সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়)/সিরাজের যৌবরাজ্যাভিষেক


পঞ্চম পরিচ্ছেদ।


সিরাজের যৌবরাজ্যাভিষেক।

 বাঙ্গালা দেশ যখন বগীর হাঙ্গামায় নিতান্ত ব্যতিব্যস্ত, দিল্লীর বাদ- শাহ তখন একেবারেই শক্তিহীন হইয়া পড়িয়াছিলেন। ১৭৪৬ খৃষ্টাব্দে আহমদশাহ আবদালী দিল্লী লুণ্ঠন করিয়া স্বদেশে প্রত্যাগমন করেন। ১৭৪৭ খৃষ্টাব্দে বাদশাহ মোহম্মদশাহার মৃত্যু হয়। সেই হইতে দিল্লীর প্রবল প্রতাপ একেবারেই বিলুপ্ত হইয়া গেল![১]

 সময় বুঝিয়া কেবল মাহারাষ্ট্রদলই যে স্বাধীন রাজ্য সংস্থাপনের চেষ্টা করিতেছিলেন তাহা নহে; যাঁহারা দিল্লীর বিশ্বাসভাজন মুসলমান অমাত্য, তাঁহারাও স্বাধীনতা লাভের আয়োজন করিতেছিলেন।[২] মুসলমান জায়গীরদারগণ কর প্রদান করিতে অসম্মত, কেমন করিয়া স্বাধীনতালাভ করিবেন, তাহার জন্য সর্ব্বদাই উদগ্রীব। চতুর আলিবর্দ্দী তাঁহাদিগের ভাবগতিক বুঝিতে পারিয়া একে একে সকলকেই রাজকার্য্য হইতে অপসৃত করিয়াছিলেন।

 এইরূপে সমসের খাঁ ও সরদার খাঁ নামক দুইজন আফগান বীর পদচ্যুত হইয়া দ্বারভাঙ্গা প্রদেশে জায়গীর লইয়া বাস করিতে আরম্ভ করেন। হাজি আহ্‌মদ ও জয়েনউদ্দীনের উপর পাটনার শাসনভার অর্পিত থাকায়, নবাব আলিবর্দ্দী আর আফগান জায়গীরদারদিগের কোন সংবাদ লইতেন না। জয়েনউদ্দীন তাঁহাদিগকে ক্রমে ক্রমে বশীভূত ও পক্ষভুক্ত করিবার আশায় পাটনায় নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইলেন। ইহাতে হিতে বিপরীত হইল। আফগানগণ বশ্যতা স্বীকার করিয়া নজর দিবার উপলক্ষ করিয়া পাটনায় প্রৱেশ করিল; দরবারে আসিয়া যথাযোগ্য সমাদরে জয়েনউদ্দীনের নিকট অবনত হইয়া জানু পাতিয়া উপবেশন করিল; এবং নজর দিবার ছল করিয়া সহসা বীরবিক্রমে সকলে মিলিয়া আক্রমণ করিল! জয়েনউদ্দীন অসি কোষমুক্ত করিবার জন্য চেষ্টা করিবারও অবসর পাইলেন না; তাঁহার ছিন্নমুণ্ড মস্‌নদের উপর লুটাইয়া পড়িল! হাজি আহ্‌মদ বন্দী হইলেন। সপ্তদশ দিন নিদারুণ উৎপীড়ন সহ্য করিয়া অবশেষে ভগ্নহৃদয়ে বন্দীশালায় প্রাণ পরিত্যাগ করিলেন; সিরাজদ্দৌলার মাতা আমিনা বেগম আফগান-শিবিরে বন্দিনী হইলেন![৩]

 সংবাদ পাইয়া আলিবর্দ্দী একেবারে মর্ম্মাহত হইয়া পড়িলেন। শোকের অবরুদ্ধ কণ্ঠোচ্ছ্বাস নিবারণ করিয়া দুহিতার আয়োজন করিতে লাগিলেন। পদচ্যুত ও পদগৌরবান্বিত সমুদায় সেনাপতিদিগকে সম্মিলিত করিয়া আলিবর্দী যখন করুণ বিলাপে এই শোক-কাহিনী বর্ণনা করিতে আরম্ভ করিলেন, তখন সকলেই একে কোরাণ স্পর্শ করিয়া অসিহস্তে তাঁহার সঙ্গে প্রাণ-বিসর্জ্জন করিবার জন্য শপথ করিলেন। এই উপলক্ষে কলহ বিবাদ মিটিয়া গেল। মীরজাফর পুনরায় সেনাপতিপদে নিযুক্ত হইলে, আতাউল্লাও অসিহস্তে নবাবের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইতে ত্রুটি করিলেন না। আতাউল্লার সঙ্গে হাজি অহ্‌মদের কন্যার বিবাহ হইয়াছিল, আতাউল্লার কন্যার সঙ্গে সিরাজদ্দৌলার বিবাহের প্রস্তাব চলিতে ছিল সুতরাং আতাউল্লাও একজন ঘনিষ্ঠ কুটুম্ব।

