সমালোচনা/নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি

নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি।


 একটা কথা উঠিয়াছে, মানুষ মাত্রেই কবি। যাহার মনে ভাব আছে, যে দুঃখে কাঁদে, সুখে হাসে, সেই কবি! কথাটা খুব নূতনতর। সচরাচর লোকে কবি বলিতে এমন বুঝে না। সচরাচর লোকে যাহা বলে তাহার বিপরীত একটা কথা শুনিলে অনেক সময় আমাদিগের ভারি ভালো লাগিয়া যায়। যাহার মনোবৃত্তি আছে সেই কবি, এ কথাটা এখনকার যুবকদের মধ্যে অনেকেরই মুখে শুনা যায়। কবি শব্দের ঐরূপ অতিবিস্তৃত অর্থ এখন একটা ফ্যাসান হইয়াছে বলিলে অধিক বলা হয় না। এমন-কি নীরব-কবি বলিয়া একটি কথা বাহির হইয়া গিয়াছে ও সে কথা দিনে দিনে খুব চলিত হইয়া আসিতেছে। এত দূর পর্যন্ত চলিত হইয়াছে যে, আজ যদি আমি এমন একটা পুরাতন কথা বলি যে, নীরব-কবি বলিয়া একটা কোন পদার্থই নাই তাহা হইলে আমার কথাটাই লোকের নূতন বলিয়া ঠেকে। আমি বলি কি, যে নীরব সেই কবি নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমার যা মত অধিকাংশ লোকেরই আন্তরিক তাহাই মত। লোকে বলিবে, “ও কথা তো সকলেই বলে, উহার উল্টাটা যদি কোন প্রকারে প্রমাণ করাইয়া দিতে পার’, তাহা হইলে বড় ভালো লাগে।” ভালো তো লাগে, কিন্তু বিষয়টা এমনতর যে তাহাতে একটা বই দুইটা কথা উঠিতে পারে না। কবি কথাটা এমন একটা সমস্যা নয় যে তাহাতে বুদ্ধির মারপ্যাঁচ খেলানো যায়, “বীজ হইতে বৃক্ষ কি বৃক্ষ হইতে বীজ “এমন একটা তর্কের খেলেনা নয়। ভাবপ্রকাশের সুবিধার জন্য লোকসাধারণে একটি বিশেষ পদার্থের একটি বিশেষ নামকরণ করিয়াছে, সেই নামে তাহাকে সকলে ডাকিয়া থাকে ও অনেক দিন হইতে ডাকিয়া আসিতেছে, তাহা লইয়া আর তর্ক কী হইতে পারে? লোকে কাহাকে কবি বলে? যে ব্যক্তি বিশেষ শ্রেণীর ভাবসমূহ (যাহাকে আমরা কবিতা বলি) ভাষায় প্রকাশ করে।[১] নীরব ও কবি দুটি অন্যোন্যবিরোধী কথা, তথাপি যদি তুমি বিশেষণ নীরবের সহিত বিশেষ্য কবির বিবাহ দিতে চাও, তবে এমন একটি পরস্পরধ্বংসী দম্পতির সৃষ্টি হয়, যে, শুভদৃষ্টির সময় পরস্পর চোখোচোখি হইবামাত্রেই উভয়ে প্রাণত্যাগ করে। উভয়েই উভয়ের পক্ষে ভস্মলোচন। এমনতর চোখোচোখিকে কি অশুভদৃষ্টি বলাই সঙ্গত নয়, অতএব এমনতর বিবাহ কি না দিলেই নয়? এমন হয় বটে, যে, তুমি যাহাকে কবি বল আমি তাহাকে কবি বলি না; এই যুক্তির উপর নির্ভর করিয়া তুমি বলিতে পার বটে, যে, “যখন বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন লোকে কবি বলিয়া থাকে, তখন কি করিয়া বলা যাইতে পারে যে কবি বলিতে সকলেই এক অর্থ বুঝে? “আমি বলি কি, একই অর্থ বুঝে! যখন পদ্যপুণ্ডরীকের