাষণ ভক্তির। তাঁহার কবিতার এই উভয় ভাগেই কবি অনেকদূর পর্যন্ত দৃষ্টি প্রসারিত করিয়াছেন; এক দিগন্ত হইতে আর-এক দিগন্তে দৃষ্টিপাত করিয়াছেন।

 প্রথম ভাগ। প্রথম, শিশু জন্মাইতেই তিনি ভাবিলেন, এ কোথা হইতে আসিল? বৈদিক ঋষি-কবিরা মহা-অন্ধকারের রাজ্য হইতে দিগন্তপ্রসারিত সমুদ্রগর্ভ হইতে তরুণ সূর্যকে উঠিতে দেখিয়া যেমন সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করিতেন ‘এ কোথা হইতে আসিল’ তেমনি সসম্ভ্রমে কবি জিজ্ঞাসা করিলেন, এ কোথা হইতে আসিল? তিনি বর্তমান দেশকালের বন্ধনসীমা অতিক্রম করিয়া কত দূরে কত উচ্চে অতীতের মহাগঙ্গোত্রীশিখরের দিকে ধাবমান হইলেন। কবির বিচরণের স্থান এমন আর কোথায়? তিনি দেখিলেন, এই শিশুটি যে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে সেই পৃথিবীরই সহোদর। মহাসৌরজগতের যমজ ভ্রাতা। তিনি তাহাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিলেন, “বৎস আমার, মহাসমুদ্র হইতে, যেখানে যাহা-কিছু- ছিল’র মধ্যে যাহা-কিছু-হইবে (অর্থাৎ অতীতের মধ্যে ভবিষ্যৎ, অপরিস্ফুটতার মধ্যে পরিস্ফুটতা) কোটি কোটি যুগ যুগান্তর ধরিয়া অগণ্য আবর্তমান জ্যোতিঃপুঞ্জের মহামরুর মধ্যে ঘূর্ণ্যমান হইতেছিল, তুমি সেইখান হইতে আসিতেছ। সেইখান হইতেই সূর্য আসিয়াছে, পৃথিবী ও চন্দ্র আসিয়াছে, এবং তাহার অন্যান্য গ্রহ সহোদরগণ আসিয়াছে।” অতীতের সেই উষাগর্ভে কবি প্রবেশ করি য়াছেন; দেখিলেন অপরিস্ফুট পৃথিবীর কারণপুঞ্জ যেখানে আবর্তিত হইতেছে, আজিকার সদ্যোজাত শিশুটির কারণপুঞ্জ সেইখানে ঘুরিতেছে। উভয়ের বয়স এক; কেবল একজন ত্বরায় আমাদের চক্ষে প্রকাশিত হইয়াছে, আর-একজন প্রকাশিত হইতে বিলম্ব করিয়াছে।

Out of the deep, my child, out of the deep,
Where all that was to be, in all that was,
Whirl’d for a million icons thro’ the vast
Waste dawn of multitudinous eddying light–
Out of the deep, my child, out of the deep,
Thro’ all this changing world of changeless law,
And every phase of ever-heightening life,
And nine long months of antenatal gloom,
With this last moon, this crescent– her dark orb
Touch’d with earth’s light-thou comest, darling boy!

 অতীতের কথা শেষ হইয়াছে, এখন বর্তমানের কথা আসিতেছে। কবি শিশুটির পানে চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, অতীত কাল যাহাকে এত যত্নে লালনপালন করিয়া আসিয়াছে, সে কে? সে তাহারই প্রাণাধিক পুত্র। তাহারই পুত্রকে সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারার সঙ্গে অতীত মাতা এক গর্ভে ধারণ করিয়াছে, এক জ্যোতির্ময় দোলায় দোলাইয়াছে, এক স্তন পান করাইয়া পুষ্ট করিয়াছে, আজ তাঁহারই হস্তে সমর্পণ করিল। তাহার আজিকার এই প্রাণাধিক বৎস প্রকৃতির এত দিনকার যত্নের ধন। তাহাকে কহি লেন, “তুই আমাদের আপনার ধন। তোর সর্বাংশসুন্দর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও গঠন ভাবী সর্বাঙ্গসুন্দর বয়স্ক পুরুষের ভবিষ্যৎ সূচনা করিতেছে। আমার স্ত্রীর ও আমার মুখ ও গঠন তোর মুখের ও গঠনের মধ্যে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বিবাহিত হইয়াছে। “কবি দেখিলেন, সে নিতান্তই তাঁহাদের। তাহার শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাঁহাদের উভয়ের হইতে গঠিত হইয়াছে। অবশেষে তাহার ভবিষ্যতের দিকে চাহিয়া দেখিলেন ও কহিলেন; –

