সীতারাম/তৃতীয় খণ্ড/ষোড়শ পরিচ্ছেদ
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
সেই দিন দৈবগতিকে চিত্তবিশ্রামের দ্বারদেশে এক জন ভৈরবী আসিয়া দর্শন দিল। এখন চিত্তবিশ্রাম ক্ষুদ্র প্রমোদগৃহ হইলেও রাজগৃহ; জনকত দ্বারবানও দ্বারদেশে আছে। ভৈরবী দ্বারবানদিগের নিকট পথ ভিক্ষা করিল।
দ্বারবানেরা বলিল, “এ রাজবাড়ী—এখানে একটি রাণী থাকেন। কাহারও যাইবার হুকুম নাই।” বলা বাহুল্য যে, রাজাদিগের উপরাণীরাও ভৃত্যদিগের নিকট রাণী নাম পাইয়া থাকে।
ভৈরবী বলিল, “আমার তাহা জানা আছে। রাজাও আমায় জানেন। আমার যাইবার নিষেধ নাই। তোমরা গিয়া রাজাকে জানাও।”
দ্বারবানেরা বলিল, “রাজা এখন এখানে নাই—রাজধানী গিয়াছেন।”
ভৈরবী। তবে যে রাণী এখানে থাকেন, তাঁহাকেই জানাও। তাঁর হুকুমে হইবে না?
দ্বারবানেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করিল। চিত্তবিশ্রামের অন্তঃপুরে কখনও কেহ প্রবেশ করিতে পায় নাই—রাজার বিশেষ নিষেধ। রাণীরও নিষেধ। রাজার অবর্ত্তমানে দুই এক জন স্ত্রীলোক (নন্দার প্রেরিতা) অন্তঃপুরে যাইতে চাহিয়াছিল, কিন্তু রাণীকে সংবাদ দেওয়াতে তিনি কাহাকেও আসিতে দিতে নিষেধ করিয়াছিলেন। তবে আবার রাণীকে খবর দেওয়া যাইবে কি? তবে এ ভৈরবীটার মূর্ত্তি দেখিয়া ইহাকে মনুষ্য বলিয়া বোধ হয় না—তাড়াইয়া দিলেও যদি কোন গোলযোগ ঘটে!
দ্বারবানেরা সাত পাঁচ ভাবিয়া পরিচারিকার দ্বারা অন্তঃপুরে সংবাদ পাঠাইল। ভৈরবী আসিতেছে শুনিয়া শ্রী তখনই আসিবার অনুমতি দিল। জয়ন্তী অন্তঃপুরে গেল।
দেখিয়া শ্রী বলিল, “আসিয়াছ, ভাল হইয়াছে। আমার এমন সময় উপস্থিত হইয়াছে যে, তোমার পরামর্শ নহিলে চলিতেছে না।”
জয়ন্তী বলিল, “আমি ত এই সময়ে তোমার সংবাদ লইতে আসিব বলিয়া গিয়াছিলাম। এখন সংবাদ কি, বল। নগরে শুনিলাম, রাজ্যের নাকি বড় গোলযোগ। আর তুমিই নাকি তার কারণ? টোলে টোলে শুনিয়া আসিলাম, ছাত্রেরা সব রঘুর ঊনবিংশের শ্লোক আওড়াইতেছে। ব্যাপারটা কি?”
শ্রী বলিল, “তাই তোমায় খুঁজিতেছিলাম।” শ্রী তখন আদ্যোপান্ত সকল বলিল। জয়ন্তী বলিল, “তবে তোমার অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম করিতেছ না কেন?”
শ্রী। সেটা ত বুঝিতে পারিতেছি না।
জয়ন্তী। রাজধানীতে যাও। রাজপুরীমধ্যে মহিষী হইয়া বাস কর। সেখানে রাজার প্রধান মন্ত্রী হইয়া তাঁহাকে স্বধর্ম্মে রাখ এ তোমারই কাজ।
শ্রী। তা ত জানি না। মহিষীর ধর্ম্ম ত শিখি নাই। সন্ন্যাসিনীর ধর্ম্ম শিখাইয়াছ, তাই শিখিয়াছি। যাহা জানি না, যাহা পারি না, সেই ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া সব গোল করিব। সন্ন্যাসিনী মহিষী হইলে কি মঙ্গল হইবে?
জয়ন্তী ভাবিল। বলিল, “তা আমি বলিতে পারি না। তোমা হইতে সে ধর্ম্ম পালন হইবে না, বোধ হইতেছে—তাহা হইবার সম্ভাবনা থাকিলে কি এত দূর হয়?”