গ্রন্থকার শ্রীযুক্ত রামবাবুকে তুমি কবি বলিতেছ, আমি কবি বলিতেছি না ও কবিতাচন্দ্রিকার গ্রন্থকার শ্রীযুক্ত শ্যামবাবুকে আমি কবি বলিতেছি তুমি বলিতেছ না, তখন তোমাতে আমাতে এই তর্ক যে, “রামবাবু কি এমন কবি যে তাঁহাকে কবি বলা যাইতে পারে?” বা “শ্যামবাবু কি এমন কবি যে তাঁহাকে কবি বলা যাইতে পারে?” রামবাবু ও শ্যামবাবু এক স্কুলে পড়েন, তবে তাঁহাদের মধ্যে কে ফাষ্ট্‌ ক্লাসে পড়েন কে লাষ্ট্‌ ক্লাসে পড়েন তাহাই লইয়া কথা। রামবাবু ও শ্যামবাবু যে এক স্কুলে পড়েন, সে স্কুলটি কি? না, প্রকাশ করা। তাঁহাদের মধ্যে সাদৃশ্য কোথায়? না, প্রকাশ করা লইয়া। বৈসাদৃশ্য কোথায়? কিরূপে প্রকাশ করা হয় তাহা লইয়া। তবে, ভাল কবিতাকেই আমরা কবিতা বলি, কবিতা খারাপ হইলে তাহাকে আমরা মন্দ কবিতা বলি, সুকবিতা হইতে আরও দূরে গেলে তাহাকে আমরা কবিতা না বলিয়া শ্লোক বলিতে পারি, ছড়া বলিতে প্রবন্ধটির মধ্যে আড়ম্বর করিয়া কবিতা কথাটির একটি দুরূহ সংজ্ঞা নির্ণয় করিতে বসা সাজে না বলিয়া আমরা নিরস্ত হইলাম। পারি, যাহা ইচ্ছা। পৃথিবীর মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জীবকে আমরা মানুষ বলি, তাহার কাছাকাছি যে আসে তাহাকে বনমানুষ বলি, মানুষ হইতে আরো তফাতে গেলে তাহাকে মানুষও বলি না, বনমানুষও বলি না, তাহাকে বানর বলি। এমন তর্ক কখনো শুনিয়াছ যে Wordsworth শ্রেষ্ঠ কবি না ভজহরি (যে ব্যক্তি লেখনীর আকার কিরূপ জানে না) শ্রেষ্ঠ কবি? অতএব এটা দেখিতেছ, কবিতা প্রকাশ না করিলে কাহাকেও কবি বলা যায় না। তোমার মতে ত বিশ্ব-সুদ্ধ লোককে চিত্রকর বলা যাইতে পারে। এমন ব্যক্তি নাই, যাহার মনে অসংখ্য চিত্র অঙ্কিত না রহিয়াছে, তবে কেন মনুষ্যজাতির আর এক নাম রাখ না চিত্রকর? আমার কথাটি অতি সহজ কথা। আমি বলি যে, যে ভাববিশেষ ভাষায় প্রকাশ হয় নাই তাহা কবিতা নহে ও যে ব্যক্তি ভাববিশেষ ভাষায় প্রকাশ করে না সেও কবি নহে। যাঁহারা ‘নীরব কবি’ কথার সৃষ্টি করিয়াছেন তাঁহারা বিশ্বচরাচরকে কবিতা বলেন। এ-সকল কথা কবিতাতেই শোভা পায়। কিন্তু অলঙ্কারশূন্য গদ্যে অথবা তর্কস্থলে বলিলে কি ভাল শুনায়? একটা নামকে এরূপ নানা অর্থে ব্যবহার করিলে দোষ হয় এই যে, তাহার দুইটা ডানা বাহির হয়, এক স্থানে ধরিয়া রাখা যায় না ও ক্রমে ক্রমে হাতছাড়া এবং সকল কাজের বাহির হইয়া বুনো হইয়া দাঁড়ায়, “আয়” বলিয়া ডাকিলেই খাঁচার মধ্যে আসিয়া বসে না। আমার কথাটা এই যে, আমার মনে আমার প্রেয়সীর ছবি আঁকা আছে বলিয়াই আমি কিছু চিত্রকর নই ও ক্ষমতা থাকিলেই আমার প্রেয়সীকে আঁকা যাইতে পারিত বলিয়া আমার প্রেয়সী একটি চিত্র নহেন।