Live and be happy in thyself, and serve
This mortal race thy kin so well, that men
May bless thee as we bless thee, O young life
Breaking with laughter from the dark; and may
The fated channel where thy motion lives
Be prosperously shaped, and sway thy course
Along the years of haste and random youth
Unshatter’d; then full-current thro’ full man;
And last in kindly curves, with gentlest fall,
By quiet fields, a slowly-dying power,
To that last deep where we and thou are still.

 এখন আর সে নিতান্তই তাঁহাদের নহে। এখন তাহার নিজত্ব বিকশিত হইয়াছে। এখন তাহার নিজের কাজ আছে। কবি তাহার মর্ত্ত্য জীবনের তিনটি অবস্থা সমালোচনা করিয়াছেন। প্রথমে মর্ত্ত্য জীবনের আদি কারণ আলোচনা করিলেন, পরে তাহার জন্ম অর্থাৎ মনুষ্যশরীর-ধারণ আলোচনা করিলেন ও পরে তাহার পার্থিব জীবন আলোচনা করিলেন। এইখানেই সমস্ত ফুরাইল। প্রথম সম্ভাষণ শেষ হইল। এই সম্ভাষণে কবি একটি মর্ত্ত্যের মনুষ্যকে সম্ভাষণ করিয়াছেন। যতক্ষণ সে মনুষ্য ততক্ষণ সে তাঁহার। তাঁহাকে সমর্পণ করিবার জন্যই অতীত ইহাকে গড়িয়াছে। গঠিত অবস্থায় দেখিলেন সে তাঁহারই মত। ইহাতে কেবল শরীর ও জীবনের কথাই আছে। “তুমি বাঁচিয়া থাক, তুমি কাজ কর, তোমার জীবন পূর্ণতা প্রাপ্ত হউক, ও অবশেষে যথাসময়ে অতি ধীরক্রমে তাহার অবসান হউক।” ইহাই কবির সমস্ত সম্ভাষণের মর্ম্ম। কবি তাঁহার সন্তানের মর্ত্ত্য অংশকে সম্ভাষণ করিতেছেন, সুতরাং উপরি-উক্ত আশীর্ব্বচন মর্ত্ত্য জীবনের প্রতি সর্ব্বতোভাবে প্রয়োগ করা যাইতে পারে। যাহা হউক, এইখানেই সমস্ত শেষ হইয়া যায় – জীবন আরম্ভ হইল, জীবন শেষও হইল। তখন জীবনের সমাধিস্তম্ভের উপর কবি দাঁড়াইয়া দূর দূরান্তরে দৃষ্টি চালনা করিলেন; দেখিলেন জীবন শেষ হইল, তাঁহার সন্তান শেষ হইল, কিন্তু যে সূত্র বাহিয়া এই সন্তান আসিয়াছে সেই সূত্রের শেষ হইল না। তিনি এখন দেখিলেন অনন্ত পথের একজন পথিক, পথের মধ্যে অবস্থিত তাঁহার গৃহে, পৃথিবীতলে অতিথি হইয়াছে। এই আতিথ্যজীবনকে সন্তান বলে, মনুষ্য বলে। আতিথ্যজীবন ফুরায়, সন্তানও ফুরায়, মনুষ্যও ফুরায়, কিন্তু পথিক ফুরায় না। প্রথমে তিনি সেই অতিথিকে সম্ভাষণ করিলেন, এখন সেই মহাপান্থকে সম্ভাষণ করিতেছেন। এখন পৃথিবীর অতিথিকে নহে, মহাকালের অতিথিকে সম্ভাষণ করিলেন। এখন তিনি দেখিতেছেন যে, এই পথিক সৌর জগতেরও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। প্রথম সম্ভাষণে তিনি কোটি কোটি যুগ ও আবর্ত্ত্যমান আলোকের নির্ম্মাণশালার উল্লেখ করিয়াছেন, অপরিবর্ত্তনীয় পরিবর্ত্তনের জগতে ক্রমোত্থানশীল জীবনের উল্লেখ করিয়াছেন এবং কহিয়াছেন –

