সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/অর্থ-পিপাসা
নবম পরিচ্ছেদ।
অর্থ-পিপাসা।
ভারতবর্ষের তত্ত্ববিচাপরায়ণ দার্শনিক-কবি লিখিয়া গিয়াছেন:—
“অর্থমনর্থং ভাবয় নিত্যং
নাস্তি ততঃ সুখ-লেশঃ সত্যম্।”
তৈলাধার পাত্র, কি পাত্রাধার তৈল? তাহারই কুট সিদ্ধান্ত মীমাংসা করিবার জন্য প্রভাত হইতে সায়াহ্ন এবং সায়াহ্ন হইতে প্রভাত পর্যন্ত মস্তিষ্ক সঞ্চালন করিয়া যাঁহারা ন্যায়শাস্ত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম টাকা টিপ্পনী, লিখিয়া জীবনপাত করিয়াছেন, তাহাদের চক্ষে হয় ত অর্থই সকল অনর্থের মূল! “অসারে খলু সংসারে জন্মক্ষণ-পীড়িত নির্ধাজাগণ- জড়িত, দুঃখবিষাদ-তাড়িত মানবজীবনে বীতরাগ হইয়া যাহারা কুহেলিকা বেষ্টিত সূত্রভাষ্যের পদানুসরণ করিয়া লোকালয় অপেক্ষা বনচর সেবিত অরণ্য জীবনকেই শ্রেয়ঃকল্প বলিয়া প্রচার করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের চক্ষেও হয় ত অর্থই সকল অনর্থের মূল! কিন্তু মাটির দেহ লইয়া, মাটির পৃথিবীতে বাস করিয়া, জীবন-সংগ্রামের সহস্র সংঘর্ষে বায়ু-তাড়িত ধূলিপটলের ন্যায় দেশ হইতে দেশান্তরে ছুটিয়া, পুত্রকন্যার ক্ষুধার অন্নমুষ্টির জন্য যাহায় ললাটের মেদবিন্দু ক্ষরণ করিয়া, সংসার- সেবায় পলে পলে হৃদয়শোণিত ঢালিয়া দিতেছে, তাহারা, দার্শনিক- তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বুঝিতে পারে না; অর্থই তাহাদের পরম পরমার্থ। জীবনধারণের জন্য, প্রতিদিনের অভাব মোচনের জন্য, আত্মরক্ষার জন্য, আত্মাধিকারসংস্থাপন করিবার জন্য, এ সংসারে প্রতি পদে অর্থের সর্বদাই আবশ্যক। সেই জন্য সংসারের নরনারীর জীবন সমালোচনা করিতে হইলে, দার্শনিক ব্যাখ্যা দুরে রাখিয়া, সংসার- বিজ্ঞানের প্রতিদিবসের অভিজ্ঞতা লইয়াই তত্ববিচার করিতে হইবে।
মাটির পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া, ক্ষণভঙ্গুর মাটির সিংহাসনের জন্য সিরাজদ্দৌলা এত লালায়িত কেন? দুই দিন পরেই যে জল- বিম্ব গভীর অতলস্পর্শ জীবনসমুদ্রের অনন্ত জলরাশিতে মিশিয়া যাইবে। যে রাজ্য, যে রাজসিংহাসন, যে চতুরঙ্গসেনাসেবিত রণপতাকা দুই দিন পরেই পরের হাতের ক্রীড়াকন্দুকে পর্য্যবসিত হইবে, তাহার জন্য সিরাজদ্দৌলার এত মস্তিষ্ক-কণ্ডূয়ন কেন? যাঁহারা এরূপভাবে সিরাজদ্দৌলার জীবন-সমালোচনা করিবেন, তাহাদের হাতে সিরাজদ্দৌলার পরিত্রাণলাভের কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। কিন্তু যাঁহারা সংসার-তত্ত্ব বিচার করিয়া, পৃথিবীর অন্যান্য স্বাধীন ভূপতিদিগের কার্যাকার্যেয় তুলাদণ্ড লইয়া, সিরাজদ্দৌলার কৃতাপরাধের পরিমাপ করিতে অগ্রসর