সমস্যা।

 আজকাল প্রায় এমন দেখা যায় অনেক বিষয়ে অনেক রকম মত উঠিয়াছে, কিন্তু কাজের সঙ্গে তাহার মিল হয় না। এমনও দেখা যায় অল্প বয়সে যাঁহারা পরমোৎসাহে সম্পূর্ণ নূতন করিয়া সমাজের পরিবর্তন-সাধনে উদ্যোগী হইয়াছিলেন কিঞ্চিৎ অধিক বয়সে তাঁহারাই পুরাতন প্রথা অবলম্বন করিয়া শান্তভাবে সংসারযাত্রা নির্বাহ করিতেছেন। অনেকে ইহার কারণ এমন বলেন যে, বাঙালিদের কোন মতের বা কাজের উপর যথার্থ অকৃত্রিম সুগভীর অনুরাগ নাই– মতগুলি কার্য পরিণত করিবার জন্য হৃদয়ের যতটা বলের আবশ্যক তাহা নাই। এ কথা যে সম্পূর্ণ অমূলক তাহা নহে, কিন্তু ইহা ছাড়া আরো কতকগুলি কারণ জুটিয়াছে।

 সমাজ যখন সমস্যা হইয়া দাঁড়ায় তখন মানুষ সবলে কাজ করিতে পারে না, যখন ডান পা একটি গর্তের মধ্যে নিবিষ্ট করিয়া বাঁ পা কোথায় রাখিব ভাবিয়া পাওয়া যায় না, তখন দ্রুতবেগে চলা অসম্ভব। কিংবা যখন মাথা টলমল করিতেছে কিন্তু পা শক্ত আছে, অথবা মাথার ঠিক আছে কিন্তু পায়ের ঠিকানা নাই– তখন যদি চলিবার বিশেষ ব্যাঘাত হয় তবে জমির দোষ দেওয়া যায় না। আমরা বঙ্গসমাজ নামক যে মকড়ষার জালে মাছির ন্যায় বাস করিতেছি, এখানে মতামত-নামক আস্‌মানগামী ডানা দুটো খোলসা আছে বটে কিন্তু ছটা পা জড়াইয়া গেছে। ডানা আস্ফালন যথেষ্ট হইতেছে কিন্তু উড়িবার কোন সুবিধা হইতেছে না। এখানে ডানা-দুটো কেবল কষ্টেরই কারণ হইয়াছে।

 যেটা ভাল বলিয়া জানিলাম সেটা ভাল রকম হইয়া উঠে না– জ্ঞানের উপর বিশ্বাস হ্রাস হইয়া যায়। যে উদ্দেশ্যে যে কাজ আরম্ভ করিলাম পদে পদে তাহার উল্টা উৎপত্তি হইতে লাগিল, সে কাজে আর গা লাগে না।

 আমাদের সমাজ যে উত্তরোত্তর জটিল সমস্যা হইয়া উঠিতেছে, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নাই। কেহ বলিতেছে বিধবাবিবাহ ভাল, কেহ বলিতেছে মন্দ; কেহ বলিতেছে বাল্যবিবাহ উচিত, কেহ বলিতেছে অনুচিত; কেহ বলে পরিবারের একান্নবর্ত্তিতা উঠিয়া গেলে দেশের মঙ্গল, কেহ বলে অমঙ্গল। আসল কথা, ভাল কি মন্দ কোনটাই বলা যায় না– কোথাও বা ভাল কোথাও বা মন্দ।

