সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/কে শান্তি প্রিয়,—মুসলমান সিরাজ, না খৃষ্টীয়ান ইংরাজ?

বিংশ পরিচ্ছেদ।

কে শান্তিপ্রিয়,-মুসলমান সিরাজ, না খৃষ্টীয়ান ইংরাজ?

ক্লাইব এবং ওয়াট্‌সন্ ফল্‌তায় পদার্পণ করিয়াই বীরদর্পে কলিকাতা পুনরধিকার করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিলেন। তাঁহারা যে মনে মনে লঙ্কাভাগ করিয়া তাহার কাম্যধন লুণ্ঠন করিবার জন্যই এতদূর অসহিষ্ণু হইয়া উঠিয়াছিলেন, ফল্‌তার ইংরাজেরা তাহার গুপ্ত সমাচার জানিতে পারেন নাই। তাঁহারা যুদ্ধকলহ উপস্থিত করিতে নিতান্ত অসম্মত;—নবাব যখন বিনাযুদ্ধেই বাণিজ্যাধিকার পুনঃপ্রদান করিতে সম্মত হইয়াছেন, তখন আর অনর্থক নরহত্যায় লিপ্ত হইবার প্রয়োজন কি? তাঁহারা বুঝাইতে লাগিলেন যে, যুদ্ধে জয় পরাজয় এবং সৈন্যক্ষয় হইবার অনিশ্চিত ফলাফল পরিহার করিবার উপায় নাই; কিন্তু ধীরভাবে আর কিছুদিন অপেক্ষা করিলে নিশ্চয়ই বিনাযুদ্ধে বাণিজ্যাধিকার লাভ করিতে পারা যাইবে। ক্লাইব সে সকল কথায় কর্ণপাত করিলেন না। কলিকাতা আক্রমণ করাই স্থির হইয়া গেল! মহাবীর ক্লাইব তখন গর্বোন্নত মস্তকে অনেক কটুকাটব্য প্রয়োগ করিয়া একখানি পত্র লিখিলেন, এবং সেই পত্র সিরাজদ্দৌলার নিকট পাঠাইয়া দিবার জন্য মাণিকচাঁদের হস্তে সমর্পণ করিলেন। বলাবাহুল্য মাণিকচাঁদের সাহসে কুলাইল না; তিনি কিছুতেই সে উদ্ধতলিপি নবাবের নিকট প্রেরণ করিতে সম্মত হইলেন না।

 ক্লাইব ২৭শে ডিসেম্বর তারিখে ময়দাপুরের ময়দানের নিকটে জাহাজ লাগাইয়া স্থলপথে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করিতে লাগিলেন। ভাগীরথীতীরে বজ্‌বজ্‌ নামক স্থানে একটি ক্ষুদ্র দুর্গ ছিল। ওয়াট্‌সন্ জলপথে সেই দুর্গ আক্রমণ করিবেন, এবং যদি কেহ দুর্গত্যাগ করিয়া পলায়নের আয়োজন করে, স্থলপথে ক্লাইব তাহাদের ভবন্ত্রণা দূর করিতে ক্রটি করিবেন না— এইরূপ সংকল্পে যুদ্ধযাত্রা আরম্ভ হইল! কিন্তু যুদ্ধের উপক্রমেই গৃহকলহের সূত্রপাত হইল। স্থলপথে যুদ্ধযাত্রা করিতে হইলে, কামান টানিবার জন্য, বারুদ টানিবার জন্য, রসদ টানিবার জন্য, গোরু ঘোড়া মহিষের প্রয়োজন। কলিকাতার পলায়িত ইংরাজগণ এই সকল জীবজন্তু সংগ্রহ করিয়া না দিলে ক্লাইবের উপায়ান্তর নাই। কিন্তু তাঁহারা কিছুতেই নবাবের ক্রোধোদ্দীপন করিয়া ক্লাইবের সহায়তা করিতে সম্মত হইলেন না। ক্লাইব তাঁহাদিগকে ভীরু, কাপুরুষ প্রভৃতি সুমিষ্ট সম্বোধনে আপ্যায়িত করিয়া স্বয়ং অধ্যবসায়বলে সমস্যাপূরণ করিতে অগ্রসর হইলেন;——দুইটিমাত্র কামান এবং একখানিমাত্র বারুদের গাড়ি সজ্জীভূত হইল; পদাতিকগণ পর্য্যায়ক্রমে তাহা টানিয়া লইতে লাগিল। এইরূপ অসমসাহসে অকুতোভয়চিত্তে অপরাজিত উৎসাহে ক্লাইবের সেনাপ্রবাহ কলিকাতাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিল, ওয়াট্‌সন্ জলপথে ধীরে ধীরে উজান বহিয়া চলিতে লাগিলেন।[১]

