সাহিত্য/গ্রন্থপরিচয়

গ্রন্থপরিচয়

সাহিত্য গদ্যগ্রন্থাবলীর চতুর্থ ভাগ রূপে ১৩১৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। মূল প্রবন্ধগুলির অতিরিক্ত চৌদ্দটি প্রবন্ধ বর্তমান সংস্করণের সংযোজনে কালক্রমে সংকলিত হইল। তন্মধ্যে শেষ তিনটি প্রবন্ধ (পরবর্তী তালিকায় ২৩-২৫) পূর্ববর্তী সংস্করণেও ছিল; অন্য চারিটি প্রবন্ধ (১৬-১৯) ‘সাহিত্যের পথে’র প্রথম প্রকাশকালে ‘পত্রালাপ’ শিরোনামে সংকলিত হয় (প্রচলিত ‘সাহিত্যের পথে’ গ্রন্থে নাই), ‘সাহিত্য’ গ্রন্থের ১৩৪৮ মাঘ সংস্করণে গৃহীত ও পরে বর্জিত হয়, বর্তমানে সমসাময়িক অন্য রচনাচয় সংকলন করায় অভিন্ন প্রসঙ্গসূত্রে সংগত কারণেই একত্র গ্রথিত হইল— শিরোনামগুলি ‘সাধনা’ হইতে লওয়া হইয়াছে। সংকলিত সমুদয় প্রবন্ধের সাময়িক পত্রে প্রকাশকাল নিম্নে মুদ্রিত হইল।—

সাহিত্যের তাৎপর্য বঙ্গদর্শন অগ্রহায়ণ ১৩১০
সাহিত্যের সামগ্রী বঙ্গদর্শন কার্তিক ১৩১০
সাহিত্যের বিচার
‘সাহিত্যসমালোচনা’ আখ্যায়

বঙ্গদর্শন
আশ্বিন ১৩১০
সৌন্দর্যবোধ বঙ্গদর্শন পৌষ ১৩১৩
বিশ্বসাহিত্য বঙ্গদর্শন মাঘ ১৩১৩
সৌন্দর্য ও সাহিত্য বঙ্গদর্শন বৈশাখ ১৩১৪
সাহিত্যসৃষ্টি বঙ্গদর্শন আষাঢ় ১৩১৪
বাংলা জাতীয় সাহিত্য সাধনা বৈশাখ ১৩০২
বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বঙ্গদর্শন শ্রাবণ ১৩০৯
১০ ঐতিহাসিক উপন্যাস ভারতী আশ্বিন ১৩০৫
১১ কবিজীবনী বঙ্গদর্শন আষাঢ় ১৩০৮
সংযোজন
১২ কাব্য: স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট ভারতী ও বালক চৈত্র ১২৯৩
১৩ সাহিত্যের উদ্দেশ্য ভারতী ও বালক বৈশাখ ১২৯৪
১৪ সাহিত্য ও সভ্যতা ভারতী ও বালক বৈশাখ ১২৯৪
১৫ আলস্য ও সাহিত্য ভারতী ও বালক শ্রাবণ ১২৯৪
১৬ আলোচনা সাধনা ফাল্গুন ১২৯৮
১৭ সাহিত্য সাধনা বৈশাখ ১২৯৯
১৮ সাহিত্যের প্রাণ সাধনা আষাঢ় ১২৯৯
১৯ মানবপ্রকাশ সাধনা ভাদ্র-আশ্বিন ১২৯৯
২০ কাব্য সাধনা চৈত্র ১২৯৮
২১ বাংলা সাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞা সাধনা সাধনা বৈশাখ ১২৯৯
২২ বাংলা-লেখক সাধনা মাঘ ১২৯৯
২৩ সাহিত্যের গৌরব সাধনা শ্রাবণ ১৩০১
২৪ সাহিত্যসম্মিলন বঙ্গদর্শন ফাল্গুন ১৩১৩
২৫ সাহিত্যপরিষৎ বঙ্গদর্শন চৈত্র ১৩১৩