 বর্তমান বঙ্গসমাজ যে এতটা ঘোলাইয়া গিয়াছে তাহার গুরুতর কারণ আছে। প্রাচীন কালে স্ত্রী পুরুষ বা সমাজের উচ্চনীচ শ্রেণীর মধ্যে শিক্ষার ন্যূনাধিক্য ছিল বটে, কিন্তু শিক্ষার সাম্যও ছিল। সকলেরই বিশ্বাস, লক্ষ্য, আকাঙ্ক্ষা, রুচি ও ভাব এক প্রকারের ছিল। সমাজসমুদ্রের মধ্যে তরঙ্গের উঁচু-নীচু অবশ্যই ছিল, কিন্তু তেলে জলের মত একটা পদার্থ ছিল না। পরস্পরের মধ্যে যে বিভিন্নতা ছিল তাহার ভিতরেও জাতীয়ভাবের একটি ঐক্য ছিল, সুতরাং এরূপ সমাজে জটিলতার কোন সম্ভাবনা ছিল না। সে সমাজ সবল ছিল কি দুর্ব্বল ছিল সে কথা হইতেছে না, কিন্তু তাহার সর্বাঙ্গীণ স্বাস্থ্য ছিল, অর্থাৎ তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে সামঞ্জস্য ছিল। কিন্তু এখন সেই সামঞ্জস্য নষ্ট হইয়া গেছে। সেই জন্য বাঁ কান এক শোনে, ডান কান আর শোনে; তুমি মাথা নাড়িতে চাহিলে, তোমার দুই পায়ের দুই বুড় আঙুল নড়িয়া উঠিল! এক করিতে আর হয়।

 আমাদের দেশে ইংরাজি শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের মধ্যে বিজাতীয় প্রভেদ দাঁড়াইয়াছে। সুতরাং স্ত্রী পুরুষের মধ্যে, উচ্চ নীচের মধ্যে, প্রাচীন নবীনের মধ্যে, অর্থাৎ বাপে বেটায়, এক প্রকার জাতিভেদ হইয়াছে! যেখানে জাতিভেদ আছে অথচ নাই, সেখানে কোন কিছুর হিসাব ঠিক থাকে না। দুই বৃক্ষ দুই দিকে যদি মুখ করিয়া থাকে তাহাতে উদ্ভিদ্‌রাজ্যের কোন ক্ষতি হয় না– কিন্তু যেখানে ডালের সঙ্গে গুঁড়ির, আগার সঙ্গে গোড়ার মিল হয় না, সেখানে ফুলের প্রত্যাশা করিতে গেলে আকাশকুসুম পাওয়া যায় এবং ফলের প্রত্যাশা করিতে গেলে কদলীও মিলে না।

 আমাদের সমাজ যদি গাছপাকা হইয়া উঠিত তবে আর ভাবনা থাকিত না; তাহা হইলে আঁঠিতে খোসাতে এত মনান্তর, মতান্তর, অবস্থান্তর থাকিত না। কিন্তু হিন্দুসমাজের শাখা হইতে পাড়িয়া বঙ্গসমাজকে বলপূর্ব্বক পাকানো হইতেছে। ইহার একটা আশু উপকার এই দেখা যায় অতি শীঘ্রই পাক ধরে, গাছে পাঁচ দিনে যাহা হয় এই উপায়ে এক দিনেই তাহা হয়। বঙ্গসমাজেও তাহাই হইতেছে। বঙ্গসমাজের যে অংশে ইংরাজি সভ্যতার তাত লাগিতেছে সেখানটা দেখিতে দেখিতে লাল হইয়া উঠিতেছে, কিন্তু শ্যামল অংশটুকুর সঙ্গে তাহার কিছুতেই বনিতেছে না। এরূপ ফলের মধ্যে সহজ নিয়ম আর খাটে না।

