সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/ইংরাজের সর্ব্বনাশ
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ।
ইংরাজের সর্বনাশ।
ইংরাজবণিকের দর্প চূর্ণ করাই সিরাজদ্দৌলার একমাত্র অভিপ্রায়। সে অভিপ্রায় সিদ্ধ হইবামাত্র, তিনি আর অধিকদিন কলিকাতায় অবস্থান করিতে পারিলেন না। তিনি ২রা জুলাই সৈণ্যসামন্ত লইয়া রাজধানীর দিকে প্রত্যাবর্তন করিতে আরম্ভ করিলেন; -মহারাজ মাণিকঁচাদ তিন সহস্ত্র সিপাহী-সাহায্যে কলিকাতার শাসনভার পরিচালনা করিতে লাগিলেন। কলিকাতায় ইংরাজ রাজশক্তির চিহ্নমাত্র বর্ত্তমান রহিল না,,তাহার নাম পর্য্যন্তও পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল।[১]
পথশ্রম দুর করিবার জন্য হুগলীতে বিচিত্র পটমণ্ডপ সুবিস্তৃত হইয়াছিল। সেখানে আসিতে না আসিতে, অভ্যর্থনার সমারোহে জলস্থল টলমল করিয়া উঠিল। সেকালের বাদশাহ বা নবাবেরা যেখানে ছাউনী ফেলিতেন, সেই স্থান বহুজনাকীর্ণ রাজনগর হইয়া উঠিত। চারিদিকে যথাযোগ্য দূরস্থানে পাত্রমিত্র ও সামন্তবর্গের পট্টাবাস, তাহার বাহিরে চক্রাকারে সেনানিবাসের সহস্র সহস্র বস্ত্রগৃহ, তাহার পার্শ্বদেশে অগণিত বিপণিশ্রেণী;—কেন্দ্রস্থলে বিচিত্র কারুকার্য্যখচিত সুরচিত কনকপদ্মবিভূষিত নবাবের গর্ব্বোন্নত পটমণ্ডপ;—সেই হস্ত্যশ্বপদাতিসেনা, সেই প্রহরগণনানিপুণ প্রহরিদল, সেই সর্ব্বজনভৈরব মোগলবিভবের সমুজ্জ্বল চিত্রপট শ্মশানভূমিকেও নন্দনশোভায় উদ্ভাসিত করিয়া তুলিত, দ্বারে দ্বারে দৌবারিকদল করালকৃপাণস্কন্ধে নিঃশব্দে পদচালনা করিয়া বেড়াইত, প্রভাতে সায়াহ্নে রাজবৈতালিকগণের তানলয়সংযুক্ত সুমধুর যন্ত্রসঙ্গীত বায়ুভরে দূর দূরান্তরে ভাসিয়া চলিত, তিমিরাবগুণ্ঠিত নিশীথ-সময়েও প্রদীপ্ত প্রদীপালোকে চারিদিক ঝলমল করিত!
হুগলীর পটমণ্ডপে সিরাজদ্দৌলার দরবার বসিল। সে দরবারে ওলন্দাজ ও ফরাসিবণিকগণ গললগ্নীকৃতবাসে আনুগত্য স্বীকার করিবার জন্য সসম্ভ্রমে উপঢৌকনহস্তে উপনীত হইলেন। ওলন্দাজেরা ৪॥ লক্ষ এবং ফরাসিরা ৩॥ লক্ষ টাকা ‘নজর’ প্রদান করিলেন। অতঃপর ইংরাজদিগের কথা উত্থাপিত হইল। তাঁহাদিগকে একেবারে দেশ বহিষ্কৃত করা যে সিরাজদ্দৌলার অভিপ্রায় নহে, সে কথা বুঝাইয়া দিয়া তিনি ওয়াটস্ এবং কলেট সাহবকে মুক্তিদান করিলেন, এবং হলওয়েলের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। সেনাপতি মীরমদন ইতিপুর্ব্বেই নবাবের অজ্ঞাতসারে হলওয়েল এবং তাঁহার তিনজন সঙ্গীকে বন্দীবেশে মুর্শিদাবাদে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন; সুতরাং আপাততঃ তাঁহাদের সম্বন্ধে কোনরূপ রাজাজ্ঞা প্রচারিত হইতে পারিল না।[২] যাঁহারা ফল্তায় পলায়ন করিবার অবসর না পাইয়া ইতস্ততঃ লুকাইয়া রহিয়াছেন, সেই সকল ইংরাজ সওদাগরের যদি কেবলমাত্র সওদাগরি করিবার জন্য কলিকাতায় বাস করিতে ইচ্ছা করেন, তবে তাঁহারা অনায়াসে নগরপ্রবেশ করিতে পারিবেন;—এইরূপ সাধারণ রাজাজ্ঞা প্রচার করিয়া সিরাজদ্দৌলা হুগলী হইতে ছাউনী উঠাইয়া পুনরায় রাজধানীর দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।[৩] পলায়নপরায়ণ ইংরাজগণ কলিকাতায় প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া ইংরাজবন্ধু উমাচরণের বদান্যতাগুণে প্রয়োজনানুরূপ অন্নজল প্রাপ্ত হইলেন।
