সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/বৃদ্ধ নবাবের অন্তিম উপদেশ

একাদশ পরিচ্ছেদ।


বৃদ্ধ নবাবের অন্তিম উপদেশ।

বিধাতার বিড়ম্বনায় রাজবল্লভের সকল চেষ্টাই বিফল হইয়া গেল। ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দে আলিবর্দ্দী বর্ত্তমানে নওয়াজে মহম্মদের মৃত্যু হইল! [] রাজবল্লভের মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল! মুসলমান, ইতিহাসলেখক বলেন যে, “সকলে মিলিয়া ধরাধরি করিয়া শবদেহ যখন সমাধিগহ্বরের নিকটস্থ করিল, তখন চারিদিক হইতে সহস্র সহস্র কণ্ঠে এমন করুণ ক্রন্দন উত্থিত হইল যে, সমাধিস্থানে কেহ কখন তেমন আর্ত্তনাদ শ্রবণ করে নাই।”[] সকলই ফুরাইল। নওয়াজের মহিষী ঘসেটি বেগম মতিঝিলে আর্তনাদ করিতে লাগিলেন। সিরাজদ্দৌলা যে তাহার কত না দুর্গতি করিবেন, তাহা ভাবিয়া আকুল হইয়া উঠিলেন। ইহার অল্পদিন পরেই পূর্ণিয়ার সাইয়েদ আহমদেরও মৃত্যু হইল! তাঁঁহার পুত্র শওকতজঙ্গ পূর্ণিয়া প্রদেশের নবাব হইলেন। শওকত তরুণ যুবক, ঘসেটি বেগম অন্তঃপুরচারিণী দুর্ব্বল রমণী;—সুতরাং সিরাজের কণ্টক দূর হইল বলিয়া আলিবর্দ্দী আশ্বাসলাভ করিতে না করিতেই রাজবল্লভ এক নুতন প্রতিদ্বন্দ্বী উপস্থিত করিলেন।

 নওয়াজেসের কোন সন্তান সন্ততি ছিল না। তিনি সেই জন্য সিরাজদ্দৌলার কনিষ্ঠ সহোদরকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করিয়াছিলেন। সে পোষ্যপুত্র নওয়াজেসের জীবনকালেই পরলোক গমন করে। কিন্তু তাহার একটি অল্পবয়স্ক পুত্রসন্তান বর্তমান ছিল। রাজবল্লভ সেই শিশুসন্তানকে সিংহাসনে বসাইয়া ঘসেটি বেগমের নামে স্বয়ং বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার নবাবী করিবার কল্পনা করিলেন[]

 আলিবর্দ্দীর জীবনের আশা ফুরাইয়া আসিতেছে, সুনিপুণ রাজবৈদ্যগণ বৃদ্ধ নবাবের দিকে সানয়নে দৃষ্টিপাত করিয়া ভগ্নহৃদয়ে ফিরিয়া আসিতেছেন, সিরাজদ্দৌলা নিশিদিন মাতামহের শয্যাপার্শ্বে কণ্ঠলগ্ন হইয়া বসিয়া রহিয়াছেন;—রাজবল্লভ বুঝিলেন, ইহাই উপযুক্ত সুসময়। তিনি কৃষ্ণবল্লভকে সংবাদ পাঠাইলেন যে, “আর কি দেখিতেছ, ঢাকার ধনসম্পদ ও পরিবার লইয়া নৌকাপথে কলিকাতা অঞ্চলে পলায়ন কর।” কলিকাতায় গিয়া কৃষ্ণবল্লভ যাহাতে ইংরাজের আশ্রয় পান, তাহার জন্য, ওয়াটস সাহেবকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাইলেন। ইংরাজ ইতিহাসলেখক বলেন যে, “ওয়াটস্ সাহেবের বিশেষ . অপরাধ ছিল না। সকলেই বলিতে লাগিল যে, বৃদ্ধ নবাবের শেষনিঃশ্বাস পতিত হইতে যাহা কিছু অপেক্ষা, রাজবল্লভ থাকিতে সিরাজদ্দৌলা কখনই সিংহাসনে বসিবার অবসর পাইবেন না; ঘসেটি বেগমের পালিত সন্তানই সিংহাসনে আরোহণ করিবে,—অতএব ঘসেটি বেগমের চিরানুগত বিশ্বস্ত মন্ত্রী রাজবল্লভের অনুরোধ আর কেমন করিয়া উপেক্ষা করা যায়? ওয়াটস্ যখন অনুরোধপত্র পাঠাইলেন, গবর্ণর ড্রেক সাহেব তখন স্বাস্থ্যলাভের জন্য বালেশ্বরের বন্দরে বায়ুপরিবর্তন করিতেছিলেন। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা না করিয়াই কলিকাতার ইংরাজগণ কৃষ্ণবল্লভকে কলিকাতায় আশ্রয় দিতে স্বীকৃত হইলেন।” এদিকে কৃষ্ণবল্লভ ৺পুরুষোত্তমধাম দর্শন করিবেন বলিয়া, সপরিবারে নৌকাপথে যাত্রা করিলেন। ঢাকার বিপুল ধনভাণ্ডার বহন করিয়া কৃষ্ণবল্লভের তীর্থযাত্রার তরণীগুলি পথ ভুলিয়া পদ্ম ও জলঙ্গী নদী বাহিয়া ভাগীরথীতে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং লোকে ভাল করিয়া বুঝিতে না বুঝিতে কলিকাতার বন্দরে গিয়া নিরাপদে উপনীত হইল।[]