 ময়দাপুর হইতে বজ্‌বজিয়া আটক্রোশ। পথঘাটের সুব্যবস্থা না থাকায়, বনজঙ্গল ভাঙ্গিয়া সেই আটক্রোশ আসিতেই ইংরাজসেনা পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িল। দুর্গটি নিতান্ত ক্ষুদ্রায়তন, তন্মধ্যে সিপাহীর সংখ্যাও যৎসামান্য;— তথাপি ওয়াট্‌সন্ না আসিলে, একাকী ক্লাইব দুর্গাক্রমণ করিতে সাহস পাইলেন না। সকলেই পথশ্রমে এরূপ ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, প্রহরী পর্যন্ত না রাখিয়া, সকলেই একে একে অনাবৃত ভূতলশয্যায় প্রগাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলেন।

 ইংরাজেরা সসৈন্যে কলিকাতাভিমুখে অগ্রসর হইতেছেন, এই সংবাদে মাণিকচাঁদ বিষম সমস্যায় পতিত হইলেন। সন্ধির প্রস্তাব চলিতেছে, সন্ধি ও হয় হয় হইয়াছে;—সুতরাং তিনি যুদ্ধকলহের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তথাপি নবাবের লবণের মর্য্যাদা রক্ষার জন্য লোক দেখাইবার মত বাহ্যাড়ম্বর করিতে হইল, মাণিকচাঁদ স্বয়ং সসৈন্যে বজ্‌বজিয়াভিমুখে ধাবিত হইলেন।

 মাণিকচাঁদ গোলাবর্ষণ করিয়া সুপ্তসিংহকে প্রবুদ্ধ করিতে না করিতে উভয়দলে শক্তিপরীক্ষা আরম্ভ হইল। সে পরীক্ষায় রাজা মাণিচাদ বীরোচিত কর্ত্তব্যপালনের জন্য ব্যাকুল হইলেন না;—ইংরাজেরা দুই চারিটি গোলা ছাড়িতে না ছাড়িতেই মাণিকচাঁদ পলায়ন করিলেন। ইংরাজেরা পরিহাসচ্ছলে লিখিয়া রাখিয়াছেন যে, “মাণিকচাঁদের উষ্ণীষের নিকট দিয়া শন্ করিয়া বন্দুকের গুলি চলিয়া গেল, আর তিনি অমনি চম্পট!”[২] তিনি আর সে অঞ্চলে মুহূর্ত্তমাত্র তিষ্ঠিতে পারিলেন না; বজবজ ছাড়িয়া, কলিকাতা ছাড়িয়া, একেবারে উর্দ্ধশ্বাসে মুর্শিদাবাদে পলায়ন করিলেন! মাণিকচাঁদের পলায়নকাহিনী সবিশেষ বিস্ময়পরিপূর্ণ;—ইতিহাস তাহার রহস্যনির্ণয় না করিয়া তাঁহাকে ভীরু কাপুরুষ বলিয়া উপহাস করিয়াছে; কিন্তু ইংরাজদিগের সহিত মানিকচাঁদের যে সখ্য সংস্থাপিত হইয়াছিল, তাহার সহিত কি ইহার কোনই সংস্রব ছিল না?[৩]