২ এই প্রবন্ধের ছটি বর্জিত অংশ বঙ্গদর্শন হইতে উদষ্কৃত হইল—

 যেখানে রচনার সঙ্গে তাহার বিষয়ের এইরূপ একাত্মতা। আছে সেইখানেই সাহিত্য সজীব মূর্তিতে প্রকাশ পায়। কুমারসম্ভবের মধ্যে যে বিষয়টুকু আছে তাহা। জানা। হইলেই যে কুমারসম্ভব পড়ার ফল পাওয়া যায় তাহা নহে। উহার ছন্দোবন্ধ, উহার অগাগোড়াই পড়িতে হইবে। কুমারসম্ভব ছাড়া আর কোনোখানেই কুমারসম্ভব-পাঠের উদ্দেশ্য সফল। করিবার কোনো উপায় নাই। উজ্জয়িনীতে বসিয়া কত শতাবী পূর্বে কালিদাস যে-কয়টি কথা লিখিয়াছেন তাহার একটি অক্ষর বাদ দিলে চলিবে না। ঊাহারই ভাব তাহারই ভাষায় গাহারই রচনার ভঙ্গীতে আমাদিগকে সমগ্র আকারে গ্রহণ করিতে হইবে, নতুবা তাহার প্রাণহানি হইবে। ইহাই যথার্থ বাচিয়া থাকা।

 সৃষ্টির মূল উপাদান অসংখ্য নহে। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন আধারে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হইয়া অসীম বৈচিত্র্য রচনা করিতেছে। সাহিত্যেরও মূল। উপাদান সীমাবদ্ধ। একই ভাব সহস্র চিত্ত হইতে সহস্র ভাবে প্রতিফলিত হইয়া। মামুষের নন্দলোককে নব নব বৈচিত্র্য দান করিতেছে।

-বঙ্গদর্শন। কার্তিক ১৩১০

৪ বঙ্গদর্শনের যে সংখ্যায় মুদ্রিত তাহার সূচীপত্রে উল্লেখ আছে‘জাতীয় শিক্ষাপরিষদের প্রথম বর্তৃতা। এই প্রবন্ধে, ৫০ পৃষ্ঠায় নিয় হইতে গণিলে সপ্তম ও ষষ্ঠ, এই উভয় ছত্রের অস্তরে অনেকটা রচনা বঙ্গদর্শনে মুদ্রিত থাকিলেও গ্রন্থে প্রথমাবধি বর্জিত হইয়াছে।

৫, ৬, ৭ ‘জাতীয় শিক্ষাপরিষদে পঠিত।

৮ সাধনায় প্রবন্ধশেষে মুদ্রিত আছে, ‘এই প্রবন্ধ ২৫শে চৈত্র রবিবার | বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদের সাম্বৎসরিক উৎসবসভায় পঠিত হয়। এই প্রবন্ধের বর্ধিত অংশে প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির এরূপ সমালোচনা ছিল

 প্রচলিত পদ্ধতিতে যেমন করিয়া ইংরাজি শিক্ষা দেওয়া হয় তাহাতে ছাত্রদের সমস্ত অবসর এবং সেই সঙ্গে সমস্ত উৎসাহ ও স্বাধীন চেষ্টার উগম শোষণ করিয়া। লয়। বৃক্ষের চারি দিকে আকাশের নায় শিক্ষার চারি দিকে খানিকটা অবকাশের আবখ্যক করে। এমন খানিকটা অবসর ও শক্তি থাকা চাই যাহ। অবলম্বন করিয়া নবলব্ধ শিক্ষা সম্যকরূপে আলোচিত প্রসারিত পরীক্ষিত হইতে পারে। কিন্তু বাঙালির ছেলেকে যখন কেবল ইংরাজি ভাষামাত্র নহে, পরন্ত সমস্ত পাঠ্য বিষয়গুলিকেও ইংরাজিতে শিক্ষা করিতে হয়, তখন তাহার অবকাশ এবং শক্তির শেষ সূচ্যগ্র ভূমি পর্যন্ত ছাড়িয়া দিতে হয়। অপরিচিত ভাষা এবং অপরিচিত বিষয় এই উভয় দৈত্যের দ্বারা একই সময়ে দক্ষিণে বামে আক্রান্ত হইয়া বাঙালির ছেলের চিন্তা করিবার অবসর মাত্র থাকে না, কেবল সে অন্ধভাবে প্রাণপণ করিয়া যুঝিতে থাকে। অন্তত ঘদি এনট্রেনস ক্লাস পর্যন্তও বাংলা ভাষায় বিষয়-শিক্ষা ও ইংরাজিকে স্বতন্ত্র শিক্ষণীয় বিষয়ম্বরূপে গণ্য করা হয় তবে ছাত্রগণ কুতরপে শিক্ষা করিবার অবকাশ পায় এবং শিক্ষাসমাপনের পর স্বদেশের হিতসাধন ও জীবনের মহৎ কর্তব্য -পালনের উপায় তাহাদের নিকট সুগম করিয়া দেওয়া হয়।

