সীতারাম/প্রথম খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

 যেখানে গাছতলায় পড়িয়া এলোচুলে মাটিতে লুটাইয়া গঙ্গারামের ভগিনী কাঁদিতেছিল, সেইখানে এ সংবাদ পৌছিল। ভগিনী শুনিল, ভাইয়ের কাল জীয়ন্তে কবর হইবে। তখন সে উঠিয়া বসিয়া চক্ষু মুছিয়া এলোচুল বাধিল।

 গঙ্গারামের ভগিনী শ্রীর বয়স পঁচিশ বৎসর হইতে পারে। সে গঙ্গারামের অনুজা।

 সংসারে গঙ্গারাম, গঙ্গারামের মা এবং শ্ৰী ভিন্ন কেহই ছিল না। গঙ্গারামের মা ইদানীং অতিশয় রুগ্না হইয়াছিলেন, সুতরাং শ্ৰীই ঘরের গৃহিণী ছিল। ঐ সধবা বটে, কিন্তু অদৃষ্টক্রমে স্বামিসহবাসে বঞ্চিত।

 ঘরে একটি শালগ্রাম ছিল,—এতটুকু ক্ষুদ্র একখানি নৈবেদ্য দিয়া প্রত্যহ তাহার একটু পূজা হইত। শ্রী ও শ্রীর মা জানিত যে, ইনিই সাক্ষাৎ নারায়ণ। শ্রী চুল জড়াইয়া সেই শালগ্রামের ঘরের দ্বারের বাহিরে থাকিয় মনে মনে অসংখ্য প্রণাম করিল। পরে হাত যোড় করিয়া বলিতে লাগিল, “হে নারায়ণ! হে পরমেশ্বর! হে দীনবন্ধু। হে অনাথনাথ! আমি আজ যে দুঃসাহসের কাজ করিব, তুমি ইহাতে সহায় হইও। আমি স্ত্রীলোক—পাপিষ্ঠা। আমা হইতে কি হইবে! তুমি দেখিও ঠাকুর!”

 এই বলিয়া সেখান হইতে ঐ অপসৃতা হইয়া বাটীর বাহিরে গেল। পাঁচকড়ির মা নামে তাহার এক বর্ষীয়সী প্রতিবাসিনী ছিল। ঐ প্রতিবাসিনীর সঙ্গে ইহাদিগের বিলক্ষণ আত্মীয়তা ছিল, সে শ্রীর মার অনেক কাজ কৰ্ম্ম করিয়া দিত। এক্ষণে তাহার নিকটে গিয়া শ্রী চুপি চুপি কি বলিল। পরে দুই জনে রাজপথে নিষ্ক্রান্ত হইয়া, অন্ধকারে গলি ঘুঁজি পার হইয়া অনেক পথ হাটিল। সে দেশে কোট ঘর তত বেশী নয়, কিন্তু এখনকার অপেক্ষা তখন কোটা ঘর অধিক ছিল, মধ্যে মধ্যে একটি একটি বড় বড় অট্টালিকাও পাওয়া যাইত। ঐ দুই জন স্ত্রীলোক আসিয়া, এমনই একটা বড় অট্টালিকার সম্মুখে উপস্থিত হইল। বাড়ীর সম্মুখে দীঘি, দীঘিতে বাঁধা ঘাট। বাঁধা ঘাটের উপর কতকগুলা দ্বারবান্ বসিয়া, কেহ সিদ্ধি ঘুঁটিতেছিল, কেহ টপ্পা গাইতেছিল, কেহ স্বদেশের প্রসঙ্গে চিত্ত সমর্পণ করিতেছিল। তাহাদেরই মধ্যে এক জনকে ডাকিয়া পাঁচকড়ির মা বলিল, “পাড়ে ঠাকুর। ভাণ্ডারীকে ডেকে দাও না?” দ্বারবান্ বলিল, “হাম পাড়ে নেহি, হাম্ মিশর হোতে হেঁ।”

 পাঁচকড়ির মা। তা আমি জানি না, বাছা! পাঁড়ে কিসের বামুন? মিশর যেমন বামুন!

 তখন মিশ্রদেব প্রসন্ন হইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোম ভাণ্ডারী লেকে কেয়৷ করোগে?”