 আলিবর্দ্দী গতানুশোচনা পরিত্যাগ করিয়া পাটনাভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করিবেন, ঠিক সেই সময়ে উড়িষ্যাপ্রান্তে মহারাষ্ট্রীয়দিগের বিজয় ভেরী বাজিয়া উঠিল। এরপর আর আলিবর্দ্দী বর্গীর হাঙ্গামার গতিরোধ করিতে অগ্রসর হইতে পারলেন না। রাজধানীর গমনাগমনপথ রক্ষা করিবার জন্য সাইয়েদ অহ্‌মদকে ভগবানগোলায় পাঠাইয়া দিলেন; নওয়াজেস্‌ এবং আতাউল্লার অধীনে পাঁচ সহস্র সৈন্য রাখিয়া তাহাদের উপর রাজধানী রক্ষার ভারার্পণ করিলেন; এবং চারিদিকে ঘোষণা দিলেন যে, এবার প্রজার ধন প্রাণ রক্ষার ভার তাহাদের উপর, তাহাদের শক্তি এবং সাহস থাকে, তাহারা বাহুবলে আত্মরক্ষা করিবে, না পারে প্রাণ লইয়া পলায়ন করিবে।” লোকে যে যেখানে সুবিধা পাইল, পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল![৪]

 সিরাজদ্দৌলা বালক হইলেও এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় অতিমাত্র ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। পিতা এবং পিতামহ উভয়েই শত্রু হস্তে নিহত, মাতা বন্দিনী, সিরাজদ্দৌলা নীরবে এই সকল সংবাদ সহ্য করিতে পারিলেন না; অসিহস্তে মাতামহের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সিরাজ বালক হইলেও বীরবালক, নবাব তাঁহাকে সঙ্গে লইয়াই যুদ্ধযাত্রা করিলেন।

 ইংরাজের ইতিহাসে সিরাজদ্দৌলা কেবল ইন্দ্রিয়পরায়ণ, অকর্ম্মণ্য, জঘন্য রুচির চঞ্চল যুবক বলিয়াই পরিচিত।[৫] কিন্তু সিরাজদ্দৌলা স্বয়ং অসিহস্তে যতবার সম্মুখ যুদ্ধে অগ্রসর হইয়াছেন, বিপদের সংবাদ পাইয়া যতবার ক্ষিগ্রহস্তে অসিচালনা করিয়াছেন, আলীবর্দ্দী ভিন্ন আর কোন নবাবই সেরূপ দৃষ্টান্ত দেখাইয়া যাইতে পারেন নাই। সিরাজদ্দৌলার জীবনে ইহাই প্রথম যুদ্ধযাত্রা নহে। তিনি আশৈশব মাতামহের কণ্ঠালগ্ন হইয়া প্রায় প্রত্যেক যুদ্ধেই শিবিরে পরিভ্রমণ করিতেন। বর্দ্ধমানের নিকট মহারাষ্ট্র সেনা যে সময়ে সদর্পে আলিবর্দ্দীর গতিরোধ করে, তখন সিরাজ নিতান্ত বালক। কিন্তু সেই সময় হইতেই তাঁহাকে নবাব-শিবিরে দেখিতে পাওয়া যায়।[৬] তাহার পর প্রায় প্রতি বর্ষেই বর্গীর হাঙ্গামার ইতিহাসের সঙ্গে সিরাজের রণশিক্ষার ইতিহাস সংযুক্ত হইয়া রহিয়াছে। কখন মাতামহের আজ্ঞাবহ হইয়া, কখন বা রাজাজ্ঞায় স্বয়ং সেনাচালনার ভার গ্রহণ করিয়া, এই বীরবালক যে সকল সমরকৌশলের পরিচয় প্রদান করেন, বড়বাটীর দুর্গজয়-কাহিনী বর্ণনা করিবার সময়ে মুসলমান ইতিহাস লেখক তাহার সমুচিত প্রশংসা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাকে রণপণ্ডিত করিবেন বলিয়াই আলিবর্দ্দী শৈশবে সেনাচালনার ভার প্রদান করিয়াছিলেন।[৭] এই সকল ঐতিহাসিক প্রমাণের উল্লেখ করিয়াও নবাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাসলেখক লিখিয়াছেনঃ- “অন্য শিক্ষার অভাব হইলেও, যুদ্ধ শিক্ষায় সিরাজের সবিশেষ সুবিধা ছিল; উচ্ছল সিরাজ, এ সুযোগেরও সদ্ব্যবহার করিতে পারেন নাই। সচরাচর প্রচলিত ইতিহাসে সিরাজ রণভীরু বলিয়া কলঙ্কিত। সে কলঙ্কের প্রমাণাভাব। তথাপি প্রচলিত কলঙ্কের সমর্থন বাসনায় বাঙ্গালী ইতিহাসলেখক মানবলে যাহা লিখিয়াছেন, তাহার বিস্তৃত সমালোচনা অনাবশ্যক।