 অনেকে বলেন, সমস্ত মনুষ্যজাতি সাধারণতঃ কবি ও বালকেরা অশিক্ষিত-লোকেরা বিশেষরূপে কবি। এ মতের পূর্ব্বোক্ত মতটির ন্যায় তেমন বহুল প্রচার হয় নাই। তথাপি তর্ককালে অনেকেরই মুখে এ কথা শুনা যায়। বালকেরা যে কবি নয়, তাহার প্রমাণ পূর্ব্বেই দেওয়া হইয়াছে। তাহারা কবিতাময় ভাষায় ভাব প্রকাশ করে না। অনেকে কবিত্ব অনুভব করেন, কবিত্ব উপভোগ করেন, যদি বা বলপূর্ব্বক তুমি তাঁহাদিগকেও কবি বল তথাপি বালকদিগকে কবি বলা যায় না। বালকেরা কবিত্ব অনুভব করে না, কবিত্ব উপভোগ করে না; অর্থাৎ, বয়স্ক লোকদের মত করে না। অনুভব ত সকলেই করিয়া থাকে, পশুরাও ত সুখ দুঃখ অনুভব করে। কিন্তু কবিত্ব-অনুভব কয়জন লোকে করে? যথার্থ সুন্দর ও যথার্থ কুৎসিত কয়জন ব্যক্তি পরখ করিয়া তফাৎ করিয়া দেখে ও বুঝে? অধিকাংশ লোক সুন্দর চিনিতে ও উপভোগ করিতেই জানে না। সুন্দর বস্তু কেন সুন্দর তাহা বুঝিতে পারা, অন্য সমস্ত সুন্দর বস্তুর সহিত তুলনা করিয়া তাহাকে তাহার যথাযোগ্য আসন দেওয়া, একটা সুন্দর বস্তু হইতে দশটা সুন্দর বস্তুর কথা মনে পড়া, অবস্থাবিভেদে একটি সুন্দর বস্তুর সৌন্দর্য্যবিভেদ কল্পনা করিতে পারা কি সকলের সাধ্য? সকল চক্ষুই কি শরীরী পদার্থের মধ্যে অশরীরী কি-একটি দেখিতে পায়? অল্পই হউক আর অধিক হউক কল্পনা ত সকলেরই আছে। উন্মাদগ্রস্ত ব্যক্তির অপেক্ষা কল্পনা কাহার আছে? কল্পনা প্রবল হইলেই কবি হয় না। সুমার্জ্জিত সুশিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণীর কল্পনা থাকা আবশ্যক। কল্পনাকে যথাপথে নিয়োগ করিবার নিমিত্ত বুদ্ধি ও রুচি থাকা আবশ্যক করে। পূর্ণচন্দ্র যে হাসে, বা জ্যোৎস্না যে ঘুমায়, এ কয়জন বালকের কল্পনায় উদিত হয়? একজন বালক যদি অসাধারণ কাল্পনিক হয়, তবে পূর্ণচন্দ্রকে একটি আস্ত লুচি বা অর্দ্ধচন্দ্রকে একটি ক্ষীরপুলি মনে করিতে পারে। তাহাদের কল্পনা সুসংলগ্ন নহে; কাহার সহিত কাহার যোগ হইতে পারে, কোন্‌ কোন্‌ দ্রব্যকে পাশাপাশি বসাইলে পরস্পর পরস্পরের আলোকে অধিকতর পরিস্ফুট হইতে পারে, কোন্‌ দ্রব্যকে কি ভাবে দেখিলে তাহার মর্ম্ম তাহার সৌন্দর্য্য চক্ষে বিকাশ পায়, এ সকল জানা অনেক শিক্ষার কাজ। একটি দ্রব্য অনেক ভাবে দেখা যাইতে পারে। বৈজ্ঞানিকেরা এক ভাবে জগৎ দেখেন, দার্শনিকেরা একভাবে দেখেন ও কবিরা আর এক ভাবে দেখেন। তিন জনে তিন প্রকার পদ্ধতিতে একই বস্তু দেখিতে পারেন। তুমি কি বল উহার মধ্যে দুই প্রকার পদ্ধতি আয়ত্ত করিতে শিক্ষার আবশ্যক করে, আর তৃতীয়টিতে করে না? শুদ্ধ করে না তাহাই নয়, শিক্ষাতেই তাহার বিনাশ! কোন্‌ দ্রব্য কোন্‌ শ্রেণীর, কিসের সহিত তাহার ঐক্য ও কিসের সহিত তাহার অনৈক্য, তাহা সূক্ষ্মানুসূক্ষ্মরূপে নির্ণয় করা দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও কবি তিন জনেরই কাজ। তবে একটা দ্রব্যের তিনটি দিক আছে, তিন জন তিন বিভিন্ন দিকের ভার লইয়াছেন। তিন জনের মধ্যে এই মাত্র প্রভেদ, আর কিছু প্রভেদ আছে কি? অনেক ভাল ভাল কবি যে ভাবের পার্শ্বে যে ভাব বসানো উচিত, স্থানে স্থানে তাহার ব্যতিক্রম করিয়া শিক্ষার অসম্পূর্ণতা প্রকাশ করিয়াছেন। Marlowর “Come, live with me and be my love” নামক সুবিখ্যাত কবিতাতে ইহা লক্ষিত হয়।

