সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/দ্বিতীয় অঙ্ক/চতুর্থ গর্ভাঙ্ক

চতুর্থ গর্ভাঙ্ক

কলিকাতা—উমিচাঁদের উদানস্থ কক্ষ

সিরাজদ্দৌলা, মীরজাফর, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ মহাতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদ,
রাজবল্লভ, উমিচাঁদ, করিম, মীরমদন প্রভৃতি

মীরজাঃ। জনাব, বান্দার ক্ষুদ্র বিবেচনায়, সন্ধিস্থাপন কোন রূপেই কর্ত্তব্য নয়। আপাততঃ ফরাসীর সহিত ইংরাজের বিবাদ উপস্থিত। এই নিমিত্ত কপট ইংরাজ, সন্ধিস্থাপন করতে প্রস্তুত। কিন্তু সে সন্ধি, কোনও মতে স্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়। স্বর্গীয় নবাবের সময় হ’তে, ইংরাজ নানা সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করেছে; কিন্তু পত্রের মর্ম্মানুসারে কোনও কার্য্য করে নাই।
রায়দুঃ। ইংরাজ যুদ্ধার্থে প্রস্তুত নয়, এই নিমিত্তই সন্ধিতে সম্মত। সুযোগ প্রাপ্ত হ’লেই, সন্ধি ভঙ্গ ক’রে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে। তাদের দমন কর্‌বার এই উত্তম সুযোগ। আমরা যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হয়েছি, যুদ্ধ করাই সঙ্গত।
সিরাজ। (উমিচাঁদের প্রতি দৃষ্টিপাত)
উমি। জনাব, যদিচ কার্য্যের অনুরোধে ইংরাজের সহিত মৌখিক সদ্ভাব আছে, কিন্তু ইংরাজ আমায় আবদ্ধ করেছিল, আমার আবাস লুণ্ঠন করেছিলো, পরিবারবর্গ ইংরাজের দৌরাত্ম্যে নিহত,—এ সকল এক দণ্ডের নিমিত্ত বিস্মৃত হই নাই! ইংরাজ দমিত হ’লে আমার প্রতিহিংসা তৃপ্ত হয়। আমার মন্তব্য, যুদ্ধ ব্যতীত আর কি হ’তে পারে!
করিম। চাচা, কোল্‌কাতা থেকে পালিয়ে, পল্‌তায় যখন ইংরাজ নোনা পানি খাচ্ছিল, তখন সদ্ভাব ক’রে তাদের সামগ্রী বেচে লাভ করেছ। কেবল দোষ দেখ্‌লেই তো হবে না, গুণও গাও। রসদ যুগিয়ে এক গুণে একশো গুণ তো দাম নিয়েছ চাচা। এক টাকায় একটা চাঁপা কলা বেচেছ। দিনকতক ইংরেজ থাক্‌লে, যা লুট করেছে, তার দুনো আদায় কর্‌বে, ভাবনা কি?
রাজবঃ। জনাব, বান্দাও,—খাঁ সাহেব, বণিকপ্রবর উমিচাঁদ ও রাজা রায়দুর্লভের প্রস্তাবের সম্পূর্ণ অনুমোদন করে।
করিম। (স্বগত) এলোমেলো ক’রে দে মা,—লুটে পুটে খাই!
সিরাজ। কি করিম চাচা, কি বল্‌ছ? তোমার মত কি?
করিম। জনাব, কথার মতামত—না অন্তরের মতামত?
সিরাজ। (ঈষদ্ হাস্য করতঃ) সে কি করিম চাচা?
করিম। আমার কথার মতামত, যাতে ভাল হয় করুন। অন্তরের মতামত, সরাবের স্রোত ব’য়ে যাগ্, কামানের গোলার মত আফিমের তাল গাদা হ’য়ে থাকুক, যাকে পাই বাগ মাপিক লুটে নি, আর আপ্‌না আপ্‌নি খুব বাহাদুর ব’লে বগল বাজাই।
মীরমঃ। জনাব, কৃতদাসেরও অভিপ্রায় যুদ্ধ,—ইংরাজ অতি কপট।
করিম। চাচা, গান ধরেছ ঠিক,—কিন্তু তোমার সুরটা কিছু বেয়াড়া, আমার সুরে মেলে না। আমার সুর কি জানো? একটা ওলট-পালট হ’লেই কিছু আরামে থাকি। তোমার মত, না ওলট-পালট হয়।
সিরাজ। (ঈষদ্ হাস্য সহ) কি করিম চাচা, রাজ্য বিশৃঙ্খল হয়, এই তোমার ইচ্ছা?