 ইহার পর আর যুদ্ধ করিতে হইল না। ক্লাইব এবং ওয়াট্‌সন্ ২রা জানুয়ারী তারিখে কলিকাতা-দুর্গের নিকটস্থ হইলে দুর্গাধিকারী সিপাহীদল দুই চারিটী গোলা চালনা করিয়াই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিল;—মহাবীর ক্লাইব সদর্পে কলিকাতার শূন্যদুর্গে বিজয়পতাকা প্রোথিত করিয়া দিলেন।

 দুর্গজয় সুসম্পন্ন হইল, রণকোলাহল শান্তিলাভ করিল, কিন্তু ইংরাজসেনানায়কদিগের মধ্যে হিংসা দ্বেষ বিবর্দ্ধিত হইয়া উঠিল। ক্লাইব এবং ওয়াট্‌সন্ উভয়েই চতুরচূড়ামণি;—চতুরে চতুরে সংঘর্ষ উপস্থিত হইবার উপক্রম হইল। উভয়েই বুঝিলেন যে, দুর্গ যাঁহার হস্তে থাকিবে, লুঠের ধনে তাঁহারই আধিপত্য জন্মিবে। সুতরাং ওয়াট্‌সন্ দুর্গদখল করিবার জন্য কাপ্তান কূটকে এক পরোয়ানা প্রদান করিলেন। কাপ্তান কুট পরোয়ানা লইয়া দুর্গদ্বারে উপনীত হইবামাত্র ক্লাইব তাঁহাকে দূর করিয়া দিলেন। তিনি বলিতে লাগিলেন যে, “ওয়াট্‌সনের অধিকার মানি না; আমি দুর্গাধিপতি,—যদি অজ্ঞাপালন করিতে ইতস্ততঃ কর, এখনই কারারুদ্ধ করিব!” কূট সাহেব কূটকৌশলে পরাস্ত হইয়া ওয়াট্‌সন্‌কে পরোয়ানা ফিরাইয়া দিতে বাধ্য হইলেন। ওয়াট্‌সন্ সহজে ছাড়িবার পাত্র নহেন;—তিনি কাপ্তান স্পিক্‌কে পাঠাইয়া দিলেন; স্পিক্ আসিয়া ক্লাইবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাহার আজ্ঞায় দুর্গাধিকার করিয়াছ?” ক্লাইব বলিলেন যে, তিনিই প্রধান সেনাপতি, সুতরাং দুর্গাধিকারে তাঁহারই একমাত্র ক্ষমতা,—ওয়াট্‌সনের কোন ক্ষমতা নাই। এই সংবাদে ওয়াট্‌সন্ বলিয়া পাঠাইলেন যে, ক্লাইব সহজে দুর্গাধিকার পরিত্যাগ না করিলে তাঁহাকে কামানের গোলায় উড়াইয়া দিব”;—ক্লাইব বলিলেন, “তথাস্তু; কিন্তু এই আত্মকলহের জন্য ওয়াট্‌সন্ দায়ী!” অবশেষে কাপ্তান লাথাম ও স্বয়ং ওয়াট্‌সন ও দুর্গমূলে শুভাগমন করিলেন, এবং অনেক তর্ক বিতর্কের পর উভয়পক্ষে সন্ধি হইয়া ক্লাইবের হস্তেই দুর্গাধিকার সমর্পিত হইল।[৪] পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক দুর্গজয়ের কাহিনী লিখিত রহিয়াছে; কিন্তু এরূপ গৃহকলহের দৃষ্টান্ত বোধ হয় অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়।

 উভয়দলের মনোমালিন্য দূর করিবার জন্য ড্রেক সাহেবকে কলিকাতার শাসনভার প্রদান করা হইল; তিনি পুনরায় কলিকাতার কর্ত্তা হইয়া সগৌরবে আসনগ্রহণ করিলেন।

 ইংরাজেরা দুর্গপ্রবেশ করিয়া দেখিতে পাইলেন যে, দুর্গমধ্যে কোম্পানীর অধিকাংশ দ্রব্যজাত যেরূপ অবস্থায় রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহা সেইরূপ ভাবেই পড়িয়া রহিয়াছে,—কিছুই অপহৃত বা বিলুণ্ঠিত হয় নাই।[৫] দুর্গপ্রাচীরের বাহিরে যে সকল বাড়ীঘর ছিল, তাহাই কেবল সিপাহীরা লুটিয়া লইয়া গিয়াছে।