“হবি কি আমার প্রিয়া, রবি মোর সাথে?
অরণ্য, প্রান্তর, নদী, পর্ব্বত গুহাতে
যত কিছু, প্রিয়তমে, সুখ পাওয়া যায়,
দু-জনে মিলিয়া তাহা ভোগ করি আয়!
শুনিব শিখরে বসি পাখী গায় গান
নদীর শব্দ-সাথে মিশাইয়া তান;
দেখিব চাহিয়া সেই তটিনীর তীরে
রাখাল গরুর পাল চরাইয়া ফিরে।

রচি দিব গোলাপের শয্যা মনোমত,
সুরভি ফুলের তোড়া দিব কত শত;
গড়িব ফুলের টুপি, পরিবি মাথায়;
আঙিয়া রচিয়া দিব গাছের পাতায়।
লয়ে মেষশিশুদের কোমল পশম
বসন বুনিয়া দিব অতি অনুপম;
সুন্দর পাদুকা এক করিয়া রচিত
খাঁটি সোনা দিয়ে তাহা করিব খচিত।
কটিবন্ধ গড়ি দিব গাঁথি তৃণজাল,
মাঝেতে বসায়ে দিব একটি প্রবাল।
এই সব সুখ যদি তোর মনে ধরে
হ’ আমার প্রিয়তমা, আয় মোর ঘরে।
হস্তিদন্তে গড়া এক আসনের ‘পরে
আহার আনিয়া দিবে দুজনের তরে–
দেবতার উপভোগ্য, মহার্ঘ্য এমন,
রজতের পাত্রে দোঁহে করিব ভোজন।
রাখাল-বালক যত মিলি একত্তরে
নাচিবে গাইবে তোর আমোদের তরে।
এই সব সুখ যদি মনে ধরে তব
হ’ আমার প্রিয়তমা, এক সাথে রব’।

