বসন্তরায়।

 কেহ কেহ অনুমান করেন, বসন্তরায় আর বিদ্যাপতি একই ব্যক্তি। এই মতের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক প্রমাণ কিছু আছে কি না জানি না, কিন্তু উভয়ের লেখা পড়িয়া দেখিলে উভয়কে স্বতন্ত্র কবি বলিয়া আর সংশয় থাকে না। প্রথমত, উভয়ের ভাষায় অনেক তফাত। বিদ্যাপতির লেখায়–ব্রজভাষায় বাংলা মেশানো, আর রায়বসন্তের লেখায়– বাংলায় ব্রজভাষা মেশানো। ভাবে বোধ হয়, যেন ব্রজভাষা আমাদের প্রাচীন কবিদের কবিতার আফিসের বস্ত্র ছিল। শ্যামের বিষয় বর্ণনা করিতে হইলেই অমনি সে আটপৌরে ধুতি চাদর ছাড়িয়া বৃন্দাবনী চাপকানে বত্রিশটা বোতাম আঁটিত ও বৃন্দাবনী শাম্‌লা মাথায় চড়াইয়া একটা বোঝা বহিয়া বেড়াইত। রায়বসন্ত প্রায় ইহা বরদাস্ত করিতে পারিতেন না। তিনি খানিকক্ষণ বৃন্দাবনী পোষাক পরিয়াই অমনি– “দূর করো” বলিয়া ফেলিতেন! বসন্তরায়ের কবিতার ভাষাও যেমন কবিতার ভাবও তেমন। সাদাসিধা, উপমার ঘনঘটা নাই, সরল প্রাণের সরল কথা– সে কথা বিদেশী ভাষায় প্রকাশ করিতে যাওয়াই মিথ্যা। কারণ, সরল প্রাণ বিদেশী ভাষায় কথা কহিতে পারেই না; তাহার ছোটো ছোটো সুকুমার কথাগুলি, তাহার সূক্ষ্ম স্পর্শকাতর ভাবগুলি বিদেশী ভাষার গোলেমালে একেবারে চুপ করিয়া যায়, বিদেশী ভাষার জটিলতার মধ্যে আপনাদের হারাইয়া ফেলে। তখন আমরা ভাষাই শুনিতে পাই, উপমাই শুনিতে পাই, সে সুকুমার ভাবগুলির প্রাণ-ছোঁওয়া কথা আর শুনিতে পাই না। এমন মানুষ তো সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় যাহাদের দেখিলে মনে হয়– মানুষটা পোষাক পরে নাই, পোষাকটাই মানুষ পরিয়া বসিয়াছে। পোষাককে এমনি সে সমীহ করিয়া চলে যে, তাহাকে দেখিলে মনে হয়, আপনাকে সে পোষাক ঝুলাইয়া রাখিবার আল্‌না মাত্র মনে করে, পোষাকের দামেই তাহার দাম। আমার তো বোধ হয়, অনেক স্ত্রীলোকের অলঙ্কার ঘোমটার চেয়ে অধিক কাজ করে, তাহার হীরার সিঁথিটার দিকে লোকে এতক্ষণ চাহিয়া থাকে যে তাহার মুখ দেখিবার আর অবসর থাকে না। কবিতারও সেই দশা আমরা প্রায় মাঝে মাঝে দেখিতে পাই। বিদ্যাপতির সহিত চণ্ডিদাসের তুলনা করিলেই টের পাওয়া যাইবে যে, বিদ্যাপতি অপেক্ষা চণ্ডিদাস কত সহজে সরল ভাব প্রকাশ করিয়াছেন। আবার বিদ্যাপতির সহিত বসন্তরায়ের তুলনা করিলেও দেখা যায়, বিদ্যাপতির অপেক্ষা বসন্ত-রায়ের ভাষা ও ভাব কত সরল। বসন্তরায়ের কবিতায় প্রায় কোনখানেই টানাবোনা তুলনা নাই, তাহার মধ্যে কেবল সহজ কথার যাদুগিরি আছে। যাদুগিরি নহে তো কি? কিছুই বুঝিতে পারি না, এ গান শুনিয়া প্রাণের মধ্যে কেন এমন মোহ উপস্থিত হইল,– কথাগুলিও তো খুব পরিষ্কার, ভাবগুলিও তো খুব সোজা, তবে উহার মধ্যে এমন কি আছে যাহাতে আমার প্রাণে এতটা আনন্দ, এতটা সৌন্দর্য আনিয়া দেয়? এইখানে দুই-একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথমে বিদ্যাপতির রাধা, শ্যামের রূপ কিরূপে বর্ণনা করিতেছেন তাহা উদ্ধৃত করিয়া দিই,–