সিরাজদ্দৌলা সমুচিত সমারোহে ১১ই জুলাই রাজধানীতে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। বিজয়োৎসবের আনন্দকোলাহলে নাগরিকদিগের উচ্ছৃঙ্খল নৃত্যগীতে, মঙ্গলবাদ্যের মধুর নিক্কণে, ঘন ঘন কামানগর্জ্জনের গুরুগম্ভীর রবে এবং নবাব-সেনার সগৰ্ব আস্ফালনভরে মুর্শিদাবাদ প্রকম্পিত হইয়া উঠিল! সেই আনকোলাহলের মধ্যে রত্নচতুর্দোলা বোহণে পাত্রমিত্র সমভিব্যাহারে বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যার অদ্বিতীয় অধীশ্বর নবাব সিরাজদ্দৌলা যখন নগরপ্রদক্ষিণ করিয়া মতিঝিলে গমন করিতেছিলেন, সেই সময়ে হলওয়েলের কারাকক্ষ তাহার নয়নগোচর হইল। সহসা বাদ্যোদ্যম নীরব হইয়া গেল, দোলারোহণ পরিত্যাগ করিয়া সিরাজদ্দৌলা স্বয়ং পদব্রজে কারাগারদ্বারে দণ্ডায়মান হইলেন, পার্শ্বস্থ চোপদারকে দিয়া তৎক্ষণাৎ হলওয়েল ও তাহার সঙ্গীদিগের শৃঙ্খলমোচন করাইয়া, তাহাদিগকে যথেচ্ছদেশে গমন করিবার অনুমতি প্রচার করিয়া, পুনরায় দোলানোহণ করিলেন।[৪]
ইংরাজদিগের পক্ষে কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিবার আর কোন রূপ প্রতিবন্ধক রহিল না। পূর্ব্ব্বকাহিনী বিস্মৃত হইয়া অনেকেই ধীরে ধীরে কলিকাতায় শুভাগমন করিতে লাগিলেন, কিন্তু স্বভাবদোষে অতি অল্পদিনের মধ্যেই “জন বুলের” সর্ব্ব্বনাশ উপস্থিত হইল! একজন মদিরা সক্ত সার্জন সাহেব একদিন একজন নিরপরাধ মুসলমানকে হত্যা • করিয়া বসিলেন। সেকালের মুসলমান রাজদরবারে ইহাতে হুলস্থূল উপস্থিত হইল। রাজা মাণিকচাদের আদেশে একের অপরাধে ইংরাজ মাত্রেই কলিকাতা হইতে তাড়িত হইলেন।[৫] ইংরাজের কপাল ভাঙ্গিল; তাহাদের জন্য আর কলিকাতায় স্থান হইল না। কেবল হেষ্টিংস প্রভৃতি কয়েকজন কুঠিয়াল কাশিমবাজারে বসিয়া রহিলেন, তদ্ভিন্ন আর আর ইংরাজেরা-যিনি যেখানে ছিলেন,—সকলেই আসিয়া লতার বন্দরে সমবেত হইতে লাগিলেন।
এত দিনের পর ইংরাজের প্রবল প্রতাপ একেবারে চূর্ণ হইয়া গেল; কাশিমবাজার গেল; কলিকাতা গেল; কলিকাতার ইংরাজদুর্গের উপর রাজা মাণিকৰ্চাদের বিজয়পতাকা সগৌরবে আকাশে অঙ্গবিস্তার করিল। ইংরাজেরা অনন্যোপায় হইয়া গড্ডলিকা-প্রবাহের স্থায় ছুটিয়া আসিয়া ফতার পলায়িত জাহাজে সম্মিলিত হইতে লাগিল।
সকলই ফুরাইল! তথাপি এ সকল শশাচনীয় কাহিনী সহসা মাদ্রাজের ইংরাজ-দরবারের কর্ণগোচর হইতে পারিল না! তাঁহারা সুদূর সমুদ্রকুলে বসিয়া ১৫ই জুলাই তারিখে কাশিমবাজার অবরোধের প্রথম সংবাদ প্রাপ্ত হন। তাহাতে তেমন বিচলিত হইবার কারণ ছিল না; বাঙ্গালাদেশ হইতে প্রায় মধ্যে মধ্যেই সেরূপ সংবাদ আসিত; আবার হয়ত সঙ্গে সঙ্গেই শুনা যাইত যে, “গোযোগ মিটমাট হইয়া গিয়াছে; সময়োচিত উপঢৌকন দিয়া সকলকেই শান্ত করিয়াছি; বাণিজ্য-ব্যবসায় একরূপ ভালই চলিতেছে!”[৬] সুতরাং কাশিমবাজারের সংবাদ পাইয়াও, মাদ্রাজের ইংরাজ-দরবার কেবল কলিকাতায় সেনাবল বৃদ্ধি করিবার জন্য মেজর কিলপ্যাট্রিকের সঙ্গে ২৪০ জনমাত্র গোরা পল্টন পাঠাইয়া দিয়া, দ্বিতীয় সংবাদের অপেক্ষায় কথঞ্চিৎ নিশ্চিন্তমনেই কালযাপন করিতে লাগিলেন।
৫ই আগষ্ট তারিখে রণপলায়িত ম্যানিংহাম সাহেব মাদ্রাজের বন্দরে উপনীত হইলেন। তাঁহার মুখে মাদ্রাজের ইংরাজ দরবার কলিকাতার কথা, সিরাজদ্দৌলার কথা ইংরাজের সর্বনাশের কথা,—এক সঙ্গে সকল কথাই শুনিতে পাইলেন! সে সংবাদে মাথায় বজ্রাঘাত পড়িল। সকলে একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন। সকলেই একবাক্যে বলিতে লাগিলেন;—“হায়! হায়! কি হইল? এতদিনের এত আশা, সকল আশাই এক ফুৎকারে নির্মূল হইয়া গেল!”[৭]