শ্রী। বুঝি সে একদিন ছিল। যে দিন আঁচল দোলাইয়া মুসলমান সেনা ধ্বংস করিয়াছিলাম—সে দিন থাকিলে বুঝি হইত। কিন্তু অদৃষ্ট সে পথে গেল না, সে শিক্ষা হইল না। অদৃষ্ট গেল ঠিক উল্টা পথে—বনবাসে—সন্ন্যাসে গেল। কে জানে আবার অদৃষ্ট ফিরিবে?
জ। এখন উপায়?
শ্রী। পলায়ন ভিন্ন ত আর উপায় দেখি না। কেবল রাজার জন্য বা রাজ্যের জন্য বলি না। আমার আপনার জন্যও বলিতেছি। রাজাকে রাত্রি দিন দেখিতে দেখিতে অনেক সময়ে মনে হয়, আমি গৃহিণী, উঁহার ধর্ম্মপত্নী।
জ। তা ত বটেই।
শ্রী। তাতে পুরাণ কথা মনে আসে; আবার কি ভালবাসার ফাঁদে পড়িব? তাই, আগেই বলিয়াছিলাম, রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করাই ভাল। শত্রু, রাজা লইয়া বার জন।
জয়ন্তী। আর এগার জন আপনার শরীরে? ভারি ত সন্ন্যাস সাধিয়াছ, দেখিতেছি! যাহা জগদীশ্বরে সমর্পণ করিয়াছিলে, তাহা আবার কাড়িয়া লইয়াছ, দেখিতেছি! আবার আপনার ভাবনাও ভাবিতে শিখিয়াছ, দেখিতেছি! একে কি বলে সন্ন্যাস?
শ্রী। তাই বলিতেছিলাম, পলায়নই বিধি কি না?
জ। বিধি বটে।
শ্রী। রাজা বলেন, আমি পলাইলে তিনি আত্মঘাতী হইবেন।
জ। পুরুষ মানুষের মেয়ে ভুলান কথা! পুষ্পশরাহতের প্রলাপ!
শ্রী। সে ভয় নাই?
জ। থাকিলে তোমার কি? রাজা বাঁচিল মরিল, তাতে তোমার কি? তোমার স্বামী বলিয়া কি তোমার এত ব্যথা? এই কি সন্ন্যাস?
শ্রী। তা হোক না হোক—রাজা মরিলেই কোন্ সর্ব্বভূতের হিতসাধন হইল?
জ। রাজা মরিবে না, ভয় নাই। ছেলে খেলানা হারাইলে কাঁদে, মরে না। তুমি ঈশ্বরে কর্ম্মসংন্যাস করিয়া যাহাতে সংযতচিত্ত হইতে পার, তাই কর।
শ্রী। তা হইলে এখান হইতে প্রস্থান করিতে হয়।
জ। এখনই।
শ্রী। কি প্রকারে যাই? দ্বারবানেরা ছাড়িবে কেন?
জ। তোমার সে গৈরিক, রুদ্রাক্ষ, ত্রিশূল, সবই আছে দেখিতেছি। ভৈরবীবেশে পলাও, দ্বারবানেরা কিছু বলিবে না।
শ্রী। মনে করিবে, তুমি যাইতেছ? তার পর তুমি যাইবে কি প্রকারে?
জয়ন্তী হাসিয়া বলিল, “এ কি আমার সৌভাগ্য! এত কালের পর আমার জন্য ভাবিবার একটা লোক হইয়াছে! আমি নাই যাইতে পারিলাম, তাতে ক্ষতি কি দিদি?
শ্রী। রাজার হাতে পড়িবে—কি জানি, রাজা যদি তোমার উপর ক্রুদ্ধ হন!
জ। হইলে আমার কি করিবেন? রাজার এমন কোন ক্ষমতা আছে কি যে, সন্ন্যাসিনীর অনিষ্ট করিতে পারে?
জয়ন্তীর উপর শ্রীর অনন্ত বিশ্বাস। সুতরাং শ্রী আর বাদানুবাদ না করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার সঙ্গে কোথায় সাক্ষাৎ হইবে?”
জ। তুমি বরাবর—গ্রামে যাও। সেখানে রাজার পুরোহিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও। তোমার ত্রিশূল আমাকে দাও, আমার ত্রিশূল তুমি নাও। সে গ্রামের রাজার পুরোহিত আমার মন্ত্রশিষ্য। তিনি আমার চিহ্নিত ত্রিশূল দেখিলে তুমি যা বলিবে, তাই করিবেন। তাঁকে বলিও, তোমাকে অতি গোপনীয় স্থানে লুকাইয়া রাখেন। কেন না, তোমার জন্য বিস্তর খোঁজ তল্লাস হইবে। তিনি তোমাকে রাজপুরীমধ্যে লুকাইয়া রাখিবেন। সেইখানে তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হইবে।
তখন শ্রী জয়ন্তীর পদধূলি গ্রহণ করিয়া আবার বনবাসে নিষ্ক্রান্ত হইল। দ্বারবানেরা কিছু বলিল না।