 বাঙালা-ভাষাশিক্ষাঅভাবে ছাত্রগণ যে বাংলা সমাজের জন্য সম্পূর্ণ রূপে প্রস্তুত হইতে পারিতেছে না কেবল তাহাই নহে, তাহাদের নূতন শিক্ষাও সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হইতেছে না। কখনো কখনো আমাদের ইংরাজ শিক্ষকগণ আক্ষেপ করিয়া থাকেন যে, আমাদের শিক্ষিত ব্যক্তিগণ ইংরাজি ও বাংলায় যেসকল প্রবন্ধ রচনা করেন অনেক সময় তাহাতে চিন্তা ও ভাবের অকিঞ্চিৎকরতা লক্ষিত হয়; স্পষ্টই বুঝা যায় আমাদের শিক্ষিত বিষ্ঠাকে আমরা নিজের মনের চিন্তায় পরিণত করিতে কোনো কালে। অভ্যাস করি নাই, সেগুলিকে বলপূর্বক অশ্রুসিক্ত চক্ষে সমগ্র গলাধঃকরণ। করিয়াছি। কিন্তু পরকীয় বিষ্ঠাকে স্বকীয় চিন্তায় পরিণত করিতে হইলে মাঝথানে স্বদেশীয় ভাষা আবশ্যক। বিশ্ববিষ্ঠ্যালয়ের পাকশালায় ছত্রিশ অধ্যাপকে মিলিয়া ছত্রিশ বিদ্যার ব্যঞ্জন রন্ধন করিতে পারেনকিন্তু নিজের হৃৎপিণ্ডের নিকটবর্তী অ্যাজমকালীন পাকযন্ত্রটির মধ্যে তাহাকে পুনঃ পাক করিয়া লইলে তবেই সে যথার্থ আপনার হয়। আমরা রসনায় ইংরাজি বিস্তার বিচিত্র আম্বাদ পাইতেছি সনেহ নাই, কিন্তু যতক্ষণে। তাহা বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের নাড়ীতে নাড়ীতে উত্তপ্ত রক্তরূপে প্রবাহিত না হয় ততক্ষণ সে বিষ্ঠা যে হজম হইয়াছে তাহার কোনে। প্রমাণ নাই।

—সাধনা। বৈশাখ ১৩০২

৯ বঙ্গদর্শনে মূজিত আছে, এই প্রবন্ধ ‘গত জ্যৈষ্ঠ মাসে মজুমদার লাইব্রেরীর অন্তর্গত আলোচনাসমিতির বিশেষ অধিবেশনে পঠিত’। গ্রন্থে বর্জিত শেষ অংশ সাময়িক হইতে সংকলিত হইল”―