 পুরুষদের মধ্যে ইংরাজি শিক্ষা ব্যাপ্ত হইয়াছে, স্ত্রীলোকদের মধ্যে হয় নাই। শিক্ষার প্রভাবে পুরুষেরা স্থির করিয়াছেন বাল্য-বিবাহ দেশের পক্ষে অমঙ্গলজনক– ইহাতে সন্তান দুর্ব্বল হয়, অল্প বয়সে বহু পরিবারের ভারে সংসারসাগরে অশ্রুপূর্ণ লোনাজলে হাবুডুবু খাইতে হয় ইত্যাদি। এই শিক্ষার গুণে হারা আত্মসংযমপূর্ব্বক নিজের ও দেশের দূর মঙ্গল ও অমঙ্গলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া অধিক বয়সে বিবাহ করিবার পক্ষে উপযোগী হন। কিন্তু স্ত্রীলোকেরা এরূপ শিক্ষা পান নাই এবং অধিক বয়সে বিবাহ করিবার জন্য প্রস্তুতও হন নাই। তাঁহারা অন্তঃপুরের পুরাতন প্রথার মধ্যে, ঠাট্টার সম্পর্কীয়দের চিরন্তন উপহাস-বিদ্রূপের মধ্যে, বিবাহ প্রভৃতি গৃহকর্ম্মের নানাবিধ আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানের মধ্যে আশৈশব লালিত পালিত হইয়াছেন। আপিসের অন্নের ন্যায় প্রত্যুষেই তাঁহাদিগকে খরতাপে চড়ানো হইয়াছে, এবং ক্রমাগত গরম মসলা পড়িতেছে– চেষ্টা হইতেছে যাহাতে দশ, বড় জোর সাড়ে দশের আগেই রীতিমত “কনে” পাকাইয়া তাঁহাদিগকে ভদ্রলোকের পাতে দেওয়া যাইতে পারে। সুতরাং স্ত্রীলোকদের বাল্য-বিবাহ আবশ্যক। কিন্তু পুরুষেরা অধিক বয়সে বিবাহ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলে মেয়েদের বর শীঘ্র জুটিবে না– তাঁহাদিগকে দায়ে পড়িয়া অপেক্ষা করিতে হইবে। তাহা ছাড়া অধিকবয়স্ক পুরুষেরা নিতান্ত অল্পবয়স্ক কন্যাকে বিবাহ করিতে সম্মতও হইবেন না। অথচ বহুদিন অপেক্ষা করিবার মত অবস্থা ও শিক্ষা নহে– বিশেষতঃ প্রাচীনারা কন্যার বিবাহে বিলম্ব দেখিয়া বিবাহের আবশ্যকতা সম্বন্ধে রীতিমত আন্দোলন করিয়া বেড়াইতেছেন। অনেকে বলিবেন, স্ত্রীশিক্ষাও ত প্রচলিত হইয়াছে। কিন্তু সে কি আর শিক্ষা? গোটা দুই ইংরাজি প্রাইমার গিলিয়া, এমন-কি এন্‌ট্রেন্সের পড়া পড়িয়াও কি কঠোর কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য-নির্ণয়ের শক্তি জন্মে? শত শত বৎসরের পুরুষানুক্রমবাহী সংস্কারের উপরে মাথা তুলিয়া উঠা অল্প শিক্ষা ও অল্প বলের কাজ নহে! রীতিমত স্ত্রীশিক্ষা প্রচলিত হওয়া ও অন্তঃপুরের চিরন্তন আবহাওয়ার পরিবর্ত্তন হওয়া এখন অনেক দিনের কথা। অথচ বাল্যবিবাহের প্রতি বিদ্বেষ আজই জাগিয়া উঠিয়াছে। এখন কি করা যায়!

 একান্নবর্ত্তী পরিবারের মধ্যে বাস করিতেছি, অথচ বাল্যবিবাহ উঠাইতে চাই। একান্তবর্ত্তী পরিবারের মধ্যে অধিকবয়স্ক নূতন লোক প্রবেশ করিতে পারে না। চরিত্রগঠনের পূর্ব্বেই উক্ত পরিবারের সহিত লিপ্ত হওয়া চাই, নতুবা সেই নূতন লোক অচর্ব্বিত কঠিন খাদ্যের ন্যায় পরিবারের পাকস্থলীতে প্রবেশ করিয়া বিষম বিশৃঙ্খলা উপস্থিত করে।

