মহাজন

 গ্রামের কোন বৌ যখন বলে, ‘তােমারই পথ চেয়েছিলাম’, পথ সম্বন্ধে তখন গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বাঁধান পাকা রাস্তা কাঁচামাটির আঁকা-বাঁকা সঙ্কীর্ণ পল্লীপথে পরিণত হওয়ার উপক্রম করে। দুপাশে দেখা দেয় ঝােপঝাড় ডোবাপুকুর, জীর্ণ খড় অথবা শণে ছাওয়া বাড়ী-ঘর—একটি মেয়ের ঘােমটা ফাঁক করিয়া পথের দিকে চাহিয়া থাকিবার ফলে চারিদিকের আবহাওয়াই যেন বদলাইয়া যায়। পথটি দিয়া মোটর চালান যায় না, পথের দুদিকে কতকটা আধুনিক ফ্যাশনের পাকা দালান খাড়া করা যায় না, যে চোখ দুটি দিয়া বৌটি পথের দিকে চাহিয়া ছিল (চাহিয়া ছিল কিনা ভগবান জানেন, হয়ত সমস্ত দিনটা পড়িয়া পড়িয়া ঘুমাইয়াছিল,—‘তােমার পথ চেয়ে ছিলাম গাে!’—যাকে বলিতে হয় সে যে রাত্রিটা ঘুমাইতে দিবার পাত্র নয় এটুকু জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা গ্রামের বৌদেরও থাকাটা অস্বাভাবিক নয়) সে চোখে একজোড়া চশমা আমদানী করাটাও প্রায় অসম্ভব হইয়া দাঁড়ায়।

 তবে বলিয়া দিলে সকলেরই বিশ্বাস করা উচিত যে, বাঙ্গা গ্রামের বৌ, প্রায় সাড়ে তিনশ’ মাইল লম্বা বাঁধান রাস্তার ধারে গ্রামেরই দোতালা পাকা দালানে তার বাস, ঘুমানো দূরে থাক সারাদিন সে পাঁচ মিনিট চুপ করিয়া এক জায়গায় বসিয়াছে কিনা সন্দেহ এবং সত্যসত্যই একজনের পথের দিকে চাহিয়া থাকিছে।

 কখনও সদর দরজায় দাঁড়াইয়া চাহিয়াছে, কখনও জানালার শিকের ফাঁকে চাহিয়াছে, কখনও আলিসাহীন ছাদে দাঁড়াইয়া চাহিয়াছে। পথ ছাড়া আর যা কিছু দেখিবার আছে, কিছুই দেখিতে বাদ দেয় নাই। তবে সে একরকম মূল্যহীন দেখা। অনেকদিনের অতি পরিচিত আবেষ্টনী। চোখের সঙ্গে এমন অদ্ভুত ঘনিষ্ট পরিচয় যে, নূতনত্ব সৃষ্টিই হইতে পারে না। যে দু’একখানা নতুন ঘরবাড়ী উঠিয়াছে, যে ঘরবাড়ীর সংস্কার হইয়াছে, যেখানে বন সাফ হইয়াছে, যেখানে গাছপালা নিবিড়তর হইয়াছে, যেখানে মাঠের খোলা বুক ফসলে ভরিয়া গিয়াছে, যেখানে শুকনো জমিতে জল জমিয়া আয়নার মত ঝকঝকে জলা হইয়াছে,—তার চোখের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিবার জন্য কোথাও যেন আকস্মিকতা আমল পায় নাই, সমস্ত পরিবর্তনের পিছনে তার শুভদৃষ্টির অনুমোদন লাগিয়া আছে।

 এই ব্যাপারটাই আগাগোড়া কেমন খাপছাড়া লাগে। প্রায় চুয়াল্লিশ বছর বয়সে এসব কি চলে মেয়েমানুষের! বাহিরটা ভিতরে চলিয়া আসিবে, এ বয়সে এটা আর ঠিক মানায় না, উচিত হয় না, প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। কপালে ত্রিশ বছরের সিঁদূরের ফোঁটাটা একবারও চড়চড় না করিলে যেমন অন্যায় হয়, এও কতকটা সেইরকম বই কি। সকালে, দুপুরে, বিকালে, রাত্রে, চারিপাশের জগৎকে খুঁটিয়া খুঁটিয়া ভিতরে আনা, তুচ্ছতম পরিবর্ত্তনকে পর্য্যন্ত সূচনা হইতে চিনিয়া রাখা। দশটা দিক তার জগতের, দশ-প্রহরণের বৈচিত্র্য। চেতনাকে অবশ করিয়া রাখা মহাপাপের সামিল নয় কি? বিশেষতঃ আজ যখন একজনের আসিবার কথা ছিল? আজ যখন সে একজনের পথ চাহিয়া আছে?

