সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/চতুর্থ অঙ্ক/দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক

দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক

পলাশী—নবাব-শিবিরাভ্যন্তর

সিরাজদ্দৌলা

সিরাজ।

মেঘমুক্ত পুনঃ দিবাকর;—
বিপক্ষের পক্ষে হেলি ভাতিল গগনে,
তীব্র করে বারে যেন সৈন্যগতি মম।
মম পক্ষে নাহি শুনি কামান গর্জন,
বিপক্ষের তোপধ্বনি উগ্রতর ক্রমে
মুহুর্মুহু ভীষণ গর্জ্জন;—
অরি-বল হইতেছে প্রবল।
বর্ষিল কি বারিধারা মধ্যাহ্ন দিবায়,
নিভাতে উদ্যম মম স্বপক্ষ সেনার!
বীরকণ্ঠে নাহি সে হুঙ্কার,
নাহি নায়কের উত্তেজনা নাদ,
রবহীন বিপুলবাহিনী,
বিপক্ষ কামান ঘন কাঁপায় প্রান্তর!
কি হয় কি হয় রণে—
মুহূর্ত্তে বা মজিল সকলি!

দূতের প্রবেশ

কি সংবাদ?
মম পক্ষে তোপধ্বনি নীরব কি হেতু?

দূত। জনাব, হঠাৎ বৃষ্টিতে আমাদের বারুদ ভিজে গেছে, ইংরাজ আম্র-কানন আবরণে আপনাদের বারুদ রক্ষা কর্‌তে পেরেছে।
সিরাজ।

আজি হেরি সবে অরি মম,
স্থলজল গগন বিরূপ মন প্রতি;—
আম্রশাখা পক্ষ ইংরাজের!
পরাজয় নিশ্চয় আমার।

দূত। জাঁহাপনা, চিন্তা দূর করুন। ঐ শুনুন, ফরাসী সিনফ্রেঁর তোপ ইংরাজকে বিতাড়িত কচ্ছে। স্বয়ং মীরমদন, অশ্বারোহী সেনাদলে আক্রমণে অগ্রসর। পশ্চাৎ মহাবেগে সসৈন্যে মোহনলাল ধাবিত। ইংরাজ সৈন্য পশ্চাদপদ হ’য়ে আম্রকাননে আশ্রয় গ্রহণ ক’চ্ছে,—সামান্য সৈন্য, এখনি ধ্বংস হবে। এ সময় যদি সেনাপতি মীরজাফর, কিঞ্চিৎ সাহায্য প্রদান করেন, এক ঘণ্টার মধ্যে রণজয় হয়। রায়দুর্লভ ও ইয়ারলতিফের সেনা, দর্শকের ন্যায় যুদ্ধস্থলে দণ্ডায়মান। তাঁদের নিকট, বারবর মোহনলাল আমায় প্রেরণ করেছিলেন। তাঁদের আক্রমণ ক’র্‌তে বলায় তাঁরা উত্তর দেন, যে মোহনলালের আজ্ঞায় আমরা সৈন্য চালিত কর্‌তে বাধ্য নই, সময় উপস্থিত হ’লে কর্ত্তব্য কার্য্য আমরা ক’র্‌বো।
সিরাজ। যাও শীঘ্র যাও, মীরজাফরকে ডেকে আনো।
দূতের প্রস্থান
ছিঃ ছিঃ! এখনও কপটতা, কোরাণ স্পর্শ ক’রে কপটতা! মুসলমান হৃদয়ে এতদূর কপটতা সম্ভব, আমার ধারণা ছিল না।

এ কি, ঘোর সিংহনাদ শুনি ইংরাজের দলে!
জ্ঞান হয় হা-হা রবে কাঁদে মম সেনা,
আজি দেখি ফুরায় সকলি!