 এই যেমন একটা উদাহরণ দেওয়া গেল, তেমনি আরেক শ্রেণীর আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ইংরাজি শিক্ষা সত্ত্বেও কেহ কেহ এমন বিবেচনা করেন যে, বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত নহে। বিধবাদের পক্ষে ব্রক্ষ্মচর্য্য অবলম্বন করিয়া থাকার অপেক্ষা মহত্ত্ব আর কি হইতে পারে? ইহাতে পরিবারের মধ্যে একটি পবিত্র আদর্শের প্রতিষ্ঠা করা হয়।

 যখন আজন্মকালের শিক্ষা ও উদাহরণের প্রভাবে বঙ্গনারী স্বামীকে দেবতা জ্ঞান করিত– স্বামীকেই স্ত্রীলোকের চরম গতি পরম মুক্তির কারণ বলিয়া জানিত, তখন বিধবাদের ব্রক্ষ্মচর্য্য পালন করা স্বাভাবিক ছিল, এবং না করা দূষ্য ছিল। কিন্তু সে শিক্ষা, সে উদাহরণ, সে ভাব চলিয়া যাইতেছে; তবে ব্রক্ষ্মচর্য্য ব্রত কিসের বলে দাঁড়াইবে? তাহা ছাড়া কেবল একটা বাহ্য অনুষ্ঠান পালন করার কোন ফল নাই, তাহার আভ্যন্তরিক ভাবেই তাহার মহত্ত্ব। এক কালে আমাদের সমাজ ভক্তি ও স্নেহের সূত্রেই গাঁথা ছিল। তখন পুত্র পিতাকে,শিষ্য গুরুকে, ছোট ভাই বড় ভাইকে, সমস্ত স্নেহাস্পদেরা সমস্ত গুরুজনদের অসীম ভক্তি করিত। সমাজের সে অবস্থায় স্ত্রীও স্বামীকে দেবতা জ্ঞান করিত। সমাজের সমস্ত সুর এক হইয়া মিলিত। এখন স্বতন্ত্র শিক্ষার প্রভাবে সমাজের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ কতকটা একাকার হইয়া পড়িতেছে। এখন বড় ভাইকে ছোট ভাই, গুরুজনদিগকে স্নেহাস্পদেরা, এমন-কি পিতাকে পুত্র, তেমন ভাবে দেখে না, তেমন করিয়া মানে না– ইহা কেহই অস্বীকার করিতে পারেন না। এই সংক্রামক ভাব যদি সমাজের সর্ব্বত্রই আক্রমণ করিয়া থাকে তবে কি কেবল পতি-পত্নীর সম্পর্কই ইহার হাত হইতে রক্ষা পাইতে পারে? তাহাদের মধ্যেও কি সাম্যভাব প্রবেশ করে নাই, অথবা দ্রুতবেগে করিতেছে না? চারিদিকের উদাহরণে এই ভক্তির ভাব কি মন হইতে শিথিল হইয়া যায় নাই? আগে কার বউরা শাশুড়িকে যেরূপ মান্য করিত এখনকার বউরা কি তেমন মান্য করে? শাশুড়ির প্রতি যে কারণে ভক্তির লাঘব হইয়াছে সেই কারণেই কি স্বামীর প্রতিও ভক্তির লাঘব হয় নাই? তবে কিরূপে আশা করা যায় পূর্ব্বে যেরূপ অচলা নিষ্ঠার সহিত বিধবারা ব্রক্ষ্মচর্য্য পালন করিতেন, এখনও তাঁহারা সেইরূপ পারিবেন? এখন বলপূর্ব্বক সেই বাহ্য অনুষ্ঠান অবলম্বন করাইলে কি সমাজে উত্তরোত্তর গুরুতর অধর্ম্মাচরণ প্রবেশ করিয়া নিদারুণ অমঙ্গলের সৃষ্টি করিবে না?