এ সখি কি দেখিনু এক অপরূপ,
শুনাইতে মানবি স্বপনস্বরূপ।
কমলযুগল-‘পর চাঁদকি মাল,
তা ‘পর উপজল তরুণ তমাল।
তা ‘পর বেড়ল বিজুরীলতা,
কালিন্দী তীর ধীর চলি যাতা।
শাখাশিখর সুধাকরপাঁতি,
তাহে নবপল্লব অরুণক ভাতি।
বিমল বিম্বফলযুগল বিকাশ,
তা ‘পর কির থির করু বাস।
তা ‘পর চঞ্চল খঞ্জনযোড়,
তা ‘পর সাপিনী ঝাঁপল মোড়।

 আর বসন্তরায়ের রাধা শ্যামকে দেখিয়া কি বলিতেছেন?

সজনি, কি হেরনু ও মুখশোভা!
অতুল কমল সৌরভ শীতল,
অরুণনয়ন অলি-আভা।
প্রফুল্লিত ইন্দীবর বর সুন্দর
মুকুরকান্তি মনোৎসাহা।
রূপ বরণিব কত ভাবিতে থকিত চিত,
কিয়ে নিরমল শশিশোহা।

বরিহা বকুল ফুল অলিকুল আকুল,
চূড়া হেরি জুড়ায় পরাণ!
অধর বান্ধুলী ফুল শ্রুতি মণিকুণ্ডল
প্রিয় অবতংস বনান।
হাসিখানি তাহে ভায়, অপাঙ্গ-ইঙ্গিতে চায়,
বিদগধ মোহন রায়।
মুরলীতে কিবা গায় শুনি আন নাহি ভায়,
জাতি কুলশীল দিনু তায়।
না দেখিলে প্রাণ কাঁদে দেখিলে না হিয়া বাঁধে,
অনুখন মদনতরঙ্গ।
হেরইতে চাঁদ মুখ মরমে পরম সুখ,
সুন্দর শ্যামর অঙ্গ।
চরণে নূপুরমণি সুমধুর ধ্বনি শুনি
ধরণীকে ধৈরজ ভঙ্গ।
ও রূপসাগরে রস- হিলোলে নয়ন মন
আটকল রায় বসন্ত॥