 বিদ্রোহী আফগানগণ বিহার অঞ্চল লুণ্ঠন করিয়া পাটনার ধনাঢ্য অধিবামীদিগের, লাঞ্ছনার একশেষ করিয়া যথাশক্তি নজর আদায় করিয়া লইল এবং জয়েনউদ্দীনের রাজকোষ হস্তগত করিয়া সৈন্যবল বৃদ্ধি করিতে আরম্ভ করিল; আলিবর্দ্দী সসৈন্যে যুদ্ধযালা করিয়াছেন। সংবাদ পাইবামাত্র বিদ্রোহিদল স্বপক্ষ সবল করিবার আশায় মহারাষ্ট্র দিগকে আহ্বান করিতে লাগিল। মহারাষ্ট্রসেনাও লাভের গন্ধ পাইয়া আনলে পাটনা অঞ্চলে ধাবিত হইল। আলিবর্দ্দী ধরিত- গমনে ভাগলপুরের নিকটে মহারাষ্ট্রদলকে আক্রমণ করিলেন। তাহারা সম্মুখ যুদ্ধ চাহে না; তাড়া পাইয়া বনপথে পলায়ন করিতে ত্রুটি করিল না। আলিবর্দ্দী সসৈন্যে মুঙ্গেরে আসিয়া উপনীত হইলেন।

 এইখানে আসিয়া এক গুপ্তচর ধরা পড়িল। তাহার বস্ত্রাভ্যন্তরে একখানি পত্র বাহির হইল। সেই পত্রে বিশ্বাসঘাতক আতাউল্লা আফগানদিগকে মনের কথা খুলিয়া লিখিয়াছেন! সুযোগ পাইলে তিনিও যে বিদ্রোহিদলে যোগদান করিবেন, তাহার প্রস্তাব করিয়াছেন। সিরাজদ্দৌলা এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় পাইয়া একেবারে ক্রোধোন্মত্ত হইয়া উঠিলেন। বহুদর্শী বৃদ্ধ নাবাব আশু তাহার কোনরূপ প্রতিকার না করিয়া, কন্যার বন্ধনমোচন করিবার জন্যই অগ্রসর হইতে লাগিলেন। দ্বারভাঙ্গা প্রদেশের যে সকল হিন্দু জমীদার আফগানদিগের অত্যাচারে জর্জ্জরিত হইতেছিলেন, তাঁহারা মুঙ্গেরে আসিয়া আলিবর্দ্দীর সঙ্গে মিলিত হইলেন। তাঁহাদের মুখে আলিবর্দ্দী সংবাদ পাইলেন যে, বিদ্রোহীদল পাটনা ছাড়িয়া বাঢ় নামক স্থানে শিবির-সন্নিবেশ করিয়াছে।

 আলিবর্দ্দী বাঢ়ের বিস্তৃত ক্ষেত্রে শত্রুসেনার সম্মুখীন হইলেন। তানোজির আজ্ঞাধীন মহারষ্ট্রীয় সৈন্যদল ইতিপূর্ব্বে সেখানে উপস্থিত হইয়াছিল। তাহারা প্রকাশ্যে আফগানদিগের সহায়তা করিতে সম্মত হইয়া, গোপনে গোপনে উভয় দলেরই শিবির লুণ্ঠন করিবার সংকল্প করিয়াছিল। আলিবর্দ্দী কালক্ষয় না করিয়া আফগান শিবির আক্রমণ করিলেন।

 যুদ্ধের প্রথম উপক্রমেই সরদার খাঁ নিহত হইলেন। তাঁহার ছত্রভঙ্গ সৈন্যদল প্রাণভয়ে চারিদিকে পলায়ন করিতেছে। তাহাদিগকে আবার সমরক্ষেত্রে সমবেত করিবার জন্য সমসের খাঁ সসৈন্যে অগ্রসর হইয়েছেন। আলিবর্দ্দী উভয় সেনাদলকে বামে দক্ষিণে যুগপৎ আক্রমণ করিয়া বীরদর্পে ছুটিয়া চলিয়াছেন, চারিদিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে খণ্ড যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে, এমন সময়ে সুযোগ বুঝিয়া চতুর মহারাষ্ট্রদল নবাবসেনাদলকে আক্রমণ করিবার জন্য অগ্রসর হইতে লাগিল। সম্মুখে প্রবল আফগানদল, পার্শ্বে লুণ্ঠন লোলুপ মহারাষ্ট্র সেনা;—কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য না করিয়া আলিবর্দ্দী ক্ষিপ্তের ন্যায় কেবল সম্মুখেই অগ্রসর হইতেছেন। সিরাজদ্দৌলা বালক, প্রবীণ রণপণ্ডিত আলিবর্দ্দীর তুলনায় শিশু অপেক্ষাও অশিক্ষিত; কিন্তু তিনি এই ভ্রম ধরিয়া ফেলিলেন। মাতামহের অনুমতি লইয়া মহারাষ্ট্রদলকে আক্রমণ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। আলিবর্দ্দী সে কথায় কর্ণপাত করিলেন না; কেবল সম্মুখের দিকেই অগ্রসর হইতে লাগিলেন।