 বিধবা-বিবাহের সম্বন্ধে আরও একটা কথা আছে। আমাদের সমাজে একান্নবর্ত্তী পরিবারের মূল শিথিল হইয়া আসিতেছে। গুরুজনের প্রতি অচলা ভক্তি ও আত্মমতবিসর্জ্জনই একান্নবর্ত্তী পরিবারের প্রতিষ্ঠাস্থল। এখন সাম্যনীতি সমাজে বন্যার মত আসিয়াছে, কোঠা বাড়ি হইতে কঞ্চির বেড়া পর্য্যন্ত উঁচু জিনিষ যাহা কিছু আছে সমস্তই ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে। তাহা ছাড়া শিক্ষাও যত বাড়িতেছে, মতভেদও তত বাড়িতেছে। দুই সহোদর ভ্রাতার জীবনযাত্রার প্রণালী ও মতে মিলে না, তবে আর বেশী দিন একত্র থাকা সম্ভবে না। একান্নবর্ত্তী পরিবার-প্রথা ভাঙ্গিয়া গেলে স্বামীর মৃত্যুর পর একাকিনী বিধবা কাহাকে আশ্রয় করিবে? বিশেষতঃ তাহার যদি ছোট ছোট দুই একটি ছেলে-মেয়ে থাকে তবে তাহাদের পড়ানো শুনানো রক্ষণাবেক্ষণ কে করিবে? আজকাল যেরূপ অবস্থা ও সমাজ যেদিকে যাইতেছে, তাহারই উপযোগী পরিবর্ত্তন ও শিক্ষা হওয়া কি উচিত নয়?  কিন্তু যতদিন একান্নবর্ত্তিত্ব একেবারে না ভাঙ্গিয়া যায় ততদিনই বা বিধবাবিবাহ সুচারুরূপে সম্পন্ন হইবে কি করিয়া? স্বামী ব্যতীত শ্বশুরালয়ের আর কাহারও সহিত যাহার তেমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল না, সে রমণী স্বামীর মৃত্যুর পরে বিবাহ করিয়া শ্বশুরালয়ের সহিত একেবারেই বিচ্ছিন্ন হইতে পারে, তাহাতে আপত্তি দেখি না। কিন্তু একান্নবর্ত্তী পরিবারে শ্বশুরালয়ে স্বামী ছাড়াও কত শত বন্ধন। অতএব স্বামীর মৃত্যুতেই শ্বশুরালয় হইতে ধর্ম্মতঃ মুক্তি লাভ করা যায় না। এতদিন যাহাদের সহিত রোগে শোকে বিপদে উৎসবে অনুষ্ঠানে সুখদুঃখের আদান প্রদান চলিয়া আসিয়াছে, যাহাদের গৌরব ও কলঙ্ক তোমার নিকট কিছুই গোপন নাই, যেখানকার শিশুরা তোমার স্নেহের উপরে নির্ভর করে, সমবয়স্কেরা তোমার মমতা ও সান্ত্বনার উপর নির্ভর করে, গুরুজনেরা তোমার সেবার উপর নির্ভর করে, সেখান হইতে তুমি কোনক্রমে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিতে পার না। তাহা হইলে ধর্ম্ম থাকে না, পরিবারে সুখশান্তি থাকে না। সমাজের ক্ষতি হয়। বিশেষতঃ বিধবার যদি সন্তান থাকে, তাহাদিগকে এক বংশ হইতে আর এক বংশে লইয়া গেলে পরিবারে অসুখ ও অশান্তি উপস্থিত হয়, যদি না লইয়া যাওয়া হয় তবে সন্তানেরা মাতৃহীন হইয়া থাকে।