 দুর্গ হস্তগত হইল। দেশের লোকে দলে দলে কলিকাতায় প্রত্যাবর্ত্তন করিল। ইংরজি-বাণিজ্য পুনঃসংস্থাপনের সূত্রপাত হইল। ক্লাইবের কর্ত্তব্যকার্য্য শেষ হইয়া গেল; কিন্তু লঙ্কাভাগ ত হইল না! সুতরাং দেশ লুণ্ঠনের জন্য সকলেই ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন! অবশেষে হুগলী লুণ্ঠন করা স্থির হইল। হুগলী বহুদিনের পুরাতন স্থান; ফৌজদারের রাজধানী; বাণিজ্যের সর্ব্বপ্রধান ভিত্তিভূমি;—সেখানে অবশ্যই অগণিত ধনরত্ন পুঞ্জীকৃত থাকা সম্ভব। মেজর কিল্‌প্যাট্রিক বহুদিন নিষ্কর্ম্মা বসিয়া রহিয়াছেন, তাঁহার উপরেই লুণ্ঠনের ভার সমর্পিত হইল। পদাতিক, গোলন্দাজ, ভলণ্টিয়ার,—লুণ্ঠনলোভে ইংরাজমাত্রেই হুগলীর দিকে ছুটিয়া চলিল। হুগলীর দুর্গ এবং রাজধানী লুষ্ঠিত হইল; তাড়াতাড়ি পাড়াপাড়ি করিয়া ইংরাজসেনা যতদূর পারিল লোকের বাড়ীঘর ভূমিসাৎ করিয়া কলিকাতায় প্রত্যাবর্ত্তন করিল।[৬]

 ওয়াট্‌সন্ এবং ক্লাইব বঙ্গদেশে শুভাগমন করিবামাত্র সিরাজদ্দৌলার নিকট সন্ধির প্রস্তাব লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন। সিরাজদ্দৌলাও সম্মতিসূচক প্রত্যুত্তর পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। সে কথায় কিছুমাত্র আস্থা স্থাপন না করিয়া, ইংরাজেরা বাহুবলে কলিকাতা আক্রমণ করিয়া যথেষ্ট ধৃষ্টতার পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন। তথাপি সিরাজদ্দৌলা তাহাতে উত্ত্যক্ত না হইয়া পুনরায় লিখিয়া পাঠাইলেন:—

January 23, 1757

 You write me, that the King your master sent you into India to protect the Company's settlements, trades, rights and privileges; the instant I recieved this letter, I sent you an answer; but it appears to me that my reply never reached you, for which reason I write again.

 I must inform you, that Roger Drake, the Company's Chief in Bengal, acted contrary to the orders I sent him, and encroached upon my authority; he gave protection to the King's subjects who absented themselves from the inspection of the Durbar, which practice I did forbid, but to no purpose. On this account, I was determined to punish him, and accordingly expelled him my country; but it was my inclination to have given the English Company permission to have carried on their trade as formerly, had another Chief been sent here; for the good therefore of these Provinces, and the inhabitants, I send you this letter; and if you are inclined to re-establish the Company, only appoint a Chief, and you may depend upon my giving currency to their commerce upon the same terms as heretofore enjoyed. If the Enlish behave themselves like merchants, and follow my orders, they may rest assured of my favour, protection, and assistance.”[৭]

 এই পত্রে সিরাজচরিত্রের যেরূপ পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহার সহিত ইতিহাস-বর্ণিত সিরাজদ্দৌলার কত প্রভেদ! কিন্তু ইংরাজেরা সে সকল কথা জানিয়া শুনিয়াও শান্তিপ্রিয়তার পরিচয় প্রদান করিতে পারিলেন না। এই পত্র যখন ইংরাজদিগের হস্তগত হইল, তখন তাঁহারা কলিকাতা পুনরধি কার করিয়া, হুগলী বিপর্যস্ত করিয়া, বীরসিংহ হইয়া বৃটীশদুর্গে বিশ্রাম-সুখ উপভোগ করিতেছিলেন। সুতরাং ওয়াট্‌সনের শান্তমূর্ত্তি তিরোহিত হইয়া গেল;—তিনি এবার সিংহবিক্রমে প্রত্যুত্তর পাঠাইলেন:—