With this last moon, this crescent,– her dark orb
Touch’d with earth’s light– thou comest,”

অর্থাৎ মনুষ্যের জন্মও এইরূপ চন্দ্রকলার ন্যায়; তাহার একাংশ পৃথিবীর জীবন, পৃথিবীর বুদ্ধি পাইয়া আলোকিত হয়। দ্বিতীয় ভাগে যাহাকে সম্ভাষণ করিতেছেন তাহার কারণ আলোচনা করিতে গিয়া কবি সময়ের সংখ্যা গণনা করেন নাই, নির্ম্মাণের উপাদান উল্লেখ করেন নাই। এইবার তিনি কহিতেছেন –

Out of the deep, my child, out of the deep,
From that great deep, before our world begins,
Whereon the Spirit of God moves as he will–
Out of the deep, my child, out of the deep,
From that true world within the world we see,
Whereof our world is but the bounding shore–
Out of the deep, Spirit, out of the deep,
With this ninth moon, that sends the hidden sun
Down yon dark sea, thou comest, darling boy.

 এবার কবি যে সমুদ্রের কথা উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা আলোকের সমুদ্র নহে, অতীত বা ভবিষ্যৎ কালের দিকে তাহার উপকূল নাই, তাহা তিন কাল মগ্ন করিয়া বিরাজ করিতেছে। জগতের আত্মাকে তিনি উল্লেখ করিতেছেন। জগতের অন্তরস্থিত যথার্থ জগতের কথা বলিতেছেন। বাহ্য জগৎ সেই অন্তর্জগৎকে সীমাবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে মাত্র।

“Out of the deep, Spirit, out of the deep,
With this ninth moon, that sends the hidden sun
Down yon dark sea, thou comest, darling boy.

 সেই সমুদ্র হইতে তুমি আসিতেছ। জ্যোতির্ম্ময় সূর্য্যকে সমুদ্রতলে বিসর্জ্জন দিয়া ক্ষীণালোকে চন্দ্র উদিত হইল। তাহার সঙ্গে সঙ্গে তুমিও উদিত হইলে, তুমিও মহাজ্যোতিকে বিসর্জ্জন করিয়া আসিলে। পূর্ব্বে যে মনুষ্যকে কবি সম্ভাষণ করিয়াছিলেন, সে অপরিস্ফুটতর অবস্থা হইতে পরিস্ফুটতা প্রাপ্ত হইয়াছে, এবারে যে আত্মাকে সম্ভাষণ করিতেছেন সে পূর্ণ অবস্থা হইতে অপূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়াছে।

For in the world, which is not ours, They said
‘Let us make man’ and that which should be man,
From that one light no man can look upon,
Drew to this shore lit by the suns and moons
And all the shadows.’

 কি মহারহস্যপূর্ণ উক্তি! কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না, কিছুরই সীমা পাইতেছি না। “সে জগৎ আমাদের নহে।” সে কোন্‌ জগৎ? কে জানে কোন্‌ জগৎ। মহাকবি আদিকবির মনোজগৎ কি? “They said” তাহারা কহিল– কাহারা? কে জানে কাহারা! তাঁহার মনোরাজ্যের অধিবাসীরা? তাঁহার ভাব- সমূহ? তাঁহার কল্পনা? এখানে সমস্তই রহস্য। কবি আলোকের রাজ্যে অন্ধ হইয়া দিশাহারা হইয়া গিয়াছেন, স্পষ্ট করিয়া কিছুই দেখিতে পাইতেছেন না। এই নিমিত্ত তাঁহার কথা অস্পষ্ট অথচ মহান্‌ ভাবপূর্ণ। আমরা কল্পনায় দেখিতে পাইতেছি, একটি মর্ত্ত্যের শিশু বর্ণনার অতীত মহাজ্যোতির্ম্ময় অনন্ত রাজ্যের মধ্যে গিয়া পড়িয়াছে; কোথায় কি ঠাহর পাইতেছে না, চোখে ধাঁধা লাগিয়াছে, মন অভিভূত হইয়া গিয়াছে, মুখে কথা ফুটিতেছে না। তিনি কহিতেছেন, “যে জগৎ আমাদের নহে, সেই জগতে তাহারা কহিল– ‘আইস, আমরা মনুষ্য হই’।– ভাবী মনুষ্য, মনুষ্যচক্ষুর অসহনীয় সেই এক- আলোক হইতে এই ছায়ালোকিত উপকূলে আসিয়া উপস্থিত হইল।” One light ইতে তাহারা আসিতেছে। সেই জ্যোতির তাহারা অংশ। খৃষ্টান সমালোচকগণ এ-সকল ভাব বুঝিবে কিরূপে?

