সীতার বনবাস/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।


রাম, মন্ত্রভবনে প্রবিষ্ট হইয়া, রাজাসনে উপবিষ্ট হইলেন, এবং সন্নিহিত পরিচারক দ্বারা, ভরত, লক্ষ্মণ, শত্রু, তিন, জনকে, সত্বর উপস্থিত হইবার নিমিত্ত, ডাকিয়া পাঠাইলেন। দিবাবসানসময়ে, আর্য্য জনকতনয়াসহবাসে কালযাপন করেন; ঈদৃশ সময়ে, মন্ত্রভবনে গমন করিয়া, অকস্মাৎ আমাদিগের আহবান করিলেন কেন, ইহার কিছুই নির্ণয় করিতে না পারিয়া, ভরতপ্রভৃতি সাতিশয় সন্দিহান ও আকুলহৃদয় হইলেন, এবং, মনে মনে নানা বিতর্ক করিতে করিতে, সত্বর গমনে মন্ত্রভবনে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, রাম, করতলে কপোল বিন্যস্ত করিয়া, একাকী উপবিষ্ট আছেন, মুহুর্মুহু দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগ করিতেছেন; নয়নযুগল হইতে অনর্গল অশ্রুজল নির্গত হইতেছে। অগ্রজের তাদৃশী দশা দৃষ্টিগোচর করিয়া, অনুজেরা বিষাদসাগরে মগ্ন হইলেন, এবং, কি কারণে তিনি এরূপ অবস্থাপন্ন হইয়াছেন, কিছুই বুঝিতে না পারিয়া, স্তব্ধ ও হতবুদ্ধি হইয়া, সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিলেন। অতি বিষম অনিষ্টসংঘটনের আশঙ্কা করিয়া, তিন জনের মধ্যে, কাহারও এরূপ সাহস হইল না যে, কারণ জিজ্ঞাসা করেন। অবশেষে, তাঁহারাও তিন জনে, ঘোরতর বিপৎপাত স্থির করিয়া, এবং রামের তাদৃশী দশা দর্শনে নিতান্ত কাতর ভাবাপন্ন হইয়া, অশ্রুবিসর্জন করিতে লাগিলেন।

 কিয়ৎ ক্ষণ পরে, রাম, উচ্ছলিত শোকাবেগের কথঞ্চিৎ সংবরণ ও নয়নের অশ্রুধারামার্জ্জন করিয়া, সস্নেহ সম্ভাষণ পূর্ব্বক, অনুজদিগকে সম্মুখদেশে বসিতে আদেশ করিলেন। তাঁহারা, আসনে উপবেশন করিয়া, কাতর ভাবে, রামচন্দ্রের নিতান্ত নিষ্প্রভ মুখচন্দ্রে দৃষ্টিযোজনা করিয়া রহিলেন। রামের নয়নযুগল হইতে, প্রবল বেগে, বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল। তদ্দর্শনে তাঁহারাও, যৎপয়োনাস্তি শোকাভিভূত হইয়া, প্রভূত বাষ্পবারি বিমোচিত করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, লক্ষ্মণ, আর অপেক্ষা করিতে না পারিয়া, বিনয়পূর্ণ বচনে জিজ্ঞাসা করিলেন, আর্য্য, আপনকার এই অবস্থা দেখিয়া, আমরা ম্রিয়মাণ হইয়াছি। ভবদীয়, ভাব দর্শনে স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, অবশ্যই কোনও অপ্রতিবিধেয় অনিষ্টসংঘটন হইয়াছে। গভীর জলধি, কখনও, অল্প কারণে আকুলিত হয় না; সামান্য বায়ুবেগের প্রভাবে, হিমাচল কদাচ বিচলিত হইতে পারে না। অতএব, কি কারণে, আপনি এরূপ কাতরভাবাপন্ন হইয়াছেন, তাহার সবিশেষ নির্দ্দেশ করি, আমাদের প্রাণরক্ষা করুন। আপনকার মুখারবিন্দ সায়ংকালের কমল অপেক্ষাও ম্লান, ও প্রভাতসময়ের শশধর অপেক্ষাও নিষ্প্রভ, লক্ষিত হইতেছে। ত্বরায় বলুন, আর বিলম্ব করিবেন না। আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে।

 লক্ষ্মণ, এইরূপ আগ্রহাতিশয় সহকারে, কারণ জিজ্ঞাসু হইলে, রামচন্দ্র অতি দীর্ঘনিশ্বাসভার পরিত্যাগ পূর্ব্বক, দুর্বহ শোকভরে অভিভূত হইয়া, নিতান্ত কাতর স্বরে থলিতে লাগিলেন, বৎস ভরত, বৎস লক্ষ্ণণ, বৎস শত্রুঘ্ন, তোমরা আমার জীবন; তোমরা আমার সর্ব্বস্ব ধন; তোমাদের নিমিত্তই আমি দুর্বহ রাজ্যভারের দুঃসহ বহনক্লেশ সহ্য করিতেছি। হিতসাধনে বা অহিতনিবারণে তোমরাই আমার প্রধান সহায়। আমি বিষম বিপদে পড়িয়াছি, এবং সেই বিপদ্‌ হইতে উদ্ধারলাভের অভিপ্রায়ে, তোমাদিগকে অসময়ে সমবেত করিয়াছি। আপতিত অনিষ্টের নিবারণোপায় একমাত্র আছে। আমি, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, অবশেষে, সেই উপায় অবলম্বন করাই সর্ব্বতোভাবে বিধেয় বোধ করিয়াছি। তোমরা অবহিত চিত্তে শ্রবণ কর; সকল বিষয়ের সবিশেষ সমস্ত তোমাদের গোচর করিয়া, সমুচিত অনুষ্ঠান দ্বারা, উপস্থিত, বিপৎপাত হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিব।