 সিরাজদ্দৌলা যে অত্যাচারী নিষ্ঠুর নবাব, তাহা বলিয়া রাজবল্লভ ভীত হইলেন না। তিনি জানিতেন যে, সিরাজদ্দৌলাই প্রকৃত নবাব আলিবর্দ্দীর মেহপুত্তল এবং প্রতিভাশালী তেজস্বী যুবক। সিরাজদ্দৌলা সিংহাসনে আরোহণ করিলে ঢাকার নেয়াবতে উপযুক্ত নবাব নির্ব্বাচন করিবার এবং পূর্বনবাব নওয়াজেস মোহম্মদ ও রাজবল্লভের হিসাব নিকাশ লইবার অধিকার সিরাজদ্দৌলারই হইবে॥[] নবাব নাজিম বলিয়াই হউক, আর নওয়াজেসের উত্তরাধিকারী বলিয়াই হউক, নওয়াজেসের ধনরত্নে রাজবল্লভ অপেক্ষা সিরাজদ্দৌলারই যে শাস্ত্রানুমোদিত অধিকার, তাহা কেহই অস্বীকার করিতে পারিবে না। সিরাজজৌলা সেই অধিকার সংস্থাপন করিয়া পিতৃব্যের ত্যক্তসম্পত্তি সহ পিতৃব্যরমণী ঘসেটি বেগমকে অন্তঃপুরে আনিয়া প্রতিপালন করিতে চাহিলে রাজবল্লভ কি বলিয়া বাধা দিবেন। আর লোকেই বা কি বলিবে? সিরাজদ্দৌলা সিংহাসনে বসিতে নাপারিলে এ সকল গোলযোগর কিছু মাত্র সম্ভাবনা থাকে না। অগত্যা রাজবল্লভ মতিঝিলে সেনাসংগ্রহ করিয়া বাহুবলে ও মন্ত্রণাকৌশলে সিরাজদ্দৌলার গতিরোধ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 সেকালে পথ ঘাটের তত সুবিধা ছিল না। লোকে নৌকাপথে দেশ বিদেশে যাতায়াত করিত। সিপাহীরা নৌকায় চড়িয়া যুদ্ধযাত্রা করিত, বণিকেরা নৌকাযোগে বাণিজ্য ব্যাপার চালাইত, বিলাসীরা নৌকায় নৌকায় জলবিহারে বাহির হইত;—পদ্মা এবং ভাগীরথী | বহিয়া লোকে সহজেই মুর্শিদাবাদে আসিতে পারিত। মুর্শিদাবাদে কয়েকটি নগরতোরণ ভিন্ন কোন দুর্গ কি নগরপ্রাচীর ছিল না। রাজধানী নিতান্ত অরক্ষিত অবস্থাতেই পড়িয়াছিল। দেশ অরক্ষিত, প্রজা নিরপেক্ষ, জমীদারদল অসন্তুষ্ট; এরূপ অবস্থায় কেহ সাহস করিয়া সহসা আক্রমণ করিলে সহজেই কার্যসিদ্ধি হইতে পারে। সুতরাং জমীদারগণ ও জগৎশেঠ মনের মত নবাব নির্বাচন করিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। আলিবর্দ্দী যদিও সিরাজদ্দৌলাকে সিংহাসনে বসাইবেন বলিয়া পূর্বেই ঘোষণা দিয়াছিলেন, এবং সিরাজদ্দৌলা তদনুসারে ইউরোপীয়দিগের নিকটেও নজর পাইতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, তথাপি মুসলমান ইতিহাসলেখক সাইয়েদ গোলামহোসেন সে কথা স্বীকার করেন নাই। সাইয়েদ আহমদের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা থাকায় তিনি অনেক সময়ে তাহার দরবারের শোভাবর্ধন করিতেন। তিনি লিখিয়া গিয়াছেন যে, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্তও সাইয়েদ আহমদের বিশ্বাস ছিল যে, তিনিই আলিবর্দ্দীর সিংহাসনে আরোহণ করিবেন।[]তাঁহার অভাবে তাঁহার পুত্র শওকতজঙ্গ বাহাদুর পূর্ণিয়ার নবাব হইয়াছিলেন। আলিবর্দীর সিংহাসনের উপর তাহারও কিঞ্চিৎ লোভদৃষ্টি পতিত হইয়াছিল। লোকে এ সকল কথা জানিত। রাজবল্লভ অনন্যোপায় হইয়া একটি শিশুসন্তানকে সিংহাসনে বসাইবার কল্পনা করিতেছিলেন; কিন্তু এখন সকলে মিলিয়া শওকতজঙ্গকে নবাব করিবার প্রস্তাব তুলিলেন।

