সীতারাম/তৃতীয় খণ্ড/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
চতুর্দ্দশ-পরিচ্ছেদ
যে কথাটা চন্দ্রচূড় রাজাকে জানাইতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, তাহা এই। যত বড় রাজ্য হউক না কেন, আর যত বড় রাজা হউক না কেন, টাকা নইলে কোন রাজ্যই চলে না। আমরা একালে দেখিতে পাই, যেমন তোমার আমার সংসার টাকা নহিলে চলে না—তেমনই ইংরেজের এত বড় রাজ্যও টাকা নহিলে চলে না। টাকার অভাবে তেমনই রোমক সাম্রাজ্য লোপ পাইল—প্রাচীন সভ্যতা অন্ধকারে মিশাইল। সীতারামের সহসা টাকার অভাব হইল।
সীতারামের টাকার অভাব হওয়া অনুচিত; কেন না, সীতারামের আয় অনেক গুণ বাড়িয়াছিল। ভূষণার ফৌজদারীর এলাকা তাঁহার করতলস্থ হইয়াছিল—বারো ভূঁইয়া তাঁহার বশে আসিয়াছিল। তচ্ছাসিত প্রদেশ সম্বন্ধে দিল্লীর বাদশাহের প্রাপ্য যে কর, সীতারামের উপর তাহার আদায়ের ভার হইয়াছিল। সীতারাম এ পর্য্যন্ত তাহার এক কড়াও মুর্শিদাবাদে পাঠান নাই—যাহা আদায় করিয়াছিলেন, তাহা নিজে ভোগ করিতেছিলেন। তবে টাকার অকুলান কেন?
লোকের আয় বাড়িলেই অকুলান হইয়া উঠে। কেন না, খরচ বাড়ে। ভূষণা বশে আনিতে কিছু খরচ হইয়াছিল—বারো ভূঁইয়াকে বশে আনিতে কিছু খরচ হইয়াছিল। এখন অনেক ফৌজ রাখিতে হইত—কেন না, কখন কে বিদ্রোহী হয়, কখন কে আক্রমণ করে— সে জন্যও ব্যয় হইতেছিল। অভিষেকেও কিছু ব্যয় হইয়াছিল। অতএব যেমন আয়, তেমনই ব্যয় বটে।
কিন্তু যেমন আয়, তেমনই ব্যয় হইলে অকুলান হয় না। অকুলানের আসল কারণ চুরি। রাজা এখন আর বড় কিছু দেখেন না—চিত্তবিশ্রামেই দিনপাত করেন। কাজেই রাজপুরুষেরা রাজভাণ্ডারের টাকা লইয়া যাহার যাহা ইচ্ছা, সে তাহাই করে, কে নিষেধ করে? চন্দ্রচূড় ঠাকুর নিষেধ করেন, কিন্তু তাঁহার নিষেধ কেহ মানে না। চন্দ্রচূড় জনকত বড় বড় রাজকর্ম্মচারীর চুরি ধরিলেন,—মনে করিলেন, এবার যে দিন রাজা দরবারে বসিবেন, সেই দিন খাতাপত্র সকল তাঁহার সম্মুখে ধরিয়া দিবেন। কিন্তু রাজা কিছুতেই ধরা দেন না, “কাজ যা থাকে, মহাশয় করুন” বলিয়া কোন মতে পাশ কাটাইয়া চিত্তবিশ্রামে পলায়ন করেন। চন্দ্রচূড় হতাশ হইয়া শেষে নিজেই কয় জনের বর্তরফের হুকুম জারি করিলেন। তাহারা তাঁহাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিল,—বলিল, “ঠাকুর! যখন স্মৃতির ব্যবস্থা প্রয়োজন হইবে, তখন আপনার কথা শুনিব। রাজার সহি মোহরের পরওয়ানা দেখান, নহিলে ঘরে গিয়া সন্ধ্যা আহ্নিক করুন।”
রাজার সহি মোহর পাওয়া কিছু শক্ত কথা নহে। এখন রাজার কাছে যা হয় একখানা কাগজ ধরিয়া দিলেই তিনি সহি দেন—পড়িবার অবকাশ হয় না—চিত্তবিশ্রামে যাইতে হইবে। অতএব চন্দ্রচূড়, এই অপরাধীদিগের বর্তরফি পরওয়ানাতে রাজার সহি করাইয়া লইলেন। রাজা না পড়িয়াই সহি দিলেন।
কিন্তু তাহাতে চন্দ্রচূড়ের কার্য্যসিদ্ধি হইল না। প্রধান অপরাধী খাতাঞ্জি দরবারে উপস্থিত ছিল, সে দেখিল যে, রাজা না পড়িয়াই সহি দিলেন। রাজা চলিয়া গেলে, সে বলিল, “ও হুকুম মানি না। ও তোমার হুকুম—রাজার নয়। রাজা কাগজ পড়িয়াও দেখেন নাই। যখন রাজা স্বয়ং বিচার করিয়া আমাদিগকে বর্তরফ করিবেন, তখন আমরা যাইব,—এখন নহে।” কেহই গেল না। খুব চুরি করিতে লাগিল। ধনাগার তাহাদের হাতে, সুতরাং চন্দ্রচূড় কিছু করিতে পারিলেন না।
তাই আজ চন্দ্রচূড় রাজাকে পাকড়াও করিয়াছিলেন। রাজা দরবারে বসিলে অপরাধীদিগের সমক্ষেই চন্দ্রচূড় কাগজপত্র সকল রাজাকে বুঝাইতে লাগিলেন। রাজা একে সমস্ত জগতের উপর রাগিরাছিলেন, তাহাতে আবার চুরির বাহুল্য দেখিয়া ক্রোধে অত্যন্ত বিকৃতচিত্ত হইয়া উঠিলেন। রাজাজ্ঞা প্রচার করিলেন যে, অপরাধী সকলেই শূলে যাইবে।
হুকুম শুনিয়া আম দরবার শিহরিয়া উঠিল। চন্দ্রচূড় যেন বজ্রাহত হইলেন। বলিলেন, “সে কি মহারাজ! লঘু পাপে এত গুরু দণ্ড?”
রাজা ক্রোধে অধীর হইয়া বলিলেন, “লঘু পাপ কি? চোরের শূলই ব্যবস্থা।”
চন্দ্র। ইহার মধ্যে কয় জন ব্রাহ্মণ আছে। ব্রহ্মহত্যা করিবেন কি প্রকারে?
রাজা। ব্রাহ্মণদিগের নাক কাণ কাটিয়া, কপালে তপ্ত লোহার দ্বারা “চোর” লিখিয়া ছাড়িয়া দিবে। আর সকলে শূলে যাইবে।
এই হুকুম জারি করিয়া, রাজা চিত্তবিশ্রামে চলিয়া গেলেন। হুকুম মত অপরাধীদিগের দণ্ড হইল। নগরে হাহাকার পড়িয়া গেল। অনেক রাজকর্ম্মচারী কর্ম্ম ছাড়িয়া পলাইল।