 পাচকড়ির মা। কি আর করিব? আমার ঘরে কতকগুলা নাউ কুমড়া তরকারী হয়েছে, তাই বলে যাব যে, কাল গিয়ে যেন কেটে নিয়ে আসে।

 দ্বারবান্। আচ্ছা, সো হাম্ বোলেঙ্গে। তোম্ ঘর্ মে যাও।

 পাঁচকড়ির মা। ঠাকুর, তুমি বলিলে কি আর সে ঠিকানা পাবে কার ঘরে তরকারী হয়েছে?

 দ্বারবান্। আচ্ছা । তোমারি নাম বোল্‌‌কে যাও।


 পাঁচকড়ির মা। যা আবাগির বেটা! তোকে একটা নাউ দিতাম, তা তোর কপালে হলো না।

 দ্বারবান্। আচ্ছা, তোম্ খাড়ি রহো। হাম্ ভাণ্ডারীকে বোলাতে হেঁ।

 তখন মিশ্ৰঠাকুর গুন্ গুন্ করিয়া পিলু ভাঁজিতে ভাঁজিতে অট্টালিকামধ্যে প্রবেশ করিলেন, এবং অচিরাৎ জীবন ভাণ্ডারীকে সংবাদ দিলেন যে, “এক্‌‌ঠো তরকারিওয়ালি আয়ি হৈ। মুঝ্‌কো কুছ্‌ মেলেগা, তোম্‌কো বি কুছ্‌ মেল সক্‌তা হায়। তোম্ জল্‌দী আও।”

 জীবন ভাণ্ডারীর বয়স কিছু বেশী, কতকগুলো চাবি ঘুন্ সিতে ঝোলান। মুখ বড় রুক্ষ। কিঞ্চিৎ লাভের প্রত্যাশ পাইয়া সে শীঘ্ৰ বাহির হইয়া আসিল। দেখিল, দুইটি স্ত্রীলোক দাঁড়াইয়া আছে। জিজ্ঞাসা করিল, “কে ডেকেছ গা?”

 পাঁচকড়ির মা বলিল, “এই আমার ঘরে কিছু তরকারি হয়েছে, তাই ডেকেছি। কিছু বা তুমি নিও, কিছু বা দরওয়ান্‌জীকে দিও, আর কিছু বা সরকারীতে দিও।”

 জীবন ভাণ্ডারী। তা তোর বাড়ী কোথা বলে যা, কাল যাব।

 পাঁচকড়ির মা। আর একটি দুঃখী অনাথা মেয়ে এয়েছে, ও কি বল্ বে একবার শোন।

 শ্রী গলা পৰ্য্যন্ত ঘোম্‌টা টানিয়া প্রাচীরে মিশিয়া এক পাশে দাঁড়াইয়াছিল। জীবন ভাণ্ডারী তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রুক্ষভাবে বলিল, “ও ভিক্ষে শিক্ষের কথা আমি হুজুরে কিছু বলিতে পারিব না।” পাঁচকড়ির মা তখন অস্ফুট স্বরে ভাণ্ডারী মহাশয়কে বলিল, “ভিক্ষে যদি কিছু পায় ত অৰ্দ্ধেক তোমার।”

 ভাণ্ডারী মহাশয় তখন প্রসন্নবদনে বলিলেন, “কি বল মা ?” ভিখারির পক্ষে ভাণ্ডারীর প্রভুর দ্বার অবারিত। শ্ৰী ভিক্ষার অভিপ্রায় জানাইল, সুতরাং ভাণ্ডারী মহাশয় তাহাকে মুনিবের কাছে লইয়া যাইতে বাধ্য হইলেন।

 ভাণ্ডারী শ্রীকে পৌছাইয়া দিয়া প্রভুর আজ্ঞামত চলিয়া গেল।

 শ্ৰী আসিয়া দ্বারদেশে দাঁড়াইল। অবগুণ্ঠনবতী, বেপমানা। গৃহকর্ত্তা বলিলেন, “তুমি কে?”