 উভয় সৈন্যের তুমুল সংঘর্ষে যুদ্ধ-কোলাহলে শত্রুমিত্র মহাসমরে মিশিয়া গেল। সেই গোলোযোগে সমসের খাঁ নিজ সৈন্যের গতিরোধ করিতে পারিলেন না। কে কোথায় ছিটকাইয়া পড়িতে লাগিল; অবশেষে সমসের খাঁ একাকী শত্রুমধ্যে পতিত হইলেন। হবিববেগ নামক একজন সেনানায়ক সুযোগ পাইয়া একলম্ফে সমসেরের মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন; কবন্ধদেহ হস্তীপৃষ্ঠ হইতে ভুমিতলে লুটাইয়া পড়িল। সমসেরের ছিন্নমুণ্ড লইয়া হবিববেগ আলিবর্দ্দীর হস্তে উপহার প্রদান করিলেন। আর যুদ্ধ করিতে হইল না, আফগান সৈন্য পলায়ন করিল, মহারাষ্ট্রদল দূরে সরিয়া দাঁড়াইল। আলিবর্দ্দী রুধিরচর্চ্চিত রণক্ষেত্রে অসিহস্তে চাহিয়া দেখিলেন, যুদ্ধজয় সমাধা হইয়াছে। ঘটনাচক্রে সমসের খাঁ নিহত হওয়াতেই যুদ্ধজয় হইল। কিন্তু যদি ঘটনাচক্র অন্যভাবে পরিবর্ত্তিত হইত, তবে সিরাজদ্দৌলার পরামর্শ উপেক্ষা করিবার জন্য আলিবর্দ্দী অনুশোচনা করিবার অবসর পাইতেন কি না, কে বলিতে পারে?

 যুদ্ধাবসানে কন্যার বন্ধন মোচন করিয়া আলিবর্দ্দী বিহার প্রদেশে শান্তিস্থাপন করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। পরাজিত বিদ্রোহীদল নানাস্থানে পলায়ন করিল, লোকে আবার নিরুদ্বেগে সংসার-কার্য্যে মনোনিবেশ করিতে লাগিল; পূর্ণিয়া প্রদেশেও শান্তি সংস্থাপিত আলিবর্দ্দী তখন মহাসমারোহে দরবার করিয়া সাইয়েদ আহ্‌মদকে পূণিয়ার এবং সিরাজদ্দৌলাকে পাটনার নবাব নিযুক্ত করিলেন। সাইয়েদ আহ্‌মদ পূর্ণিয়ায় গমন করিলেন। কিন্তু সিরাজদ্দৌলা বালক বলিয়া রাজা জানকীরাম বিহারের রাজপ্রতিনিধি হইলেন; সিরাজদ্দৌলা বিহারের নামসর্ব্বস্ব নবাব হইয়া মাতামহের সঙ্গে রাজধানীতে ফিরিয়া আসিলেন।

 “রাজা জানকীরাম বঙ্গীয় দক্ষিণরাঢ়ী কায়স্থ। ইনি বাঙ্গালা হইতে দেওয়ান হইয়া আলিবর্দ্দীর নায়েবী আমলে পাটনায় গমন করেন। নাজিম হইয়া আলিবর্দ্দী খাঁ ইঁহাকে প্রথমতঃ দেওয়ান-ই-তন্‌ ও সামরিক বিভাগের প্রধান মন্ত্রিত্বপদে নিযুক্ত করেন। দুর্দ্দান্ত মহারাষ্ট্র কটকের আক্রমণে বিতাড়িত আলিবর্দ্দীর কটক হইতে প্রত্যাবর্ত্তনের সময়, ইনি নবাবের সমভিব্যাহারে ছিলেন। পরে স্বকীয় অর্থদ্বারা নবাবের সৈন্যসংগ্রহাদি কার্য্যের সহায়তা করেন। প্রকৃত পক্ষে ইনিই প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। সম্পূর্ণ বিশ্বাসভাজন বলিয়া মহারাষ্ট্রীয় সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের প্রাণবধের কল্পনা প্রধান সেনাপতি মুস্তাফা খাঁ ভিন্ন কেবল ইঁহারই নিকট পূর্ব্বে প্রকাশিত হইয়াছিল। * * * অতঃপর রাজা জানকীরামের প্রভুত্ব এত হইয়াছিল যে, নবাবের ভ্রাতুষ্পুত্রেরাও কোনও বিষয়ে দরবার করিতে হইলে মন্ত্রিবরের সাহায্য প্রার্থনা করিতেন। পাটনার ডেপুটি সুবাদার সিরাজের পিতা জয়েনউদ্দীনের মৃত্যুর পর, ঐ পদে সিরাজকে নাম মাত্র নিযুক্ত করিয়া, প্রকৃত প্রস্তাবে রাজা জানকীরামকেই প্রতিনিধি শাসনকর্ত্তা করিয়া রাখা হয়।”[৮]