O dear spirit half lost
In thine own shadow and this fleshly sign
That thou art thou– who wailest being born
And banish’d into mystery, and the pain
Of this divisible-indivisible world
Among the numerable-innumerable
Sun, sun, and sun, thro’ finite-infinite space
In finite-infinite Time – our mortal veil
And shatter’d phantom of that infinite One,
Who made thee unconceivably Thyself
Out of His whole World-self and all in all—
Live thou;

 হে আত্মা, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? তুমি কি হইতে কি হইয়াছ! তুমি যে জগতে আসিয়াছ, তাহাকে ভাগ করিয়া শেষ করা যায়। তখন যে এক-জগতে ছিলে তাহা গণনার জগৎ নহে। এখন যে জগতে আসিয়াছ এখানে সূর্য্য নক্ষত্র গণনা করিয়া শেষ করা যায় না, তথাপি গণনা করা যায়। তখন অসীম দেশে অসীম কালে ছিলে, এখন যে দেশে যে কালে নির্ব্বাসিত হইয়াছ তাহার সীমা পাইতেছি না, অথচ সীমা আছে। তাহা সীমা-বিভক্ত অসীম।

তুমি কি ছিলে, কি হইয়াছ! তুমি ছিলে এক অসীমের মধ্যে, এখন তুমি তাঁহার চূর্ণ বিচূর্ণ উপচ্ছায়া মাত্র। কিন্তু এইখানেই তোমার শেষ নহে। তুমি অসীমের নিকট হইতে অসীম দূরে আসিয়াছ; তুমি অনন্তকাল ধরিয়া ক্রমশঃ তাঁহার নিকটবর্ত্তী হইতে থাকিবে। তোমাকে আর কি কহিব! –

“Live thou! and of the grain and husk, the grape
And ivyberry, choose; and still depart
From death to death thro’ life and life, and find
Nearer and ever nearer Him, who wrought
Not matter, nor the finite-infinite,
But this, main-miracle, that thou art thou,
With power on thine own act and on the world.”

 প্রথম সম্ভাষণে মনুষ্য-ভাবে তোমাকে কহিয়াছিলাম

‘Live, and be happy in thyself, and serve
This mortal race thy kin.”

 বাঁচিয়া থাক, তুমি সুখী হও, তোমার স্বজাতীয় জীবদিগকে সুখী কর ও অবশেষে বিনা কষ্টে ধীরে ধীরে মৃত্যু লাভ কর। মানুষের পক্ষে ইহা অপেক্ষা আর কি আশীর্ব্বাদ আছে! কিন্তু দ্বিতীয় সম্ভাষণে তোমাকে কহিতেছি “বাঁচিয়া থাক।” এখানে বাঁচিয়া থাকার অর্থে মর্ত্ত্য জীবন নহে, অনন্ত চেতনা। জন্মে জন্মে যাহা ভাল তাহাই গ্রহণ কর, যাহা মন্দ তাহাই পরিত্যাগ কর। ও পদে পদে মৃত্যুর দ্বারসমূহ অতিক্রম করিয়া অমৃতের দিকে ধাবমান হও। দুইটি সম্ভাষণে দুই প্রকারের বিভিন্ন আশীর্ব্বাদ কেন করিলাম? না, প্রথম বারে আমি বস্তু (matter) ও সসীম-অসীমকে সম্বোধন করিয়াছিলাম। দ্বিতীয় বারে আমি তোকে সম্ভাষণ করিতেছি Who art “not matter, nor the finite-infinite, but this main-miracle, that thou art thou, with power on thine own act and on the world.”