 বর্তমান বঙ্গসাহিত্যও হঠাৎ একদিন অভাবনীয় উন্নতির উচ্চশিখরে উঠিবে, এরূপ আশা করি। কখন উঠিবে? যখন একমাত্র ভাব উচ্ছ্বসিত হইয়া তাহার প্লাবনের দ্বারা নানাকে এক করিয়া দিবে, সকলের হৃদয়কে সকলের সম্মুখে আনিয়া দিবে, কাহারও কাহাকেও বুঝিতে বিলম্ব হইবে। যখন বিভাগের মধ্যে এককে পাইব, বিচ্ছেদের মধ্যে মিলন পাইব। যখন অনুগ্রহের দ্বারা পীড়িত হইব না, যেখানে আমাদের গৌরব আছে সেই জায়গাটা সন্ধান করিয়া বাহির করিতে পারিব। যখন আমরা বর্তমানের বন্ধন ছেদন করিয়া তাহার বাহিরে একটা অনন্ত আশার ক্ষেত্র বিস্তৃত দেখিব। এখন ইংরাজের সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান রাষ্ট্রতন্ত্র আমাদিগকে চারি দিকে নীরভাবে বেষ্টন করিয়া আছে, আমরা তাহার বাহিরে কিছুই দেখিতে পাই না। পরের জিনিস আমাদিগকে একেবারে গ্রাস করিয়াছে। যখন কোনো প্রতিভাসম্পন্ন মনীষী আসিয়া এই বেষ্টনকে ভেদ করিয়া আমাদিগকে মুক্তি দিবেন, যখন হঠাৎ আমরা অনুভব করিব অনুকরণই আমাদের একমাত্র গৌরব নয়, আবিষ্কার করিব আমাদের নিজের মধ্যে এমন এক বিশেষ শক্তি আছে যাহা অন্য কোনো জাতির নাই, যখন চেতনা হইবে ইংরাজি গ্রন্থের অর্থপুস্তক না মুখস্থ করিয়াও আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হইতে পারে, যখন আমাদের নিজের গৌরবের আনন্দে আমাদিগকে এক করিয়া দিবে, পরস্পরের সহিত সম্বন্ধস্বীকারে আমাদের কোনো লজ্জা থাকিবে না, তখন সেই আনন্দের দিনে, আশার দিনে, গৌরবের দিনে, মিলনের দিনে, যে সৌভাগ্যবান কবি বাংলাদেশে গান ধরিবেন তাহার গান জগতের মধ্যে সার্থক হইবে। বঙ্গদেশ যখন নিজের অমরত্ব নিজের মধ্যে সুস্পষ্টরূপে উপলব্ধি করিবে, নিজের সম্বন্ধে যখন তাহার কোনো সংশয় কোনো সংকোচ থাকিবে না, তখন নির্ভীক বঙ্গসাহিত্য সমস্ত সমালোচকের সমস্ত বাঁধি বোল, সমস্ত ইস্কুলের সমস্ত মুখস্থ গৎ অবজ্ঞাভরে উপেক্ষা করিয়া নিজের অন্তরের মহান আদর্শ অবলম্বন করিয়া অপূর্ব কারুকৌশলে আপন নবীন দেবমন্দিরকে অভ্রভেদী করিয়া তুলিবে এবং মুহূর্তের মধ্যে তাহাকে প্রাচীনের চিরন্তন মহিমা সমর্পণ করিবে। আমরা নিজের অবস্থা-গণ্ডীর মধ্যে বদ্ধ হইয়া যাহা পারিয়াছি তাহাই করিয়াছি, যাহা শিখিয়াছি তাহাই বকিয়াছি, যাহা সম্মুখে পাইয়াছি তাহাই বিহিত নিয়মে সাজাইয়া গেছি। আমাদের রচনা বাংলার বর্তমান ভিত্তির মধ্যে এখনও কোনাে নূতন গবাক্ষ কাটিয়া কোনাে নূতন আলােক আনে নাই, কোনাে নূতন আশায় দেশকে প্লাবিত করে নাই, সাহিত্যকে এমন একটি প্রাণশক্তি দেয় নাই যে শক্তিবলে আমাদের সাহিত্য দেশের ও বিদেশের পক্ষে চিরকালের জন্য প্রাণের সৌন্দর্যের ও কল্যাণের অক্ষয় ভাণ্ডার হইয়া থাকে।