হইবেন, তাঁহারাই বলিবেন যে, সিরাজ যে কেবল অন্যায় কৌশলে পিঞ্জরাবব্ধ বনশাৰ্দলের ন্যায় নৃশংসভাবে নিহত হইয়াছেন, তাহাই নহে;—তাহার নাম, তাহার স্মৃতি, তাহার ইতিহাসও কত অন্যায় আক্রমণে চুর্ণবিচূর্ণ হইয়া গিয়াছে! বাঙ্গালী তাহার উপর যে জন্য হস্ত হইয়াছিলেন, তাহার একটির মূল ইন্দ্রিয়-বিকার, অপরটির মূল অর্থপিপাসা। প্রথমটির আলোচনা হইয়াছে; দ্বিতীয়টিরও আলোচনা করা আবশ্যক।
মুর্শিদাবাদের অনতিদূরেই মতিঝিল। মতিঝিলের পূর্ব্ব সৌভাগ্য এখন তিরোহিত হইয়া গিয়াছে। এখন মতিঝিল কেবল কণ্টক- বনে বেষ্টিত। কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস হইতে মতিঝিলের নাম বিলুপ্ত হইবার সম্ভাবনা নাই। ইংরাজ মহিলা বিবি কিণ্ডারলি, ১৭৬৬ খ্রষ্টাব্দে মতিঝিলের রমণীয় স্থান পরিদর্শন করিয়া, বিলাতে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, সে পত্রখানির কিয়দংশ এখন এ দেশেও প্রচারিত হইয়াছে। মূলপত্রখানি ইংলণ্ডের “বৃটিশ মিউজিয়মে সযত্নে রক্ষিত হইয়া আসিতেছে।[১] এই মতিঝিলের রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করিতে কত অর্থই না ব্যয়িত হইয়াছিল! চিরদিনের আনন্দকানন সাজাইবার জন্য কক্ষে কক্ষে কত বহুমুল্য বিলাসদ্রব্যই না পুঞ্জীকৃত হইয়াছিল। কিন্তু কেহ কি স্বপ্নেও জানিত যে, কালক্রমে তাহা ইংরাজের বাসভবনে পরিণত হইয়া অবশেষে জীর্ণস্তুপে রূপান্তরিত হইবে? এই প্রাসাদের কক্ষে কক্ষে ভ্রমণ করিবার সময়ে, ইংরাজ-মহিলা বিবি কিডারলির বিস্ময় বিস্ফারিত নয়নযুগলও পুরাতত্ত্ব স্মরণ করিয়া অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিয়াছিল![২]
মতিঝিলের সে নবাব-ভবন এখন ধূলিবিলুষ্ঠিত, তাহার কৃষ্ণমর্ম্মর- খচিত রচিত তোরণদ্বারের ভগ্নাবশেষত্র বর্তমান;—তাহাও লতা- গুল্মে ঢাকিয়া পড়িতেছে! ভাগীরথী আর তাহার পাদধৌত করিয়া প্রবাহিত হয় না! ঝিলের নীল সলিলে আর পদ্মকোরক তেমন শোভায় বিকশিত হয় না! চারিদিক হইতে কি যেন এক গভীর মর্ম্ম- বেদনার হাহাকার বহন করিয়া তীরতরুগুলি বায়ুভরে নিরন্তর শন্ শন করিতেছে! ঝিলের জল শৈবাল শালে কলঙ্কিত হইয়াছে! লতানিকুঞ্জ তৃণকণ্টকে পরিপূর্ণ হইয়াছে! বনজন্তুর নিভৃত নিকেতন বলিয়া জন- সমাগম রহিত হইয়া গিয়াছে! যে দিন লর্ড ক্লাইব “দেওয়ানী সনন্দ” ঘোষণা করিয়া মতিঝিলের প্রাসাদ-কক্ষে প্রথম পুণ্যাহের সুচনা করিয়া- ছিলেন, যে দিন মতিঝিলের শূন্যকক্ষে ওয়ারেন হেষ্টিংস, স্যর জন, সোর প্রভৃতি ইংরাজকর্মচারিগণ বাসভবন নির্দেশ করিয়াছিলেন, সে দিনও কেহ জানিত না যে, মতিঝিলের এরূপ শশাচনীয় পরিণাম হইবে। মুসলমান রাজ্য যেমন ইতিহাসগত, মতিঝিলের রাজপ্রাসাদও সেইরূপ ইতিহাসগত,—তাহাকে আর জীবন্তভাবে দেখিবার উপায় নাই।