রক্তাক্ত ছিন্নপদ মীরমদনকে লইয়া সৈন্যগণের প্রবেশ
মীরমদন, মীরমদন—ভাই! কি হ’লো!
মীরমঃ। জনাব, আমার সম্মুখে অবস্থান করুন, আমি প্রভুর চন্দ্রবদন দেখ্‌তে দেখ্‌তে প্রাণবায়ু পরিত্যাগ করি। বড় সাধ ছিলো, ক্লাইবের মস্তক চরণে উপহার দেবো! বড় উৎসাহে অশ্বারোহী সৈন্যে আম্রকানন আক্রমণে অগ্রসর হয়েছিলেম, দৈব বিড়ম্বনা! অকস্মাৎ ইংরাজের গোলায় আহত হয়েছি। জনাবকে দর্শন কর্‌বার জন্য, ভগ্নদেহে এখনও প্রাণবায়ু অবস্থান কচ্ছে। জনাব, সাবধান,—বিশ্বাসঘাতকদের আর বিশ্বাস কর্‌বেন না, সকলেই শত্রু। হস্তীপৃষ্ঠে অবতীর্ণ হোন। বাঙ্গ্‌লার সেনা রাজভক্ত, যুদ্ধস্থলে জনাবকে রণস্থলে দেখে, বিশ্বাসঘাতকদের বাক্য অবহেলন ক’রে, সকলে প্রাণপণে ইংরাজকে আক্রমণ করবে। জনাব, সেলাম! রসুল আল্লা!(মৃত্যু)
সিরাজ। মীরমদন—মীরমদন—অভাগাকে ফেলে কোথায় যাও,—তুমি যে আমার দক্ষিণ বাহু, আমায় শত্রু বেষ্টিত রেখে কোথায় গেলে! আমি কাকে বিশ্বাস ক’র্‌বো, আমার আপনার কে আছে? মীরমদন ওঠো, কলিকাতা আক্রমণে, নিশাযুদ্ধে তুমি আমায় রক্ষা করেছিলে, আজ পলাশী ক্ষেত্রে কে আমায় রক্ষা কর্‌বে!—তাই ওঠো, চলো রাজ্য পরিত্যাগ ক’রে যাই, আর আমার পাপ রাজ্যে প্রয়োজন নাই! মীরমদন—মীরমদন কোথায় গেলে!

দূতের পুনঃ প্রবেশ

দূত। জনাব, সেনাপতি মীরজাফর উত্তর দিয়েছে, যে এ সময় যুদ্ধস্থল পরিত্যাগ করা, আমার উচিত নয়;—আমার অদর্শনে, সৈন্যগণ উৎসাহ ভঙ্গ হ’য়ে, যুদ্ধস্থল পরিত্যাগ কর্‌বে।
সিরাজ। আমার হস্তী আনয়ন করো, আমি স্বয়ং যুদ্ধস্থলে যাবো। দেখি আমায় নবাব ব’লে সেনারা গ্রহণ করে কি না; আমার বীরবংশে জন্ম কি না পরিচয় দেবো। মীরমদন পড়েছে, আমি স্বয়ং না যুদ্ধ ক’র্‌লে কে যুদ্ধ ক’রবে। বিদেশী বণিক দেখুক,—এখনো বাঙ্গলার বীর্য্য নির্ব্বাপিত নয়, নবাবের প্রভাবে ষড়যন্ত্রকারীর মন্ত্রণা বিফল হয় কি না দেখুক! হয় ইংরাজ নির্ম্মূল হবে, নয় আলীবর্দ্দীর বংশ নাশ হবে।(গমনোদ্যম)

বালকবেশে জহরার প্রবেশ

জহরা। জনাব জনাব, বালকের গোস্তাকি মার্জ্জনা হয়,—সেনাপতি মোহনলাল, বীর বিক্রমে বিপক্ষকে আক্রমণ কচ্ছেন। জনাবকে রণস্থলে দেখ্‌লে, তিনি জনাবের রক্ষার্থে আক্রমণ হ’তে বিরত হবেন। মীরজাফর, রায়দুর্লভ প্রভৃতি কুচক্রীর সেনারা তাদেরই বশীভূত, জনাবের আজ্ঞা কতদূর রক্ষা করবে জানি না। জনাব যুদ্ধস্থলে গেলে এখনি বিপর্য্যয় ঘট্‌বে। চিন্তা দূর করুন, মোহনলালের প্রভাবে রণজয় হবে। আমি মীরজাফরকে ডেকে দিচ্ছি।
সিরাজ। যাও, সত্বর যাও, ডেকে আনো।
জহরার প্রস্থান
দেখি কি কঠিন পাষাণে নির্ম্মিত! অনুনয়-বিনয়—কিছুতেই কি কঠিন হৃদয় দ্রব হবে না? কি জানি, রাজ্য লোভ—রাজ্য লোভ! যখন লোকভয়, ধর্ম্মভয়, মনুষ্যত্ব বর্জ্জন করেছে, তখন কি কথায় দুরভিসন্ধি পরিত্যাগ ক’র্‌বে? আমি স্বয়ং তাকে রাজ্য প্রদান ক’র্‌বো। ইংরাজ পরাজিত হোক, বাঙ্গলার গৌবব রক্ষিত হোক, মুসলমানের প্রভাব অপ্রতিহত থাকুক, বিদেশীর গর্ব্ব খর্ব্ব হোক। আমার রাজ্য প্রয়োজন নাই, মীরজাফর রাজেশ্বর হোক। রাজ্য প্রাপ্ত হ’লেও কি স্বদেশের গৌরবের প্রতি দৃষ্টি রাখবে না? জন্মভূমির প্রতি লক্ষ্য রাখবে না? আমার বিপুলবাহিনীর অধিকাংশই বিশ্বাসঘাতকদের অধীন, এ বিশ্বাসঘাতকেরা বাঙ্গলার পক্ষে যুদ্ধ জয় না ক’রলে রণজয়ের আশা নাই।—আমার রাজ্যত্যাগে যদি মুসলমানের রাজ্য রক্ষিত হয়, এ ছার রাজ্য আমার প্রয়োজন নাই।