 আবেগ বাঙ্গার অতি অভ্যস্ত অনুভূতি—চুয়াল্লিশ বছর বয়সে পর্য্যন্ত। আবেগের আতিশয্যে প্রায় প্রত্যেক দিনই কয়েকবার কিছুক্ষণের জন্য মাথা ঝিমঝিম করে। এতদিন এজন্য বিশেষ কোন ভাবনা ছিল না, এতবড় বাড়ীতে এত কম লোকের মধ্যে এত কম কাজ করিয়া দিন কাটাইতে হইলে মাঝে মাঝে আবেগের আতিশয্য ঘটিয়া মাথাটা ঝিমঝিম করিলেই বরং আরাম লাগে, কিছুক্ষণের জন্য ভাবনা চিন্তা অনুভূতি সব ভোঁতা হইয়া যায়,—কিন্তু এবার কদিন আগে হঠাৎ একটা দুর্ভাবনা গজাইয়া উঠায় বিপদ হইয়াছে। চুলে নাকি বাঙ্গার পাক ধরিয়াছে এইজন্য,—এরকম আবেগের আতিশয্য ঘটিয়া মাথা ঝিমঝিম করিতে থাকিলে কিছুদিনের মধ্যেই নাকি তার চুল পাকিয়া যাইবে। বুড়ী হইয়া পড়িবে বাঙ্গা। হায়, চুয়াল্লিশ বছর বয়স হইয়াছে বাজার, চুল পাকিয়া বাঙ্গা বুড়ী হইয়া যাইবে!

 বাঙ্গা নিজেই এটা আবিষ্কার করিয়াছে। কয়েকদিন আগে করুণা বৌকে সে এই বলিয়া বকুনি দিয়াছিল; “বিইয়েছিস তো বাছা একটা মোটে মেয়ে, লজ্জা-সরম নাই বা এরমধ্যে ভাসিয়ে দিলি? যাক না আর দুটো দিন? হোক না আর দুটো একটা বাচ্চা-কাচ্চা?”

 করুণার বৌ জবাব দিয়াছিল: ‘বেশী কাচ্চা-বাচ্চা না হলে বুঝি বুড়ো বয়েস পোয্যোন্তো কনে বৌটি সেজে থাকতে দিদি?’

 ‘কি বললি?’

 ‘বলিনি কিছু, জিগ্‌গেস করছি। তোমার একটির বেশী কাচ্চা-বাচ্চা হয়নি তো, মাথার চুলে পাক ধরেছে, তবু যে কনে বৌটির মত লজ্জা সরম রেখে চলেছ এটা সেইজন্য কি-না, তাই জিগ্‌গেস করছি। জিগ্‌গেস করলে তো দোষ নেই দিদি? তোমায় জিগ্‌গেস না করলে কাকেই বা জিগ্‌গেস করব বল? তুমি হলে গিয়ে, কি যেন বলে, সব জান্তা।—’

 চুলে পাক ধরিয়াছে? ধরুক। স্বাভাবিক নিয়মে ঠিক বয়সে পাক ধরিয়া সমস্ত চুল শণের নুড়ি হইয়া যাক। কিন্তু মন কেমন করিয়া মাথা ঝিম-ঝিমানির জন্য অসময়ে মাথার চুল সাদা হইবে কেন? সে কি বরদাস্ত হয় মানুষের? কে জানিত মাথা ঝিম-ঝিম করার এমন একটা কুফল আছে!