নওয়াজেস মোহম্মদ এইখানে বিপুল অর্থ ব্যয় করিয়া বাসভবন নির্মাণ করিয়াছিলেন। নিজামতের পত্রসংগ্রহ পুস্তকে এখনও যে সকল আবেদনপত্র রক্ষিত হইয়া আসিয়াছে, তাহার মধ্যে একখানি পত্রে প্রকাশ আছে যে, নওয়াজেস মোহম্মদ এইখানে ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দের সম- কালে একটি মসজেদ, একটি মাদ্রাসা এবং একটি অতিথিশালা নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। সে মসজেদটি এখনও রক্ষিত হইয়া আসিতেছে। স্বর্গীয় হাঙ্গামা উপলক্ষে নওয়াজেস মোহম্মদ কখন গোদাগাড়িতে কখন বা মুর্শিদাবাদে অবস্থান করিতেন। তদুপলক্ষেই মতিঝিলে বাসভবন নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। যখন শুনিলেন যে, আলিবর্দ্দী উত্তর কালের জন্য সিরাজদ্দৌলাকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করিয়া- ছেন; তখন হইতে নওয়াজে সিরাজের সিংহাসনলাভে বাধা দিবার জন্য বদ্ধপরিকর হন, এবং সেই উদ্দেশ্যে মুর্শিদাবাদেই নিয়ত বাস করিতে আরম্ভ করেন।
এইরূপে মতিঝিলে নিয়ত বাস করিবার সময়ে, দীনদুঃখী অশ্রু মোচন করিয়া, ক্ষুধার্তের অন্নসংস্থান করিয়া, পীড়িতের ঔদানের ব্যবস্থা করিয়া, স্বভাবসুলভ সদয় ব্যবহারগুণে নওয়াজে অল্পদিনের মধ্যে কি হিন্দু কি মুসলমান সকলের নিকটেই সম্মানভাজন হইয়া উঠিয়াছিলেন।[৩] তাহার সুযোগ্য প্রতিনিধিভুভক্ত রাজবল্লভ ঢাকা হইতে যে রাজকর পাঠাইয়া দিতেন, নওয়াজেস তাহা লইয়া এইরূপে স্যয় করিতে আরম্ভ করার ললাকে তাঁহার গোলাম হইয়া উঠিতে লাগিল। আলিবর্দ্দীর জীবনকাল যতই শেষ হইয়া আসিতে লাগিল, নওয়াজেসের গুপ্তকল্পনা ততই ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। ক্রমে ক্রমে রাজবল্লভও কৃষ্ণবল্লভ নামক সুযোগ পুত্রের হস্তে ঢাকার রাজভাণ্ডার সমর্পণ করিয়া মুর্শিদাবাদে শুভাগমন করিলেন। সকলেই বুঝিল যে, আলিবর্দ্দীর মনোবাঞ্ছা যাহাই হউক না কেন, বুদ্ধ নবাবের শেষ নিশ্বাস পতিত হইতে না হইতেই, রাজবল্লভের সহায়তায়, অর্থবলে বলীয়ান নওয়াজে মোহম্মদই বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যার মসনদে আরোহণ করি- বেন। সিরাজের উজ্জ্বল ব্যবহারে যাহারা মর্মপীড়িত, নওয়াজেদের সদয় ব্যবহারে তাহারা পরম প্রীতিলাভ করিয়াছিলেন। সিরাজ বালক; নওয়াজে পরিণামদর্শী বয়োজ্যষ্ঠ। সিরাজদ্দৌলা একবার স্বাধীনভাবে রাজদণ্ড পরিচালনা করিবার অবসর পাইলেই ইচ্ছামত দুষ্টদমন করিবেন বলিয়া যাহাদের মনে মনে ভয় ছিল, তাঁহারা দেখিলেন যে, নওয়াজেসই মনের মত নবাব। কিছুই স্বচক্ষে দেখেন না, কিছুই স্বকর্ণে শুনেন “রাজকার্য