করিম। আজ্ঞে হ্যাঁ। সব ঠিক ঠাক্ হ’য়ে গেল, রাজ্য সুশৃঙ্খলায় চল্‌লো, তাহ’লে আমার লাভ কি বলুন? বরাদ্দ মাফিক মদটুকু, বরাদ্দ মাফিক আফিংটুকু, বরাদ্দ মাফিক চণ্ডু;—জনাবও যদি মদ না ছাড়তেন, তাহ’লে কতক সুবিধা ছিলো। একটা ওলট-পালট না হ’লে, আমার সুবিধা কিসে হয় বলুন?—বেওয়ারিস প্রজা দাবিয়ে মজা করি কিসে বলুন?
মীরমঃ। করিম চাচা তুমি এমন? রাজ্যের বিশৃঙ্খলা কামনা করো?
করিম। কেন চাচা, উল্টো বুঝ্‌লে কেন? আমার কি বাঙ্গ্‌লা দেশে জন্ম নয়, আমি কি মতলববাজ নই, আমি কি আপনি গাঁট দিতে জানি নি? আমি কি আপনার ভালাই খুঁজিনি, যে পরের ভালাই খুঁজতে যাবো? প্রজার ভাল হলো না হলো, আমার কি ব’য়ে গেল? বাঙ্গলায় জন্মেছি, আমার আপনার ভালাই ভালো! প্রাণে বৈরাগ্য আছে—তাই মনে করি—কে কার, কার জন্যে ভাব্‌বো—আপনি গুছিয়ে নিই, পরকালে না হোক, ইহকালের তো কাজ বটে!
সিরাজ। ছিঃ ছিঃ করিম চাচা, তুমি এমন?
করিম। জনাব, নেশাখোর মানুষ, আঁতের সুখে গেয়ে ফেলেছি! মুখের সুখে গাই একবার শুনুন, প্রাণ ঠাণ্ডা করে দিচ্ছি। জনাব, হুজুর, কদাচ ইংরাজের সঙ্গে সন্ধি কর্‌বেন না। ইংরাজ অতি ছল, অতি কপট। জনাব ক্ষণজন্মা, দ্বিতীয় সেকেন্দর সা, সমস্ত পৃথিবী অধিকার করবেন। দিনরাত যুদ্ধবিগ্রহে নিযুক্ত থাকুন। এই ইংরাজকে তোপে উড়িয়েই সসৈন্যে দিল্লীতে যাত্রা ক’রে, দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করুন। আপনি না দিল্লীর তক্তে বস্‌লে দিল্লীর শোভা হবে না! মীর মদন চাচা, এইবাব মামার গাওনা পছন্দসই কি?
মীরমঃ। চাচা, তুমি বঙ্গবাসীর নিন্দা করো? আমরা কি বঙ্গবাসী নয়? তোমার বিবেচনায় কি আমরা সকলেই স্বার্থপর?
করিম। চাচা, এই রাজসভাসদের ন্যায় গোটাকতক আগাছা গজায়। নইলে এই বঙ্গভূমিরূপ বিধাতার সাধের উদ্যানে স্বার্থকুসুম ফুটেই রয়েছে, ছোট বড় সব স্ব স্ব প্রধান,—সুসৌরভে এ বলে আমায় দেখ—ও বলে আমায় দেখ! এ বাঙ্গালায় যিনি শান্তি স্থাপন কর্‌বেন, তিনি বিধাতা পুরুষ। বাঙ্গ্‌লা ফিরে গড়্‌তে হবে, পুরাণো বাঙ্গ্‌লায় চল্‌বে না।
সিরাজ। কেন করিম চাচা, তোমার এত বিরাগ কেন?
করিম। জনাব, এই বাঙ্গলায়, যদি তিন জনের দু’মত দেখাতে পারেন, তাহ’লে নাকে খৎ দিয়ে, আফিং ছেড়ে দেবো। তিন জনের তিন মত! যদি একমতে বাঙ্গ্‌লায় কাজ হতো, বঙ্গবাসী যদি এক মতে বল্‌তে শিখ্‌তো, তাহ’লে বাঙ্গলায় মাটী থাক্‌তো না,—সোণা হতো। বাঙ্গলার বুদ্ধিও যেমন প্রখর, প্যাঁচও তেমনি ঝুড়ি ঝুড়ি! এই প্যাঁচ খেলা চলেছে—যেটা কাটে, যেটা থাকে!
দূতের প্রবেশ
দূত। জনাব, ইংরাজ উকীলদ্বয় ওয়ালস্ ও স্ক্রাফ্‌টন সাহেব নবাবদর্শনে সমাগত।
সিরাজ। সমাদরের সহিত নিয়ে এসো। (স্বগত) ইংরাজকে বিশ্বাস করা কর্ত্তব্য নয় বটে। কিন্তু উপদেষ্টা অমাত্যবর্গ, নিজের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য ক’রে উপদেশ প্রদান কচ্ছে। রাজ্যে গোলযোগ স্থায়ী হ’লেই তাদের মঙ্গল। করিমচাচা প্রকারান্তরে তাদের মনোভাব যথার্থ বলেছে।