 কপাল পোড়া, তাই অসময়ে জানিতে হইল। এতকাল না জানিয়া কাটিয়াছিল, আরও কয়েকটা দিনও না হয় কাটিত। বছরে চারটি দিনের জন্য বিধুশেখর বাড়ী আসে, তার ঠিক কয়েকটা দিন আগে এমন চাঞ্চল্যকর জ্ঞান নাই বা জুটিত। বিধুশেখর ফিরিয়া যাওয়ার পর জুটিলে জ্ঞানটা নাড়াচাড়া করার সময় পাওয়া যাইত একটা বছর। এক বছরে নূতনত্ব ঘুচিয়া যাইত জ্ঞানের, আর চঞ্চল করিতে পারিত না। বছরে চারদিনের জন্য যে স্বামীকে কাছে পায়, দুর্ভাবনা দিয়া স্বামীকে অভ্যর্থনা করা তার পক্ষে মহাপাপ। অন্ততঃ স্বামী তো একটা মারাত্মক ভুল-বোঝা বুঝিয়া ফেলিবার সুযোগ পাইবে। মনে তো করিয়া বসিবে যে বৎসরান্তে চারদিনের জন্য স্বামীকে কাছে পাইয়াও অন্যবারের মত বৌটা খুসী পর্য্যন্ত হয় নাই, মুখটা হাঁড়ি করিয়া আছে। তারপর ভাবিয়া চিন্তিয়া হয় তো ঠিক করিয়া ফেলিবে যে, এমন বৌয়ের কাছে বছরে চারদিনের জন্যও আর তবে আসিয়া কাজ নাই! ব্যস, আর আসিবে না। দিন কাটিবে মাস কাটিবে বছর কাটিবে, স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিক নিয়মে বাঙ্গার চুল সাদা হইয়া আসিবে, চামড়া লোল হইয়া পড়িবে, কোমর বাঁকিয়া যাইবে,—বিধুশেখর আসিবে না। বছরে চারিদিনের জন্যও আসিবে না, একদিনের জন্যও আসিবে না। ত্রিশ বছরের নিয়মটা ভাঙ্গিয়া যাইবে। না মরিলেও দুজনের প্রত্যেকের মনে হইবে, হয় সে নিজে নয় অপর জন মরিয়া গিয়াছে।

 পূজার সময় চারদিনের জন্য বিধুশেখর বাড়ী আসে। কবে আসে সেটা নির্দ্দিষ্ট থাকে না, কোন বছর পূজার দুদিন আগেই আসিয়া পড়ে, কোন বছর পূজার মধ্যে কোন একটা দিন আসিয়া হাজির হয়। গুনিয়া গুনিয়া চারিটি দিন সে থাকে তাও নয়। কোনবার একদিন কমও থাকে কোনবার একদিন বেশীও থাকে। চারিদিনের হিসাবটা বাঙ্গার ত্রিশ বছরের গড়পড়তায় হিসাব—এ হিসাব বাঙ্গার একেবারে নিজস্ব। বছরে চারদিনের জন্য স্বামীকে কাছে পাইবে বাঙ্গার এই আশা, ভরসা ও বিশ্বাস—নিজের প্রাপ্য সম্বন্ধে ধারণা। বছর ভরিয়া এটা কল্পনার কাজে লাগে। বিধুশেখর একদিন কম থাক আর একদিন বেশী থাক সেজন্য কিছু আসিয়া যায় না, ওটা সাময়িক লাভ লােকসানের ব্যাপার।

 ‘মােটে তিনদিন থাকবে এবার?’

 এই কথাটা বলিবার সময়টুকুর মধ্যেই প্রায় বুকটার ধড়াস ধড়াস সামলাইয়া অন্ধকার পৃথিবীতে আলো আবিষ্কার করিয়া আত্মসম্বরণ করিয়া ফেলিতে পারে—নিজের ব্যথা ভুলিয়া স্বামীকে দরদ দেখানাের কর্ত্তব্য পালন করিতে আর স্বামীকে কাছে পাওয়ার জন্য তার যে আনন্দের সীমা নাই এই ভাবটা আবার মুখে ফুটাইয়া তুলিতে বড় জোর আরও ততটুকু সময় লাগে। বাস্, যেমন বাঙ্গা ছিল, আবার তেমনি বাঙ্গা,—দীর্ঘ বিরহের অবসানে বুড়া বয়সেও মেয়েমানুষের যতটা আনন্দে ডগমগ হওয়া উচিত তার চেয়ে বোধ হয় বেশী ডগমগ বাঙ্গা!