লইয়া কোনরূপ গোযোগ করিবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই! সুতরাং স্বার্থলুব্ধ কর্মচারিদল সহজেই নওয়াজেসের পক্ষপাতী হইয়া উঠিতে লাগিলেন। নওয়াজেসও সময় বুঝিয়া মুক্তহস্তে অর্থব্যয় কারতে আরম্ভ করিলেন। জমীদারদল সময় বুঝিয়া নওয়াজেসের দর বারেই বিশেষরূপে গতায়াত করিতে আরম্ভ করিলেন। মাসিক বৃত্তির নির্দিষ্ট তঙ্কায় সিরাজদ্দৌলারই ভাল করিয়া আহার বিহার চলে না, লোকে আর কেমন করিয়া তাহার কাছে সাহায্য ভিক্ষা করিবে? আর ইচ্ছা থাকিলেই বা কে সাহসে বুক বাঁধিয়া সিংহবিবরতুল্য সিরাজদ্দৌলার বাসভবনের সম্মুখীন হইবে? মতিঝিলের অবারিত দ্বার অতিক্রম করিতে সেরূপ কোন ইতস্ততঃ ছিল না। সেখানে একবার পদার্পণ করিতে পারিলেই হইল। সেখানে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আদবকায়দার খুঁটি- নাটি নাই; গুরু লঘু বলিয়া আসন-পার্থক্য নাই; প্রভু-ভৃত্য বলিয়া ভিন্নভাব নাই; যেন আগন্তুক অতিথিগণই মতিঝিলের প্রভু, আর মতিঝিলের অধিপতি নওয়াজে মোহম্মদই তাহাদের পদানত ভৃত্য। সুতরাং লোকে দিন দিনই নওয়াজেসের পক্ষভুক্ত হইয়া উঠিতে লাগিল।[৪]
সিরাজদ্দৌলা এই সকল কারণে বড়ই উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। মহারাষ্ট্রীয়দিগের সঙ্গে সন্ধিসংস্থাপন করিয়া নিরুদ্বেগে রাজ্যভোগ করি- বার জন্য আলিবর্দী যখন রাজধানীতে প্রত্যাগমন করিলেন, তখনই বুঝিলেন যে অনাহারে, অনিদ্রায়, শত্রুসেনার পশ্চাতে পশ্চাতে ছুটিয়া তাহার বলিষ্ঠ বীরতনুও রোগ-জর্জ্জরিত হইয়া পড়িয়াছে। একে বৃদ্ধ দশা, তাহাতে খল ব্যাধি; আলিবর্দ্দী আর ভাল করিয়া রাজকার্য্যে মনোনিবেশ করিবার অবসর পাইলেন না। তাঁহার নিয়োগানুসারে সিরাজদ্দৌলাই সকল কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু রাজকার্য্যে হস্তক্ষেপ কটিতে না করিতেই সিরাজের মোহনিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল। সম্মুখে যে সিংহাসনে বলদর্পিত মাতামহ দৃঢ়পদে আসীন রহিয়াছেন, যে সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী বলিয়া ধাত্রীক্রোড় হইতে সিরাজদ্দৌলা পরম সমাদরে লালিত পালিত হইয়া আসিয়াছেন, সে সিংহাসনে যে একদিনের জন্য ও সিরাজদ্দৌলার পদস্পর্শ হইবে, তাহার নিশ্চয়তা কি? কর্ম্মচারিগণ স্বার্থসাধন করিবার প্রলোভনে নওয়াজেসের পক্ষভুক্ত হইয়াছেন, রাজবল্লভ বিপুল ধনভাণ্ডার লইয়া নওয়াজেসের হিতাকাঙ্ক্ষায় নিযুক্ত রহিয়াছেন, সিরাজের বিরুদ্ধে লোকচিত্ত বিদ্বেষ- বিষে পরিপূর্ণ করিবার কোন আয়োজনেরই ত্রুটি হইতেছে না। এদিকে সিরাজদ্দৌলার আশা ভরসার একমাত্র সহায় বৃদ্ধ নবাব অন্তিমশয্যায়, রাজকোষ অর্থশূন্য,—দেশ শক্রসঙ্কুল। এরূপ অবস্থায় বাহুবলে সিংহাসন রক্ষা করিবার জন্য, সিরাজদ্দৌলাও গোপনে গোপমে আয়োজন করিতে লাগিলেন। নওয়াজে ঢাকার নবাব, রাজবল্লভ নওয়াজেসের প্রতিনিধি;—উভয়েই বিপুল ধনসঞ্চয় করিয়াছেন, এবং উভয়েই সিরাজদ্দৌলার চক্ষে প্রধান শ্রেণীর রাজবিদ্রোহী। যদি সিরাজদ্দৌলা কোনরূপে একবার সিংহাসনে পদার্পণ করিবার অবসর পান, তবে যে তিনি নওয়াজে ও রাজবল্লভকেই সর্বাগ্রে শাসন করিবেন, সকলেরই তাহা দৃঢ়নিশ্চয় হইল। তখন আত্মরক্ষা ও স্বার্থসাধনের জন্য নওয়াজেদ এবং রাজবল্লভ প্রকাশ্যভাবে আত্মপক্ষ প্রবল করিতে আরম্ভ করিলেন
সিরাজদ্দৌলার ভবিষ্যৎ অদৃষ্টাকাশ ঘন-তমসাচ্ছন্ন হইয়া আসিতে লাগিল। তিনি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন যে, বাহুবল ভিন্ন সিংহাসন রক্ষার উপায়ান্তর নাই। কিন্তু বাহুবল শুধু শারীরিক বল নহে;—তাহার জন্য বিশ্বস্ত রণকুশল সেনানায়ক চাই, কলহ বিবাদে জয়লাভ করিতে পারে, এরূপ সাহসী সৈন্যদল চাই, এবং এই সকল সৈন্যদলকে অন্নবস্ত্র ও বেতন দিয়া প্রতিপালন করিতে পারেন, এরূপ অর্থবল চাই। সিরাজদ্দৌলার ইহার কোন সম্বলই নাই।
সেকালে রাজধানীতে যে সকল ধনশালী বণিক ও জমীদারদিগের বসতি ছিল, তাঁহারা জানিতেন যে, দেশে বিচার নাই, বাহুবল অথবা নবাবের ইচ্ছাই একমাত্র প্রবলশক্তি। সুতরাং তাঁহারা মুখে নবাবের অধীন বলিয়া পরিচয় দিলেও, কার্য্যতঃ বাহুবলে বাহুবল পরাস্ত করিবার জন্য, আবশ্যক মত সৈন্যদল পোষণ করিতেন; এবং সর্ব্বদা সতর্ক প্রহরীর মত আত্ম-পার্শ্ব রক্ষা করিতেন। সিংহাসন লইয়া নওয়াজেসের সঙ্গে কলহবিবাদ উপস্থিত হইলে, এই শ্রেণীর নাগরিকগণ যে ইঙ্গিতমাত্রে নওয়াজেসের পক্ষাবলম্বন করিবেন, তাহা বুঝিতে সিরাজদ্দৌলার বিলম্ব হইল না।
দৈশে যুদ্ধব্যবসায়ী লোকের অভাব ছিল না। আজ যে বাঙ্গালী রাজানুমতি না লইয়া একখানি জরাজীর্ণ পুরাতন তরবারিও ব্যবহার করিতে পারে না, আজ যে বাঙ্গালী মসীমলিনমূর্ত্তি হাব্সী অপেক্ষাও অস্ত্রব্যবহারের অযোগ্য বলিয়া রাজবিধির কঠিন নিগড়ে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে, সেই বাঙ্গালীও তখন অশ্বারোহী ও পদাতিক দলে প্রবেশ করিত, এবং প্রতিভা ও রণকৌশল থাকিলে সেনাপতি-পদেও অভিষিক্ত হইত। বাঙ্গালী হিন্দুস্থানী হিন্দু মুসলমান, এবং পর্ত্তূগিজ ফরাসী ওলন্দাজগণও সৈন্যদলে প্রবেশ করিবার প্রত্যাশায়, দলে দলে দেশে দেশে ঘুরিয়া, বেড়াইত। টাকা থাকিলে সপ্তাহের মধ্যে যে কেহ সহস্র সহস্র সেন সংগ্রহ করিতে সক্ষম হইত। ইহারা কোন নির্দ্দিষ্ট সেনানিবাসে বাস করিত না। আবশ্যক হইলে যে কেহ অর্থবিনিময়ে এই সকল শোণিতলোলুপ সৈনিকদলের সাহায্য ক্রয় করিতে