 কিন্তু অন্তরের মধ্যে অনুভব করিতেছি, সেদিন দূরে নাই। সমস্ত অনুকরণ অনুসরণকে তুচ্ছ করিয়া দিয়া নিজেকে নিজে লাভ করিবার জন্য আমাদের হৃদয়ের মধ্যে তীব্র বেদনা উপস্থিত হইয়াছে। মরুভূমির মধ্যে ক্ষুধাতুর তৃষার্তের স্কন্ধে টাকার থলি যেমন কেবল ভারমাত্র তেমনি বিদেশের যে-সমস্ত বহুমূল্য বােঝ আমরা মাথায় চাপাইয়াছি, বুঝিতে পারিতেছি, তাহার মূল্য যতই হােক, তাহা আমাদের বল অপহরণ করিতেছে; এখন মন কেবলই বলিতেছে: চাহি না, চাহি না, এ-সমস্ত কিছুই চাহি না। তবে কী চাই? হৃদয়ের মধ্য হইতে এই প্রার্থনা উর্ধস্বরে কঁদিয়া উঠিতেছে: আপনাকে চাই! চাই আপনার শক্তিকে প্রচুর হইলেও উপকরণমাত্রে কোনাে লাভ নাই, তাহা আবর্জনা। সভা সমিতি দরখাস্ত ও কগ্রেসে যে আমাদিগকে হীনতা হইতে মুক্তি দিতে পারে এ মােহ আমাদের মন হইতে চলিয়া যাইতেছে, গার্মেণ্ট অনুগ্রহপূর্বক উচ্চ আসনে চড়াইয়া আমাদিগকে বড়াে করিতে পারে এই মিথ্যা আশাও শিথিল হইয়া আসিয়াছে। এখনি যথার্থ সময়। এখনি মনে হইতেছে, কোনাে মহাপুরুষের আবির্ভাব আসন্ন হইয়াছে যিনি ভারতবর্ষের সম্মুখে ভারতবর্ষের পথ উদঘাটিত করিয়া দিবেন; যিনি আমাদের অন্তরের মধ্যে এই কথা ধ্বনিত করিয়া তুলিবেন যে, আমরা ভারতবাসী, আমরা ফিরিঙ্গি নই, আমরা বর্বর নই, আমাদের লজ্জার কোনো কারণ নাই; যিনি আমাদের মনকে, আমাদের হৃদয়কে, আমাদের কল্পনাকে স্বাধীন করিয়া দিবেন; যিনি আমাদের শিক্ষার বন্ধনমোচন করিবেন, আমাদের বিদেশী সংস্কারের সমস্ত কুহেলিকা অপসারিত করিয়া দিবেন। তখন আমাদের বর্তমান অবস্থা যেমনি থাক, আমাদের চিত্ত তাহার বহু উর্ধ্বে উঠিয়। সমস্ত বিশ্বজগৎকে প্রত্যক্ষ আপনার সম্মুখে প্রসারিত দেখিবে। এমন মুক্তি আছে যাহাকে রাজার শাসন, প্রবলের পীড়ন, অবস্থার পেষণ স্পর্শ করিতে পারে না। সেই মুক্তিই ভারতবর্ষের লক্ষ্যস্থল ছিল এবং সকল ক্ষুদ্রতা ও স্বার্থচেষ্টার আক্রমণ হইতে সেই রত্নকে রক্ষা করিবার ভার লইয়াই ব্রাহ্মণ ভারতবর্ষে গৌরব লাভ করিয়াছিলেন এবং সেই রত্ব হারাইয়াই ব্রাহ্মণ ও ভারতবর্ষ রসাতলে গেছে। সেই মুক্তির আশা ও আনন্দ যখন অরুণালোকের ন্যায় আমাদের মাতৃভূমির উদয়াচল স্পর্শ করিবে তখন যে অপরূপ সংগীত চতুদিক হইতে ধ্বনিত উদ্‌গীত হইয় উঠিবে তাহ আমার অস্তরে বাজিতেছে, কিন্তু তাহ প্রকাশ করিবার সাধ্য আমার নাই। সেইদিনকার বঙ্গসাহিত্যের জন্য আমরা অপেক্ষ করিয়া আছি, ততদিন যাহা করিতেছি তাহা ক্রীড়াচ্ছলে সময়যাপন মাত্র।

—বঙ্গদর্শন। শ্রাবণ ১৩০৯

১৬, ১৭, ১৮, ১৯ সাধনা পত্রে প্রকাশিত এই নিবন্ধমালা কবিবন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিতের সহিত কবির পত্রালাপচ্ছলে রচিত হইয়াছিল। কৌতুহলী পাঠক সাধনায় লোকেন্দ্রনাথের পত্রপ্রবন্ধগুলিও পাইবেন; ‘সাহিত্যের সত্য’, ‘সাহিত্যের উপাদান’ এবং ‘সাহিত্যের নিত্যলক্ষণ' শিরোনামে ১২৯৮ চৈত্র, ১২৯৯ জ্যৈষ্ঠ এবং ১২৯৯ শ্রাবণ সংখ্যায় মুদ্রিত হইয়াছিল।

২২ এই প্রবন্ধটির সহিত সাহিত্য মাসিক পত্রে প্রকাশিত চন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের কড়াক্রান্তি’ প্রবন্ধের সম্পর্ক রচনার ভিতরেই জানা যায়। শেষােক্ত প্রবন্ধের সামাজিক দিক হইতে যে সমালােচনা লিখিত হয় তাহা সাধনার পূর্ববর্তী পৌষ সংখ্যায় কড়ায়-কড়া কাহনে-কানা’ শিরােনামে প্রথম প্রকাশ পায়, পরে ‘আচারের অত্যাচার’ নামে ‘সমাজ’ গ্রন্থে সংকলিত হয়; রবীন্দ্র-রচনাবলীর দ্বাদশ খণ্ডে উক্ত রচনা ও তৎসম্পর্কে বহু তথ্য মুদ্রিত হইয়াছে।

২৪ বঙ্গদর্শন পত্রে (১৩১৩ ফাল্গুন) লেখা হয়, ভারতীয় শিল্পপ্রদর্শনীক্ষেত্রে গত সাহিত্যসম্মিলন উপলক্ষে পঠিত।