 শ্রী বলিল, “আমি শ্রী।”

 “শ্রী! তুমি তবে কি আমাকে চেন না? না চিনিয়া আমার কাছে আসিয়াছ? আমি সীতারাম রায়।”

 তখন শ্রী মুখের ঘোমটা তুলিল। সীতারাম দেখিলেন, অশ্রুপূর্ণ বর্ষাবারি-নিষিক্ত পদ্মের ন্যায়, অনিন্দ্যসুন্দরমুখী। বলিলেন, “তুমি শ্ৰী! এত সুন্দরী!'"

 শ্রী বলিল, “আমি বড় দুঃখী। তোমার ব্যঙ্গের যোগ্য নহি।” শ্ৰী কাঁদিতে লাগিল।

 সীতারাম বলিলেন, “এত দিনের পর কেন আসিয়াছ? আসিয়াছ ত অত কাঁদিতেছ কেন?”

 শ্রী তবু কাঁদে—কথা কহে না। সীতারাম বলিল, “নিকটে এসো।”

 শ্রী তখন মৃদুস্বরে বলিল, “আমি বিছানা মাড়াইব না—আমার অশৌচ।”

 সীতা। সে কি?

 গদগদস্বরে অশ্রুপূর্ণলোচনে শ্রী বলিতে লাগিল, “আজ আমার মা মরিয়াছেন।”

 সীতারাম। সেই বিপদে পড়িয়া কি তুমি আজ আমার কাছে আসিয়াছ?

 শ্রী। না—আমার মার কাজ আমিই যথাসাধ্য করিব। সে জন্য তোমায় দুঃখ দিব না। কিন্তু আজ আমার ভারি বিপদ্।

 সীতা। আর কি বিপদ্!

 শ্রী। আমার ভাই যায়। কাজি সাহেব তাহার জীয়ন্তে কবরের হুকুম দিয়াছেন। সে এখন হাবুজখানায় আছে।

 সীতা। সে কি? কি করেছে?

 তখন শ্রী যাহা যাহা শুনিয়াছিল এবং যাহা যাহা দেখিয়াছিল, তাহা মৃদুস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে আদ্যোপান্ত বলিল। শুনিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া সীতারাম বলিলেন, “এখন উপায়?”

 শ্রী। এখন উপায় তুমি। তাই এত বৎসরের পর এসেছি।

 সীতারাম। আমি কি করিব?

 শ্রী। তুমি কি করিবে? তবে কে করিবে? আমি জানি, তুমি সব পার।

 সীতা। দিল্লীর বাদশাহের চাকর এই কাজি। দিল্লীর বাদশাহের সঙ্গে বিরোধ করে কার সাধ্য?

 শ্রী বলিল, “তবে কি কোন উপায় নাই?”

 সীতারাম অনেক ভাবিয়া বলিলেন, “উপায় আছে। তোমার ভাইকে বাঁচাইতে পারি। কিন্তু আমি মরিব।”

 শ্রী। দেখ, দেবতা আছেন, ধর্ম্ম আছেন, নারায়ণ আছেন। কিছুই মিথ্যা নয়। তুমি দীন দুঃখীকে বাঁচাইলে তোমার কখনও অমঙ্গল হইবে না। হিন্দুকে হিন্দু না রাখিলে কে রাখিবে?

 সীতারাম অনেক ক্ষণ ভাবিল। পরে বলিল, “তুমি সত্যই বলিয়াছ, হিন্দুকে হিন্দু না রাখিলে কে রাখিবে? আমি তোমার কাছে স্বীকার করিলাম, গঙ্গারামের জন্য আমি যথাসাধ্য করিব।”

 তখন প্রীতমনে ঘোম্‌টা টানিয়া শ্রী প্রস্থান করিল।

 সীতারাম দ্বার অর্গলবদ্ধ করিয়া, ভৃত্যকে আদেশ করিলেন, “আমি যত ক্ষণ না দ্বার খুলি, তত ক্ষণ আমাকে কেহ না ডাকে।” মনে মনে একবার আবার ভাবিলেন, “শ্রী এমন শ্রী? তা ত জানি না। আগে শ্রীর কাজ করিব, তার পর অন্য কথা।” ভাবিলেন, “হিন্দুকে হিন্দু না রাখিলে কে রাখিবে?”