ওয়াল্‌স্ ও স্ক্রাফ্‌টনের প্রবেশ ও জানু গাতিয়া নবাবকে অভিবাদন

আসন গ্রহণ করুন। বক্তব্য প্রকাশ করুন।
ওয়ালস্। জনাবের পত্র আহ্লাদের সহিত প্রাপ্ত হইয়া, পত্রের আদেশানুসারে কর্ণেল ক্লাইব, আমাদিগকে তাঁর প্রতিনিধি স্বরূপ প্রেরণ করিয়াছেন। পত্রে প্রকাশ, যে জনাব আমাদের হুগলীবন্দর লুণ্ঠন মার্জ্জনা করিবেন; ইতিপূর্ব্বে কলিকাতা হইতে বিতাড়িত হওয়ায় ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানী যাহা ক্ষতিগ্রস্থ হইয়াছে, তাহা কতক পূরণ করিবেন।
সিরাজ। হ্যাঁ, আমাদের অভিপ্রায় সেইরূপ।
স্ক্রাফ্‌টন। জনাব, আমাদেরও অভিপ্রায়, আমরা বণিক, বাণিজ্য করিব, যুদ্ধ-বিগ্রহে বিস্তর ক্ষতি, নবাব যদি অনুগ্রহ করিয়া আমাদের মার্জ্জনা করেন, আমাদের পরম সৌভাগ্য। সন্ধিপ্রস্তাবে আমরা এই দণ্ডেই সম্মত।
সিরাজ উত্তম। আপনারা দাওয়ানখানার শিবিরে যান, সন্ধিপত্র প্রস্তুত, স্বাক্ষর করুন।
স্ক্রাফ্‌টন্‌ ও ওয়াল্‌স্। হুজুরের যেইরূপ হুকুম।
উমিচাঁদ ও ইংরাজদ্বয় ব্যতীত সকলের প্রস্থান
ওয়াল্‌স্। উমিচাঁদ বাবু, দাওয়ানখানা অনুগ্রহ পূর্ব্বক দেখাইয়া দেন।
উমি। সাহেব শোনো, শোনো,—দাওয়ানখানায় যেয়ো এখন—এ কপট নবাবকে বিশ্বাস ক’র্‌ছ? ভেবেছ কি নবাব সত্যই সন্ধি ক’র্‌তে প্রস্তুত?
উভয়ে। তবে কিরূপ—তবে কিরূপ?
উমি। নবাবের তোপ আস্‌তে বিলম্ব হবে জেনে, এই সন্ধির প্রস্তাব করেছে। এখন তোপ এসেছে, এখনি যুদ্ধ আরম্ভ কর্‌বে। তোমরা দাওয়ানখানায় পৌঁছন মাত্র, তোমাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখবে।
ওয়াল্‌স্। Oh the devil!
স্ক্রাফ্‌টন। তবে আমরা এখন কি করিব?
উমি। লম্বা ঠ্যাং চালিয়ে দাও, পেছু পানে চেয়ো না, কেল্লায় পৌঁছে হাঁপ ছেড়ো।
উভয়ে। সেলাম, আমরা চলিলাম—আমরা চলিলাম।
উমি। এক মুহূর্ত্ত বিলম্ব করো না।
ইংরেজদ্বয়ের দ্রুত প্রস্থান
যাক্ লড়াই তো বাধলো!

স্বরূপচাঁদের প্রবেশ

স্বরূপ। খাঁ সাহেব আপনার নিকট পাঠালেন,—কি হলো?
উমি। খাঁ সাহেবকে বল্‌বেন, যে তাঁরও যে স্বার্থ আমারও সেই স্বার্থ, আমি তাঁর অনুরোধ মত কার্য্য করেছি। ইংরাজ উকীল দ্রুতপদে কেল্লায় প্রতিগমন করেছে, সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয় নাই, চিন্তা নাই, চলুন। আমি স্বয়ং গিয়ে সংবাদ দিচ্ছি।
উভয়ের প্রস্থান