২৫ বঙ্গদর্শন পত্রে (১৩১৩ চৈত্র) প্রবন্ধশেষে পাদটীকায় জানা যায়, ‘এই প্রবন্ধ বহরমপুরের প্রস্তাবিত প্রাদেশিক সাহিত্যসম্মিলনের জন্য লিখিত হইয়াছিল। এই সাহিত্যসম্মিলনের প্রধান উদযােগী ও পৃষ্ঠপােষক ••• মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী বাহাদুরের জ্যেষ্ঠ পুত্রের শােচনীয় অকালমৃত্যুতে এই সম্মিলন স্থগিত করা হইয়াছে। এই প্রবন্ধ মুদ্রিত হইবার সময়ে আমরা এই নিদারুণ সংবাদ পাই, সেজন্য প্রবন্ধ যে ভাবে রচিত হইয়াছিল ঠিক সেই ভাবেই প্রকাশিত হইল।

 এ সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য রবীন্দ্র-রচনাবলীর অষ্টম খণ্ডে গ্রন্থপরিচয়ে পাওয়া যাইবে। •

 ‘বাংলা জাতীয় সাহিত্য (প্রবন্ধসংখ্যা ৮) বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদের সাংবৎসরিক সভায় পঠিত ইহা পূর্বেই উল্লেখ হইয়াছে। ১৩১৫ সালের ২১ অগ্রহায়ণ তারিখে সাহিত্যপরিষদের স্বগৃহ-প্রবেশ-উৎসবে রবীন্দ্রনাথ যে বক্তৃতা দেন তাহা নিম্নে সংকলিত হইল—

 কিছুকাল হইল শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্র মহাশয় তাহার কোনাে-একটি প্রবন্ধে পাণিনির ব্যাকরণ প্রভৃতি হইতে প্রমাণ করিয়াছেন, ভারতবর্ষে প্রাচীন কালে পুত্রশব্দের অর্থ ছিল, যে পূর্ণ করে সেই পুত্র। পুত্রামক কোনাে-একটি নরক হইতে ত্রাণ করে, এই ব্যাখ্যাটি পরবর্তী কালে আমাদের পুরাণে স্থান পাইয়াছে।

 পিতাকে সম্পূর্ণ করিয়া তুলে বলিয়াই পুত্রের গৌরব। পুত্র পিতার অকৃত কর্মগুলিকে সম্পন্ন করে, তাহার ভারকে বহন করে, তাহার ঋণকে পরিশােধ করিয়া দেয়। এই কারণেই, কেবলমাত্র স্নেহপ্রবৃত্তির চরিতার্থতার জন্য নহে, কল্যাণপ্রাপ্তির জন্য, অকৃতার্থতা ও অসমাপ্তি হইতে মুক্তিলাভের জন্যই, পুত্রকে আমাদের দেশে দেবতার বিশেষ প্রদলাভের মতােই গণ্য করিত।

 আমাদের দেশ বহুকাল হইতে পুত্রহীন হইয়া শােক করিতেছে। সে যাহা আরম্ভ করে তাহা কোনাে-একটি ব্যক্তিকেই আশ্রয় করিয়া দেখা দেয় এবং সেই একটি ব্যক্তির সঙ্গেই বিলীন হইয়া যায় তাহার সংকল্পকে বিচিত্র সার্থকতার পরম্পরার মধ্য দিয়া ভাবী পরিণামের দিকে বহন করিয়া লইয়া যাইবার কোন উপায় নাই। ক্ষুদ্রতা, বিচ্ছিন্নতা, অসমাপ্তি কেবলই দেশের ঋণের বােঝা বাড়াইয়াই চলিয়াছে; কোনােটাই পরিশােধ হইবার কোনাে সুলক্ষণ দেখা যাইতেছে না।

 এই সম্পূর্ণতাহীন খণ্ডতাশাপগ্রস্ত বন্ধ্যদশা ঘুচাইবার জন্য আমাদের অভাগা দেশ কামনা করিতেছিল। কারণ, বন্ধ্যত্বমাত্রই বন্ধন। যে ব্যক্তি নিজের ফল ফলাইতে পারিল না সে নিষ্কৃতি পাইল কৈ? আমাদের দেশের অভ্যন্তরে যে অভিপ্রায় রহিয়াছে সেই অভিপ্রায় যদি চারি দিকে সফলতার বিচিত্র রূপ ধারণ করিয়া উঠিতে না থাকে, যদি তাহা কেবল গুপ্তই থাকিয়া যায়, যদি তাহা অঙ্কুরিত হইয়াই শুকাইতে থাকে, তবে এমন কোনাে কৃত্রিম উপায় নাই যাহার সাহায্যে দেশ মুক্তিলাভ করিতে পারিবে। যাহারা নিরন্তর কালের মধ্য দিয়া অবিচ্ছিন্নভাবে দেশের সংকল্পকে সিদ্ধির পথে, মুক্তির পথে লইয়া যাইবে তাহারাই দেশের পুত্র।