রায়দুর্লভের প্রবেশ

রায়দুঃ। জনাব, কি নিমিত্ত চিন্তা কচ্ছেন, বার বার কি নিমিত্ত সেনাপতিকে ডাক্‌ছেন? ইংরাজ আম্রকাননে আশ্রয় গ্রহণ ক’রেছে, এক্ষণে তাদের আক্রমণ উচিত নয়। বিশেষ আমাদের বারুদ সব নষ্ট হয়েছে, অদ্য যুদ্ধ এই অবস্থায় থাকুক, কাল প্রাতে আক্রমণ মাত্রেই ইংরাজ পতন হবে। সেনাপতি মীরমদন, নিষেধ না শুনে হত হয়েছেন। মোহনলাল যদি নিরস্ত না হন, তা হ’লে বিপদের আশঙ্কা অধিক।
সিরাজ। আপনি সেনাপতিকে একবার আস্‌তে বলুন।

মীরজাফর ও রাজবল্লভের প্রবেশ

রায়দুঃ। এই যে সেনাপতি আগত।
সিরাজ। সেনাপতি—সেনাপতি, আর বিরূপ কেন? এ সময় কেন আমাকে পরিত্যাগ কচ্ছেন? আমি বার বার আপনাদের বলেছি, আমায় যদি অযোগ্য বিবেচনা করেন, আমায় রাজ্যচ্যুত ক’রে যোগ্য বাক্তিকে রাজ্য প্রদান করুন! এই দেখুন, এই রাজমুকুট আপনার পদতলে স্থাপন কচ্ছি, আপনি স্বয়ং গ্রহণ করুন। আসুন, আমি সমস্ত সৈন্যের সম্মুখে আপনাকে বাঙ্গলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব ব’লে অভিবাদন কচ্ছি। আপনি নবাবের মর্য্যাদা, মুসলমানের মর্য্যাদা, বাঙ্গলার মর্য্যাদা, বাঙ্গলার স্বাধীনতা আজ যুদ্ধে রক্ষা করুন। আর বিরূপ হবেন না, সকলই যাবে, আজই বিধর্ম্মী, বিজাতীর পদানত হ’তে হবে, বাঙ্গলার গদী ফিরিঙ্গির পায়ে অর্পণ করবেন না।
মীরজাঃ—জনাব, কি আজ্ঞা কচ্ছেন? আজ্‌কের যে অবস্থা, এতে রণজয় অসম্ভব, আক্রমণে কেবল সৈন্যক্ষয় হবে, শত্রুর হানি হবে না। আমায় সেনাপতি করেছেন, কিন্তু মীরমদন আমার আজ্ঞা লঙ্ঘন ক’রে প্রাণত্যাগ করেছে,—মোহনলালও সৈন্যক্ষয় ক’রতে প্রবৃত্ত হয়েছে। যুদ্ধ জয়, কেবল উৎকট সাহসে হয় না,—রণকৌশল আবশ্যক। আপনি মোহনলালকে নিবৃত্ত হ’তে আজ্ঞা দেন।
সিরাজ। যেরূপ কর্ত্তব্য হয় করুন, মোহনলালকে আমার নামে ক্ষান্ত হ’তে বলুন।
রায়দুঃ। সেনাপতি মহাশয়, আমার বিবেচনায় নবাবের মুর্শিদাবাদ যাওয়া কর্ত্তব্য। নিশাকালে যদি ক্লাইব শিবির আক্রমণ করে, সে এক মহা বিপদের কথা।
মীরজাঃ। সঙ্গত প্রস্তাবই করেছেন। (সিরাজের প্রতি) যদি বান্দার বাক্য গ্রহণ করেন, বেগগামী উষ্ট্র প্রস্তুত আছে, ক’জন রক্ষকের সহিত নবাব মুর্শিদাবাদ গমন করুন,—কল্য জয় সংবাদ সিংহাসনে প্রাপ্ত হবেন।
সিরাজ। যদি আপনাদের অভিমত হয়, আমি মুর্শিদাবাদে যেতে প্রস্তুত, কিন্তু মোহনলালকে ডাকুন।
মীরজাঃ। আপনি প্রত্যাগমনের উদ্যোগ করুন, আমরা তাঁর নিকট দূত প্রেরণ কচ্ছি।
সিরাজদ্দৌলা ব্যতীত সকলের প্রস্থান
সিরাজ। বিশ্বাসঘাতকতা সকলের বদনে অঙ্কিত—নয়ন-কোণে বিশ্বাসঘাতকতা প্রকাশ পাচ্ছে। অসহায় মোহনলাল যুদ্ধ কচ্ছে, আমার হৃদয় কম্পিত! মীরমদন পতিত, মোহনলালের অমঙ্গল হ’লে সর্ব্বনাশ! কি করবো! মোহনলাল আসুক, সে যেরূপ পরামর্শ দেয়, সেইরূপ করা উচিত।