 ‘পাঁচদিন থাকবে? সত্যি?’

 বলিয়া খুসিতে ছোট মেয়েটি বনিয়া যাওয়া তো আরও সহজ ব্যাপার, আরও কম সময়ের কাজ।

 এবার সপ্তমীর দিনটাও পথ চাহিয়া কাটিয়াছে। বিধুশেখর আসে নাই। অন্য বছর এটা অসাধারণ ঠেকিত না। আজ আসে নাই, কাল আসিবে। কেবল একটা দিনের এই-আসে-এই-আসে-প্রতীক্ষার ব্যর্থতা, পরদিন আরও বেশী অধীরতার সঙ্গে প্রতীক্ষা। কিন্তু এবার ব্যাপারটা আগাগোড়া কেমন যেন খাপছাড়া। কোনবার আসিবার আগে বিধুশেখর পত্র লেখে না, এবার আগেই লিখিয়া জানাইয়াছে, সপ্তমীর দিন আসিয়া পৌঁছিবে। সপ্তমীর দিন না-আসাটা তাই অনন্যসাধারণ ঘটনার পর্য্যায়ে গিয়া পড়িয়াছে।

 করুণা বলিয়াছে, ‘আসবেন লিখে এলেন না—এতো ভারি আশ্চর্য্যি! নয় বৌঠান, আশ্চর্য্যি নয়? দাদার বেলা তো এমন হয় না।’ বাঙ্গা বলিয়াছে, ‘কেন হবে না, হয়। ওঁর কি কথার ঠিক আছে?’ করুণার বৌ ফিসফিস করিয়া বলিয়াছে, ‘কথার ঠিক আছে, মাথার ঠিক নেই। মাথা বেঠিক বলেই না তিরিশ বচ্ছর চুলচিরে কথার ঠিক থেকেছে।’

 ‘কি বল্‌লি?’

 ‘বললাম, কোন কাজে হয় তো আটকে গেছেন কাল আসবেন।’

 ‘আর এসেছে। আসবে লিখেছে যখন, আর কোনদিন আসবে না। জীবনে কোনদিন আসবে না বলে চলে গিয়েছিল কি না, তাই প্রতি বছর এসেছে। এবার আসবে লিখেছে কি না, আর আসবে না।’

 এই ক্ষুব্ধ আলোচনার জেরটা কাটিয়া যাওয়ার আগেই বিধুশেখর আসিয়া হাজির হয়। অসময়ে, বিনা সংবাদে, একেবারে আলােচনা-সভার মাঝখানে। আলােচনাটা তখন বাঙ্গাকে প্রায় কাঁদাইয়া ছাড়িয়াছে। অন্যবারের মত তাই হাসিমুখে স্বামীকে অভ্যর্থনা করিবার সুযােগটা এবার বাঙ্গার ফস্কাইয়া গেল। বিধু আসিয়া দ্যাখে কি, এবার বাঙ্গার মুখের ভঙ্গিটা বড় খাপছাড়া, বেশভূষাটা বড় বেমানান। গায়ে সেমিজ থাকা দূরে থাক, পরণের কাপড়টাও ময়লা। মুখে হাসি থাকা দূরে থাক, চোখ ঠাসা জল। স্বামী যেন এবার বাঙ্গার আসিয়াও আসে নাই।

 সবচেয়ে বিপদের কথা, এবার বাঙ্গার আত্মসংযম নাই। গত বছর বাঙ্গার বয়স ছিল প্রায় তেতাল্লিশ, কি গভীর আত্মসংযমে গত বছরও নিজেকে সে যুবতী করিয়া রাখিয়াছিল! এবার দিদিমার মত বুড়ী সাজিয়া অসংযমের চরম করিয়া ছাড়িল। চোখ পাকাইয়া বিধুর দিকে চাহিয়া মুখ ভ্যাংচাইয়া বলিল, ‘কেন এলে আজ? কাল আসবে লিখে আজ এলে কেন শুনি? আরে আমার সাতজন্মের ভালবাসার ভাতার! কাল আসবেন লিখে আজ এসেছেন পিরীত করতে!'