শোকের প্রথম উচ্ছাস চলিয়া গেল। তখন তোক ডাকাইয়া, সভা বসাইয়া, যিনি যেখানে ছিলেন, সকলে মিলিয়া মন্ত্রণা আরম্ভ করিলেন। কেহ কেহ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ন্যায় প্রবল বিক্রমে গর্জন করিয়া উঠিলেন; কেহ কেহ প্রতিহিংসাসাধনের জন্য বীরপ্রতিজ্ঞা অবলম্বন করিবার উত্তেজনা করিতে লাগিলেন;কিন্তু তখন ইংরাজেরা যেরূপ ক্ষীণবল, ফরাসি-সমর-শঙ্কায় নিরন্তর চিন্তাক্লিষ্ট, তাহাতে সহসা কিংকর্তব্য স্থির হইয়া উঠিল না।
এদিকে মেজর সাহেব ভাগীরথী-মুখে প্রবেশ করিয়াই ফলতার বন্দরে আসিয়া পলায়িত ইংরাজ-জাহাজের সন্ধান পাইলেন। তিনি আর ২৪০ জন গোরা লইয়া একাকী কি করিবেন? সকলকে যথাশক্তি আশা ভরসায় উৎসাহিত করিয়া, আত্মরক্ষার জন্য ফলতার বন্দরেই জাহাজ নোঙ্গর করিয়া ফেলিলেন। পলায়িত ইংরাজগণ তথন পর্যন্তও জীবিত, কিন্তু সকলেই জীবন্মত! অনেকে চিররুগ্ন হইয়া পড়িয়াছেন, যাঁহারা সুস্থ সবল, তাঁহারাও ভগ্নহৃদয়ে মলিনমুখে সতৃষ্ণনয়নে অকুল সমুদ্রের উত্তালতরঙ্গের দিকে চাহিয়া চাহিয়া, কতদিনে মাদ্রাজ হইতে সেনাদল আসিবে—কেবল সেই চিন্তায় শীর্ণ হইয়া উঠিয়াছেন।
দুর্দশার দিনে দুর্ম্মতি আসিয়া ইংরাজদিগের দুংখলৈ দ্বিগুণ করিয়া তুলিল! কেন তাহাদের এরূপ শোচনীয় দুর্গতি উপস্থিত হইল,সেই কথা লইয়া তুমুল গৃহকলহ উপস্থিত হইল। নব্যতন্ত্রের ইংরাজযুবকেরা ইংরাজদরবারের উপরেই সকল অপরাধ আরোপ করিতে লাগিলেন। যাঁহারা দরবারের সদস্য, তাঁহারাও পরস্পর পরস্পকে অপরাধী করিবার জন্য আয়োজনের ত্রুটি করিলেন না! এই সূত্রে ইংরাজদিগের মধ্যে নানা বাগ্বিতণ্ডা চলিতে লাগিল। কথায় কথায় বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটিতে লাগিল; সর্বপ্রকার সমবেদনা দূরীভূত হইয়া গেল। অবশেষে অনেকেই বলিতে লাগিলেন যে—“যাঁহারা উৎকোচ লোভে কৃষ্ণবল্পভকে কলিকতায় আশ্রয় দিয়াছিলেন, এবং যাহাকে তাহাকে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করিবার জন্য কোম্পানীর নামাঙ্কিত পয়োনা বিক্রয় করিয়া অর্থোপাৰ্জন করিতেছিলেন, তাঁহারাই সকল অনর্থের মূল।[৮] পরবর্তী ইতিহাস-লেখকগণ অনেক যুক্তি তর্ক উপস্থিত করিয়া লিথিয়া গিয়াছেন যে, এ সকল কথা নিতান্তই অমূলক! এতকালের পর সে সকল অভি যোগের সত্য মিথ্যা নির্ণয় করা সহজ নহে। যাঁহারা এ বিষয়ে সাক্ষ্যদান করিতে পারিতেন, তাঁহারা বলিয়া গিয়াছেন যে, ইংরাজদরবারের সদস্যদিগের ব্যবহার গুণেই নবাব সিরাজদ্দৌলা এতদূর উত্যক্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। তাঁহাদের সাক্ষ্যই সত্য বলিয়া স্বীকার করিব,—না, পরবর্ত্তী ইতিহাস-লেখকদিগের কথাই অভ্রান্ত বলিয়া মানিয়া লইব? ইতিহাস-লেখক অর্ম্মি বলেন,—“যুবকদলের অভিযোগে কর্ণপাত করা নিষ্প্রয়োজন। বৃদ্ধদিগকে পাকেচক্রে পদচ্যুত করিবার জন্যই যুবকদল এই সকল অমূলক অভিযোগের সৃষ্টি করিয়া থাকিবেন!”[৯]
ফলতায় পলায়ন করিয়া কোনরূপে প্রাণরক্ষা হইল;—কিন্তু ইংরাজদিগের দুর্দ্দশার আর অবধি রহিল না! একে নিদারুণ গ্রীষ্মকাল, তাহাতে একেবারে নিরাশ্রয়;—একে রোগক্লিষ্ট, তাহাতে আবার নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর স্থান;—একে সকলেই মর্ম্মপীড়িত, তাহাতে আবার প্রতিদিনই খাদ্যাভাব! জাহাজের ভাণ্ডার শূন্য; তহবিলে তঙ্কার অনাটন; নিকটে হাট বাজারের অসদ্ভাব;—ইচ্ছা থাকিলেও মাণিকচাঁদের ভয়ে দোকানী পশারী জাহাজের কাছে অগ্রসর হইতে সাহস পাইতেছে না! আর কিছুদিন এরূপ দুর্দ্দশার প্রতিকার না হইলে, সকলকেই একে একে ভাগীরথী-গর্ভে জীর্ণ-কঙ্কাল বিসর্জ্জন করিতে হইত। মাণিকচাঁদের ভয়ে সকলেই জড়সড়;—কেবল ফরাসী, আর ওলন্দাজ, আর ইংরাজের বিপদের বন্ধু কৃষ্ণকায় ‘নেটিভ’ (বাঙ্গালী) বণিকেরা গোপনে গোপনে যাহা কিছু অন্নজল পাঠাইতে লাগিলেন, তাহাতেই কোনরূপে কায়ক্লেশে ইংরাজের দিনপাত হইতে লাগিল।[১০]