সক্ষম হইত। নবাব বা বাদশাহদিগের জীবনকাল যতই শেষ হইয়া আসিত, এই শ্রেণীর লুণ্ঠনলোলুপ সৈনিকগণ ততই রাজধানীর আশে পাশে সমবেত হইতে আরম্ভ করিত। ইহাদের সাহায্যে, ভারতবর্ষের অনেক বাদসাহ, প্রকৃত উত্তরাধিকারীকে পথের ফকির করিয়া, বাহুবলে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। সিরাজদ্দৌলা তাহা জানিতেন, আর জানিতেন বলিয়াই আপন দৈন্যদশা এবং নওয়াজেসের অর্থবলের তুলনা করিয়া শিহরিয়া উঠিতেন। হাতে টাকা থাকিলে সৈন্যদল সংগ্রহ করা তাঁহার পক্ষেও সহজ কথা; কিন্তু টাকা কোথায়? সিরাজদ্দৌলা টাকা টাকা করিয়া ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন, ইহাই তাঁহার অর্থপিপাসার মূল।
সিরাজ অর্থপিপাসায় ব্যাকুল হইয়া চারিদিকে শ্যেনদৃষ্টিতে নয়নসঞ্চালন করিতেছেন,এমন সময়ে সহসা এক নূতন বিপদ উপস্থিত হইল। নওয়াজেসের হিতৈষীদিগের মধ্যে রাজবল্লভ এবং হোসেন কুলি খাঁর নাম বাঙ্গালার ইতিহাসে পরিচিত হইয়াছে; তাঁহারা উভয়েই বিদ্যাবুদ্ধি এবং কুটিল-নীতির জন্য সমধিক শক্তিশালী হইয়া উঠিয়াছিলেন। হোসেন কুলীর হস্তে নওয়াজেসের ধনভাণ্ডার ন্যস্ত ছিল। তদুপলক্ষে নওয়াজেসের সংসারে হোসেন কুলীর যথেষ্ট প্রভুত্ব ছিল। কিন্তু কর্ম্মদোষে হোসেন কুলীখাঁ সেই প্রভুত্বের সদ্ব্যবহার করিতে পারেন নাই। তাঁহার নামের সঙ্গে নওয়াজেসের বেগম ঘসেটির নাম সংযুক্ত করিয়া দাসদাসীগণ অনেক কথা কাণাকাণি করিত; সে কথা ক্রমেই পল্লবিত হইয়া উঠিতেছিল। সকলেই তাহা জানিত, কিন্তু উদ্ধতস্বভাব সিরাজদ্দৌলাকে কেহই সাহস করিয়া সে কথা বলিতে পারিত না। অবশেষে পারিবারিক কলঙ্ক যখন ক্রমেই বহুবিস্তৃত হইয়া পড়িল, তখন আলিবর্দ্দী-বেগম গোপনে কলঙ্কমোচন করিবার জন্য সে পাপকথা সিরাজের কর্ণগোচর করিলেন। সিরাজদ্দৌলা আর আত্ম- সন্মরণ করিতে পারিলেন না। মুর্শিদাবাদের রাজপথ হোসেন কুলীর হৃদয়-শোণিতে কলঙ্কিত হইল; তাহার দেহ খণ্ডবিখণ্ড করিয়া হন্তিপৃষ্ঠে তুলিয়া নগরের প্রকাশ্য পথে পথে রাজামুচরেরা বহন করিয়া চলিল! এ সংবাদে নওয়াজেস বা আলিবর্দী কোন কারোক্তি বা বিরক্তি প্রকাশ করিলেন না;[৫] কিন্তু ইহাতে উত্তরকালে রাজবল্লভের অন্তরাত্মা কাপিয়া উঠিয়াছিল! তাহার সম্বন্ধেও একজন সমসাময়িক ইংরাজ লেখক কলঙ্কটনা করিয়া গিয়াছেন।[৬]
রাজবল্লভ সিরাজদ্দৌলার নামে মিথ্যা কলঙ্ক রটনা করিবার জন্য, এবং তাঁহার বিরুদ্ধে গণ্যমান্য সামন্তবর্গকে উত্তেজিত করিবার জন্য, অনেক কথাই প্রচার করিতে লাগিলেন। সেই সকল কথা এখন ইতিহাসেও স্থানলাভ করিয়াছে; এবং তাহাকে মূলভিত্তি করিয়া, ইতিহাস-লেখকগণ এখনও বর্ণনালালিত্য বিস্তার করিবার জন্য সকলকে শুনাইয়া বলিতেছেন যে, “সিরাজদ্দৌলার নৃশংস স্বভাবের আর অধিক কি পরিচয় দিব? তাঁহার ভয়ে মুর্শিদাবাদের প্রকাশ্য রাজপথেও লোকে নিরাপদে চলাচল করিতে পারিত না, তিনি স্বহস্তে রাজপথে নিরপরাধ নাগরিকদিগকে খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া ফেলিতেন!”[৭]