 লুণ্ঠনপরায়ণ মহারাষ্ট্রদলকে হাতের কাছে পাইয়াও আক্রমণ করা হইল না, আতাউল্লার বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় পাইয়াও তাঁহাকে সসৈন্যে ধনসম্পদ লইয়া স্থানান্তরে চলিয়া যাইবার অনুমতি দেওয়া হইল, মীরজাফরের ন্যায় বিশ্বাসী কুটুম্বকে সমুচিত শিক্ষা না দিয়া তাঁহাকে সেনাপতিপদে বাহাল রাখা হইল, এতকষ্টে বিহার প্রদেশে শান্তি সংস্থাপন করিয়া রাজা জানকীরামকে তাহার ফলভোগ করিতে দিয়া সিরাজদ্দৌলাকে কে নামসর্ব্বস্ব পাটনার নবাব বলিয়া ঘোষণা করা হইল,—ইহার কোন ব্যবস্থাই সিরাজদ্দৌলার মনঃপূত হইল না। তিনি প্রতিবাদ করিয়াও যখন আলিবর্দ্দির মত পরিবর্ত্তন করিতে পারিলেন না, তখন মাতামহের উপর নিতান্ত অসন্তুষ্ট হইয়া ক্ষুণ্নমনেই রাজধানীতে প্রত্যাগমন করিলেন।

 ইহার পর একবৎসর একরূপ নিরাপদে কাটিতে না কাটিতেই আবার উড়িষ্যাপ্রদেশে মহারাষ্ট্রসেনার সমর-কোলাহল উপস্থিত হইল! সংবাদ পাইবামাত্র মুর্শিদাবাদ হইতে ছুটিয়া যাওয়া সহজ নহে, সুতরাং আলিবর্দ্দী এইবার হইতে মেদিনীপুরে বাসস্থান নির্ম্মাণ করিরার আয়োজন করিলেন। মহারাষ্ট্রীয়দিগকে পরাজয় করিয়া আসিয়া, এবার কিছু দিন মেদিনীপুরেই অবস্থান করিতে আরম্ভ করিলে সিরাজ মাতামহের অনুমতি লইয়া মুর্শিদাবাদে প্রত্যাগমন করিলেন।[৯]

 সিরাজ বুঝিলেন যে, এইবার সুসময় উপস্থিত। পূর্ণিয়ার বিস্তৃত জনপদে সাইয়েদ আহ্‌মদ নবাবী করিতেছেন, ঢাকার বিপুল রাজভাণ্ডার হাতে পাইয়া নওয়াজেস্ এবং রাজবল্লভ মুক্তহস্তে অর্থব্যয় করিতেছেন, যাঁহারা বিদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক তাঁহারাও পরম সুখে পদগৌরব উপভোগ করিতেছেন; কেবল সিরাজদ্দৌলাই বিহারের নবাব হইয়াও মাসিক বৃত্তির নির্দিষ্ট তঙ্কা লইয়া রজধানীতে বসিয়া আলস্যে জীবন যাপন করিবেন কেন? তিনি আর এমন করিয়া আপন স্বার্থ পদদলিত করিতে সম্মত হইলেন না। পিতা নাই, তিনি বিহারে সিংহাসনে বসিয়া যে প্রভূত ধনরত্ন সঞ্চয় করিয়াছিলেন, তাহাও আফগানগণ লুটিয়া লইয়াছে, আজ কাল বিহারে যাহা কিছু আয় হইতেছে, তাহাও কেবল জানকীরামেরই সৌভাগ্য বর্দ্ধন করিতেছে। সিরাজদ্দৌলার চক্ষে ইহা বড়ই অবিচার বলিয়া বোধ হইল। তিনি বিশ্বাসী অনুচর লইয়া দেশভ্রমণ উপলক্ষে মুর্শিদাবাদ হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন।[১০] মাতামহ মেদিনীপুরে, সুতরাং কেহ আর সাহস করিয়া সিরাজদ্দৌলার গতিরোধ করিল না।

 পাটনায় আসিয়াই সিরাজদ্দৌলা ছদ্মবেশ খুলিয়া ফেলিলেন, রাজা জানকীরামকে স্পষ্টই বলিয়া পাঠাইলেন যে, তিনি রাজপ্রতিনিধি মাত্র,

সিরাজই পাটনার প্রকৃত নবাব। এতদিন নিজরাজ্যের কোনই সংবাদ লন নাই, কিন্তু রাজা এখন সশরীরে সিংহদ্বারে শুভাগমন করিয়াছেন। জানকীরামের বিষম সমস্যা উপস্থিত হইল। নবাবের অনুমতি লইয়া সিরাজদ্দৌলাকে শাসনভার ছাড়িয়া দিতে সাহস হইল না। সিরাজদ্দৌলার আদেশ অবহেলা করিতেও সাহস হইল না। অনেক ইতস্ততঃ করিয়া জানকীরাম নবাবের নিকট সংবাদ পাঠাইয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন।[১১]