 বিদ্যাপতি হইতে উদ্ধৃত কবিতাটি পড়িয়াই বুঝা যায়, এই কবিতাটি রচনা করিবার সময় কবির হৃদয়ে ভাবের আবেশ উপস্থিত হয় নাই। কতকগুলি টানাবোনা বর্ণনা করিয়া গোটাকতক ছত্র মিলাইয়া দিয়াছেন। আমার বোধ হয় যেন, বিদ্যাপতি কৃষ্ণ হইয়া রাধার রূপ উপভোগ করিতে পারিয়াছেন, কিন্তু রাধা হইয়া কৃষ্ণের রূপ উপভোগ করিতে পারেন নাই। বিদ্যাপতির যে কবিতাটি উদ্ধৃত করিয়াছি, উহা ব্যতীত প্রাচীন কাব্য সংগ্রহে বিদ্যাপতি-রচিত আর একটি মাত্র কৃষ্ণের রূপবর্ণনা আছে, তাহাও অতি যৎসামান্য। বসন্তরায়ের কৃষ্ণের বর্ণনা পড়িয়া দেখ। কবি এমনি ভাবে মুগ্ধ হইয়া গাহিয়া উঠিয়াছেন যে, প্রথম ছত্র পড়িয়াই আমাদের প্রাণের তার বাজিয়া ওঠে। “সজনি, কি হেরনু ও মুখশোভা! “শ্যামকে দেখিবামাত্রই যে বন্যার মত এক সৌন্দর্য্যের স্রোত রাধার মনে আসিয়া পড়িয়াছে, রাধার হৃদয়ে সহসা যেন একটা সৌন্দর্য্যের আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে– একেবারে সহসা অভিভূত হইয়া রাধা বলিয়া উঠিয়াছে, “সজনি, কি হেরনু ও মুখশোভা! “আমরা রাধার সেই সহসা উচ্ছ্বসিত ভাব প্রথম ছত্রেই অনুভব করিতে পারিলাম। শ্যামকে দেখিবামাত্রই তাঁহার প্রথম মনের ভাব– মোহ। প্রথম ছত্রে তাহাই প্রকাশ পাইতেছে। ইহার সমস্তটা আপ্লুত করিয়া একটা সৌন্দর্য্যের ভাব মাত্র বিরাজ করিতেছে। রাধা মাঝে মাঝে রূপ বর্ণনা করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু মনঃপূত না হওয়ায় ছাড়িয়া দিয়াছেন, বলিয়াছেন– “রূপ বরণিব কত, ভাবিতে থকিত চিত।” তাহার রূপ কেমন তাহা আমি কি জানি, তাহার রূপ দেখিয়া আমার চিত্ত কেমন হইল তাহাই আমি জানি। রাধা মাঝে মাঝে বর্ণনা করিতে যায়, অমনি বুঝিতে পারে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বর্ণনা করিলে খুব অল্পই বলা হয়, আমি যে কি আনন্দ পাইতেছি সেটা তাহাতে কিছুতেই ব্যক্ত হয় না। শ্যামের রূপের আকৃতি ত সজনিরা সকলেই দেখিতে পাইতেছে, কিন্তু রাধা যে সেই রূপের মধ্যে আরো অনেকটা দেখিতে পাইয়াছে, যাহা দেখিয়া তাহার মনে কথার অতীত কথা-সকল জাগিয়া উঠিয়াছে– সেই অধিক-দেখাটা ব্যক্ত করিবে কিরূপে? সে কি তিল তিল বর্ণনা করিয়া? বর্ণনা করিতে চেষ্টা করিয়া হতাশ হইয়া বর্ণনা বন্ধ করিয়া কেবল ভাবগুলি মাত্র ব্যক্ত করিতে হয়। হাসি বর্ণনা করিতে গিয়া “হাসি-খানি” বলিতে হয়, রূপ বর্ণনা করিতে গিয়া মুরলীর গান মনে পড়ে। শ্যামের ভাব– রূপেতে হাসিতে গানেতে জড়িত একটি ভাব, পৃথক্‌ পৃথক্‌ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমষ্টিগত একটি ভাব নহে। রাধা যে বলিয়াছেন “হেরইতে চাঁদমুখ মরমে পরম সুখ”, ঐ কথাটাই সত্য– নহিলে, “ভুরু বাঁকা “বা “চোখ টানা” বা “নাক সোজা “ও-সব কথা কোন কাজের কথাই নয়।

 বিদ্যাপতি-রচিত রূপবর্ণনার সহিত বসন্তরায় রচিত রূপবর্ণনার একটি বিশেষ প্রভেদ আছে। বিদ্যাপতি রূপকে একরূপ চক্ষে দেখিতেছেন, আর বসন্তরায় তাহাকে আর-এক চক্ষে দেখিতেছেন। বিদ্যাপতি কহিতেছেন, রূপ উপভোগ্য বলিয়া সুন্দর; আর বসন্তরায় কহিতেছেন, রূপ সুন্দর বলিয়া উপভোগ্য। ইহা সত্য বটে, সৌন্দর্য্য ও ভোগ একত্রে থাকে; কিন্তু ইহাও সত্য উভয়ে এক নহে। বসন্তরায় তাঁহার রূপবর্ণনায় যাহা কিছু সুন্দর তাহাই দেখাইয়াছেন, আর বিদ্যাপতি তাঁহার রূপবর্ণনায় যাহা কিছু ভোগ্য তাহাই দেখাইয়াছেন। উদাহরণ দেওয়া যাক্‌। বিদ্যাপতির– যেখান হইতে খুশী– একটি রূপবর্ণনা বাহির করা যাক্‌–