 এ বজ্রপাতের সামিল। হাতের স্যুটকেশটা মাটিতে ফেলিয়া বিধু বজ্রাহতের মত তার উপরে বসিয়া পড়িল। একটা বজ্রপাত করিতেই বাঙ্গার সমস্ত বিদ্যুৎ খরচ হইয়া গিয়াছিল, মেয়েমানুষের বিদ্যুৎ আর জীবনশক্তি এক জিনিষ, বাঙ্গাও তাই যেন হঠাৎ মরিয়া গেল। বোকার মত জিভ্ কাটিয়া প্রথমে বলিল, ‘ছি!',—তারপর চারদিকে উদভ্রান্তের মত চাহিয়া বলিল, ‘কি বললাম?’

 বিধু গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমার শরীর ভাল নেই?’

 চুলের প্রায় তিনভাগ সাদা বিধুর, বয়স তাে গিয়াছে ষাটে। তা ছাড়া শরীরটাতে ধরিয়াছে ভাঙ্গন। ত্রিশ বছর আগে এরকম মুখ করিয়া এত দরদের সঙ্গে এরকম একটা প্রশ্ন করা চলিত, এখন আর চলে না। করুণা, করুণার বৌ, করুণার মেয়ে আর বাঙ্গা চারজনেরই সর্ব্বাঙ্গে তাই রােমাঞ্চ দেখা দিল। করুণার মেয়ের কোলের আড়াই বছরের শিশুটা পর্যন্ত আবহাওয়ার মধ্যে একটা দুর্ব্বোধ্য ভয়ানক কিছুর আবির্ভব টের পাইয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

 মােটের উপর অবস্থাটা দাঁড়াইয়া গেল কুৎসিৎ। প্রাণাধিকের মৃতদেহটা জড়াইয়া ধরিয়া একটু বেহিসাবী রকমের বেশী সময় কাঁদাকাটা করার পর নাকে পচা গন্ধ লাগিতে আরম্ভ করিলে যেমন বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয়।

 যাই হােক, রবীন্দ্রকাব্যের চোলাই-খানার দেশে তামাসা করাটা সব অবস্থাতেই সােজা এবং নিরাপদ। করুণার বৌ তাই মেয়ের কোল হইতে মেয়ের ক্রন্দনপরায়ণ ছেলেকে নিজের কোলে নিয়া তার হাঁ করা মুখে হাত চাপা দিয়া বলিল, ‘বলনা খোকন তাের দাদুকে, তুমি এসেছ দাদামশাই এবার দিদিমার শরীল ভাল হবে, সম্বচ্ছর কেঁদে কাটালে শরীল খারাপ হবে না একটু?’

 বাঙ্গা বলিল, ‘কি বেহায়াপনা করিস! সম্বচ্ছর কেঁদে কাটাই না তাের মাথা।’

 মুখে হাত চাপা দেওয়ায় খােকনের ফাঁপর লাগিবার উপক্রম হইয়াছে, তবু করুণার বৌ হাত সরাইল না। মুখ নীচু করিয়া একটু হাসিয়া বলিল, ‘আমার কাছে কি লুকোনাে আছে দিদি, কত রাত কেঁদে কাটাতে দেখেছি!’

 ‘তোর মাথা দেখেছিস, বেহায়া বজ্জাত মাগি! ছেলেটাকে মারবি না কি অ্যাঁ?’

 করুণার বৌ-এর কোল হইতে ছেলেটাকে বাঙ্গা ছিনাইয়া নিল। এঘরে আর থাকা চলে না। পাশের একটা ঘরে গিয়া বিছানায় বসিয়া নাতিকে কোলে করিয়া চুপি চুপি কাঁদিতে লাগিল। নাতির গগনভেদী আর দিদিমার মৃদুল কান্নার সমন্বয় এবাড়ীতে একটা নূতনত্বের সৃষ্টি করিল বৈ কি আজ। পূজার বাজনা শুনিতে শুনিতে মনে হইতে লাগিল, কয়েক মাইল দূরের গ্রামগুলিতে যেমন বন্যার জলে দুর্ভিক্ষের আগুন জ্বালাইয়া রাখিয়া যাইবার মত অদ্ভুত কাণ্ড ঘটাইয়া গিয়াছে পূজার উৎসবটা সেই রকম মানুষের জীবনটা নিরানন্দে ভরিয়া দিতেছে।