হোসেন কুলীর হত্যাকাণ্ডের জনশ্রুতি মুখে মুখে বিস্তৃতিলাভ করিয়া এতই রূপান্তরিত হইয়া পড়িয়াছে যে, একজন সুলেখক তাহার উল্লেখ করিতে গিয়া একখানি মাসিক পত্রিকায় লিখিয়া গিয়াছেন যে,— “হোসেনকুলী সিরাজদ্দৌলার শিক্ষাগুরু ছিলেন, বাল্যকালে সিরাজকে বড়ই নিদারুণভাবে বেত্রাঘাত করিতেন; সিংহাসনে পদার্পণ করিয়া সিরাজদ্দৌলা তাহার প্রতিশোধ লইবার জন্য সর্বজনসমক্ষে হোসেন কুলীকে হত্যা করেন?[৮] বলা বাহুল্য যে, ইহা সর্ব্বৈব স্বকপোল কল্পিত!
লোকে যাহাই বলুক, পাপ চিরদিনই পাপ। হোসেন কুলীকে হত্যা করিয়া, সিরাজদ্দৌলা যে সেই পাপস্মৃতি আমরণ বহন করিয়া- ছিলেন, তাহার পরিচয় যথাস্থানে প্রকাশিত হইবে। যেরূপ ঘটনাচক্রে পতিত হইয়া সিরাজদ্দৌলা এই হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হইয়াছিলেন, সিরাজদ্দৌলা কেন,—নিতান্ত নিরীহভাব দরিদ্র গৃহস্থের পক্ষেও, সেরূপ ক্ষেত্রে আত্মসংবরণ করা সহজ হইত না।
ইংলণ্ডের ধর্মযাজক ও ধর্মানুপ্রাণিত নরনারী এক সময়ে স্বদেশের অনুদার রাজশাসনের তীব্র কশাঘাত সহ করিতে অক্ষম হইয়া, চিরজীবনের জন্য স্বদেশ প্রজাতির মায়ামমতা বিসর্জন দিয়া, জন্মভূমির পবিত্র সীমা উল্লঙ্ঘন করিয়া, দলে দলে গৃহতাড়িত শীর্ণ কুকুরের ন্যায় আমেরিকার নবাবিকৃত উর্বর ক্ষেত্রে ভয়ে ভয়ে পাদবিক্ষেপ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের সে দিনের দুঃখকাহিনী স্মরণ করিয়া আমেরিকার ইতিহাস-লেখক জীবন্ত ভাষায় ইতিহাস লিখিয়া গিয়াছেন।[৯] ইউরোপের সে অনুদায় শাসন চলিয়া গিয়াছে। একদিন স্বহারা গৃহষ্ঠাড়িত হইয়া শত ক্লেশে অসভ্য দেশে জীবনবিসর্জন করিয়াছিলেন, এখন ইউরোপে “আমেরিকার তীর্থযাত্রী” বলিয়া তাহাদের স্মৃতির কতই সমাদর! কিন্তু সেই সকল তীর্থযাত্রী ধর্মযাজকগণ এবং ধর্মানুপ্রাণিত প্রবীণ ইংরাজগণ একবার আমেরিকার সাগর-চুম্বিত শান্ত, শীতল, উদার রাজ্যে অতিথির বেশে আশ্রয়লাভ করিয়া, পরক্ষণেই সে দেশের আশ্রয়দাতা আদিম অধিবাসীদিগকে দিনে দিনে রহিয়া রহিয়া কিরূপভাবে ধনে বংশে বিনাশ করিয়াছিলেন,—কৈ, ইতিহাস তু তাহার জন্য একবারও শিহরিয়া উঠে নাই। তাহাদের তুলনায় অপরিণামদর্শী সিরাজদ্দৌলার এই হত্যাপরাধ কি বড়ই দুরপনেয়?
- ↑ Calcutta Review. No.-CXC.