গেলি কামিনী গজবরগামিনী,
বিহসি পালটি নেহারি।
ইন্দ্রজালক কুসুমসায়ক
কুহকী ভেল বরনারী।

জোরি ভুজযুগ মোড় বেড়ল,
ততহি বয়ান সুছন্দ।
দামচম্পকে কামপূজল
যৈছে সারদচন্দ।
উরহি অঞ্চল ঝাঁপি চঞ্চল,
আধ পয়োধর হেরু।
পবন-পরভাবে শরদঘন জনু
বেকত কয়েল সুমেরু।
পুনহি দরশনে জীবন জুড়ায়ব,
টুটব বিরহ কওর।
চরণযাবক হৃদয়পাবক
দহই সব অঙ্গ মোর॥

 এমন, একটা কেন, এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। আবার রায়বসন্ত হইতে দুই-একটি উদাহরণ উদ্ধৃত করা যাক্‌।

সই লো কি মোহন রূপ সুঠাম,
হেরইতে মানিনী তেজই মান।
উজর নীলমণি মরকতছবি জিনি
দলিতাঞ্জন হেন ভাল।
জিনিয়া যমুনার জল নিরমল ঢলঢল
দরপণ নবীন রসাল।
কিয়ে নবনীল নলিনী কিয়ে উতপল
জলধর নহত সমান।

কমনীয়া কিশোর কুসুম অতি সুকোমল
কেবল রসনিরমাণ॥
অমল শশধর জিনি মুখ সুন্দর
সুরঙ্গ অধর পরকাশ,
ঈষৎ মধুর হাস সরসহি সম্ভাষ
রায়বসন্ত-পহু রঙ্গিণী বিলাস॥

 ইহাতে কেবল ফুল, কেবল মধুর হাসি ও সরল সম্ভাষণ আছে, কেবল সৌন্দর্য্য আছে। এক শ্যামের সৌন্দর্য্য দেখিয়া জগতের সৌন্দর্য্যের রাজ্য উদঘাটিত হইতে চাহে। যমুনার নিরমল ঢলঢল ভাব ফুটিয়া ওঠে, একে একে একেকটি ফুল শ্যামের মুখের কাছে আসিয়া দাঁড়ায় – কারণ, সৌন্দর্য্য সৌন্দর্য্যকে কাছে ডাকিয়া আনে– ফুলের যাহা প্রাণের ভাব সে তাহা উন্মুক্ত করিয়া দেয়। বসন্তরায় এ সৌন্দর্য্য মুগ্ধনেত্রে দেখিয়াছেন, লালসাতৃষিত নেত্রে দেখেন নাই! এমন, একটি কেন, রায়বসন্ত হইতে তাঁহার সমুদয় রূপবর্ণনা উদ্ধৃত করিয়া দেওয়া যায়– দেখানো যায় যে যাহা তাঁহার সুন্দর লাগিয়াছে, তাহাই তিনি বর্ণনা করিয়াছেন। রূপবর্ণনা ত্যাগ করা যাক্‌, সম্ভোগবর্ণনা দেখা যাক্‌। বিদ্যাপতি কেবল সম্ভোগমাত্রই বর্ণনা করিয়াছেন; বসন্তরায় সম্ভোগের মাধুর্য্যটুকু, সম্ভোগের কবিত্বটুকু মাত্র বর্ণনা করিয়াছেন। বিদ্যাপতি-রচিত “বিগলিতচিকুর মিলিত মুখমণ্ডল” ইত্যাদি পদটির সহিত পাঠকেরা বসন্তরায়-রচিত নিম্নলিখিত পদটির তুলনা করুন।

বড় অপরূপ দেখিনু সজনি
নয়লি কুঞ্জের মাঝে,
ইন্দ্রনীল মণি কেতকে জড়িত
হিয়ার উপরে সাজে॥
কুসুমশয়ানে মিলিত নয়ানে
উলসিত অরবিন্দ,
শ্যামসোহাগিনী কোরে ঘুমায়লি
চাঁদের উপরে চন্দ॥
কুঞ্জ কুসুমিত সুধাকরে রঞ্জিত
তাহে পিককুল গান –
মরমে মদনবাণ দুঁহে অগেয়ান,
কি বিধি কৈল নিরমাণ॥
মন্দ মলয়জ পবন বহে মৃদু
ও সুখ কো করু অন্ত।
সরবস-ধন দোঁহার দুঁহু জন,
কহয়ে রায় বসন্ত॥