 অর্থব্যয় করিতে হইবে না; শরীরের রক্ত ক্ষয় করিয়া নিরন্তর শিবিরে শিবিরে মৃত্যুক্রোড় আলিঙ্গন করিবার জন্য কৃপাণহতে ছুটাছুট করিতে হইবে না, জয় পরাজয়ের উৎকট চিন্তায় ব্যাকুল-হৃদয়ে বিনিদ্রনয়নে কালপ্রতীক্ষা করিতে হইবে না; যে যেখানে আছে, যে যেরূপ ভাবে আছে, যে যেমন পদগৌরব, সম্ভোগ করিতেছে, তাহা সকলই স্থির থাকিবে,—কেবল একটি মুখের কথা বলিলেই ঘদি শওকতজঙ্গ আসিয়া সিরাজদ্দৌলার মুণ্ডচ্ছেদ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিতে অগ্রসর হন,তবে তাহাতে আর জমীদারদলের ইতস্ততঃ কি? সুতরাং সকলে সহজেই সম্মত হইলেন।

 শওকতজ বাহাদুর ইহাতে অসম্মত হইলেন না; কিন্তু তাঁঁহার প্রবীণ মন্ত্রিদল একটু ইতস্ততের মধ্যে পড়িলেন। অবশেষে তাঁঁহাদের মন্ত্রণাক্রমে দিল্লী হইতে একখানি বাদশাহী সনদ আনাইবার চেষ্টা করাই স্থির হইয়া গেল;—দিল্লীতে প্রচুর অর্থবৃষ্টি হইতে লাগিল।[]

