সিরাজদ্দৌলা (নাটক)/পঞ্চম অঙ্ক/দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক
(পৃ. ১৭৯-১৮২)
দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক
মুর্শিদাবাদ—মীরণের বিলাস-গৃহ
লুৎফউন্নিসা
লুৎফ। প্রাণেশ্বর, কোথায় তুমি? এ দাসীকে ফেলে কোথায় আছ! প্রাণ, তুমি তো কঠিন, তবে এ মৃত্তিকার দেহ ভঙ্গ কর্তে পাচ্ছ না কেন? আর কেন দেহে আছ? কই, অনাহারে তো মৃত্যু হয় না!
বালিকা অনাহারে মরেছে। আমার কঠিন প্রাণ, অনাহারে কেন বেরুবে! আমার দেহ বজ্র নির্ম্মিত! এ সময়ে যদি কেউ বন্ধু থাকে, যদি আমায় গরল প্রদান করে, আমি তার মঙ্গল কামনা ক’রে প্রাণত্যাগ করি। এততেও মৃত্যু হলো না, এত যন্ত্রণাও সহ্য হয়!
মীরণের প্রবেশ
মীরণ। প্রেয়সি, কার জন্য ভাব্ছো, কার জন্যে কাঁদ্ছো? সিরাজ তোমায় তাল্লাক দিয়ে ত্যাগ করেছে। আমার তুমি হৃদয়েশ্বরী, আমার হৃদয়ে তোমার স্থান। সিরাজের শত শত বেগম ছিলো;—আমি তোমার পদপ্রান্তে প’ড়ে থাক্বো—।
লুৎফ। মীরণ, তুমি কি সয়তান,—অসহায়কে পীড়ন কর্তে এসেছ? তুমি কি পশু? তুমি কি সম্বন্ধ-বিচার শূন্য? আমি তোমার মাতৃস্থানীয়, আমার উপর এই উক্তি? মীরণ তোমার কল্যাণ হোক, আমার প্রাণবধ করো, আমি তোমায় আশীর্ব্বাদ ক’রে যাই। অবলাকে রক্ষা করা মুসলমানের ধর্ম্ম, সতীর সতীত্ব রক্ষা মুসলমানের ধর্ম্ম;—তুমি মুসলমান, লোকধর্ম্ম বিসর্জ্জন দিয়ো না। দয়া করো—মীরণ, দয়া করো—এ স্থান ত্যাগ করো। কঠিন যন্ত্রণা দিয়ে আমার প্রাণবধ করো;—অনাহারে, মাংস ছিন্ন ক’রে, যেরূপ তোমার অভিরুচি হয়, সেইরূপে আমায় বধ করো। মীরণ, এস্থান পরিত্যাগ করো, আর কুবচন বলো না।
মীরণ। প্রেয়সি, তুমি আমায় চেনো না। যখন তোমার অঙ্কুরিত যৌবন, তখন তোমার অনুসরণ করেছি; যখন নবাব-গৃহে তুমি বাঁদী, যখন সিরাজ-মহিষী হও নাই, তখন তোমার লালসায় নারী-বেশে অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছিলেম, আলিবর্দ্দীর দণ্ড ভয় করি নাই। তোমার অপরূপ সৌন্দর্য্য আমায় দিবানিশি দগ্ধ কচ্ছে। অনেক সহ্য করেছি, এখন সুযোগ উপস্থিত, কেমন ক’রে পরিত্যাগ কর্বো! তুমি দয়া প্রার্থনা কচ্ছ কেন? আমি তোমার দয়াপ্রার্থী! আমার প্রাণ রাখ, মদন-তাড়নে রক্ষা করো!
লুৎফ। মীরণ, তুমি কি ভাবো, ঈশ্বররাজ্যে সতীর রক্ষক নাই? অত্যাচারীর দণ্ড নাই? যাও, মিনতি কচ্ছি,—তোমার আগমনে স্থান কলুষিত হয়, বায়ু কলুষিত হয়,—যাও, সতী-মন্দির কলুষিত করো না, দূর হও।
মীরণ। প্রিয়ে, মনস্কামনা পূর্ণ হ’লেই যাবো!
(বলপ্রকাশে উদ্যম)
লুৎফ। জগদীশ্বর রক্ষা করো—জগদীশ্বর রক্ষা করো!
(মূর্চ্ছা)
মীরণ। একি মৃত? না না জীবিত। একটু সরাব মুখে দিই, এখনি চৈতন্য হবে। নেসা হ’লে আর বাধা দেবে না।
লুৎফ। (উঠিয়া) এ কি, কোথায় আমি? এই যে মীরণ! ভগবান রক্ষা করো—ভগবান রক্ষা করো—
(পুনরায় মূর্চ্ছা)
মীরণ। এই পারস্যদেশীয় সরাব পান কর্লে, মৃতদেহ সঞ্জীবিত হয়, মৃতদেহেও কাম-অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়। সিরাজ এ সরাব বহু অর্থব্যয়ে প্রস্তুত করেছিল, আমার কার্য্যে আসুক।
(লুৎফউন্নিসার মুখে সরাব প্রদানোদ্যম)
লুৎফ। (উঠিয়া) ভগবান রক্ষা করো—ভগবান রক্ষা করো!
দুইজন ইংরাজ সৈন্যসহ ওয়াট্স-পত্নীর বেগে প্রবেশ
ওয়াট্স-পত্নী। Oh! you lecherous villain! Soldiers, do your duty.
১ম সৈন্য। (মীরণকে ধরিয়া) You rascally nigger!
২য় সৈন্য। Oh you hell-hound!
মীরণ। (বন্দী অবস্থায়) আমি যুবরাজ—আমি যুবরাজ।
ওয়াট্স-পত্নী। Hold your silly tongue you brute! যুবরাজ কাহাকে দেখাইতেছ? আমি ইংলণ্ড-দুহিতা, এই দুই ব্যক্তি English soldiers. তুমি জানো, যাহারা তোমার পিতাকে গদী দিয়াছে, সে গদী কাড়িয়া লইতে পারে? (লুৎফউন্নিসার প্রতি) বেগম সাব—বেগম সাব, ডরো মাৎ—ডরো মাৎ। হামি আসিয়াছি। আপনি আমার পতিকে মুক্তি দান করিয়াছিলেন। হামি আপনার প্রত্যুপকার করিব promise করিয়াছিলাম। ইংলণ্ডদুহিতা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না। আপনি আইসেন, কোন চিন্তা নাই।
লুৎফ। বিবি—বিবি—তুমি ঈশ্বর-প্রেরিতা, আমার রক্ষার জন্য তোমায় ঈশ্বর প্রেরণ করেছেন! এখন বুঝ্লেম, কি ক’রে তোমরা জয়লাভ ক’রেছ। ঈশ্বর তোমাদের সহায়! বিবি—বিবি—আমার জীবন রক্ষা ক’রেছ—ধর্ম্মরক্ষা ক’রেছ—আমার পতিকে রক্ষা করো।
ওয়াট্স-পত্নী। Soldiers, take the rascal before the Darbar, I am coming.
মীরণকে লইয়া সৈন্যদ্বয়ের প্রস্থান
আইসেন, আপনার স্বামী কোথায় জানেন কি?লুৎফ। না মেম সাহেব, তুমি অনুসন্ধান করো।
ওয়াট্স-পত্নী। আইসেন—সেইরূপই হইবে।
উভয়ের প্রস্থান