 মৃদু বাতাস বহিতেছে, কুঞ্জে জ্যোৎস্না ফুটিয়াছে, চাঁদনী রাত্রে কোকিল ডাকিতেছে, এবং সেই কুঞ্জে, সেই বাতাসে, সেই জ্যোৎস্নায়, সেই কোকিলের কুহুরবে, কুসুমশয়ানে মুদিত নয়ানে, দুটি উলসিত অলসিত অরবিন্দের মত, শ্যামের কোলে রাধা– চাঁদের উপরে চাঁদ ঘুমাইয়া আছে। কি মধুর! কি সুন্দর! এত সৌন্দর্য্য স্তরে স্তরে একত্রে গাঁথা হইয়াছে– সৌন্দর্য্যের পাপড়ির উপরে পাপড়ি বিন্যাস হইয়াছে যে, সবসুদ্ধ লইয়া একটি সৌন্দর্য্যের ফুল, একটি সৌন্দর্য্যের শতদল ফুটিয়া উঠিয়াছে। “ও সুখ কো করু অন্ত”– এমন মিলন কোথায় হইয়া থাকে!

 বসন্তরায়ের কবিতায় আর একটি মোহমন্ত্র আছে, যাহা বিদ্যাপতির কবিতায় সচরাচর দেখা যায় না! বসন্তরায় প্রায় মাঝে মাঝে বস্তুগত বর্ণনা দূর করিয়া দিয়া এক কথায় এমন একটি ভাবের আকাশ খুলিয়া দেন, যে, আমাদের কল্পনা পাখা ছড়াইয়া উড়িয়া যায়, মেঘের মধ্যে হারাইয়া যায়! এক স্থলে আছে– “রায় বসন্ত কহে ও রূপ পিরীতিময়।” রূপকে পিরীতিময় বলিলে যাহা বলা হয়, আর কিছুতে তাহার অপেক্ষা অধিক বলা যায় না। যেখানে বসন্তরায় শ্যামের রূপকে বলিতেছেন।–

কমনীয়া কিশোর কুসুম অতি সুকোমল
          কেবল রস নিরমাণ।”

 সেখানে কবি এমন একটি ভাব আনিয়াছেন যাহা ধরা যায় না, ছোঁওয়া যায় না। সেই ধরা-ছোঁওয়া দেয় না– এমন একটি ভাবকে ধরিবার জন্য কবি যেন আকুল ব্যাকুল হইয়া পড়িয়াছেন। “কমনীয়” “কিশোর” “সুকোমল” প্রভৃতি কত কথাই ব্যবহার করিলেন, কিছুতেই কুলাইয়া উঠিল না– অবশেষে সহসা বলিয়া ফেলিলেন “কেবল রসনিরমাণ! “কেবল তাহা রসেই নির্মিত হইয়াছে, তাহার আর আকার প্রকার নাই।

 শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে বলিতেছেন;–

“আলো ধনি, সুন্দরি, কি আর বলিব?

তোমা না দেখিয়া আমি কেমনে রহিব?
তোমার মিলন মোর পুণ্যপুঞ্জরাশি,
মরমে লাগিছে মধুর মৃদু হাসি!
আনন্দমন্দির তুমি, জ্ঞান শকতি,
বাঞ্ছাকল্পলতা মোর কামনা মূরতি।
সঙ্গের সঙ্গিনী তুমি সুখময় ঠাম।
পাসরিব কেমনে জীবনে রাধা নাম।
গলে বনমালা তুমি, মোর কলেবর।
রায় বসন্ত কহে প্রাণের গুরুতর।”