 এই বলিয়া, রাম বিরত হইলেন, এবং পুনর্বার, প্রবল বেগে, অশ্রুবিসর্জন করিতে লাগিলেন। অমুজেরা, তদ্দর্শনে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর কাতর হইয়া, ভাবিতে লাগিলেন, আর্য্যের ভাব দেখিয়া বোধ হইতেছে, অবশ্যই অতি বিষম অনর্থপাত ঘটিয়াছে; না জানি, কি সর্ব্বনাশের কথাই বলিবেন। কিন্তু, অনুভবশক্তি দ্বারা কিছুরই অনুধাবন করিতে না পারিয়া, শ্রেবণের নিমিত্ত নিতান্ত উৎসুক হইয়া, তাঁহারা, একান্ত আকুল হৃদয়ে, তদীয় বদনে দৃষ্টিযোজনা করিয়া রহিলেন।

 রাম, কিয়ৎ ক্ষণ, মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন, অনন্তর, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, ভ্রাতৃগণ, শ্রবণ কর; আমাদের পূর্ব্বে, ইক্ষাকুবংশে যে মহানুভব নরপতিগণ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহারা অপ্রতিহত প্রভাবে প্রজাপালন, ও অশেষবিধ অলৌকিক কর্ম্মসমুদয়ের অনুষ্ঠান দ্বারা, এই পরম পবিত্র রাজবংশকে ত্রিলোকবিখ্যাত করিয়া গিয়াছেন। আমার মত হতভাগ্য আর নাই; আমি জন্মগ্রহণ করিয়া সেই চিরপবিত্র ত্রিলোকবিখ্যাত বংশকে দুষ্পরিহর কলঙ্কপঙ্কে লিপ্ত করিয়াছি। লক্ষণ, তোমার কিছুই অবিদিত নাই। যৎকালে, আমরা তিন জনে পঞ্চবটীতে অবস্থিতি করি, দুর্বৃত্ত দশানন, আমাদের অনুপস্থিতিকালে, বলপূর্ব্বক, সীতারে আপন আলয়ে লইয়া যায়। সীতা একাকিনী, সেই দুর্বত্তের আলয়ে, দীর্ঘ কাল অবস্থিতি করেন। অবশেষে আমরা সুগ্রীবের সহায়তায়, দুরাচারের সমুচিত শাস্তিবিধান করিয়া, সীতার উদ্ধারসাধন করি। আমি সেই একাকিনী পরগৃহবাসিনী সীতারে লইয়া গৃহে রাখিয়াছি; ইহাতে পৌরগণ ও জনপদবর্গ অসন্তোষপ্রদর্শন ও কলঙ্ককীর্ত্তন করিতেছে। এজন্য, আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, জানকীরে আর গৃহে রাখিব না। সর্ব্ব প্রযত্নে প্রজারঞ্জন, রাজার পরম ধর্ম্ম। যদি তাহাতে কৃতফার্য্য হইতে না পারি, নিতান্ত অনার্য্যের ন্যায়, বৃথা জীবনধারণের ফল কি বল। এক্ষণে, তোমরা, প্রশস্ত মনে, অনুমোদন কর; তাহা হইলে, আমি উপস্থিত সঙ্কট হইতে পরিত্রাণ পাই।

 অগ্রজের এই কথা শ্রবণগগাচর করিয়া, অনুজেরা যৎপরোনাস্তি বিষন্ন হইলেন; এবং, ভয়ে ও বিস্ময়ে একান্ত অভিভূত ও কিংবর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া, কিয়ৎ ক্ষণ, অধোমুখে মৌনভাবে অবস্থিতি করিলেন। পরিশেষে, লক্ষ্মণ, অতি কাতর স্বরে, বিনীত ভাবে, নিবেদন করিলেন,—আর্য্য, আপনি যখন যে আজ্ঞা করিয়াছেন, আমরা কখনও তাহাতে দ্বিরুক্তি বা আপত্তি করি নাই। এক্ষণেও, আমরা আপনার আজ্ঞাপ্রতিরোধে প্রবৃত্ত নহি। কিন্তু, আপনকার প্রতিজ্ঞা শুনিয়া, আমাদের প্রাণপ্রয়াণের উপক্রম হইয়াছে। আমরা যে, আপনার নিকটে আসিয়া, এরূপ সর্ব্বনাশের কথা শুনিব, এক মুহূর্ত্তের নিমিত্ত, আমাদের অন্তঃকরণে সে আশঙ্কার উদয় হয় নাই। যাহা হউক, এ বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে, যদি অনুমতি প্রদান করেন, নিবেদন করি।