দুঃখিনী বঙ্গভূমি সেই পুত্র কামনা করিতেছিল।

 আমাদের দেশমাতাকে বহুপুত্রবতী হইতে হইবে। এই পুত্রদের কেহ বা দেশের জ্ঞানকে, কেহ বা দেশের ভাবকে, কেহ বা দেশের কর্মকে অনুবৃত্তি দান করিয়া তাহাকে উত্তরােত্তর পরিপূর্ণ করিয়া তুলিবে। তাহারা নানা লােকের উদ্যমকে এক স্থানে আকর্ষণ করিয়া লইবে, তাহারা নানা কালের চেষ্টাকে একত্রে বাঁধিয়া চলিবে। তাহারা দেশের চিত্তকে নানা ব্যক্তির মধ্যে ব্যাপ্ত করিয়া দিবে এবং অনাগত কালের মধ্যে বহন করিয়া। চলিবে। এমনি করিয়াই দেশের বন্ধ্যা অবস্থার সংকীর্ণতা ঘুচিয়া যাইবে, সে জ্ঞানে প্রেমে কর্মে সকল দিকেই পরিপূর্ণ হইয়া উঠিবে।

 এইরূপ পুত্রের জন্য বঙ্গভূমির কামনা জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছে, পুত্রেষ্টিযজ্ঞ আরম্ভ হইয়াছে।

 বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎকে আমি দেশমাতার এইরূপ একটি পুত্র বলিয়া অনুভব করিয়া অনেক দিন হইতে আনন্দ পাইতেছি। ইহা একটি বিশেষ দিকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতা ঘুচাইয়া তাহাকে সম্পূর্ণতা দান করিবার জন্য অবতীর্ণ হইয়াছে। তাহা বাংলাদেশের আত্মপরিচয়চেষ্টাকে এক জেলা হইতে অন্য জেলায় ব্যাপ্ত করিয়া দিবে, এক কাল হইতে অন্য কালে বহন করিয়া চলিবে—তাহার এক নিত্যপ্রসারিত জিজ্ঞাসাসূত্রের দ্বারা অদ্যকার বাঙালির চিত্তের সহিত দূরকালের বাঙালিচিত্তকে মালায় গাঁথা চলিবে— দেশের সঙ্গে দেশের, কালের সঙ্গে কালের যােগসাধন করিয়া পরিপূর্ণতা বিস্তার করিতে থাকিবে। পুত্র পিতৃবংশকে, পিতৃকীর্তিকে, পিতৃসাধনাকে এইরূপে ভবিষ্যতের অভিমুখে অগ্রসর করিয়া দিয়া অতীতের সহিত অনাগতকে এক করিয়া মানুষকে কৃতার্থ করে; দেশপুত্রও দেশের চিত্তকে, দেশের চেষ্টাকে, বৃহৎ দেশে, বৃহৎ কালে ঐক্য দান করিয়া তাহাকে সত্য করে— তাহাকে চরিতার্থ করে। সাহিত্যপরিষৎও বাংলাদেশের চিত্তকে এইরূপ নিত্যতা দান করিয়া তাহাকে মহৎরূপে সত্য করিয়া তুলিবার আশা বহন করিয়া আনিয়াছে বলিয়াই আমরা তাহার অভ্যুদয়কে বাংলাদেশের পুণ্যফল বলিয়া গণনা করিতেছি।

 আমাদের এই সাহিত্যপরিষৎ এতদিন গর্ভবাসে ছিল। সে অল্পে অল্পে রসে রক্তে পরিপুষ্ট হইয়া উঠিতেছিল। তাহার সুহৃগণ তাহাকে নানা আঘাত-অপঘাত হইতে সযত্নে বাঁচাইয়া আসিয়াছেন। তাহার দশমাস কাটিয়া গিয়াছে, আজ সে ভূমিষ্ঠ হইয়াছে।

 কবি বলিয়াছেন: শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধন। ধর্মসাধনের গােড়াতেই শরীরের প্রয়ােজন হয়। সাহিত্যপরিষদের সেই আদ্য প্রয়ােজন আজ সম্পূর্ণ হইয়াছে; এখন হইতে তাহার ধর্মসাধনা সবলে সিদ্ধির পথে অগ্রসর হইবে এইরূপ আশা করা যাইতেছে।