 “You told me in your letter, that the reason of your expelling the English out of these countries was, the bad behaviour of Mr. Drake, the Company's Chief in Bengal. But besides that, Princes and Rulers of States, not seeing with their own eyes, nor hearing with their own ears, are often misinformed, and the truth (is) kept from them by the arts of crafty and wicked men; was it becoming the justice of a Prince to punish all for one man's sake? Or to ruin and destroy so many innocent people as had no way offended, but who, relying on Our Royal Phirmaund, expected protection and security both to their property and lives, instead of oppression and murder, which they unhappily found? Are these actions becoming the justice of a Prince? No body will say they are. They can only then have been caused by men, who have misrepresented things to you through malice, or for their own private ends; for great Princes delight in acts of justice, and in shewing mercy.

 If therefore you are desirous of meriting the fame of a great Prince, and lover of justice, shew your abhorrence of these proceedings, by punishing those evil counsellors who advised them; cause satisfaction to be made to the Company, and to all others who have been deprived of their property, and by these acts turn off the edge of the sword which is ready to fall on the heads of your subjects.

 If you have any cause of complaint against Mr. Drake, as it is but just that the master alone should have a power over his servant, send your complaints to the Company, and I will answer for it they will give you satisfation.

 Although I am a soldier as well as you, I had rather receive satisfation from your own inclination to do justice, than be obliged to force it from you by the distress of your innocent subjects”[৮]