 ইংরাজি-শিক্ষিত অনেকের এমন মত আছে যে, স্ত্রীলোকদিগকে অন্তঃপুরের বাহির করা উচিত হয় না, তাহাতে তাঁহাদের অন্তঃপুরসুলভ কমনীয়তা প্রভৃতি গুণ নষ্ট হইয়া যায়। এ কথার সত্যমিথ্যা গুণাগুণ লইয়া আমি বিচার করিতে বসি নাই। পূর্ব্বেই এক প্রকার বলিয়াছি, সমাজের বর্ত্তমান বিপ্লবের অবস্থায় কোন্‌ কাজটা সমাজের পক্ষে সর্ব্বতোভাবে উপযোগী, কেন্‌টা নয়, তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায় না।

 বঙ্গনারীদের মুখপদ্ম যদি দুর্ভাগা সূর্য্যের তৃষিত নেত্রপথের অন্তরাল করাই অভিপ্রেত হয় তবে বর্ত্তমান বঙ্গসমাজে তাহার কতকগুলি বাধা পড়িয়াছে, আমি তাহাই দেখিতে চাই। একটা দৃষ্টান্ত দেখিলেই আমার কথা স্পষ্ট হইবে। প্রাচীন কালে দেশ-বিদেশে যাতায়াতের তেমন সুবিধা ছিল না – ব্যয় অধিক এবং পথে বিপদও অনেক ছিল। এই জন্য তখনকার রীতি ছিল “পথে নারী বিবর্জ্জিতা “। এই জন্য পুরাকালের পথিকগণের বধূজন-বিলাপে কাব্য প্রতিধ্বনিত হইত। কিন্তু এখন সময়ের পরিবর্ত্তন হইয়াছে। রেলের প্রসাদে পথ সুগম হইয়াছে, পথে বিপদও নাই। দেশে বিদেশে বাঙ্গালীদের কাজ কর্ম্ম হইতেছে। যখন পথ সুগম, ব্যয় অল্প, কোন বিপদ নাই, তখন স্ত্রীপুত্রের বিরহ কাহারও সহ্য হয় না। কিন্তু রেলের এক-একটি গাড়ি একলা অধিকার করিতে পারেন এমন সঙ্গতিও অল্প লোকের আছে। এই জন্য আজকাল প্রায় দেখা যায় পরপুরুষদিগের সহিত একত্রে উপবেশন করিয়া অনেক ভদ্রলোকের পরিবার রেল-গাড়িতে যাত্রা করিতেছেন। উত্তরোত্তর এরূপ উদাহরণ আরও বাড়িতে থাকিবে। ইহা নিবারণ করা অসাধ্য। নিয়মের গ্রনিথ দুই-চারিবার খুলিয়া ফেলিলেই তাহা শিথিল হইয়া যায়। বিশেষতঃ অনভ্যাসের সঙ্কোচ যত গুরুতর, নিয়মের আঁটাআঁটি তত গুরুতর নহে। অন্তঃপুর হইতে বাহির হইবার অনভ্যাস যদি অল্পে অল্পে হ্রাস হইয়া যায়, তাহা হইলে সমাজনিয়মের বাধা আর বড় কাজে লাগে না। আর একটা দেখিতে হয়– পূর্ব্বে অবরোধপ্রথা সর্ব্ববাদিসম্মত ছিল, সুতরাং তাহার ক্ষমতা অক্ষুণ্ন ছিল। এখন কেহ বা বাহিরে যান কেহ বা যান না। যাঁহারা না যান তাঁহারা প্রসঙ্গক্রমে নানা গল্প শুনিতে পান, নানা উদাহরণ দেখিতে পান। সুতরাং