 ইতর জন্তুর অপেক্ষা মানুষের গর্ভবাসকালও দীর্ঘ; তাহার শৈশবঅবস্থাও অচির নহে। শ্রেষ্ঠতালাভের মূল্যম্বরূপ মানুষকে এই বিলম্ব স্বীকার করিতে হয়।

 সাহিত্যপরিষৎকেও তাহার বাহশরীর পূর্ণ করিতে বিলম্ব সাধিত হইয়াছে। অনেক দিন ধরিয়া নিজের প্রাণশক্তির পরিচয় দিয়া দেশের লােকের শ্রদ্ধা ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে স্থানলাভ করিয়া তবে তাহার এই স্থূলদেহটি আজ প্রকাশ প্রাপ্ত হইয়াছে।

 এই স্বাভাবিক বিলম্বই আমাদের পক্ষে আশার কারণ। ইহা ভােজবাজির খেলার মতাে অকস্মাৎ কোনাে খামখেয়ালির শ্রদ্ধাহীন টাকার জোরে এক রাত্রে সৃষ্ট হয় নাই। অনেক দিন দেশের হৃৎসঞ্চারিত রক্তের দ্বারা পুষ্ট হইয়া, তাহার জীবন হইতে জীবনলাভ করিয়া, তবেই প্রাকৃতিক অভিব্যক্তির নিয়মে পরিষদের শারীরিক আবির্ভাব ঘটিয়াছে। কিন্তু এখনাে আমাদের সম্পূর্ণ নির্ভয় ও নিশ্চিন্ত হইবার সময় আসে নাই। এখনাে এ শিশু অনেক দিন জননীর সতর্ক স্নেহের অপেক্ষা রাখে। তাহার পরে বড় হইয়া বলিষ্ঠ হইয়া জননীকে নির্ভর দান করিবে।

 অদ্যকার উৎসবে এই নৰদেহপ্রাপ্ত সাহিত্যপরিষদের মুখ দেখিয়া সমস্ত দেশের হে ও আশীর্বাদ ইহার প্রতি আকৃষ্ট হইবে, এই আমরা আশা করিয়া আছি। ঘেপর্যন্ত ইহার শৈশবের দুর্বলতা কিছুমাত্র থাকিবে সেপর্য বাঙালি ইহাকে পােষণ করিবে, রক্ষা করিবে, ইহার অভাব দূর করিয়া নিজের অবমােচনের পন্থা করিবে, এই অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রত্যাশা লইয়া আজ আমরা আনন্দ করিতে আসিয়াছি।

 তবু মন হইতে ভয় দূর হয় না। কারণ, যাহারা দুর্ভাগা তাহারা স্বভাব হইতেই ভ্রষ্ট হয়। যে পুত্র পূর্ণতা দান করে সকলে তাহাকে স্বভাবতই পূর্ণ করিতে চায়; কেবল ভাগ্যে যাহার দুর্গতি আছে সে আপন ভাবী আম্পদকেও অন্নদান করিতে বিমুখ হয়।

 বাংলাদেশের ঘরেও মাঝে মাঝে দেবলােক হইতে মঙ্গল নানা আকার ধরিয়া অবতীর্ণ হইয়াছে। আমরা তাহার সকলটিকে পালন করি নাই। এমনি করিয়া অনেক নবীন আগন্তুককেই আমরা অনাদরে অভুক্ত রাখিয়া ফিরাইয়া দিয়াছি। সেই-সকল অপমানিত মঙ্গলের অভিসম্পাত অনেক জমা হইয়া উঠিয়াছে; তাহারাই আমাদের উন্নতিপথের এক-একটি বড় বড় বাধা রচনা করিয়া রহিয়াছে। বাংলাদেশের ক্রোড়ে আজ যে কল্যাণের কমনীয় শৈশব সাহিত্যপরিষৎরূপে আমাদের দর্শনগােচর হইল, ইহার প্রতি আমাদের চিত্ত প্রসন্ন হউক, আনন্দের আনুকূল্য প্রসারিত হউক বিধাতাপুরুষ এই সভাতলে উপস্থিত থাকিয়া তাহার অলক্ষ্য লেখনী দিয়া অদ্য এই শিশুর ললাটে যে অদৃশ্যলিপি লিখিতেছেন তাহাতে বাঙালির গৌরব, বাঙালির কীর্তি, বাঙালির চরিতার্থ কালে কালে সপ্রমাণ হইয়া উইক, অন্তরের এই কামনা প্রকাশ করিয়া আমি আসন গ্রহণ করিতেছি।

—পরিষৎপরিচয় (ফান ১৩৫৬)