সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/দ্বিতীয় অঙ্ক/দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক
(পৃ. ৭৫-৮০)
দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক
মুর্শিদাবাদ—নবাব-অন্তঃপুরস্থ ঘসেটীবেগমের কক্ষ
ঘসেটীবেগম
ঘসেটী। শিরায় শিরায় অগ্নি—শিরায় শিরায় অগ্নি!—ছিঃ ছিঃ এত অদৃষ্টে ছিল, আমিনার বাঁদী হ’লেম! আমিনার পুত্র সিংহাসনে, আমার এক্রামদ্দৌলা কবরে! আমিনা নবাব-মাতা, আমিনার পুত্রের গৃহে আমি বন্দী! আবাস ভূমিশায়ী, অর্থহীনা, সহায়হীনা, আমিনার পুত্রের অন্নদাসী! আমি নবাবের জ্যেষ্ঠা কন্যা, আমার ছায়া স্পর্শ ক’রতে লোকে ঘৃণা করে, আমিনার ছায়ায় সেলাম দেয়! আমিনা অতুল ঐশ্বর্য্যশালিনী, আমার গুপ্ত ধনাগার লালকুঠি ইষ্টকচূর্ণে আবৃত। এক শান্তি, ঝিলগর্ভে ধনাগার নির্ম্মিত। যারা ধনাগার নির্ম্মাণ করেছিল, তারাও সেই ধনাগারে মৃত। সে সন্ধান রাজবল্লভও জানে না। ভূমি খনন ক’রে সে সন্ধান পাবে না। থাকো—থাকো—যারা হত হয়েছ, অশরীরি অবস্থায় ধনাগার রক্ষা ক’রো; সিরাজের শত্রুর হস্তে ধনাগার অর্পণ করো, যারা সিরাজের মস্তক ছেদন ক’রে ভূতলে পাতিত ক’র্বে, তাদের হস্তে অর্পণ ক’রো। ছিঃ ছিঃ কি কুক্ষণে রাজবল্লভের সঙ্গে দেখা হয়েছিল! কুক্ষণে তার কুমন্ত্রণায় কর্ণপাত করেছিলেম! কুক্ষণে সেই ভীরুর উত্তেজনায় রাজ্য-লালসা করেছিলেম! হোসেন কুলি—হোসেন কুলি! তুই কোথা?—দেখে যা, যেমন ঈর্ষ্যানলে দগ্ধ হ’য়ে তোর প্রাণবধে সম্মত হ’য়েছিলেম, তার সমুচিত দণ্ড পেয়েছি! আমি বন্দী, সিরাজের বাঁদী, সহায়-সম্পত্তিহীনা; আমার গর্ভধারিণী মাতা কারারক্ষক! এমন কেউ নাই, যে আমায় এই কারাগার হ’তে উদ্ধার করে!
জহরার প্রবেশ
জহরা। এই যে আমি আছি।
ঘসেটী। কে তুমি?
জহরা। নবাব মহিষীর বাদী, যে, তুমি লালকুঠি হ’তে আস্বার সময়, তোমার শিবিকায় বস্ত্র জড়িত ক’রে তোমার বহুমূল্য রত্নাদি সঙ্গে দিয়েছিল, সেই ছদ্মবেশী নবাব মহিষীর বাদী।
ঘসেটী। কে তুমি পরিচয় দাও।
জহরা। আমি জহরা, যে হোসেনকুলিকে স্মরণ ক’রে, উচ্চরবে হৃদয়তাপে স্নিগ্ধ নিশীথ-বায়ু সন্তাপিত ক’চ্ছ, সেই হোসেনকুলি আমার স্বামী। তার অতৃপ্ত প্রেতাত্মা আমার সঙ্গে দিবারাত্র ভ্রমণ ক’চ্ছে, তার উত্তেজনায় আমি একমুহূর্ত্ত স্থির নই। সিরাজের শোণিতধারা সে পান করবে; হস্তীপৃষ্ঠে তার মৃতদেহ যেমন নগরে ভ্রমণ করেছে, সিরাজের মৃতদেহ তেমনি হস্তীপৃষ্ঠে নগর ভ্রমণ ক’রবে, তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাবে,—সিরাজকে কবরে দেখে সেই অতৃপ্ত আত্মা তবে সে নিজ কবরে প্রবেশ ক’রবে! নচেৎ সে শান্ত হবে না, শোণিত-তৃষায় হা হা রবে সে আমার আহার নিদ্রা হরণ ক’রেছে! তুমিও প্রেতিনী, পিশাচিনী, নরক-সহচরী, আমিও প্রেতিনী, পিশাচিনী, নরক-সহচরী! নারকীয় সয়তানী-শক্তিতে আমার হৃদয় পরিপূর্ণ। আমি তোমার সঙ্গিনী, প্রতিবিধিৎসার সহচরী, আমায় অবিশ্বাস ক’রো না।
ঘসেটী। তুমি কি এখন আর নবাব-মহিষীর বাঁদী নও?