 এই পত্রখানি যখন সিরাজদ্দৌলার হস্তগত হইল, তৎপূর্ব্বেই হুগলীর লুণ্ঠনকাহিনী তাঁহার কর্ণগোচর হইয়াছিল। তিনি ইংরাজদিগের উদ্ধত ব্যবহারে চিরদিন যেরূপ উত্ত্যক্ত হইয়াছেন, ওয়াট সনের পত্রেও তাহাই হইল। সিরাজদ্দৌলা মুসলমান,—ওয়াট সন্ সুসভ্য খৃষ্টীয়ান; সুতরাং মুসলমান নবাব খৃষ্টীয়ান সওদাগরের ধর্ম্মনীতির যুক্তিতর্ক ভাল করিয়া বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। ইংরাজেরা বাক্য-নবাব; ‘যাহা বলি তাহাই কর, যাহা করি তাহার অনুকরণ করিও না’—এই নিগূঢ় নীতি-রহস্যের উপাসক; পরকার্য্য-সমালোচনায় প্রগাঢ় পণ্ডিত; আত্মকার্য্য লইয়া কেহ সমালোচনা করিতে চাহিলে অগ্নিশর্ম্মা হইয়া উঠেন; কার্য্য যেরূপ হয় হউক, বাক্যে তাহার দোষক্ষালনের সময়ে সকলেই পঞ্চমুখে ইংরাজের গুণগান করিতে লালায়িত;—সিরাজদ্দৌলা তরুণযুবক, তিনি ইংরাজ চরিত্রের এইরূপ সমালোচনা করিয়া ইংরাজের নামে শিহরিয়া উঠিতে শিক্ষা করিয়াছিলেন। যাঁহারা পদাশ্রিত বণিক হইয়াও হুগলীর নিরপরাধ নাগরিকদিগকে (কেবলমাত্র লুণ্ঠন-লোভেই) হত্যা করিয়া, তাহাদের বাড়ীঘর ভূমিসাৎ করিয়া দসুতস্করের ন্যায় অর্থশোষণ করিয়াছেন, তাঁহারাই কিনা তরবারির শোণিতকলঙ্ক ধৌত করিতে না করিতেই লেখনী গ্রহণ করিয়া প্রবীণ ধর্ম্মোপদেষ্টার ন্যায় কলিকাতা লুণ্ঠনের জন্য সিরাজদ্দৌলাকে তিরস্কার করিতে বসিয়াছেন। যুদ্ধকলহে একজনের অপরাধে চিরদিনই দশজনের দণ্ড হইয়া থাকে। এক রাবণের অপরাধে সমগ্র রাক্ষসকুল নির্ম্মূল হইয়াছিল; এক নেপোলিয়নের অপরাধে অগণ্য ফরাসীসেনার সর্ব্বনাশ হইয়াছিল; ইংরাজরাজ্যেও এক নরপতির কল্পিত অপরাধে অসংখ্য নাগরিকের শোণিত-প্রবাহে শ্বেতদ্বীপ রুধিরচর্চ্চিত লোহিতবর্ণে সুরঞ্জিত হইয়া উঠিয়াছিল। কলিকাতার ইংরাজেরা দশজনে মিলিয়া, সভা করিয়া, মন্তব্য লিখিয়া, নবাবদূতকে অর্দ্ধচন্দ্র প্রদান করিয়া কি সমুচিত অপরাধ করেন নাই;—না, সে অপরাধ কেবল একজনের অপরাধ? যাহারা অপরাধী ড্রেকসাহেবের সঙ্গে কোমর বাঁধিয়া লড়িবার জন্য যুদ্ধশিক্ষা করিয়া টানার দুর্গাক্রমণে, উমাচরণের সর্ব্বনাশ সাধনে অতিমাত্র প্রশংসনীয় বীরকীর্ত্তির নিদর্শন রাখিয়া কার্য্যকালে প্রাণ লইয়া পলায়ন করিয়াছিলেন, তাঁহারা প্রথমে নিরপরাধ হইলেও আত্মকার্য্যেই অপরাধী হইয়া উঠিয়াছিলেন। এইরূপ সকল দেশেই হইয়া থাকে;— রাজার অপরাধে প্রজার, সেনাপতির অপরাধে সেনাদলের, নানারূপ দণ্ড হইয়া থাকে। যুদ্ধানল জ্বলিয়া উঠিলে, তাহাতে রাজদুর্গের সঙ্গে সঙ্গে কত কাঙ্গাল-কুটীরও ভস্ম হইয়া যায়;—কে তাহার গতিরোধ করিতে পারে? ওয়াট্‌সন্ কোন লজ্জায় সত্যসঙ্কোচ করিয়া লিখিয়া পাঠাইলেন যে, সিরাজদ্দৌলা পরের কথায় নির্ভর করিয়া ইংরাজদিগের সর্ব্বনাশ করিয়াছিলেন? কলিকাতা হইতে নবাবদূতকে অপমান করিয়া তাড়াইয়া দেওয়ার কথা কলিকাতার ইংরাজেরাও অস্বীকার করেন নাই; ওয়াট্‌সন্ কি গলাবাজিতে, সকল কথাই উড়াইয়া দিতে চাহেন? ওয়াট্‌সন্ যাহাই বলুন, ইংরাজের কাগজপত্র তাহার পক্ষ সমর্থন করে না। ড্রেক সাহেব যেরূপ উদ্ধত ব্যবহারের পরিচয় দিয়াছিলেন, ওয়াট্‌সন্ বলেন যে, তজ্জন্য কোম্পানীর কাছে করজোড়ে নালিশ করাই সিরাজদ্দৌলার কর্ত্তব্য ছিল। সিরাজদ্দৌলা আর তাহার কি প্রত্যুত্তর দিবেন? তিনি যে দেশের নবাব, ড্রেক সাহেব সেই দেশের একদল সওদাগরের গোমস্তা মাত্র; অথচ সেই দেশে বসিয়া তাঁহাকে ইহাও শুনিতে হইল যে, কোম্পানীর নিকট নালিশ না করিয়া নিজে নিজে ড্রেক সাহেবকে শাস্তি দিবার চেষ্টা করা বড়ই অন্যায় হইয়াছে। শাসনক্ষমতা সংস্থাপনের জন্য, আত্ম-মর্য্যাদা সংরক্ষণের জন্য, অসহায় প্রজাপুঞ্জের ধনমান রক্ষা করিবার জন্য সিরাজদ্দৌলাকে পুনরায় যুদ্ধযাত্রা করিতে হইল। কিন্তু তিনি ক্রোধান্ধ হইয়া আত্ম-কর্তব্য বিস্মৃত হইলেন না; মুসলমান-নবাব উত্ত্যক্ত হইয়াও কতদূর ক্ষমাশীল হইতে পারেন, তাহা বুঝাইবার জন্য ওয়াট্সন‌্‌কে লিখিয়া পাঠাইলেন:—