 এমন প্রশান্ত উদার গম্ভীর প্রেম বিদ্যাপতির কোনো পদে প্রকাশ পাইয়াছে কিনা সন্দেহ। ইহার কয়েকটি সম্বোধন চমৎকার। রাধাকে যে কৃষ্ণ বলিতেছেন– তুমি আমার কামনার মূর্তি, আমার মূর্তিমতী কামনা– অর্থাৎ তুমি আমার মনের একটি বাসনা মাত্র, রাধারূপে প্রকাশ পাইতেছ, ইহা কী সুন্দর! তুমি আমার গলে বনমালা, তোমাকে পরিলে আমার শরীরতৃপ্তি হয়– না, তুমি তাহারও অধিক, তুমি আমার শরীর, আমাতে তোমাতে প্রভেদ আর নাই– না, শরীর না, তুমি শরীরের চেয়েও অধিক, তুমি আমার প্রাণ, সর্ব শরীরকে ব্যাপ্ত করিয়া যাহা রহিয়াছে, যাহার আবির্ভাবে শরীর বাঁচিয়া আছে, শরীরে চৈতন্য আছে, তুমি সেই প্রাণ– রায়বসন্ত কহিলেন, না, তুমি তাহারও অধিক, তুমি প্রাণেরও গুরুতর, তুমি বুঝি প্রাণকে প্রাণ দিয়াছ, তুমি আছ বলিয়াই বুঝি প্রাণ আছে! ঐ যে বলা হইয়াছে “মরমে লাগিছে মধুর মৃদু হাসি!” ইহাতে হাসির মাধুর্য্য কি সুন্দর প্রকাশ পাইতেছে! বসন্তের বাতাসটি গায়ে যেমন করিয়া লাগে, সুদূর বাঁশীর ধ্বনি কানের কাছে যেমন করিয়া মরিয়া যায়, পদ্মমৃণাল কাঁপিয়া সরোবরে একটুখানি তরঙ্গ উঠিলে তাহা যেমন করিয়া তীরের কাছে আসিয়া মিলাইয়া যায়, তেমনি একটুখানি হাসি– অতিমধুর অতিমৃদু একটি হাসি মরমে আসিয়া লাগিতেছে; বাতাসটি গায়ে লাগিলে যেমন ধীরে ধীরে চোখ বুজিয়া আসে তেমনিতর বোধ হইতেছে! হাসি কি কেবল দেখাই যায়? হাসি ফুলের গন্ধটির মত প্রাণের মধ্যে আসিয়া লাগে।

 রাধা বলিতেছেন –

প্রাণনাথ, কেমন করিব আমি?
তোমা বিনে মন করে উচাটন
কে জানে কেমন তুমি!
না দেখি নয়ন ঝরে অনুক্ষণ,
দেখিতে তোমায় দেখি।
সোঙরণে মন মুরছিত হেন,
মুদিয়া রহিয়ে আঁখি॥
শ্রবণে শুনিয়ে তোমার চরিত,
আন না ভাবিয়ে মনে।
নিমিষের আধ পাশরিতে নারি,
ঘুমালে দেখি স্বপনে!
জাগিলে চেতন হারাই যে আমি
তোমা নাম করি কাঁদি।

পরবোধ দেই এ রায়-বসন্ত,
তিলেক থির নাহি বাঁধি॥

 ইহার প্রথম দুটি ছত্রে ভাবের অধীরতা, ভাষার বাঁধ ভাঙ্গিবার জন্য ভাবের আবেগ কী চমৎকার প্রকাশ পাইতেছে! “প্রাণনাথ কেমন করিব আমি!” ইহাতে কতখানি আকুলতা প্রকাশ পাইতেছে! আমার প্রাণ তোমাকে লইয়া কি-যে করিতে চায় কিছু বুঝিতে পারি না। এত দেখিলাম, এত পাইলাম, তবুও প্রাণ আজও বলিতেছে “প্রাণনাথ কেমন করিব আমি!” বিদ্যাপতি বলিয়াছেন,

“লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু
           তবু হিয়ে জুড়ন না গেল!”

 বিদ্যাপতি সমস্ত কবিতাটিতে যাহা বলিয়াছেন, ইহার এক কথায় তাহার সমস্তটা বলা হইয়াছে এবং তাহা অপেক্ষা শতগুণ অধীরতা ইহাতে ব্যক্ত হইতেছে। “প্রাণনাথ কেমন করিব আমি! “দ্বিতীয় ছত্রে রাধা শ্যামের মুখের দিকে আকুল নেত্রে চাহিয়া কহিতেছেন “কে জানে কেমন তুমি! “যাহার এক তিল ঊর্ধ্বে উঠিলেই ভাষা মরিয়া যায়, সেই ভাষায় শেষ সীমায় দাঁড়াইয়া রাধা বলিতেছেন “কে জানে কেমন তুমি!”