 সন্তানের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কবি কি এক অনন্ত রাজ্যের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইয়াছেন! এই অনন্তমন্দিরে গিয়া তিনি কাহাকে দেখিতে পাইলেন? কী গান গাইয়া উঠিলেন? বৈদিক ঋষিরা যে গান গাইয়াছেন।

Hallowed be Thy name– Halleluiah!–
Infinite Ideality!
Immeasurable Reality;
Infinite Personality;
Hallowed be Thy name– Halleluiah!
We feel we are nothing– for all is Thou and in Thee
We feel we are something– that also has come from
thee;
We know we are nothing– but Thou wilt help us to be.
Hallowed be Thy name– Halleluiah:

 অনন্ত ভাব। অপরিমেয় সত্য। অপরিসীম পুরুষ। অনন্ত ভাব আমাদের হইতে অত্যন্ত দূরবর্তী। কিছুতেই তাহার কাছে যাইতে পারি না। অবশেষে সেই ভাব মাত্রকে যখন সত্য বলিয়া জানিলাম, তখন তিনি আমাদের আরো কাছে আসিলেন। কিন্তু তাঁহাকে কেবলমাত্র সত্য বলিয়া জানিয়া তৃপ্তি হয় না। কেবল মাত্র একটি অন্ধ কারণ, অন্ধ শক্তি, অন্ধ সত্য বলিয়া জানিলে সম্পূর্ণ জানা হয় না। যখন জানিলাম তিনি অসীম পুরুষ, তাঁহার নিজত্ব আছে, তখন তিনি আমাদের কাছে আসিলেন, তখন তাঁহাকে আমরা প্রীতি করিতে পারিলাম। তখন তাঁহাকে কহিলাম তোমার জয় হউক!

 “We feel we are nothing– for all is Thou and in Thee” হা অতীতের কথা। যখন আমরা তোমার মধ্যে ছিলাম তখন আমরা অনুভব করিতাম না যে আমরা কিছু, সকলই তুমি। ইহাই আমাদের ভাব মাত্র। তোমার মধ্যে আমরা ভাব মাত্রে ছিলাম। অবশেষে তোমার কাছ হইতে যখন আসিলাম তখন অনুভব করিতে লাগিলাম আমরা কিছু We feel we are something– that also has come from Thee ইহা বর্তমানের কথা, ইহাই আমাদের সত্য। এখন আমরা কিছু হইয়াছি, আমরা সত্য হইয়াছি, “We know we are nothing – but Thou wilt help us to be.” ইহা ভবিষ্যতের কথা। আমরা জানি আমরা কিছুই নই –তুমি আমাদের ক্রমশই গঠিত করিয়া তুলিতেছ, আমাদের ব্যক্ত করিয়া তুলিতেছ! মৃত্যুর মধ্য দিয়া নূতন নূতন সত্য, নূতন নূতন জ্ঞান শিখাইয়া আমাদের পূর্ণ ব্যক্তি করিয়া তুলিতেছ। কোনো কালেই তাহা হইতে পারিব না, চিরকালই “Thou wilt help us to be” অপূর্ণতা হইতে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হইবার আনন্দ আমরা চিরকাল ভোগ করিব। তোমার জয় হউক। মর্ত জীবনেও এই ক্রমোন্নতির তুলনা মিলে। মনুষ্য প্রথমে এক মহা বাষ্পরাশির মধ্যে, সমস্ত জগতের আদিভূতের মধ্যে মিলিয়া ছিল। ক্রমে ক্রমে অল্পে অল্পে পৃথক্‌ হইয়া মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করিল। অবশেষে যতই সে বড়ো হইতে লাগিল, অভিজ্ঞতা লাভ করিতে লাগিল, ততই তাহার ব্যক্তিত্ব জন্মিতে লাগিল। এই ক্রম অনুসারেই কবি ঈশ্বরকে প্রথমে অনন্ত ভাব, পরে অপরিমেয় সত্য ও তৎপরে অপরিসীম পুরুষ বলিয়াছেন। এইখানে কবিতা শেষ হইল। ইহার পরে আর কোথায় যাইবে? ইহাই চূড়ান্ত সীমা! যাঁহারা একটা দৈত্যকে পর্বত বলিলে, দৈত্যের যষ্টিকে শালবৃক্ষ কহিলে মহান্‌ভাবে হাঁ করিয়া থাকেন, তাঁহারা যে এত বড় কবিতার মহান্‌ ভাব উপলব্ধি করিতে পারেন না ইহাই আশ্চর্য। বস্তুগত মহান্‌ ভাব পর্যন্তই বোধ করি তাঁহাদের কল্পনার সীমা, বস্তুর অতীত মহান্‌ ভাব তাঁহারা আয়ত্ত করিতে পারেন না। তাহা যদি পারিতেন তবে তাঁহারা এই ক্ষুদ্র কবিতাটিকে সমস্ত ‘Paradise Lost’ এর অপেক্ষা মহান্‌ বলিয়া বিবেচনা করিতেন।