চতুর লোকে একবার একটু দাঁড়াইবার স্থান পাইলেই যথেষ্ট হয়। তাহার পর সে আপন কৌশলে সহজেই বসিবার স্থান করিয়া লইতে পারে। ইংরাজদিগেরও তাহাই হইল। যদি সিরাজদ্দৌলা ফলতা পর্য্যন্ত সসৈন্যে শুভাগমন করিতেন, তবে হয়ত সকলেই চোরের মত পলায়ন করিবার পথ পাইতেন না। কিন্তু সিরাজদ্দৌলা ইংরাজ তাড়াইবার জন্য কোনরূপ উদ্যোগ না করিয়া, কেবলমাত্র উদ্ধত-ব্যবহারের শাস্তি দিয়াই নিরস্ত হইলেন। ইহাতেই ইংরাজেরা ফলতায় পলায়ন করিয়া হাঁপ ছাড়িবার অবসর পাইয়াছিলেন। ইংরাজেরা কিন্তু সে কথা স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহেন। তাঁহারা বলিতে চাহেন যে, ইংরাজদিগকে নির্ব্বাসিত করাই সিরাজদ্দৌলার অভিপ্রায় ছিল;— কেবল দুর্ব্বলচিত্ত বলিয়াই তিনি ইংরাজদিগের পশ্চাদ্ধাবন করিতে পারেন নাই।[১১] এ কথা একেবারে মিথ্যা কথা। সিরাজদ্দৌলার মনে সেরূপ কল্পনা উদিত হইলে ইংরাজ তাড়াইতে মুহূর্ত্তমাত্রও বিলম্ব ঘটিত না, এবং হেষ্টিংস ও ডাক্তার ফোর্থ প্রভৃতি ইংরাজ কুঠিয়ালগণ স্বচ্ছন্দচিত্তে অক্ষতশরীরে কাশিমবাজারে অবস্থান করিবার অবসর পাইতেন না!
ইংরাজেরা শতবর্ষ বাণিজ্য করিয়া আসিতেছেন; ইংরাজেরা জঙ্গল কাটিয়া কলিকাতায় বিচিত্র ইন্দ্রপুরী রচনা করিয়াছেন; ইংরাজেরা মহারাষ্ট্রখাত খনন করাইয়া কত লোকের ধনপ্রাণ নিরাপদ করিয়া দিয়াছেন;—সুতরাং আত্মীয়তাসূত্রেই হউক, আর চিরকৃতজ্ঞ বাঙ্গালীজাতীর স্বভাবসুলভ পরোপকার প্রবৃত্তির জন্যই হউক, এদেশে অনেক গণ্যমান্য লোকে ইংরাজের দুঃখ-দুর্দ্দশা মোচন করিবার জন্য অগ্রসর হইয়াছিলেন।[১২] অন্যের কথা দূরে থাকুক, যে উমিচাঁদ ইংরাজবন্ধুর অকৃত্রিম সৌহার্দ্দগুণে সর্ব্বস্বান্ত, মর্ম্মপীড়িত, শোকগ্রস্ত পথের ফকির সাজিয়াছিলেন, তিনিও দুর্দ্দশার দিনে সাশ্রুনয়নে নবাবদরবারে ইংরাজের হইয়া কত কাকুতি মিনতি জানাইতে লাগিলেন! হেষ্টিংস এবং ডাক্তার ফোর্থ সাহেব কাশিমবাজারে বসিয়া গোপনে গোপনে মন্ত্রীদলের সঙ্গে আত্মীয়তা সংস্থাপন করিতে লাগিলেন; যে সকল আরমানী বণিক বাণিজ্যোপলক্ষে সমুদ্রপথে গতিবিধি করিতেন, তাঁহারাও ইংরাজদিগকে রাজধানীর গুপ্তসংবাদ প্রদান করিতে সম্মত হইলেন। এই সকল চেষ্টায় কালক্রমে ইংরাজের দুঃখ দুর্দ্দশার অবসান হইবার সদুপায় হইতে লাগিল।[১৩] দেশের লোকে বুঝিতে পারিল যে, আজি হউক, কালি হউক, আর দশ দিন পরেই হউক, ইংরাজেরা আবার এ দেশে বাণিজ্য করিবার জন্য নবাবের সনন্দলাভ করিবেন, সুতরাং দেশের লোকের আনুগত্য দিন দিন ঘনীভূত হইতে লাগিল।
মেজর সাহেব ফল্তায় আসিয়া এই সকল শুভলক্ষণ পর্য্যবেক্ষণ করিলেন। আশা হইল, সাহস হইল,—সময় পাইয়া মাণিকচাঁদকে হস্তগত করিবার আয়োজন হইল; এবং নবাবের শুভদৃষ্টি আকর্ষণ করিবার জন্য বিনীতভাবে আবেদনপত্র লিখিত হইতে লাগিল! রাজা মাণিকচাঁদ ইতিহাসে চতুর-চূড়ামণি বলিয়া সুপরিচিত। নবাব-দরবারের স্রোত কখন্ কোন্ দিকে প্রবাহিত হয়, সে দিকে সর্ব্বদাই তাঁহার তীক্ষ্ণদৃষ্টি দেখিতে পাওয়া যাইত। তিনি যখন বুঝিতে পারিলেন যে, সে স্রোত আবার ধীরে ধীরে ইংরাজদিগের অনুকূল হইয়া প্রবাহিত হইতেছে, তখন তিনিও ইংরাজের সঙ্গে আত্মীয়তা সংস্থাপনের জন্য অসম্মত হইলেন না। ইংরাজেরা নবাবের নিকট আবেদনপত্র পাঠাইবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। এই পত্রে অন্ধকূপ হত্যার জন্য কোন প্রকার আর্ত্তনাদ করা হইল না; আবার যাহাতে বাণিজ্যাধিকার প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহার কথাই বিবিধবিধানে বিবৃত হইল। যতদিন সনন্দ না আসিতেছে, ততদিন অন্ততঃ অন্নাভাবে বিড়ম্বনা ভোগ করিতে না হয়, তজ্জন্য বিশেষ ভাবে প্রার্থনা করা হইল। ওলন্দাজদিগের গভর্ণর বিস্ডম্ সাহেবের যোগে এই আবেদনপত্র নবাবদরবারে প্রেরণ করিবার আয়োজন হইতে লাগিল।