 জানকীরাম ভৃত্য হইয়া প্রভুর সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করিতে সাহস পাইবেন, তাহা সিরাজদ্দৌলার ধারণা ছিল না; তিনি একে বারে ক্রোধে উন্মত্ত হইয়া উঠিলেন। সিরাজ বিহারের নবাব; রাজধানী, রাজদুর্গ, রাজকোষ সকলই তাঁহার। জানকীরাম কে? তিনিত কেবল তাঁহারই প্রতিনিধি। তবে কোন্ সাহসে তিনি প্রভুর সম্মুখে দুর্গদ্বার অবরুদ্ধ করিয়া দিলেন? তবে কি তাঁহাকে নামমাত্র বিহারের নবাব বলিয়া মৌখিক ঘোষণা দেওয়া হইয়াছে? অবশ্য তাহাই নবাবের আদেশ; নবাবের আদেশ না থাকিলে জানকীরাম কে, যে সে তাঁহাকে এমন করিয়া অপমান করিতে সাহস পাইবে। সিরাজের অদম্য হৃদয়বেগ এত অপমান সহ্য করিতে পারিল না; তিনি আত্মসম্বরণ করিতে না পারিয়া বাহুবলে পিতৃ-সিংহাসন অধিকার করিবার জন্য দুর্গদ্বারে গোলাবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন।

 আলিবর্দ্দী যদি সংবাদ পাইবামাত্র দুর্গদ্বার উন্মোচন করিবার জন্য জানকীরামকে আদেশ করিয়া পাঠাইতেন, হয়ত সহজেই সকল গোল- যোগ মিটিয়া যাইত। তিনি তাহা না করিয়া সিরাজদ্দৌলাকে স্নেহের উপদেশসূচক এক দীর্ঘ পত্র লিখিয়া পাঠাইলেন এবং রাজধানীতে প্রত্যাগমন করিবার জন্য বারংবার অনুরোধ জানাইতে লাগিলেন। সিরাজের ক্রোধাগ্নি আরও দ্বিগুণবেগে জ্বলিয়া উঠিল!

 সিরাজদ্দৌলা আর স্বার্থ নষ্ট করিয়া নবাবের হাতের ক্রীড়া- পুত্তল হইয়া বসিয়া থাকিতে সম্মত নহেন। কবে নবাবের পক্ককেশ চিরবিশ্রাম লাভ করিবে, আর কবে বা তিনি নবীন মস্তকে রাজ- মুকুট পরিয়া বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার মস্‌নদে উপবেশন করিবেন,— সেই অনিশ্চিত শুভদিনের প্রতীক্ষায় সুনিশ্চিত পৈতৃক-সিংহাসন পরিত্যাগ করিতে পারেন না! আলিবর্দ্দী সকলকেই যথাযোগ্য রাজ- পদ দিয়াছেন, কেবল শূন্যগর্ভ স্তোকবাক্যে সিরাজদ্দৌলাকেই পিতৃ- রাজ্য হইতে বঞ্চিত রাখিবেন কেন? তিনি যখন বিহারের নবাব, তখন যেরূপে হউক আত্মরাজ্য অধিকার করিবেন; তাহাতে যেন বৃদ্ধ নবাব বাধা প্রদান করিবার চেষ্টা না করেন। রাজ্য বহুবিস্তৃত; বাহুতে বহু বল; সুতরাং আবশ্যক হইলে মাতামহের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষা করিতেও দৌহিত্র কাতর হইবেন না; হয় উভয়েই অসি- হস্তে জীবন বিসর্জ্জন করিবেন, না হয় যাঁহার জয় হইবে, তিনি নিরুদ্বেগে রাজ্যভোগ করিবেন। এইরূপ সংকল্প করিয়া সিরাজদ্দৌলা লিখিলেন;—

 “জোনাব আলি! বা ওজুদ্ এজ্‌হার ইস্ কাদার মেহের্ ও সাফ্‌কাৎকে মেরে দুষমানোকে দার্‌পার্ পার্‌ওয়ারাস হেঁয়। আজা জুম্‌লা হোসেন কুলিখাঁ কো উয়াহ্ মার্‌তাবা এজ্জাৎ ও সার্‌ওয়ারী দিয়া কে মুঝে জেল্লাৎ হায় কে বারওয়াক্ত মা-বেদাৎ বারদোয়ান্‌কে মেরে এস্তেক্‌বাল্‌কো এক কাদাম্‌ভি না বাঢ়া! আওর সাহামাৎজাঙ্গকো বেলায়েৎ আহাদ্ দে কার্ সাওলাৎ জাঙ্গকো পুর্‌ণীয়াকি ফৌজদারী আতা ফার্‌মায়ী। মেরে হাল্ পার্ বজুজ এনায়াৎ জোবানিকে কোই সেফাক্কাৎ ও নাওয়াজেস্‌ জো এজ্‌দিয়াদ্ মান্‌সাব আওর্ এক্ তেদার্ কে লায়েক হো না হই; হালা হারগেজ তাস্‌রিফ নালাইয়েগা ওয়ার্‌না আপকা শের মেরে দামান্‌মে ইয়াকে মেরী শের্ আপ কে জের্ পায়্ ফিল হোগা!”[১২]

 পত্র পড়িয়া আমরা একালের লোক একেবারে শিহরিয়া উঠিতে পারি; অকৃতজ্ঞ, নরাধম পশুপ্রকৃতি বলিয়া অভিধান বাছিয়া— সিরাজদ্দৌলাকে অভিসম্পাত করিতে পারি, আবশ্যক হইলে উপন্যাস লিখিয়া বসুন্ধরাকে দ্বিধা বিভক্ত হইবার জন্য নির্ব্বন্ধাতিশয়ে অনুরোধ জানাইতে পারি; আলিবর্দ্দী ইহার কিছুই করিলেন না।