 এ কবিতাতে একটি বিশেষ ভাবকে সমগ্র রাখা হয় নাই। মাঝখানে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। যে বিশাল কল্পনায় একটি ভাব সমগ্র প্রতি বিম্বিত হয়, যাহাতে যোড়াতাড়া দিতে হয় না, সে কল্পনা ইহাতে প্রকাশিত হয নাই। অরণ্য, পর্বত, প্রান্তরে যত কিছু সুখ পাওয়া যায়, তাহাই যে বাখানের আয়ত্তাধীন, যে ব্যক্তি গোলাপের শয্যা ফুলের টুপি ও পাতার আঙিয়া নির্ম্মাণ করিয়া দিবার লোভ দেখাইতেছে সে স্বর্ণখচিত পাদুকা, রজতের পাত্র, হস্তিদন্তের আসন পাইবে কোথায়? তৃণনির্ম্মিত কটিবন্ধের মধ্যে কি প্রবাল শোভা পায়? কবিকঙ্কণের কমলে কামিনীতে একটি রূপসী ষোড়শী হস্তী গ্রাস ও উদগার করিতেছে, ইহাতে এমন পরিমাণ সামঞ্জস্যের অভাব হইয়াছে যে, আমাদের সৌন্দর্য্যজ্ঞানে অত্যন্ত আঘাত দেয়।[২] শিক্ষিত, সংযত, মার্জ্জিত কল্পনায় একটি রূপসী যুবতীর সহিত গজাহার ও উদগীরণ কোনমতেই একত্রে উদয় হইতে পারে না।

 কল্পনারও শিক্ষা আবশ্যক করে। যাহাদের কল্পনা শিক্ষিত নহে, তাহারা অতিশয় অসম্ভব অলৌকিক কল্পনা করিতে ভালবাসে; বক্র দর্পণে মুখ দেখিলে নাসিকা পরিমাণাধিক বৃহৎ এবং কপাল ও চিবুক নিতান্ত হ্রস্ব দেখায়। অশিক্ষিতদের কুগঠিত কল্পনাদর্পণে স্বাভাবিক দ্রব্য যাহা কিছু পড়ে তাহার পরিমাণ ঠিক থাকে না; তাহার নাসা বৃহৎ ও তাহার কপাল খর্ব্ব হইয়া পড়ে। তাহারা অসঙ্গত পদার্থের জোড়াতাড়া দিয়া এক-একটা বিকৃতাকার পদার্থ গড়িয়া তোলে। তাহারা শরীরী পদার্থের মধ্যে অশরীরী ভাব দেখিতে পায় না। তথাপি যদি বল বালকেরা কবি, তবে নিতান্ত বালকের মত কথা বলা হয়। প্রাচীন কালে অনেক ভাল কবিতা রচিত হইয়া গিয়াছে বলিয়াই, বোধ হয়, এই মতের সৃষ্টি হইয়া থাকিবে যে, অশিক্ষিত ব্যক্তিরা বিশেষরূপে কবি। তুমি বল দেখি, ওটাহিটি দ্বীপবাসী বা এস্কুইমোদের ভাষায় কয়টা পাঠ্য কবিতা আছে? এমন কোন্‌ জাতির মধ্যে ভাল কবিতা আছে যে জাতি সভ্য হয় নাই। যখন রামায়ণ মহাভারত রচিত হইয়াছিল তখন প্রাচীন কাল বটে, কিন্তু অশিক্ষিত কাল কি? রামায়ণ মহাভারত পাঠ করিয়া কাহারো মনে কি সে সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে? ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে মহা মহা কবিরা ইংলণ্ডে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের কবিতায় কি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রভাব লক্ষিত হয় না? Copleston কহেন, “Never has there been a city of which its people might be more justly proud, whether they looked to its past or its future than Athens in the days of Eschylus.”

 অনেকে কল্পনা করেন যে, অশিক্ষিত অবস্থায় কবিত্বের বিশেষ স্ফূর্ত্তি হয়; তাহার একটি কারণ এই যে, তাঁহাদের মতে একটি বস্তুর যথার্থ স্বরূপ না জানিলে তাহাতে কল্পনার বিচরণের সহস্র পথ থাকে। সত্য একটি মাত্র, মিথ্যা অগণ্য। অতএব মিথ্যায় কল্পনার যেরূপ উদরপূর্ত্তি হয় সত্যে সেরূপ হয় না। পৃথিবীতে অখাদ্য যত আছে তাহা অপেক্ষা খাদ্য বস্তু অত্যন্ত পরিমিত। একটি খাদ্য যদি থাকে ত সহস্র অখাদ্য আছে। অতএব এমন মত কি কোন পণ্ডিতের মুখে শুনিয়াছ যে, অখাদ্য বস্তু আহার না করিলে মনুষ্য-বংশ ধ্বংস হইবার কথা?