জহরা। না,—বাঁদীর গদ্দিস কি আমার অঙ্গে দেখছ? আমি নানা বেশধারিণী। যে কার্য্যে নবাব-মহিষার বাঁদী হ’য়েছিলুম, সে কার্য্য উদ্ধার হ’য়েছে, আর আমার বাঁদী হবার প্রয়োজন নাই। তোমার জহরৎ গোপনে তোমায় অর্পণ কর্বার জন্য বাঁদী-বেশ ধারণ ক’রেছিলেম। একটি হীরকখণ্ড তাহ’তে গ্রহণ করেছি; আপনার কার্য্যে নয়, তোমার কার্য্যে। আমি তোমার পাপসহচরী। তোমার গুপ্ত ধনাগার আমি জানি, তোমার নিকট তার চাবি ল’তে এসেছি। আমায় দাও, সে ধনের বিশেষ প্রয়োজন। আমায় সন্দেহ ক’রো না। আমি সে ধনাগারের সন্ধান দিলে, এখনি নবাব সে স্থান খনন ক’রে, সে ধন গ্রহণ কর্তে পারে। আমার অর্থের প্রয়োজন নাই—বুঝেছ? সে প্রয়োজন থাক্লে, তোমার রত্নাদি অতি সতর্কে সংগ্রহ ক’রে বস্ত্রাবরণে তোমায় অর্পণ ক’র্তেম না। ঝিলগর্ভে তোমার ধনাগার আমি জানি; নবাবকে সন্ধান প্রদান ক’র্লে বহু অর্থ লাভ হয়। দাও, আমায় চাবি দাও। সাবধানে অবস্থান করো, নারী-হৃদয় চূর্ণ করো, নারী-জিহ্বা শৃঙ্খলাবদ্ধ করো, কেবল অন্তরাগ্নি উদ্দীপ্ত রাখো। তুমি অচিরে জান্তে পার্বে,—আমি নারকীয় শক্তিসম্পন্না, সয়তানকে আত্ম বিক্রয় করেছি! বাঙ্গলায় আগুন জ্বালাবো, যে স্থানে হোসেন কুলির রক্ত পড়েছে, সে স্থান অরণ্য হবে!
ঘসেটী। তুমি অসহায়া নারী, তুমি এত সাহস কিসে ক’চ্ছ?