 দোষ কাহার? সিরাজদ্দৌলার কথা দুরে থাকুক, প্রবীণ আলিবর্দ্দীকে কোন রাজপ্রতিনিধি এরূপ করিয়া অপমান করিলে তিনিও কি তাহা নীরবে সহ্য করিতেন? সুতরাং আলিবর্দ্দী সিরাজের উপর অসন্তুষ্ট হইলেন না, কেবল পাছে যুদ্ধকলহে সিরাজের কোন অকল্যাণ হয়, সেই চিন্তাতেই ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। মহারাষ্ট্রদমন পড়িয়া থাকিল, রাজ্য ও রাজধানীর চিন্তা পড়িয়া থাকিল, অল্প কয়েকজনমাত্র অনুচর লইয়া আলিবর্দ্দী পাটনাভিমুখে ছুটিয়া চলিলেন। সিরাজের উদ্ধৃত লিপির প্রত্যুত্তরে যাহা লিখিত হইল, তাহার নিম্নে আলিবর্দ্দী স্বহস্তে একটা ফারশী কবিতায় কেবল এইমাত্র লিখিয়া পাঠাইলেন যে, “যাহারা ধর্ম্মের জন্য সম্মুখ সংগ্রামে জীবন বিসর্জ্জন করিতে অগ্রসর হয়, তাহারা প্রায়ই ভুলিয়া যায় যে, যাহারা সংসার সংগ্রামে স্নেহের অত্যাচার সহ্য করে, তাহারাই প্রকৃত বীর! ইহাদের মধ্যে পরকালেও তুলনা হইতে পারে না; ধর্ম্মবীর শত্রুহস্তে নিহত হন, কিন্তু সংসারবীর কেবল স্নেহভাজন আত্মীয়গণের নির্য্যাতনেই জীবন বিসর্জ্জন করেন!”[১৩]

 সিরাজদ্দৌলা অনেক গোলাবর্ষণ করিয়াও দুর্গজয় করিতে পারিলেন না। তাঁহার প্রধান সেনাপতি মেহেদী নেশার খাঁ[১৪] নিহত হইতে না হইতেই অশিক্ষিত সৈন্যদল পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল! সিরাজ তখন রোষে ক্ষোভে জর্জ্জরিত হইয়া একখানি পর্ণকুটীরে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। রাজা জানকীরাম সংবাদ পাইবামাত্র তাঁহার জন্য যথোপযুক্ত বাসস্থান নির্দ্দেশ করিয়া দিলেন; কিন্তু তথাপি দুর্গদ্বার উন্মোচন করিলেন না।

 সিরাজ পঞ্চদশ বৎসরের তরুণ যুবক। পলায়িত দুর্ব্বল শত্রুর প্রতি রাজা জানকীরাম এরূপ সদয় ব্যবহার করিতেছেন কেন, সে কথা কেহ বুঝাইতে পারিল না; বরং সকলে মিলিয়া বুঝাইয়া দিল যে, জানকীরাম ভয় পাইয়া সন্ধির প্রস্তাব করিবার জন্যই এরূপ ব্যবহার করিতেছেন। সুতরাং সিরাজদ্দৌলা সসৈন্যে দুর্গবেষ্টন করিয়া বসিয়া রহিলেন।

 নবাব আসিলেন। তাঁহার আগমনবার্ত্তা জানিতে পারিয়া সিরাজ তাঁহার নিকট উপনীত হইলেন।[১৫] সিরাজদ্দৌলাকে একাকী নিরস্ত্রদেহে সহসা শিবিরের মধ্যে প্রবেশ করিতে দেখিয়া নবাব তাঁহাকে একেবারে স্নেহের কোলে তুলিয়া লইলেন; দুই গণ্ড বহিয়া স্নেহের অশ্রুধারা ঢালিয়া পড়িল; সিরাজকে যে অক্ষতদেহে জীবিত পাইয়াছেন, ইহাতেই বৃদ্ধ মাতামহ আনন্দে উন্মত্তের মত নৃত্য করিতে লাগিলেন। মাতামহে দৌহিত্রে আর শক্তিপরীক্ষা হইতে পারিল না, অশ্রুধারায় অশ্রুধারা টানিয়া আনিল, উভয়ের অশ্রুধারায় সে ছার বিদ্রোহ কোথায় ভাসিয়া গেল!