- ↑ “We may easily suppose that the Nabab who expended such great sums of money to build, to plant, and to dig that immense lake, little foresaw that it should ever become a place of residence for an English Chief, to be embellished and altered according to his taste, to be defiled by christians, or contaminated by swine's flesh.
“Much less could he foresee that his successors on the Musnud should be obliged to court these chiefs, that they should hold the Subahship only as a gift from the English, and be by them main- tained in all the pagentry without any of the power of royalty.” - ↑ “He was much esteemed by the people for his clemency and charities to the friendless and poor.”—Stewarts History of Bengal.
- ↑ He used to spend Rupees 37000 a month in charities ....He was fond of living well, and of amusement and pleasures; could not bear to be upon bad terms with any one; and was not pleased when a disservice was rendered to another ..... He loved: to live with his servants, as their friend and companion; and with his acquaintances as their brother and equal. All his friends and acquaintances were admitted to the liberty of smoking their Hooquas in his presence, and to drink coffee whilst he was con- Versing familiarly with them."-Sair Mutakherin (Mustapha's translation.)
- ↑ হোসেনকুলীর সহিত নওয়াজেস পত্নী এবং সিরাজ জননী উভয়ের নামই সংযুক্ত হইয়াছিল। আলিবর্দ্দী ও নওয়াজেস মহম্মদ হোসেনকুলীর হত্যাকাণ্ডে সন্মতি দান করিয়াছিলেন। ইহার বিশেষ বিবরণ মুতক্ষয়ীণে বিবৃত রহিয়াছে।
- ↑ A Gentoo, named Rajah-bullub, had succeeded Hossein Cooley Khan in the post of Duan or prime minister to Nowagis; after whose death his influence continued with the widow, with whom he was supposed to be more intimate than became either her rank, or his religion.” 0rme, ii, 49. অনেকে বলেন, ইয়া রাজবল্লভের অলীক কলঙ্ক! কিন্তু তাঁহার চরিতাখ্যায়ক অর্ম্মি-লিখিত ইতিহাস পাঠ করিয়াও' এ বিষয়ে নীরব রহিয়াছেন কেন?
- ↑ হোসেন কুলীকেও সিরাজদ্দৌলা স্বহস্তে নিহত করেন নাই। মাতামহীর উত্তেজনায় মাতামহ ও নোয়াজেসের সম্মতিক্রমে সিরাজের উপর এই পারিবারিক কলঙ্ক মোচনের ভার পতিত হওয়ায় তাহার সম্মুখে ও তাহার আদেশে এই হত্যাকাণ্ড সাধিত হয়। সাময়িক উত্তেজনায় হোসেন কুলীর অন্ধ ভ্রাতাও নির্দয়রূপে নিহত হন।
- ↑ জন্মভূমি।
- ↑ Bancroft's History of the United States.