স্বভাবতঃই বাহিরে যাওয়া মাত্রই তাঁহাদের তেমন বিভীষিকা বলিয়া বোধ হন না, এমন-কি বাহিরে যাইতে অনেক কারণে তাঁহাদের কৌতূহলও জন্মে। কেহ অস্বীকার করিতে পারেন না এবারকার এক্‌জিবিশনে যত পুরনারী- সমাগম হইয়াছিল, বিশ বৎসর পূর্ব্বে ইহার সিকি হইবারও সম্ভবনা ছিল না। সমাজের পরিবর্ত্তনের প্রবল প্রভাবে সেই যদি মেয়েরা বাহির হইতেছেন, তবে মূঢ়ের মত ইহা দেখিয়াও না দেখিবার ভাণ করা বৃথা। ইহার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। প্রস্তুত না হইলে সমাজের বর্ত্তমান অবস্থায় মেয়েরা সেই বাহির হইবে- - তবে অপ্রস্তুত ভাবে হইবে। তাহার দৃষ্টান্ত দেখ। অনেক ভদ্র পুরনারী রেলগাড়ি প্রভৃতি প্রকাশ্যস্থানে যাত্রা করেন, অথচ তাঁহাদের বেশভূষা অতিশয় লজ্জাজনক। অন্তঃপুরের প্রাচীন যখন আবরণের কাজ করে তখন যাহা হয় একটা বস্ত্র পরার উপলক্ষ্য রক্ষা কর আর না কর, সে তোমার রুচির উপর নির্ভর করে। কিন্তু বাহির হইতে হইলে সমাজের মুখ চাহিয়া লজ্জারক্ষার উপায় অবলম্বন করিতে হইবে- - রীতিমত ভদ্রবেশ পরিতে হইবে। পুরুষদের পরিতে হইবে অথচ মেয়েদের পরিতে হইবে না, ইহা কোন্‌ শাস্ত্রে লেখে? ভদ্র পুরুষরা যখন জামা না পরিয়া বাহির হইতে বা ভদ্রসমাজে যাইতে লজ্জা বোধ করেন, তখন ভদ্র স্ত্রীরা কি করিয়া শুদ্ধমাত্র একখানি বহু যত্নে সম্বরণীয় সূক্ষ্ম সাড়ি পরিয়া ভদ্রসমাজে বাহির হইবেন! আজকাল এরূপ রীতিগর্হিত ব্যাপার যে ঘটিতেছে, তাহার কারণ অভিভাবকদের এ বিষয়ে মতের স্থৈর্য্য নাই, একটা হিজিবিজি কাণ্ড হইতেছে। অন্তঃপুর হইতে স্ত্রীলোকদিগকে বাহিরে আনা তাঁহাদের মতও নয়, অথচ আনিতেও হইবে– এই জন্য অত্যন্ত অশোভনভাবে কার্য্য নির্ব্বাহ করা হয়। গৃহের স্ত্রীলোকদিগকে সর্ব্বজনসমক্ষে এরূপ ভাবে বাহির করিলে তাঁহাদের অপমান করা হয়। আত্বীয়স্বজন ও প্রতিবাসীদের উপহাস বিদ্রূপ উপেক্ষা করিয়া পুরস্ত্রীদিগকে যদি ভদ্রবেশ পরান অভ্যাস করাও, তবে তাঁহাদিগকে বাহিরে আনিতে পার– নতুবা উচক্কা মত বা উপস্থিত সুবিধার খাতিরে এরূপ ভদ্রজননিন্দনীয় ভাবে স্ত্রীলোকদিগকে বাহিরে আনিলে সমস্ত ভদ্র বঙ্গসমাজকে বিষম লজ্জায় ফেলা হয়।