 নবাব আসিয়াছেন শুনিয়া দুর্গদ্বার উন্মুক্ত হইল, মহাকলরবে সিরাজসৈন্য দুর্গমধ্যে প্রকাশ করিল। আলিবর্দ্দী পাটনার দুর্গমধ্যে দরবারে উপবেশন করিলেন, সিংহাসনের একপার্শ্বে স্নেহভাজন দৌহিত্রকে উঠাইয়া লইলেন, এবং সকলকে শুনাইয়া দিলেন যে, আজ হইতে সিরাজদ্দৌলা বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইলেন।[১৬]

 সিরাজদ্দৌলা সন্তুষ্ট হইলেন, কিন্তু দেশের লোকে সন্তুষ্ট হইতে পারিল না। যাহারা নানা উপায়ে অর্থোপার্জ্জন করিত, যাহারা গোপনে গোপনে সিংহাসন কাড়িয়া লইবার আয়োজন করিত, যাহারা রাজকর্ম্মচারী হইয়াও রাজবিদ্রোহিতার পরিচয় দিত, যাহারা বিদেশীয় বণিক হইয়াও দেশের লোকের মুখের গ্রাস কাড়িয়া খাইত, তাহারা যখন একে একে এই সংবাদ অবগত হইল, তখন সকলেই একে একে স্বার্থরক্ষার জন্য চিন্তিত হইয়া উঠিল!


  1. Thornton's History of British Empire, Vol. I.
  2. Chesney's Indian Polity.
  3. Stewart's History of Bengal.
  4. Stewart's History of Bengal.
  5. “His intellect was feeble, his habits low and depraved, his propencities vicious in the extreme.”—Thornton's History of British Empire, Vol. I.
  6. Mustafa's Mutakherin, vol. I. 416.
  7. His intention in this was to accustom the young man, face an enemy and to command troops.—Mustafa's Mutakheri vol. I 606.
  8. সাহিত্য, ৬ষ্ঠ বর্ষ ৬৯৫-৯৬ পৃঃ। শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়।
  9. সিরাজদ্দৌলা আপ্‌নে হসুল দাবীকো রওয়ানা হুয়া আওর মহবৎজং চন্দ্ রোজকী রোক্‌শৎ মুর্শিদাবাদকে সয়ের ও তফ্‌রীকে বাহানাসে লেকর মুর্শিদাবাদ পঁহুচা”—মুতক্ষরীণ।
  10. মুতক্ষরীণে লিখিত আছে যে, “সিরাজদ্দৌলা তাঁহার প্রিয়সহচরী লুৎফউন্নিশা বেগমকে সঙ্গে লইয়া গো-শকটে আরোহণ করিয়া প্রস্থান করেন। হোসেন কুলী খাঁ কিয়দ্দূর পশ্চাদ্ধাবন করিয়াছিলেন, ধরিতে না পারিয়া প্রত্যাগমন করিতে বাধ্য হন। সিরাজদ্দৌলার বলীবর্দ্দ দিন বিশ ক্রোশ করিয়া ছুটিত!”
  11. The Raja was at a loss how to act, being fearful of surrendering his charge without orders from the Nawab; and alarmed, If any accident should happen to Serajedowla if he opposed him; at length he resolved on defending the City, till he should hear from Aliverdi Khan."-Stewart's History of Bengal.
  12. Mutakherin.
  13. সে কবিতাটি এইরূপ—

    “গাজি কে পায়ে সাহাদাৎ আন্দার তাগো পোস্ত
    গাফেল্ কে শাহীদে এস্‌ক্ ফাজেল্‌তার্ আজ্ দাস্ত্।
    ফার্‌দায় কেয়ামাৎ ইঁ বা আঁ কায়মানাদ্।
    ইঁ কোস্তা দুষ্‌মানাস্ত্ ওঁ য়া কোস্তায়ে দোস্ত।”

    —মুতক্ষরীণ।
  14. ইনি মুতক্ষরীণ-প্রণেতা সাইয়েদ গোলাম হোসেনের মাতুল। মুতক্ষরীণে প্রকাশ যে, ইঁহার বুদ্ধিতেই সিরাজদ্দৌলা পাটনা আক্রমণ করিয়াছিলেন। মেহেদী নেশার খাঁ নিহত হইলে, সিরাজ আত্মকার্য্যের হিতাহিত চিন্তা করিয়া বোধ হয় মনে মনে লজ্জিত হইয়াছিলেন, এবং বোধ হয় সেই জন্যই নবাব শুভাগমন করিবামাত্র নিজেই তাঁহার শিবিরে উপনীত হইয়া সকল বিবাদ ভাসাইয়া দিয়াছিলেন।
  15. সিরাজদ্দৌলা এই উপলক্ষে অনেকের নিকট নিন্দাভাজন হইয়াছেন। কিন্তু তিনি যে আলিবর্দ্দীর সঙ্গে কলহ করেন নাই, মুতক্ষরীণই তাহার প্রমাণ। আলিবর্দ্দীর আগমন-সংবাদ প্রাপ্ত হইবামাত্রই সিরাজ তাঁহার নিকট গিয়া রীতিমত “কদম বোসী”—পদচুম্বন করিয়া অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন। রাজা জানকীরামের দোষেই যে এত অনর্থ ঘটিয়াছে, তাহা স্বীকার করিয়া স্বয়ং নবাব আলিবর্দ্দী জানকীরামকে ক্ষমা করার জন্য সিরাজকে অনু্রোধ করিয়াছিলেন।
  16. মুতক্ষরীণে ইহার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু অন্যান্য প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া এস্থলে আমরা মুসলমান ইতিহাস লেখকের অনুসরণ করিতে পরিলাম না।