জহরা। আমি অসহায়া? সয়তান আমার সহায়, সেই সয়তান মীরজাফরের হৃদয়ে, সেই সয়তান জগৎশেঠের হৃদয়ে! সেই সয়তান রায়দুর্লভের হৃদয়ে, সেই সয়তান রাজবল্লভকে চালিত ক’চ্ছে। হৃদয়ের সয়তান এখনো মুখাবরণ খোলে নাই, তাই তারা আপনার হৃদয়ে সয়তানের প্রতিমূর্ত্তি দেখে নি। আমি সেই সয়তানের আবরণ উন্মুক্ত ক’রে, সেই বিভীষিকা ছবি তাদের প্রদর্শন কর্বো। তারা বিমুগ্ধ হ’য়ে সয়তানের কার্য্যে প্রবৃত্ত হবে। আমি সেই সয়তানের আভাস কতক মীরজাফরকে দিয়েছি, বাঙ্গলায় আগুন জ্বল্বে, বাঙ্গ্লায় আগুন জল্বে! সাবধান, হৃদয়ভাব গোপন রেখো। দাও দাও চাবি দাও।
ঘসেটী। (চাবি প্রদান করিয়া) এই নাও, কিন্তু দেখো, তুমি স্ত্রীলোক, আমার ভয় হয়।
জহরা। তুমি এখনো সন্দেহ ক’চ্ছ? অচিরে তোমার সে সন্দেহ দূর হবে। তুমি অচিরে সংবাদ পাবে, যে সমস্ত বাঙ্গ্লা-বিহার-উড়িষ্যার মধ্যে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সিরাজের শত্রু! সিরাজের কলঙ্ক-ধ্বজা গগনমার্গে উড্ডীয়মান হবে। সমস্ত জগৎ তা দর্শন ক’র্বে। সিরাজের নামে লোকের ঘৃণার উদ্রেক হবে। সিরাজের শত্রুকে দেবতা বোধে পূজা ক’র্বে। সয়তানের অবতার ব’লে সিরাজ ইতিহাসে উল্লিখিত হবে। লুৎফউন্নিসার নিকট নবাবের নামাঙ্কিত মোহর আছে, সেই মোহর যদি কোনরূপে সংগ্রহ ক’রতে পারো, দেখ। তাতে বিশেষ কাজ হবে।
ঘসেটী। কিরূপে সংগ্রহ ক’র্বো?
জহরা। সে কি! তুমি রাজ্য প্রাপ্তির ষড়যন্ত্র করেছিলে, সামান্য একটা মোহর অপহরণ করতে পার্বে না। আমি চল্লুম, দেখ, যে রকমে পারো, সংগ্রহ করো।
ঘসেটী। শোনো শোনো—
জহরা। শোনবার অবকাশ নাই, অনেক কাজ। তোমায় তো ব’লেছি, প্রতি হৃদয়ে সয়তান জাগরিত কর্তে হবে। আমার তিলমাত্র অবসর নেই। আবার নবাবের শত্রু উপস্থিত। ইংরাজ কলিকাতা অধিকার ক’রেছে, হুগলী বন্দর লুঠ ক’রেছে, সকল সংবাদ এখনই রাজপুরে পাবে।
প্রস্থান
ঘসেটী। না না, সত্যই আমার সহায়,—সত্যই সয়তান, আমার সাহায্যের নিমিত্ত এরে প্রেরণ করেছে। প্রতিবিধিৎসার আগুন ওর চক্ষে দেখেছি, সিরাজের শোণিত-তৃষায় ওর জিহ্বা শুষ্ক। আমার শত্রু নয়, সুহৃদ্। নারী, নারীরই তো প্রতিহিংসা, প্রতিহিংসা আর কার? স্বর্ণকান্তি হোসেন কুলিকে কে বধ ক’র্লে? নারীর প্রতিহিংসা! হোসেন, হোসেন—কুক্ষণে আমায় বর্জ্জন ক’রে তুই আমিনার প্রেমে আবদ্ধ হ’য়েছিলি!―নচেৎ সিরাজের কি সাধ্য, যে সে, তারে রাজপথে বধ করে। নারী-হৃদয় চূর্ণ ক’র্বো!—না, নারীর স্বভাবজাত শঠতায় হৃদয় আবরিত কর্বো। আজ লুৎফউন্নিসা রণ-জয়ে আনন্দ ক’র্ছে,—সেই আনন্দে যোগদান ক’র্বো! আমিনা অপেক্ষা সিরাজের প্রতি স্নেহ প্রকাশ ক’র্বো, নারী কতদূর কৌশলময়ী, বাঙ্গ্লায় তার আদর্শ রেখে যাবো! দেখি, যেরূপে পারি, মোহর সংগ্রহ করি।
প্রস্থান