 এক দল লোক আছেন তাঁহারা আধাআধি রকম সমাজসংস্কার করিতে চান। “এক - চোখো সংস্কার” নামক প্রবন্ধে তাঁহাদের সংস্কারকার্য্যের বিষয়ে বিস্তারিত করিয়া লিখিয়াছি। স্বামীর মৃত্যুর পরে পুনরায় বিবাহ করিলে পবিত্র দাম্পত্য ধর্ম্মের বিরুদ্ধাচরণ করা হয়, এ বিষয়ে অনেকের সংশয় নাই। কিন্তু পৃথিবীর সুখ হইতে বিধবাদিগকে বঞ্চিত করা তাঁহারা নিষ্ঠুরতা জ্ঞান করেন। কিন্তু একটু ভাবিয়া দেখিলেই দেখা যায় বিধবাদিগকে পৃথিবীর সুখে মগ্ন করিয়া রাখাই প্রকৃত নিষ্ঠুরতা। অতএব একটাকে ছাড়িয়া আর-একটা রাখিতে গেলে, ঘাড়কে ছাঁটিয়া মাথা রাখিতে গেলে, বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়। একটি উদাহরণ দিলাম, কিন্তু এমন অনেক বিষয়েই প্রাচীন সমাজনিয়মের সহিত রফা করিয়া নূতন বন্দোবস্ত করিতে গিয়া সমাজের নানা দিকে জটিলতা আরও বাড়িয়া উঠিতেছে।  এমন জটিল সমস্যার মধ্যে বাস করিয়া সাম্প্রদায়িকতার অনুরোধে ব্যক্তিবিশেষের সামাজিক স্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ করা অন্ধ গোঁড়ামির কার্য। যদি কোন সম্প্রদায় এমন আইন জারি করেন, তাঁহাদের দলের সমুদয় লোককেই অবস্থানির্বিচারে বাল্যবিবাহ পরিহার করিতেই হইবে, বিধবাবিবাহ দিতেই হইবে, অবরোধপ্রথা ভাঙিতেই হইবে, তবে তাহাতে সমাজের অপকার হইতে পারে। মূল ধর্মনীতিসমূহের ন্যায় সমাজনীতি সকল অবস্থায় সকল লোকের পক্ষে উপযোগী না হইতে পারে। পরিবারবিশেষে বাল্যবিবাহ উঠিয়া গেলেও হানি নাই, কিন্তু সকল পরিবারেই এ কথা খাটে না। পরিবারবিশেষে বিধবাবিবাহ হইবার সুবিধা আছে, কিন্তু সকল পরিবারে নাই। স্ত্রীবিশেষ স্বাধীনতার উপযোগী কিন্তু সকল স্ত্রী নহে। যাঁহারা বলপূর্ব্বক সমাজে একটা বিশৃঙ্খলা জন্মাইয়া দিতে চান, তাঁহারা যতই স্ফীত হউন না কেন, তাঁহাদিগকে সমাজের গাত্রে একটি সুমহৎ ক্ষত বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে। সকল অবস্থাতেই আইনপূর্বক বাল্যবিবাহ বন্ধ করিলে সমাজে দুর্নীতি প্রশয় পাইতে পারে। অবস্থানির্বিচারে বিবাহার্থিনী বিধবা মাত্রেই বিবাহ দিতে গেলে অস্বাস্থ্যজনক উচ্ছ্বঙ্খলতা উপস্থিত হয়। স্ত্রী মাত্রেরই স্বাধীনতা দিতে গেলেই বঙ্গীয়সমাজকে অপদস্ত হইতে হয়। তেমনি আবার বাল্যবিবাহই একমাত্র নিয়ম বলিয়া অবলম্বন করা, সকল অবস্থাতেই সকল বিধবার স্কন্ধেই বলপূর্ব্বক ব্রক্ষ্মচর্য্য বোঝা চাপাইয়া দেওয়া এবং স্ত্রীলোকদিগকে কোন মতেই এবং কোন কালেই অন্তঃপুরের বাহিরে আনিবার চেষ্টা না করা অত্যন্ত অন্ধপ্রথাঞ্চলবর্ত্তিতার পরিচায়ক। অতএব এই সকল সমস্যার প্রতি মনোযোগ করিয়া এক প্রকার গোঁয়ার্ত্তমি গোঁড়ামি পরিত্যাগ কর। শান্ত সংযতভাবে সমাজসংস্কারের প্রতি মন দাও। অথচ বাঁধন ছিঁড়িবার উপলক্ষে তুচ্ছতর সাম্প্রদায়িক বাঁধনে সমাজের পঙ্গুদেহ জড়াইও না।