 এঘরের জানালা দিয়া পথ দেখা যায়। আর দেখা যায় পথের ওদিকের সাড়ে তিনটা কাঁচাপাকা বাড়ী। মাঝখানের বাড়ীটার একটা ঘরের জানালা প্রায় এই জানালাটার প্রতিফলিত ছবির মত। রাখাল দাসের ছবির মত সেজ মেয়ে টুনুর ঘর বলিয়া জানালাটায় কেবল একটা পর্দ্দা আছে,—তবে আধখানাই প্রায় ছেঁড়া। সকাল বেলাই খবর পাওয়া গিয়াছিল আজ টুনুরও জামাই আসিয়াছে। এখন দেখা গেল, শুধু আসে নাই, সশরীরে আসিয়াছেন। বেলা বারটার সময়েও টুনু জানালার শিক ধরিয়া দাঁড়ান মাত্র শরীরটা অনায়াসে এবং হয়ত অকারণে তার পাশে আসিয়া দাঁড়াইতে দ্বিধা করে না—টুনুর কৌতূহলেরও যেন আর ক্ষণিকের স্বাধীনতা নাই, বাহিরের জগৎকে একটু দেখিয়া লইতে জানালায় আসিলেও তাকে লজ্জা দেওয়া চাই।

 অথচ টুনু সঙ্গেই যাইবে—তিনটা কি চারটা দিন পরে। ছমাস আগে হইতে ঠিক হইয়া আছে, এবার টুনু সঙ্গেই যাইবে। অন্ততঃ ছ’মাসের জন্য সঙ্গে যাইতেই হইবে। গন্তব্য স্থানটা এতদূর আর টুনুর বয়সটা এত কম যে ছ'মাস ধরিয়া টুনুর এই সঙ্গে যাওয়ার কথাটা ভাবিতে গেলেই বাঙ্গার বুক কাঁপিয়াছে, মাথার ঝিমঝিমানি বাড়িয়া গিয়াছে।

 আজ এত সব কাণ্ডের ঠিক পরেই পর্দ্দা-ছেঁড়া জানালার ফাঁকে টুনু আর নবাগতকে এক সঙ্গে দেখিয়া ফেলার ভিতরে একটা বড় রকমের প্রলয় ঘটিয়া গেল। বিকালেও আগের মত হওয়া গেল না, পরদিনও গেল না।

 এতদিনের সাধনা, এতদিনের অভ্যাস, ভবিষ্যতের ভাবনা কিছুই কাজে লাগিল না বাঙ্গার। বাঙ্গা কোনমতেই স্বামীর সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক ব্যবহার করিতে পারিল না।

 বিধু কতকটা নীরব গাম্ভীর্য্যের সঙ্গেই তার পরিবর্ত্তনটা লক্ষ্য করিয়া গেল। কিন্তু সেও যে কিরকম সমস্যায় পড়িয়া গিয়াছে, প্রকাশ পাইতে বাকী থাকিল না। বিধুর দাড়ি-গোঁপ ভয়ানক কড়া, খুব ভাল করিয়া চাহিবার পরও হঠাৎ দেখিলে মনে হয় যেন নিষ্ঠুরতার একটা প্রকাশ্য আবরণ। এই রকম মুখে দুর্ভাবনার সঞ্চার হওয়ায় বাঙ্গার সর্ব্বাঙ্গ ভয়ে অবশ হইয়া আসিল। ভয়ে ভয়ে শেষ পর্যন্ত সে নিজেই কৈফিয়ত দিয়া বলিল, ‘দ্যাখো, আমার শরীলটা সত্যি ভাল নেই। দুদিনের জন্য এলে আমি এরকম ব্যবহার করছি বলে কিছু যেন মনে করো না তুমি, কেমন?’

 ‘না, কিছু মনে করিনি।’

 ‘এতবার এসেছে, কোনবার আমার মুখ ভার দেখেছ?’