 যাঁহারা সিরাজদ্দৌলাকে পদচ্যুত করিবার জন্য এই সকল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইতেছিলেন, তাঁহারা সকলেই শওকতজঙ্গ ও তদীয় পিতা সাইয়েদ আহমদকে বিলক্ষণরূপ চিনিতেন। সাইয়েদ আহমদ প্রথমে উড়িষ্যার শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি সেখানে উৎকলরমণীর উৎকট-সৌন্দর্য্যে আত্মবিস্মৃত হইয়া গৃহস্থ-ললনার সর্ব্বনাশ সাধনের আয়োজন করায় ধর্ম্মণীল আলিবর্দ্দী তাঁঁহাকে উড়িষ্যা হইতে দূর করিয়া দিয়াছিলেন।[] সেই সাইয়েদ আহমদের দৃষ্টান্ত ও উপদেশ পাইয়া শওকতজঙ্গ তরলহৃদয়ে সুশিক্ষালাভের অবসর পান নাই। সিরাজ বরং বিদ্যালাভ করিয়াছিলেন, সময়ে সময়ে রাজকার্য্য পরিদর্শন করিয়া রাজনীতিজ্ঞ হইয়াছিলেন, এবং আবশ্যক হইলে অসিহস্তে সম্মুখযুদ্ধে বীরের ন্যায় জীবন বিসর্জ্জন করিতেও যে কাতর নহেন, তাহারও পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন। কিন্তু শওকতজঙ্গের ইহার কোন সদগুণই ছিল না। তথাপি লোকে বাছিয়া বাছিয়া সিরাজের পরিবর্তে শওকতজঙ্গকে সিংহাসনে বসাইবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছিল কেন? ইহার একমাত্র উত্তর এই যে, দেশের জন্য বা দশের জন্য কেহই বাকুল হয় নাই, সকলেই আপন আপন স্বার্থসাধনের জন্য ব্যাকুল হইয়াছিল। সেই জন্য পাত্রপাত্র বিচার করা আবশ্যক হয় নাই। ইহারাই কালে সিরাজদ্দৌলার কলঙ্ক রটনা করিয়া আত্মপাপ ক্ষালন করিয়া গিয়াছেন![]

 নওয়াজেস এবং সাইয়েদ আহমদের মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে বিলাত হইতে সংবাদ আসিয়াছিল যে, ফরাসীরা বহুসংখ্যক রণতরী সাজাইয়া ভারতবর্ষ আক্রমণ করিতে আসিতেছেন। সংবাদ সত্য হউক, আর মিথ্যা হউক, কলিকাতার ইংরাজগণ কিন্তু সেই ধূয়া ধরিয়া দুর্গসংস্কারের জন্য বিলাত হইতে তিন চারি জন ভাল ভাল কারিগর পাঠাইবার প্রার্থনায় পত্র লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন।[১০]কর্ণেল স্কট একবার ৭৫০০০ টাকায় দুর্গসংস্কার করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন।[১১] তখন তাহা কাহারও মনঃপূত হয় নাই। এখন সকলেই তাড়াতাড়ি দুর্গসংস্করণের জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন।

 ফরাসীদিগের সহিত কলহ বিবাদের সূচনা হইবামাত্র বিলাতের কর্তৃপক্ষীয়গণ এদেশের ইংরাজদিগকে সাবধান করিয়া পত্র লিখিলেন।[১২] তাঁহাদের মতানুসারে চলিতে হইলে, কলিকাতার ইংরাজদিগকে নবাবের শরণাগত হইয়া তাঁহার আশ্রয়ে আত্মরক্ষা করিতে হইত; এবং তাহাতে নবাব সরকারের সহিত ইংরাজবণিকের কিছুমাত্র সংঘর্ষ উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা থাকিত না। কিন্তু কলিকাতার ইংরাজগণ সিরাজদ্দৌলার সাহায্য ভিক্ষার আদেশ পাইয়াও, সিরাজদ্দৌলার শত্রুদলের সহায়তা করিতে অগ্রসর হইলেন, এবং নবাবের অনুমতি না লইয়াই দুর্গ সংস্কারে হস্তক্ষেপ করিলেন।

 আলিবর্দ্দীর আর অধিকদিন বাঁচিবার আশা রহিল না।—একে বৃদ্ধকাল,তাহাতে উদরী রোগ। সুতরাং কিছুকাল চিকিৎসকের উপদেশ পালন করিয়া অবশেষে আলিবর্দ্দী, ঔষধ সেবন পরিত্যাগ করিলেন। সকলেই বুঝিল যে,জীবনপ্রদীপ আর অধিকদিন আলোকদান করিবেনা।

 আলিবর্দ্দীর শেষদিন যতই নিকট হইতে লাগিল, সিরাজদ্দৌলার ভবিষ্যদাকাশ ততই তমসাচ্ছন্ন হইয়া আসিতে লাগিল। অবশেষে এক দিন বৃদ্ধমাতামহ দৌহিত্রকে সান্ত্বনাবাক্যে আশ্বস্ত করিবার জন্য সর্ব সমক্ষে বলিতে আরম্ভ করিলেন:—