জহরার পুনঃ প্রবেশ

জহরা। কি দেখছো—কি দেখছো? সেই তস্‌বীরবাহিকা—তোমার দূত নই। যুদ্ধ জয় হবে, স্বপ্নেও মনে স্থান দিও না! আমিই তোমার বারুদের আবরণ খুলে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজিয়েছি, এই ষড়যন্ত্রে আমিই প্রধান,—তোমার মাতৃস্বসা ঘসেটী বেগমের অর্থে ইংরাজ-সৈন্য পুষ্ট, সে আমার কৌশল। এখনো পালাও—এখনও মুর্শিদাবাদে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করো, একা মোহনলাল তোমার প্রাণ রক্ষা ক্ষরতে পারবে না। আজ রজনীতে বিদ্রোহীরা একত্রিত হ’য়ে তোমার প্রাণবধ করবে। সকলেই প্রাণবধ কর্‌তে এসেছিলো, কিন্তু দিনমান, সকলে দেখ্‌বে, নবাবকে হত্যা করায় নিন্দা হবে, প্রজারা বিরূপ হওয়ার সম্ভাবনা, তাই এখনো তুমি জীবিত। পালাও—পালাও—নচেৎ নীরব নিশীথে বিদ্রোহী-হস্তে তোমার প্রাণবায়ু বহির্গত হবে— লোকের নিকট প্রচার হবে, ইংরাজ বধ করেছে। তোমায় পালাবার পরামর্শ দিয়েছে কেন জানো? তুমি ওদের উপদেশ গ্রহণ কর্‌বে না, এই খানেই অবস্থান কর্‌বে, বধ কর্‌বার সুযোগ পাবে।
সিরাজ। কে তুমি? তুমি সেই তারার তস্‌বীরবাহিকা, আমার শত্রু কেন? আমার অনিষ্ট সাধন কেন কচ্ছ?
জহরা। কে আমি—কে আমি? আমি হোসেনকুলির সন্তাপিতা স্ত্রী, যে হোসেনকুলিকে তুমি স্বহস্তে বধ করেছ! তোমার প্রাণ রক্ষার্থে, তোমায় পালাবার উপদেশ দিচ্ছি নে। যে স্থানে হোসেনকুলিকে প্রকাশ্যে বধ করেছিলে, সেই স্থানে প্রকাশ্যে তোমায় বধ কর্‌বে;—তোমার উষ্ণ শোণিত হোসেনকুলির কবরে দেবো, তবে হোসেনকুলির প্রেতাত্মা তৃপ্ত হবে! আমার প্রতিহিংসা পূর্ণ হবে!!
জহরার প্রস্থান
সিরাজ। বিভীষিকা মূর্ত্তি—বিভীষিকা মূর্ত্তি—দানবী, মানবী নয়! শোণিতলোলুপা প্রেতিনী নির্ভয়ে সৈন্যশ্রেণীতে বিচরণ কচ্ছে! না—না, এ স্থানে আর থাকা কর্ত্তব্য নয়। সকলেই শত্রু, বেলা অবসান প্রায়, রজনীতে আমায় বধ করবে! কথা অসম্ভব নয়,—বিশ্বাসঘাতক, রাজ্যলোভী, সয়তান প্রকৃতি!—এখনো আমার বিশ্বাসী শরীর-রক্ষক আছে, তাদের সাহায্যে মুর্শিদাবাদে প্রস্থান করি। কে আছ?

কয়েকজন প্রহরীর প্রবেশ

প্রহরীগণ। জনাব!
সিরাজ। হস্তীপৃষ্ঠে মীরমদনের দেহ মুর্শিদাবাদে ল’য়ে চলো!
সকলের প্রস্থান