 ‘না, তা দেখিনি।’

 ‘এবার হাসিখুসী থাকতে পারছি না—কি যেন হয়েছে। হবে আর কী, শরীলটা ভাল নেই। এবারটি আমায় মাপ করবে না?’

 এ এক ধরণের প্রেমালাপ। দিনের বেলা ঘরের বারান্দায় সকলের চোখের সামনে বসিয়া নাতিকে কোলে করিয়া এ ধরণের গভীর ও তীব্র আবেগ-ভরা প্রেমালাপ করিতে হয়। আড়ালে চুপি চুপি ফিস্ ফিস্‌ করিয়া এসব প্রেমালাপ চলে না, তার মত বেহায়াপণা আর নাই। দুজনের বয়স এখন অনেক পিছাইয়া দিলে, নাতিকে বহুদূর ভবিষ্যতে সঞ্চিত করিলে, বাঙ্গাকে টুনুর মত হাল্কা ছিপছিপে একটি নববিবাহিতা মেয়ে, আর বিধুকে টুনুর জামায়ের মত ফিটফাট নববিবাহিত ছেলে করিয়া দিলে, দুজনের এই চমৎকার মানানসই প্রকাশ্য প্রেমালাপ যেমন অকথ্য বেহায়াপণায় দাঁড়াইয়া যায়, আড়ালে এই প্রেমালাপ তেমনি বেহায়াপণা। এমন জটিল মানুষের জীবনের এই দিকটা!

 পূজা গেল। বিধু গেল না। বলিল, ‘এই যাব আজকালের মধ্যে। দুটো দিন থাকি।’

 অন্যবার এই কথায় বাঙ্গার আনন্দে পাগলামি করার কথা, এবার তার শ্রান্ত চোখ দুটি জলে ভরিয়া গেল। টুনু একজনের সঙ্গে সেইদিন কয়েক ঘণ্টা আগে চলিয়া গিয়াছে, শুধু এজন্য অবশ্য নয়, অন্য কারণও ছিল। প্রকৃতপক্ষে, অন্য কারণগুলিই প্রধান কারণ। সেইজন্য পাগলামি সে করিল অনেক রকম, কিন্তু আনন্দে পাগল হইতে পারিল না। কেবল টুনুর জন্য চোখে জল আসিলে সে অনায়াসে স্বামীর আরও দুটো দিন থাকিবার কথা শুনিয়া মুখে হাসি-কান্নার শোভা ফুটাইয়া স্বামীকে দেখাইতে পারিত। চাবির গোছাটায় অসঙ্গত আওয়াজ তুলিয়া বলিতে পারিত, ‘সত্যি আরও দুটো দিন থাকবে? বল কি গো! এবার কোন্‌দিকে সূয্যি উঠছে দেখতে হবে তো!’

 বিসর্জ্জনের দশমীর পরের পূর্ণিমা আসিল, তবু বিধুশেখরের যাওয়ার লক্ষণ দেখা গেল না। বছরের পর বছর, কেবল চারদিনের জন্য বাড়ীতে আসা-যাওয়াটা রীতিমত নাটকীয় ব্যাপার, কিন্তু বিধুশেখর আসা-যাওয়াব মধ্যে হাঙ্গামা ঢুকিতে দেয় না, যন্ত্রের মত আসে, যন্ত্রের মত চলিয়া যায়। যেন দৈনন্দিন সাধারণ কাজ—আপিসে যাতায়াতের মত। এবার আসিয়াছে সে যন্ত্রের মত, যাওয়া সম্পর্কে এরকম বাড়াবাড়ি আরম্ভ করায় সকলে অবাক হইয়া গেল। একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেল, যখন বাড়াবাড়িটা দাঁড় করাইয়া দিল অবিশ্বাস্য নাটকীয়তায়।

 আরও তিনদিন বাঙ্গার চাল-চলন লক্ষ্য করিবার পর বলিল, ‘দ্যাখো তোমায় একটা কথা বলব ভাবছিলাম। আমার সঙ্গে যাবে?’