 “আমি কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে অসিহস্তে জীবনযাপন করিয়াই সংসার হইতে অবসর গ্রহণ করিলাম। কিন্তু কাহার জন্য এত যুদ্ধ বুঝিলাম, কাহার জন্যই বা কৌশলনীতিতে রাজরক্ষা করিবার জন্য প্রাণপণ করিয়া মরিলাম? তোমার জন্যই ত এত করিয়াছি।

 “আমার অভাবে তোমার কিরূপ দুর্গতি হইবে, তাহা ভাবিয়া কত রজনী জাগরণে অতিবাহিত করিয়াছি;—তুমি তাহা কিছুই জান না। আমার অভাবে, কে কি ভাবে তোমার সর্বনাশ করিতে পারে, তাহা আমার কিছুই অপরিজ্ঞাত নাই।

 “হোসেন কুলী খাঁর বিদ্যাবুদ্ধি এবং খ্যাতি প্রতিপত্তি ছিল। শওকতজঙ্গের প্রতি তাহার ঐকান্তিক অনুরাগ জন্মিয়াছিল। আজ হোসেনকুলী জীবিত থাকিলে তোমার পথ কণ্টকশূন্য হইত না। সে হোসেনকুলী আর নাই।

 “দেওয়ান মাণিকচাঁদ তোমার প্রবল শক্ত হইয়া উঠিত। সেইজন্য আমি তাহাকে রাজপ্রসাদ দানে পরিতুষ্ট করিয়া রাখিয়াছি। .

 “এখন আর কি বলিব? আমার শেষ উপদেশ শ্রবণ কর। ইউনোপীয় বণিকদিগের কিরূপ শক্তিবৃদ্ধি হইতেছে, তাহার প্রতি সর্বদাই তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখিও। তাহারাই তোমার একমাত্র আশঙ্কার স্থল।

 “পরমেশ্বর আমার এই দীর্ঘজীবনকে আরও কিছুদিন পৃথিবীতে জীবিত রাখিলে, আমিই তোমার এ আশঙ্কা নির্ম্মূল করিয়া দিতাম। কিন্তু তাহা হইল না। এ কার্য্য এখন তোমাকেই একাকী সাধন করিতে হইবে।

 “ইহারা তেলেঙ্গা প্রদেশের যুদ্ধ ব্যাপারে লিপ্ত হইয়া যেরূপ কুটিলনীতির পরিচয় দিয়াছে, তাহা দেখিয়া তোমাকে সর্বদা সতর্ক থাকিতে হইবে। ইহারা দেশের লোকের গৃহবিবাদের উপলক্ষ করিয়া সে দেশ আপনাদের মধ্যে বটিয়া লইয়া প্রজাদিগের যথাসর্বস্ব লুটিয়া লইয়াছে। ‘

 “কিন্তু সমুদায় ইউরোপীয় বণিকদিগকেই একসঙ্গে পদানত করিবার চেষ্টা করিও না। ইংরাজদিগেরই সমধিক ক্ষমতাবৃদ্ধি হইয়াছে। সে দিন তাহার আসিয়া দেশ জয় করিয়া আসিয়াছে;—তাহাদিগকেই সর্বাগ্রে দমন করি। “ইংরাজদিগকে দমন করিতে পারিলে, অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকেরা আর মাথা তুলিয়া উৎপাত করিতে সাহস পাইবে না। ইংরাজদিগকে কিছুতেই দুর্গনির্মাণ বা সেনাসংগ্রহ করিবার প্রশ্রয় দিও না;— যদি দাও, এ দেশ আর তোমার থাকিবে না।”[১৩]

 আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তৎকালে কাশিমবাজারের ইংরাজ-কুঠীতে ডাক্তার ফোর্থ নামে একজন ডাক্তার-সাহেব ছিলেন। তিনি কেবল ঔষধপত্র লইয়াই বসিয়া থাকিতেন না; আবশ্যকমত কোম্পানীর সকল প্রকার কার্য্যই সম্পাদন করিতেন। ইহাই সেকালের রীতি হইয়া দাঁড়াইয়াছিল;—আজ যিনি মাল গুদামে বসিয়া দাদনের খাতাপত্র লিখিতেছেন, কাল আবার আবশ্যক উপস্থিত হইলে, তাঁহাকেই, কালি কলম ছাড়িয়া, বন্দুকের উপর সঙ্গীণ চড়াইয়া, কোম্পানীর বাণিজ্য রক্ষার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রেও অগ্রসর হইতে হইত। এই প্রথার বশবর্তী হইয়া, ডাক্তার-সাহেব মধ্যে মধ্যে ইংরাজ পানধি সাজিয়া নবাবদরবারেও যাতায়াত করিতেন। আলিবর্দ্দী যখন নিতান্তই শয্যাশায়ী হইয়া পড়িলেন, তখন নবাবদরবারের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করিবার জন্য ডাক্তার ফোর্থকে প্রায় প্রত্যহই নবাবের নিকট গমন করিতে হইত। ইহাই তখন তাঁহার মুখ্য কর্ম্ম হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি চিকিৎসক, আলিবর্দ্দী রোগী; সুতরাং রোগীর গৃহ তাহার পক্ষে অবারিত দ্বার;—তিনি প্রায় প্রতিদিনই সেই ধূয়া ধরিয়া সেখানে গিয়া হাজির হইতেন, এবং যেদিন যাহা শুনিতেন, আনুপূর্ব্বিক বিবরণ যত্নপূর্ব্বক লিখিয়া রাখিতেন। এ স্থলে তাহার কিয়দংশ উদ্ধত করা আবশ্যক।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, রাজবল্লভের সঙ্গে কাশিমবাজারের ইংরাজদিগের ঘনিষ্ঠতা সংস্থাপিত হইয়া সেই সূত্রে কৃষ্ণবল্লভ কলিকাতায় আশ্রয়লাভ করিয়াছিলেন। রাজবল্লভ ঘসেটি বেগমের পক্ষাবলম্বী, এবং বলিতে কি, তিনিই তখন ঘসেটি বেগমের একমাত্র নিরাশয়ের আশ্রয়। সুতরাং সেই রাজবল্লভের সঙ্গে ইংরাজদিগের ঘনিষ্ঠতা দেখিয়া সিরাজদ্দৌলার দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছিল যে, ইংরাজেরাও ঘসেটি বেগমের দলভুক্ত হইয়াছেন। ইহা নিতান্ত মিথ্যা জনরব নহে। যিনিই নিরপেক্ষভাবে ইতিহাস আলোচনা করিবেন, তিনিই স্বীকার করিবেন যে, সিরাজদ্দৌলা মিছামিছি ইংরাজদিগের নামে কলঙ্ক রটনা করিবার জন্য এ কথা প্রকাশ করেন নাই;—ইংরাজ ইতিহাস লেখকও প্রকারান্তরে বলিয়া গিয়াছেন যে, “সকলেই ভাবিয়াছিল যে, আলিবর্দীর অভাবে ঘসেটি বেগমেরই আধিপত্য হইবে, সুতরাং তাহার প্রধান পার্শ্বচর ও পরামর্শদাতা রাজা রাজবল্লভকে হাতের মধ্যে রাখিবার জন্যই ইংরাজেরা কৃষ্ণবল্লভকে কলিকাতায় আশ্রয় দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।”[১৪] ডাক্তার ফোর্থ কিন্তু এ কথা অস্বীকার করিয়া সিরাজদ্দৌলাকেই কলহপ্রিয় চঞ্চল যুবক বলিয়া লোকসমাজে প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন। তিনি বলেন:—

 ‘আমি প্রতিদিন প্রাতঃকালে বৃদ্ধ নবাবকে দেখিয়া আসিতাম। মৃত্যুর একপক্ষ পূর্ব্বে একদিন তাহাকে দেখিতে গিয়াছি, এমন সময়ে সিরাজদ্দৌলা আসিয়া নিবেদন করিলেন যে, তিনি সংবাদ পাইয়াছেন, আমরা নাকি ঘসেটি বেগমের সাহায্য করিতে স্বীকৃত হইয়াছি।

 “বৃদ্ধ নবাব তৎক্ষণাৎ আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন;—‘এ কথা কি সত্য?’