 প্রকৃত কথা এই যে, সত্যে যত কবিতা আছে, মিথ্যায় তেমন নাই। শত সহস্র মিথ্যার দ্বারে দ্বারে কল্পনা বিচরণ করিতে পারে, কিন্তু এক মুষ্টি কবিতা সঞ্চয় করিতে পারে কি না সন্দেহ; কিন্তু একটি সত্যের কাছে যাও, তাহার দশগুণ অধিক কবিতা পাও কি না দেখ দেখি। কেনই বা তাহার ব্যতিক্রম হইবে বল? আমরা ত প্রকৃতির কাছেই কবিতা শিক্ষা করিয়াছি, প্রকৃতি কখনো মিথ্যা কহেন না। আমরা কি কখনো কল্পনা করতে পারি যে, লোহিতবর্ণ ঘাসে আমাদের চক্ষু জুড়াইয়া যাইতেছে? বল দেখি, পৃথিবী নিশ্চল রহিয়াছে ও আকাশে অগণ্য তারকারাজি নিশ্চলভাবে খচিত রহিয়াছে ইহাতে অধিক কবিত্ব, কি সমস্ত তারকা নিজের পরিবার লইয়া ভ্রমণ করিতেছে তাহাতে অধিক কবিত্ব; এমনি তাহাদের তালে তালে পদক্ষেপ যে, একজন জ্যোতির্ব্বিদ্‌ বলিয়া দিতে পারেন-কাল যে গ্রহ অমুক স্থানে ছিল আজ সে কোথায় আসিবে। প্রথম কথা এই যে, আমাদের কল্পনা প্রকৃতি অপেক্ষা কবিত্বপূর্ণ বস্তু সৃজন করিতে অসমর্থ; দ্বিতীয় কথা এই যে, আমরা যে অবস্থার মধ্যে জন্মগ্রহণ করিয়াছি তাহার বহির্‌ভূত সৌন্দর্য্য অনুভব করিতে পারি না।

 অনেক মিথ্যা, কবিতায় আমাদের মিষ্ট লাগে। তাহার কারণ এই যে, যখন সেগুলি প্রথম লিখিত হয় তখন তাহা সত্য মনে করিয়া লিখিত হয়, ও সেই অবধি বরাবর সত্য বলিয়া চলিয়া আসিতেছে। আজ তাহা আমি মিথ্যা বলিয়া জানিয়াছি, অর্থাৎ জ্ঞান হইতে তাহাকে দূর করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছি; কিন্তু হৃদয়ে সে এমনি শিকড় বসাইয়াছে যে, সেখান হইতে তাহাকে উৎপাটন করিবার যো নাই। কবি যে ভূত বিশ্বাস না করিয়াও ভূতের বর্ণনা করেন, তাহার তাৎপর্য্য কি? তাহার অর্থ এই যে, ভূত বস্তুতঃ সত্য না হইলেও আমাদের হৃদয়ে সে সত্য। ভূত আছে বলিয়া কল্পনা করিলে যে আমাদের মনের কোন্‌খানে আঘাত লাগে, কত কথা জাগিয়া উঠে, অন্ধকার, বিজনতা, শ্মশান, এক অলৌকিক পদার্থের নিঃশব্দ অনুসরণ, ছেলেবেলাকার কত কথা মনে উঠে – এ-সকল সত্য যদি কবি না দেখেন ত কে দেখিবে?