 “You have taken and plundered Hughley, and made a war upon my subjects: these are not acts becoming merchants! I have, therefore, left Muxudabad, and am arrived near Hughley; I am likewise crossing the river with my army, part of which is advanced towards your camp. Nevertheless, if you have a mind to have the Company's business settled upon its ancient footing, and to give a currency to their trade, send a person of consequence to me, who can make your demands, and treat with me upon this affair. I shall not scruple to grant a Perwannah for the restitution of all the Company's Factories, and permit them to trade in my country upon the same terms as formerly. If the English, who are settled in these Provinces, will behave like merchants, obey my orders, and give me no offence, you may depend upon it I will take their loss into consideration and adjust matters to their satisfaction.

 You know how difficult it is to prevent soldiers from plundering in war; therefore, if you will, on your part, relinquish something of the damages you have sustained by being pillaged by my army, I will endeavour to give you satisfaction even in that particular, in order to gain your friendship; and preserve a good understanding for the future with your nation.

 you are a Christian, and know how much preferable it is to accommodate a dispute, than to keep it alive; but if you are determind to sacrifice the interest of your Company, and the good of private merchants to your inclination for war, it is no fault of mine: to prevent the fatal consequence of such a ruinous war, I write this letter.”[৯]

 এই পত্রের ছত্রে ছত্রে যেরূপ গাম্ভীর্য্যপূর্ণ শান্ত প্রকৃতির ঔদার্য্যগুণ প্রকাশিত রহিয়াছে, সিরাজদ্দৌলা তরুণযুবক হইয়াও যে সেরূপ উন্নত চরিত্রের পরিচয় প্রদান করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, ইহা তাঁহার পক্ষে সবিশেষ গৌরবের কথা। রাজা হইয়া প্রজার সঙ্গে যুদ্ধকলহে লিপ্ত হওয়া রাজার পক্ষে সর্ব্বথা অকল্যাণের কথা;—তাহাতে শিল্পবাণিজ্যের ক্ষতি, একের অপরাধে দশের সর্ব্বনাশ, এবং দেশের সমূহ অমঙ্গল। একথা সিরাজদ্দৌলা বুঝিতে পারিয়াই,—সন্ধিসংস্থাপনের জন্য ওয়াট্‌সন্‌কে পত্র লিখিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। ইহার সঙ্গে ইংরাজদিগের ব্যবহারের তুলনা কর। কে শান্তিপ্রিয়,—মুসলমান সিরাজ, না খৃষ্টীয়ান ইংরাজ?

  1. This arose from the continued apprehensions of the Council at Fulta, who, clinging to their first fear with more than martyr's steadfastness, did not venture to provide a single beast either of draught or burden, lest they should incur the Subhadar's resentment.—Thornton vol. 1. 201.
  2. Ive's Journal
  3. The Government (in 1763) agreed to entertain on the Company's pay the son of the deceased Manickchand, who was useful to them in various ways during the preceding 30 years though he led the Nawab's troops against the English at the battle of Budge Budge.—Revd. Long.
  4. Evidence of Lord Clive before the Committee of the House of Commons, 1772.
  5. The greatest part of the merchandizes belonging to the Company, which were in the Fort when taken, were found remaining without detriment.—Orme, ii, 126.
  6. The fort and city were plundered, and as magnificent houses destroyed, as the short time would permit.— Scrafton's Reflections.
  7. Ive's Journal.
  8. Ive's Journal.
  9. Ive's Journal.