 “আমি বলিলাম,—‘না, ইহা কখনই সত্য নহে। আমাদিগকে অপদস্থ করিবার প্রত্যাশায় আমাদের শত্রুপক্ষ এরূপ জনরবের সৃষ্টি করিয়া থাকিবে। ইংরাজ কোম্পানী বণিক, তাহারা সৈনিক নহে-দেশের রাষ্ট্র বিপ্লবে তাহারা যোগদান করিবে কেন? এই ত প্রায় শতাধিক বৎসর আমরা এ দেশে বাণিজ্য করিয়া আসিতেছি, আমরা ত চিরদিন কেবল বাণিজ্য সইয়াই সন্তুষ্ট রহিয়াছি; আমরা ত কখনই রাষ্ট্রবিপ্লবে কাহারও পক্ষসমর্থন করি নাই?'

 “তখন বৃদ্ধ নবাব জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তোমাদের কাশিমবাজারের কুঠী, না কেল্লা?—সেখানে কতজন সৈনিক থাকে?’

 “আমি বলিলাম, 'যাহা নিয়ম, তাহার বেশী থাকে না। কর্মচারী সমেত মোট ৪০ জন মাত্র।’

 ‘কখন কি তাহার বেশী থাকিত না?’

 ‘থাকিত। কিন্তু সে কেবল বর্গীর হাঙ্গামার সময়ে; বর্গীর হাঙ্গামা নিরস্ত হইবার পর হইতে সে সকল অতিরিক্ত সৈন্যদল কলিকাতায় চলিয়া গিয়াছে।’

 ‘তোমাদের যুদ্ধজাহাজ কোথায় থাকে?’

 ‘বোম্বাই।’

 ‘সে সকল যুদ্ধজাহাজ এ দেশে আসিবে না?’

 ‘আমি ত বলিতে পারি না;—আসিবার কোন কারণ দেখা যায় না।’

 ‘তিন মাস পূর্ব্বেয়াও তোমাদের কতকগুলি যুদ্ধজাহাজ এসেছিল না কি?’

 ‘এসেছিল। এমন দু’ একখানি জাহাজত প্রতি বৎসরেই আসিয়া থাকে;—রসদ সংগ্রহ করাই তাহার উদ্দেশ্য।’

 ‘এ প্রদেশে যুদ্ধজাহাজ আনিবার প্রয়োজন কি?’

 ‘কোম্পানীর বাণিজ্যরক্ষা এবং ফরাসীযুদ্ধের আশঙ্কা নিবারণ করাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।’

 ‘ফরাসীদিগের সঙ্গে তোমাদের আবার কি যুদ্ধ বাধিয়াছে?’

 ‘না। এখনও বাধে নাই;—শীঘ্রই বাধিবার আশঙ্কা আছে’।”[১৫]

 'এ সকল কথোপকথন ডাক্তার সাহেবের স্বহস্তলিখিত বিবরণীয় অনুবাদমাত্র। ডাক্তার ফোর্থ যে কোম্পানীর লবণের মর্যাদা রক্ষা করিতে কিছুমাত্র ইতস্তত করেন নাই, তাহার নিজের কথাই তাহার অকাট্য প্রমাণ! তিনি ইংরাজদিগকে নিরীহভার মেষশাবক বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার জন্য কত কথাই বলিয়াছিলেন। কিন্তু আমরা ইংরাজলিখিত ইতিহাসেই প্রমাণ পাইতেছি যে, ইংরাজগণ নবাবের অনুমতি না লইয়া দুর্গসংস্কারে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন; রাজবল্লভ এবং ঘসেটি বেগমের সহায়তা করিবার জন্য কৃষ্ণবল্লভকে কলিকাতায় আশ্রয় দিয়াছিলেন; নবাববাহাদুরের আশ্রয়গ্রহণ করিবার জন্য বিলাত হইতে আদেশ পাইয়াও নবাবের শত্রুপক্ষের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন; এবং ফরাসীদিগের সহিত যুদ্ধ না বাধিতেই সেই ধূয়া ধরিয়া রণসজ্জা করিতেছিলেন;—অথচ সিরাজদ্দৌলা যেমন অভিযোগ করিলেন যে, ইংরাজেরা ঘসেটি বেগমের পক্ষাবলম্বন করিতেছেন, ইংরাজ-প্রতিনিধি ফোর্থ সাহেব অমনি অবলীলাক্রমে বলিয়া উঠিলেন, “সে কি কথা” ইংরাজ ত বণিকমাত্র, তাহারা কি রাজনৈতিক কলহবিবাদে কাহারও পক্ষাবলম্বন করিতে পারে? এ সব নিশ্চয়ই কোন শত্রুপক্ষের রচা কথা।