 সত্য এক হইলেও যে দশ জন কবি সেই এক সত্যের মধ্যে দশ প্রকার বিভিন্ন কবিতা দেখিতে পাইবেন না তাহা তো নহে। এক সূর্যকিরণে পৃথিবী কত বিভিন্ন বর্ণ ধারণ করিয়াছে দেখো দেখি! নদী যে বহিতেছে, এই সত্যটুকুই কবিতা নহে। কিন্তু এই বহমানা নদী দেখিয়া আমাদের হৃদয়ে যে ভাববিশেষের জন্ম হয়, সেই সত্যই যথার্থ কবিতা। এখন বলো দেখি, এক নদী দেখিয়া সময়ভেদে কত বিভিন্ন ভাবের উদ্রেক হয়! কখনো নদীর কণ্ঠ হইতে বিষণ্ন গীতি শুনিতে পাই; কখনো বা তাহার উল্লাসের কলস্বর, তাহার শত তরঙ্গের নৃত্য আমাদের মনকে মাতাইয়া তোলে। জ্যোৎস্না কখনো সত্য-সত্যই ঘুমায় না, অর্থাৎ সে দুটি চক্ষু মুদিয়া পড়িয়া থাকে না ও জ্যোৎস্নার নাসিকাধ্বনিও কেহ কখনো শুনে নাই। কিন্তু নিস্তব্ধ রাত্রে জ্যোৎস্না দেখিলে মনে হয় যে জ্যোৎস্না ঘুমাইতেছে, ইহা সত্য। জ্যোৎস্নার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তন্ন তন্ন রূপে আবিষ্কৃত হউক, এমনও প্রমাণ হউক যে জ্যোৎস্না একটা পদার্থই নহে, তথাপি লোকে বলিবে জ্যোৎস্না ঘুমাইতেছে। তাহাকে কোন্‌ বৈজ্ঞানিক-চূড়ামণি মিথ্যাকথা বলিতে সাহস করিবে?


  1. প্রবন্ধটির মধ্যে আড়ম্বর করিয়া কবিতা কথাটির একটি দুরূহ সংজ্ঞা নির্ণয় করিতে বসা’ সাজে না বলিয়া আমরা নিরস্ত হইলাম।
  2.  অনেকে তর্ক করেন যে, গণেশকে দুর্গা এক একবার করিয়া চুম্বন করিতেছিনেন, তাহাই দূর হইতে দেখিয়া ধনপতি গজাহার ও উদ্গীরণ কল্পনা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা যথার্থ নহে। কারণ কবিকঙ্কণচণ্ডীতেই আছে, যে, চৌষট্টি যোগিনী পদ্মের দলরূপ ধারণ করিল, ও জয়া হস্তিনী রূপে রূপান্তরিত হইল। অতএব গণেশের সহিত ইহার কোনো সম্পর্কই নাই। কেহ বা তর্ক করেন যে, যখন কবির উদ্দেশ্য বিস্ময় ভাবের উদ্দীপন করা, তখন, বর্ণনা যাহাতে অদ্ভুত হয়, তাহারই প্রতি কবির লক্ষ্য। কিন্তু এ কথার কোনো অর্থ নাই। সুকল্পনার সহিত বিস্ময় রসের কোনো মনান্তর নাই।

     যখন অগাধ সমুদ্রের মধ্যে মরালশোভিত কুমুদ কহলার পদ্মবনের মধ্যে এক রূপসী ষোড়শী প্রতিষ্ঠিত করিলেন; সমস্তই সুন্দর; নীল জল, সুকুমার পদ্ম, পুষ্পের সুগন্ধ, ভ্রমরের গুঞ্জন, ইত্যাদি ইত্যাদি তখন মধ্য হইতে এক গজাহার আনিয়া আমাদের কল্পনায় অমন একটা নিদারুণ আঘাত দিবার তাৎপর্য কী? সুন্দর পদার্থ যেমন কবিত্বপূর্ণ বিস্ময় উৎপন্ন করিতে পারে, এমন কি, আর কিছুতে পারে? অপার সমুদ্রের মধ্যে পদ্মাসীনা ষোড়শী রমণীই কি যথেষ্ট বিস্ময়ের কারণ নহে?