ভরসা পাইয়া ইংরাজ কুঠিয়ালগণ জাহাজের উপরেই মন্ত্রীসভার বৈঠক বসাইতে আরম্ভ করিলেন। সে বৈঠকে ‘অনরেবল শ্রীল শ্রীযুক্ত রোজার ড্রেক' সাহেব বাহাদুর সভাপতি, এবং ওয়াট্স, হলওয়েল ও মেজর কিলপ্যাট্রিক সদস্যের আসন গ্রহণ করিলেন।[১৪]
২২শে আগষ্টের বৈঠকে সভাপতি মহাশয় সকলকে এই বলিয়া আশ্বাস দিলেন যে,—আর ভয় নাই; মাদ্রাজ হইতে শীঘ্রই গোরাপল্টন আসিতেছে। কিন্তু সেই দিনই সংবাদ আসিল যে, ওলন্দাজেরা ইংরাজদিগের আবেদনপত্রখানি নবাবদরবারে পাঠাইয়া দিতে ইতস্ততঃ করিতেছেন। তখন পত্রখানি কিরূপে নবাবের নিকট প্রেরিত হইতে পারে, তাহার জন্য পরামর্শ চলিতে লাগিল। ঘটনাক্রমে সেইদিন কলিকাতা অঞ্চল হইতে খোজা পিদ্রু এবং এব্রাহিম জেকবস্ নামক দুইজন আরমানী বণিক ফলতায় আসিয়া উপনীত হইয়াছিলেন। তাঁহারা ইংরাজ হিতৈষী উমিচাঁদের নিকট হইতে একখানি গুপ্তলিপি আনিয়াছিলেন। সর্ব্বসমক্ষে সেই পত্র পঠিত হইল। হায়! উমিচাঁদ; —সেই পত্রে তিনি লিখিয়াছিলেন যে,“চিরদিনও যেমন, এখনও সেইরূপ ভাবে তিনি ইংরাজের কল্যাণকামনায় নিযুক্ত রহিয়াছেন। আর ইংরাজেরা যদি রাজা রাজবল্লভ, রাজা মাণিকচাঁদ, জগৎশেঠ, খোজা বাজিদ প্রভৃতি পাত্রমিত্রের সঙ্গে গোপনে গোপনে চিঠিপত্র চালাইতে চান, তিনি তাহাও যথাস্থানে পৌঁছাইয়া দিয়া সদুত্তর আনাইয়া দিবেন।”[১৫] ইতিহাস লিখিতে বসিয়া যে ইংরাজেরা এবং যে হলওয়েল সাহেব উমিচাঁদকে নিতান্ত কুটিলহৃদয় পরমপাষণ্ড অর্থগৃধ্নু নরপিশাচ বলিয়া পৃথিবীর নিকট পরিচিত করিবার জন্য কত আগ্রহ প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন, তাঁহারা কেহই বিপদের দিনে তাঁহাকে ততদূর অবিশ্বাস করেন নাই! ইতিহাসে এ সকল কথার যথাযোগ্য সমালোচনা হয় নাই বলিয়া, বাঙ্গালী কবি লিখিয়া রাখিয়াছেনঃ—
“—যেন ভীষণ তক্ষক
আছে পাপী উমিচাঁদ ফণা আস্ফালিয়া।”[১৬]
উমিচাঁদ সহায়তাগুণে রাজা মাণিকচাঁদ সহজেই বশীভূত হইলেন। একদিন যে মাণিকচাঁদ, ইংরাজ-দলনে অপরিসীম উৎসাহ প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাহা মন্ত্রৌষধিগুণে সহসা শিথিল হইয়া পড়িল। এই সেপ্টেম্বরের বৈঠকে স্বয়ং মাণিকচাঁদের পত্র ইংরাজ দরবারে সর্ব্বসমক্ষে উদ্ঘাটিত হইল। সে পত্রে ইংরাজ আবার সাহস পাইলেন। রাজা মাণিকচাঁদ যে যথাশক্তি ইংরাজের সহায়তা করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছেন, তাহার নিদর্শন পাইতে বিলম্ব হইল না;—ফলতায় বাজার বসিল, ইংরাজের অন্নকষ্ট দূর হইয়া গেল।[১৭]
রাজা মাণিকচাঁদ এত সহজে ইংরাজের বশীভূত হইলেন কেন, ইতিহাসে সে রহস্য মীমাংসিত হয় নাই। মাণিকচাঁদ যেরূপ চরিত্রের লোক, বাতাস বুঝিয়া পাল তুলিয়া দিতে চিরদিন ক্ষিপ্রহস্ত। সিরাজ যখন সসৈন্যে কলিকাতাভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করেন, জগৎশেঠ এবং খোজা বাজিদ কৃতাঞ্জলি হইয়াও যখন সিরাজদ্দৌলাকে সংকল্পচ্যুত করিতে পারেন নাই, মাণিকচাঁদ তখন নবাবের নিকট সরফরাজ থাকিবার আশায় সবিশেষ উৎসাহের সঙ্গে ইংরাজদলনে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করিতে ত্রুটি করেন নাই। কলিকাতা জয় করা হইল, কলিকাতার নাম পর্যন্তও বিলুপ্ত হইয়া গেল, কলিকাতার সৌধধবল ইন্দ্রপুরী হইতে ইংরাজ গৃহতাড়িত হইল,—মাণিকচঁদ বুঝিলেন যে, আর বিনাযুদ্ধে “আলিনগরে” ইংরাজের পদার্পণ করিবার সম্ভাবনা রহিল না। কিন্তু মাণিকচাঁদ জানিতেন যে, বিপদে পড়িয়া বৃটিশসিংহ কিছুদিনের জন্য পলায়ন করিতে বাধ্য হইলেও, অবসর পাইবামাত্র আবার বীরদর্পে কলিকাতার উপর হুঙ্কার করিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িবে, এবং সে আক্রমণে মাণিকচাঁদেরই সমূহ সর্ব্বনাশ হইবে। তিনি সেই জন্য মূলাজোড়ে এক নূতন দুর্গ নির্ম্মাণ করিয়া সেখানে ধনরত্ন ও স্ত্রীপুত্রাদি সুরক্ষিত করিতেছিলেন। ইতিমধ্যে আবার বাতাস ফিরিয়া গেল। সিরাজদ্দৌলার মতি গতি শান্তভাব অবলম্বন করিল; ইংরাজদিগের পুনরাগমনের আশার বীজ অঙ্কুরিত হইয়া উঠিল; সুতরাং তাঁহাদের করুণক্রন্দনে উপেক্ষা প্রদর্শন করা মাণিকচাঁদের নিকট বুদ্ধিমানের কার্য্য বলিয়া প্রতীয়মান হইল না। উমিচাঁদ অনুরোধ জানাইবামাত্র মাণিকচাঁদ ইংরাজদিগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াইবার জন্য পত্র লিখিয়া পাঠাইলেন।[১৮]
নবাব-দরবারে ইংরাজদিগের কাতর নিবেদনে শুভফল ফলিবার সম্ভাবনা উপস্থিত হইল। এমন সময়ে কাশিমবাজার হইতে সহসা সংবাদ আসিল যে,—“মুর্শিদাবাদে বড়ই গোলযোগ! বাদশাহ পূর্ণিয়ার নবাব শওকতজঙ্গকেই বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার নবাবী সনদ পাঠাইয়া দিয়াছেন। তদনুসারে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন আরব্ধ হইয়াছে; তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলে, অনেকেই তাঁহার পক্ষে অস্ত্রধারণ করিবেন। আর সে সিরাজদ্দৌলা নাই। তাহার প্রবল গর্ব্ব খর্ব্ব হইয়া আসিয়াছে;—তাঁহার রত্ন সিংহাসন যায় যায় হইয়া উঠিয়াছে।[১৯]
এই সংবাদ পাইবামাত্র ইংরাজদিগের পূর্ব্বসংকল্প পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল। সকলেই বলিতে লাগিলেন,—আর কেন? সময় থাকিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া যাও। ইংরাজ-দরবার তাহাই কৱিলেন। তাঁহারা শওকতজঙ্গের সঙ্গে আত্মীয়তা করিবার জন্য এবং সিরাজদ্দৌলার সর্ব্বনাশসাধনে তাঁহাকে উৎসাহিত করিবার জন্য “নজর” পাঠাইয়া পত্র লিখিতে কৃতসংকল্প হইলেন।[২০]
সিরাজদ্দৌলা ইহার বিন্দু বিসর্গও জানিতে পারিলেন না; তাঁহার নিকট পূর্ব্ববৎ কাকুতি মিনতি চলিতে লাগিল। তিনি যদি ঘুণাক্ষরেও এই রাজবিদ্রোহিতার সন্ধান পাইতেন, তবে হয়ত ফলতার বন্দর ইংরাজের সমাধিক্ষেত্রে পরিণত হইতে বিলম্ব ঘটিত না।
এদিকে মাদ্রাজনিবাসী ইংরাজগণ দুইমাসের মধ্যেও তর্কবিতর্কের শেষ করিতে পারিলেন না। ইংরাজের ফৌজ অপ্রচুর; চিরশত্রু ফরাসী হয়ত শীঘ্রই ভারতবর্ষ আক্রমণ করিবে;—এমন সময়ে মাদ্রাজ হইতে পল্টন পাঠাইয়া দেওয়া কর্ত্তব্য কি না—সে বিষয়ে বিষম মতভেদ উপস্থিত হইতে লাগিল। এই সকল কারণে অনেক বিলম্ব হইয়া গেল,অবশেষে স্থির হইল যে, অন্যান্য প্রদেশের ভাগ্যে যাহা হয় হউক, সর্ব্বাগ্রে কলিকাতার উদ্ধারসাধন করাই কর্ত্তব্য। এই সময়ে বিখ্যাত ইতিহাসলেখক অর্ম্মি সাহেব মাদ্রাজ-দরবারের সদস্য ছিলেন, তিনি এই সকল তর্ক-যুদ্ধের সবিস্তার ইতিহাস লিখিয়া গিয়াছেন।[২১] কলিকাতার উদ্ধারসাধন করা স্থির হইল বটে, কিন্তু কাহাকে সেনাপতি করা হইবে, তাহা সহজে স্থির হইল না।