 আলিবর্দ্দীর শেষদিন নিকট হইয়া আসিল—রোগক্লিষ্ট দুর্বল দেহ অবসন্ন হইয়া পড়িল। ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দের ৯ এপ্রিল প্রজাবৎসল শান্তস্বভাব বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দ্দী চিরশান্তির শীতল ক্রোড়ে ঘুমাইয়া পড়িলেন।[১৬]


  1. নবাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাসে এই ঘটনা ১৭৫৫ খ্রীষ্টাব্দে উল্লিখিত হইয়াছে।
  2. Sair Mutakherin.
  3. Sair Mutakherin.
  4. Orme's Indostan, ii 49
  5. এই সময়ে রাজবল্পত নিকাশ দিবার জন্যই মুর্শিদাবাদে আনীত হইয়া ছিলেন।
  6. Sair Mutakherin.
  7. Stewarts History.
  8. “Being much addicted to pleasure, he was guilty of excesses in procuring women of his harem from the inhabitants.” Stewart.
  9. শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কুচক্রী পাত্রমিত্রগণের পক্ষ সমর্থ নের জন্য এই তর্কের প্রতিবাদচ্ছলে স্বকৃত, বাঙ্গালার ইতিহাসে লিখিয়াছেন:— “সম্ভবতঃ শওকতের সমস্ত বিদ্যা বুদ্ধি মুর্শিদাবাদ দরবারে পরিজ্ঞাত ছিল না। দুরত্ব অনেক সময়ে বস্তুর সোন্দর্য্যবর্দ্ধক হইয়া থাকে বলিয়াই সইদ আহম্মদের অহম্মুখ পুত্রকে তাঁহারা প্রথমতঃ চিনিতে পারেন নাই।” (২২৮ পৃষ্ঠা) বলা বাহুল্য, এই অনুমান বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের অনুমান মাত্র-নচেৎ পাত্রমিত্রগণের পক্ষে আর কৈফিয়ৎ নাই।
  10. “We make bold to make known to Your Honors that it is highly necessary to send three or four expert Gentlemen educated in the branch of Engineering and carrying on in the most regular manner Plans of Fortifications.—Despatch to Court, 22 August, 1755.
  11. Revd. Long.
  12. Courts letter, 29 December, 1755. We must recommend it to you in the strongest manner to be as well on your guard as the nature and circumstances of your presidency will permit to defend our estate in Bengal; and, in particular, that you will do all in your power to engage the Nabab to give you his protection as the only and most effectual measure for the security of the Settlement and property.
  13. Ive's journal, আলীবর্দ্দীর অন্তিম উপদেশ ইংরাজদিগের গ্রন্থে স্বীকৃত হইলেও, নবাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাসে উহ অবিশ্বাস্য বলিয়া কথিত হইয়াছে। ইঙ্গিতে ইহাও বলা হইয়াছে যে—“আলীবর্দ্দীর কথিত উপদেশকে গ্রন্থি স্বরূপ ধরিয়া সিরাজ চরিত্র সমালোচনা করা অন্যায় হইয়াছে।” বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় মীরজাফরকে বাঁচাইবার জন্য সিরাজদ্দৌলাকে আলালের ঘরের দুলাল সাজাইতে গিয়া আলীবর্দ্দীর উপদেশ অবিশ্বাস করিতে বাধ্য;—যাহাদের সেরুপ বাধ্য রাধকতা নাই, তাহারা অবিশ্বাস করিবেন কেন?
  14. There remained no hopes of Aliverdy's recovery; upon which the widow of Nowagis had quitted Muxadabad and encamped with 10000 men at Moota Gill, a garden two miles south of the city, and many now began to think and to say that she would prevail in her opposition against Surajo Dowla. Mr. Watts therefore was easily induced to oblige her minister and advised the presidency to comply with his request. - Urme's Indostan, ii, 50.
  15. Ive's Journal.
  16. Aliverdi Khan, the ablest of all the Nababs, is buried at Khusbagh, on the west side of the river, and opposite Motijhil. · H. Beveridge C. S,