 আর এক স্থলে রাধা বলিতেছেন–

ওহে নাথ, কিছুই না জানি,
তোমাতে মগন মন দিবস রজনী।
জাগিতে ঘুমিতে চিতে তোমাকেই দেখি,
পরাণপুতলী তুমি জীবনের সখি!

অঙ্গ-আভরণ তুমি শ্রবণরঞ্জন,
বদনে বচন তুমি নয়নে অঞ্জন!
নিমিখে শতেক যুগ হারাই হেন বাসি,
রায় বসন্ত কহে পহু প্রেমরাশি!”

 ঠিক কথা বটে,– নিমিখে শতেক যুগ হারাই হেন বাসি! যতই সময় পাওয়া যায়, ততই কাজ করা যায়। আমাদের হাতে “শতেক যুগ” নাই বলিয়া আমাদের অনেক কাজ অসম্পূর্ণ থাকে। শতেক যুগ পাইলে আমরা অনেক কাজ সম্পূর্ণ করিয়া যাইতে পারি। কিন্তু প্রেমের সময়গণনা যুগ যুগান্তর লইয়া নহে। প্রেম নিমিখ লইয়া বাঁচিয়া থাকে, এই নিমিত্ত প্রেমের সর্বদাই ভয়– পাছে নিমিখ হারাইয়া যায়। এক নিমিখে মাত্র আমি যে একটি চাহনি দেখিয়াছিলাম তাহাই হৃদয়ের মধ্যে লালন করিয়া আমি শতেক যুগ বাঁচিয়া থাকিতে পারি; আবার হয়তো আমি শতেক যুগ অপেক্ষা করিয়া বসিয়া আছি, কখন আমার একটি নিমেষ আসিবে, একটি মাত্র চাহনি দেখিব! দৈবাৎ সেই একটি মুহূর্ত হারাইলে আমার অতীত কালের শতেক যুগ ব্যর্থ হইল, আমার ভবিষ্যৎ কালের শতেক যুগ হয়তো নিষ্ফল হইবে। প্রতিভার স্ফূর্ত্তির ন্যায় প্রেমের স্ফূর্ত্তিও একটি মাহেন্দ্রক্ষণ একটি শুভ মুহূর্তের উপরে নির্ভর করে। হয়তো শতেক যুগ আমি তোমাকে দেখিয়া আসিতেছি, তবুও তোমাকে ভাল বাসিবার কথা আমার মনেও আসে নাই– কিন্তু দৈবাৎ একটি নিমিখ আসিল, তখন না জানি কোন্‌ গ্রহ কোন্‌ কক্ষে ছিল – দুই জনে চোখাচোখি হইল। ভালবাসিলাম। সেই এক নিমিখ হয়তো পদ্মার তীরের মত অতীত শত যুগের পাড় ভাঙিয়া দিল ও ভবি ষ্যৎ শত যুগের পাড় গড়িয়া দিল। এই নিমিত্তই রাধা যখন ভাগ্যক্রমে প্রেমের শুভ-মুহূর্ত পাইয়াছেন তখন তাঁহার প্রতিক্ষণে ভয় হয় পাছে এক নিমিখ হারাইয়া যায়, পাছে সেই এক নিমিখ হারাইয়া গেলে শতেক যুগ হারাইয়া যায়। পাছে শতেক যুগের সমুদ্রের মধ্যে ডুবিয়া সেই নিমিখের হারানো রত্নটুকু আর খুঁজিয়া না পাওয়া যায়! সেইজন্য তিনি বলিয়াছেন “নিমিখে শতেক যুগ হারাই হেন বাসি!”

 এমন যতই উদাহরণ উদ্ধৃত হইবে ততই প্রমাণ হইবে যে, বিদ্যাপতি ও বসন্তরায় এক কবি নহেন, এমনকি এক শ্রেণীর কবিও নহেন।