পিগট সাহেব মাদ্রাজের গভর্ণর। পদগগৗরবে তিনিই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু যুদ্ধব্যবসায়ে তাহার কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা নাই। সেনানায়কদিগের মধ্যে কর্ণেল অল্ডারক্রন্ সর্ব্বজ্যেষ্ঠ; কিন্তু বাঙ্গালাদেশের যুদ্ধকলহে তাঁহারও কোনরূপ অভিজ্ঞতা নাই। কর্ণেল লরেন্সের যোগ্যতা আছে, অভিজ্ঞতাও আছে,—সকল বিষয়েই তিনি পরিপক্ক। কিন্তু তিনি হাঁপানী রোগে জর্জ্জরিত,—বাঙ্গালার জলবায়ু তাঁহার ধাতুতে সহ্য হইবে না। এইরূপে যখন একে একে সকল সেনাপতি পশ্চাদ্পদ হইলেন, তখন কর্ণেল ক্লাইবের উপর অগত্যা এই ভার ন্যস্ত হইল। যাঁহারা ক্লাইবের পক্ষপাতী, তাঁহারা বলিলেন যে, ইংরাজভাগ্যে মণিকাঞ্চনের সংযোগ হইল।
কর্ণেল ক্লাইবের নাম ভারতবর্ষে চিরস্মরণীয় হইয়াছে। কলিকাতার গভর্ণমেণ্ট প্রাসাদে তাঁহার গর্বোন্নত বীরপ্রকৃতির যে সুবৃহৎ চিত্রপট বিরাজিত রহিয়াছে,[২২] তাহার প্রত্যেক তুলিকা-সম্পাতে আজিও যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞাব্যঞ্জক তীব্রতেজ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছে। কত সুলেখক তাঁহার বীরকার্ত্তির বর্ণনা করিয়া সাহিত্যজগতে চিরস্মরণীয় হইয়াছেন। তাঁহারা বলেন যে, “কর্ণেল ক্লাইব আজন্মসৈনিক,—এত সাহস, এত বীরদর্প, এত প্রত্যুৎপন্নমতি একাধারে আর কাহারও জীবনে বিকশিত হইয়াছে কি না সন্দেহ।”
মাদ্রাজ-দরবার স্থির করিয়া দিলেন যে, সেনাপতি ক্লাইব কলিকাতার ইংরাজদরবারের আজ্ঞাবহ হইবেন না, স্বাধীনভাবে সকল কার্য্য সুসম্পন্ন করিয়া সসৈন্যে মাদ্রাজে প্রত্যাবর্ত্তন করিবেন। ইংলণ্ডেশ্বরের নৌ-সেনাপতি আডমিলার ওয়াট্সন্কেও সেই সঙ্গে প্রেরণ করা স্থির হইয়া গেল।[২৩]
ভারতভাগ্যবিধাতা মহাবীর ক্লাইব এবং ওয়াট্সন্ পাঁচখানি রণপোত লইয়া ১৬ই অক্টোবর মাদ্রাজের উপকূল ছাড়িয়া সসৈন্যে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। কোম্পানী বাহাদুরের পাঁচখানি জলযান মালপত্র বহিয়া চলিল। ৯০০ গোরাপল্টনের সঙ্গে ১৫০০ কালা সিপাহী সগর্ব্বে বঙ্গোপসাগর বিকম্পিত করিয়া বৃটীশের রণবাদ্যনিনাদে তালে তালে পা ফেলিতে ফেলিতে জাহাজে পদার্পণ করিল। জাহাজ কলিকাতাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিল;—যতদুর দৃষ্টি চলিল, বেলাভূমিতে দাঁড়াইয়া ইংরাজ নরনারী রুমাল উড়াইয়া উৎসাহ বর্দ্ধন করিতে ত্রুটি করিলেন না।
একজন বাঙ্গালী-কবি শ্রুতিমধুর সংস্কৃত কবিতায় নব্যভারতের ইতিহাস সঙ্কলন করিয়া গিয়াছেন। তিনি কবিতা-রস-মাধুর্য্যের প্রাখর্য্য রক্ষার জন্য লিখিয়া গিয়াছেন যে,—“অনুকূলোহভবদ্বায়ুঃ প্রয়াণে ক্লাইবস্য হি।”[২৪] কিন্তু প্রভঞ্জন অনুকূল হইতে পারিলেন না; বায়ুবেগে জাহাজগুলি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িতে লাগিল। আড্মিরাল পোকক ২৫০ গোরা লইয়া ‘কম্বরল্যাণ্ড’ নামক সুবৃহৎ জাহাজে আরোহণ করিয়াছিলেন; এবং ‘মার্লবরা’ নামক আর এক খানি কোম্পানীর জাহাজে অধিকাংশ গুলিগোলা পুঞ্জীকৃত হইয়াছিল;—এই দুইখানি বিশেষ প্রয়োজনীয় জাহাজ যে কোথায় উড়াইয়া লইয়া গেল, তাহার আর সন্ধান মিলিল না! অবশিষ্ট জাহাজ গুলি অনেক ঝঞ্ঝাবাত সহ্য করিয়া অবশেষে বলেশ্বরের বন্দরের নিকট দিয়া ধীরে ধীরে কলিকাতাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিল।
- ↑ নবাবের আদেশে কলিকাতার নাম হইল “অলিনগর”! এখন ‘আলিপুরে” তাহার কঞ্চিৎ পরিচয় রহিয়া গিয়াছে।
- ↑ The Nawab, on his return to Hughley, made inquiry for us when he released Messrs. Watts and Collet &c. with the intention to release us also; he had expressed some resentment for having so hastily sent us up to Moorshidabad. This proved a very pleasing piece of intelligence to us.— Holwell's letter to William Davis Esq. 28 February, 1757.