 ত্রিশ বছর পরে এ প্রশ্ন বুঝিতে সময় লাগে। বাঙ্গা কিছু বলিল না।

 ‘এবার তোমায় সঙ্গে নিয়ে যাব ভাবছিলাম। বুড়ো হলাম, কবে আছি কবে নেই—’

 বাঙ্গা দুচোখ বিস্ফারিত করিয়া বলিল, ‘তুমি আমায় সঙ্গে নিয়ে যাবে? আমি তোমার কাছে গিয়ে থাকবো?’

 ‘যদি তুমি রাজী হও। আমি ভাবছিলাম কি, কবে কি হয়েছিল সেজন্য এতকাল তুমিও কষ্ট পেলে আমিও কষ্ট পেলাম, এবার বাকী কটা দিন—’

 বাঙ্গার মাথা ঝিম ঝিম করিতেছিল। সে সংক্ষেপে বলিল, ‘তুমি এখনও অনেকদিন বাঁচবে।’

 বিধু বলিল, ‘কি বললে? অনেকদিন বাঁচব? বাঁচাবাঁচির কথা পরে হবে, তুমি রাজী তো?’

 ‘রাজী নই? ওগো আমি যে সারাবছর তোমার জন্য কাঁদি আর পথের পানে চেয়ে দিন কাটাই।’

 গ্রাম্য মেয়ে এভাবে পথের পানে চাহিয়া চাহিয়া দিন কাটানর কথা বলিলে গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব না হইয়া পারে?

 বিধুশেখরের কামান কড়া দাড়িগোঁপের নিষ্ঠুর আবরণে ঢাকা মুখ হঠাৎ এমনভাবে বিকৃত হইয়া গেল যে, দেখিলে ভয় হয়। রাগে আগুন হইয়া সে বলিতে লাগিল ‘সারা বছর কাঁদ! পথের পানে চেয়ে দিন কাটাও! এতদিন বলতে পারনি এ কথাটা? এতকাল কাঁদতে পারনি একটু? সারা বছর আশায় আশায় থেকে বাড়ী ফিরতাম, চৌকাটে পা দিতে না দিতে একগাল হাসি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াতে, যে কটা দিন থাকতাম, কি স্ফূর্ত্তি, কি সব হাসি-তামাসা, হৈ চৈ ব্যাপার! কি করে জানব তুমি সারা বছর কাঁদতে? কি করে জানব তুমি পথের পানে চেয়ে দিন কাটাতে? গুণতে তো জানি না আমি!’

 চীৎকার শুনিয়া সকলে ছুটিয়া আসিয়াছিল, ছেলে কোলে করুণার মেয়ে পর্য্য‌ন্ত। কিন্তু বাঙ্গা কারও দিকে দৃষ্টিপাতও করিল না, রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আগে জানলে আমায় নিয়ে যেতে?’

 বিধুশেখর আরও রাগিয়া বলিল, ‘যেতাম না? নিয়ে যাবার জন্যই তো এসেছি প্রত্যেকবার। তোমার রকম সকম দেখে ভড়কে যেতাম। আমায় ছাড়া যে অমন স্ফূর্ত্তিতে থাকতে পারে, তাকে আর সঙ্গে নিয়ে যাবার কথা বলতেই সাধ হত না।’

 কত পাগলামিই মানুষ জানে! এসব কাণ্ড-কারখানা দেখিলে মনে হয় না, মানুষের পক্ষে ভাব-প্রবণতা মহাপাপ, যে মানুষ হাসির পিছনে কান্না, আর কান্নার পিছনে হাসি খুঁজিয়া পায় না—ত্রিশ বছর সন্ধান করিয়াও পায় না? বিশেষতঃ, কয়েকজন কবি পৃথিবীর মানুষের জন্য কাব্য-রস পরিবেশন করিয়া গিয়াছেন এবং কাব্য-রসটা সব রসের সেরা রস, এই জন্য পুরুষ মানুষের পক্ষে কবিত্ব করা আত্মহত্যার সামিল। বিধুশেখর কাব্য-রস উপভোগ করিয়াছিল, ভালই করিয়াছিল—সকলেরই করা উচিত। কবি না হইয়া কবিত্ব করিতে গেল কোন্ হিসাবে? কে আজ ত্রিশ বছরের ক্ষতিপূরণ করিবে? কোন্ মহাজনের এত ক্ষতি সহ্য হয়?