- ↑ Two or three days before his departure, he published leave to such as had escaped the dungeon to return to their houses in the town, where they were supplied with provisions by Omichand, whose intercession had probably procured their return.—Orme, vol. II. 8o.
- ↑ He ordered a Suttaburder and Chopder immediately to see our irons cut off, and to conduct us wherever we choose to go, and to take care that we received no trouble, nor insult.-Holwell's letter to William Davis Esq., 28 February, 1757. বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের নবাবী আমলের বাঙ্গালীর ইতিহাসে এই অংশ উদ্ধত, সমালোচিত বা কোন রূপে উল্লিখিত হয় নাই। সিরাজচরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করিবার সময়ে এই সকল অংশ পরিত্যাগ করিলে সুবিধা হয়, সন্দেহ নাই!
- ↑ Orme, vol. Il. 8o
- ↑ Thornton's History of British Empire, vol. I. 197
- ↑ On the 5th of August news arrived of the fall of Calcutta, which scarcely created more horror and resentment than consternation and perplexity.—Orme, vol. II.
- ↑ Orme, vol. ll. 82-83.
- ↑ Orme, vol. II. 81.
- ↑ The remains of our unfortunate colony were now lying on board a few defenceless ships at Fulta, the most unwholesome spot in the country, about twenty miles below Calcutta, and destitute of the common necessaries of life; but, by the assistance of the French, and the Dutch, to whose humanity they were much indebted on this occasion, and partly by the assistance of the natives, who both from interest and attachment, privately supplied them with all kinds of provisions, they supported the horror of their situation till August."-Ive's Jornal.
- ↑ Orme vol. II, 79
- ↑ Some of the provisions were supplied by Nobokissen at the risk of his life,—the Nabob prohibited under penalty of death any one supplying the English. This led to Warren Hastings taking Nobokissen as his Munshi and the subsequent elevation of his family.—Revd. Long.
- ↑ Long's Selections from the Records of the Government of India,
- ↑ এই বৈঠকের আনুপূর্ব্বিক কার্য্যবিবরণী Long's Selections from the Records of the Government of India নামক পুস্তকে বিস্তৃতভাবে বর্ণিত রহিয়াছে।}}
- ↑ Consultation on board the Phoenix Schooner, Fulta, August 27, 1756.
- ↑ পলাশির যুদ্ধকাব্য।
- ↑ The same day there came another letter to the Major by Coja Petross and Abraham Jacobs from Raja Manik Chand of the 2nd. inst. at Allinagore (Calcutta) with many compliments and the strongest assurance of his assistance. He sent at the same time a boat with a dustick with orders for the opening a bazar and for the supplying us with provisions of all kinds.—Consultations, 5 September, 1756.
- ↑ Omichand and Manikchand were at this time in friendly correspondence with the English, they (negotiated at this time between the Nawab and the English) understanding how to run with the hare and keep with the hound.—Revd. Long.
- ↑ Mr. Warren Hastings writes from Cossimbazar that great preparations were there making for a war with Shocut-Jung, the Nabob of Pyrnea, who has had the Nabobship of Bengal, Behar and Orissa conferred upon him by the king of Dily. Consultations, 5 September 1756.
- ↑ The Board agreed so send a letter in Persian to the Pyrnea Nabob with presents, hoping he might defeat Sirajed Dowia.— Consultations, 15 September, 1756.
- ↑ Ormę, vol. II. 84-89.
- ↑ Calcutta—Its highways and by-paths.
- ↑ ইংরাজ-লিখিত সমস্ত ইতিহাসেই এই সকল বিষয় বর্ণিত রহিয়াছে। কেবল যিনি বাঙ্গালীকে “জাল জুয়াচুরি মিথ্যাকথার” অদ্বিতীয় আধার বলিয়া সগৌরবে ইতিহাসচর্চ্চা করিয়া ইংরাজের সত্যনিষ্ঠার পরিচয় দিবার চেষ্টা করিয়াছেন, সেই সুপ্রসিদ্ধ লর্ড মেকলে কল্পনাবলে লিখিয়া গিয়াছেন যে,—“within forty-eight hours after the arrival of the intelligence it was determined that an expedition should be sent to the Hughley, and that Clive should be at the head of the land-forces."—Macaulay's Lord Clive.
- ↑ লঘুভারতম।