 লক্ষ্মণের এই বিনয়পূর্ণ কাতর বাক্য শ্রবণগগাচর করিয়া, রাম বলিলেন, বৎস, যাহা বলিতে ইচ্ছা হয়, স্বচ্ছন্দে বল। তখন লক্ষণ বলিলেন,—আর্য্যা জানকী একাকিনী রাবণগৃহে অবস্থিতি করিয়াছিলেন, যথার্থ বটে; এবং রাবণও অতি দুর্বৃত্ত, তাহার কোনও সংশয় নাই। কিন্তু, দুরাচারের সমুচিত শান্তিবিধানের পর, আর্য্যা আপনার সম্মুখে আনীত হইলে, আপনি, লোকাপবাদভয়ে, প্রথমতঃ, গ্রহণ করিতে অসম্মত হইয়াছিলেন; পরে, অলৌকিক পরীক্ষা দ্বারা, তিনি শুদ্ধচারিণী বলিয়া নিঃসংশয়িত রূপে স্থিরীকৃত হইলে, তাঁহারে গৃহে আনিয়াছেন। সে পরীক্ষাও সর্ব্ব জনসমক্ষে সমাহিত হইয়াছিল। আমরা উভয়ে, আমাদের সমস্ত সেনা ও সেনাপতিগণ, এবং যাবতীয় দেবগণ, দেবর্ষিগণ, ও মহর্ষিগণ পরীক্ষাকালে উপস্থিত ছিলেন। সকলেই, সাধুবাদপ্রদান পূর্ব্বক, আর্য্যা একান্ত শুদ্ধচারিণী বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছেন। সুতরাং, তাঁহারে আর পরগৃহবাসনিবন্ধন অপবাদে দুষিত করিবার সম্ভাবনা নাই। অতএব, আপনি কি কারণে, এক্ষণে, এরূপ বিষম প্রতিজ্ঞা করিতেছেন, বুঝিতে পারিতেছি না। অমূলক লোকাপবাদ শুনিয়া, ভবাদৃশ মহানুভাবদিগের বিচলিত হওয়া উচিত নহে। সামান্য লোকের, ন্যায় অন্যায় বিবেচনা নাই। তাহাদের বুদ্ধি ও বিবেচনা অতি সামান্য; যাহা তাহাদের মনে উদিত হয়, তাহাই বলে; এবং যাহা শুনে, সম্ভব অসম্ভব বিবেচনা না করি, প্রকৃত ঘটনা বলিয়া তাহাতেই বিশ্বাস করে। তাহাদের কথায় আস্থা করিতে গেলে, সংসারযাত্রা, সম্পন্ন হয় না। আর্য্যা যে সম্পূর্ণ শুদ্ধচারিণী, সে বিষয়ে, অন্ততঃ আমি যত দূর জানি, আপনকার অন্তঃকরণে অণুমাত্র সংশয় নাই'; এবং, অলৌকিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া, তিনি আপন শুদ্ধচারিতার যে অসংশয়িত পরিচয়প্রদান করিয়াছেন, তাহাতে কাহারও অন্তঃকরণে অণুমাত্র সংশয় থাকিতে পারে না। এমন স্থলে, আর্য্যাকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিলে, লোকে আমাদিগকে নিতান্ত অপদার্থ স্থির করিবে। এবং ধর্ম্মতঃ বিবেচনা করিতে গেলে, আমাদিগকে দুরপনেয় পাপপঙ্কে লিপ্ত হইতে হইবে। অতএব, আপনি সকল বিষয়ের সবিশেষ পর্য্যালোচনা করিয়া কার্য্যাবধারণ করুন। আমরা আপনার একান্ত আজ্ঞাবহ; যে আজ্ঞা করিবেন, তাহাই, অসন্দিহান চিত্তে, শিবোধার্য্য করিব।

 এই বলিয়া, লক্ষণ বিরত হইলেন। রাম, কিয়ৎ ক্ষণ, মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর, দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, বৎস, সীতা যে একান্ত শুদ্ধচারিণী, সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় নাই; সামান্য লোকে যে, কোনও বিষয়ের সবিশেষ অনুধাবন না করিয়া, যাহা শুনে, বা যাহা তাহাদের মনে উদিত হয়, তাহাতেই বিশ্বাস করে ও তাহারই আন্দোলন করে, তাহাও বিলক্ষণ জানি। কিন্তু, এ বিষয়ে প্রজাদিগের কিছুমাত্র দোষ নাই; আমাদের অপরিণামদর্শিতা ও অবিমৃশ্যকারিতা দোষেই, এই বিষম সর্ব্বনাশ ঘটিতেছে। যদি আমরা, অযযাধ্যায় আসিয়া, সমবেত পৌরগণ ও জানপদবর্গ সমক্ষে, জানকীর পরীক্ষা করিতাম, তাহা হইলে, তাহাদের অন্তঃকরণ হইতে তৎসংক্রান্ত সকল সংশয় অপসারিত হইত। সীতা, অলৌকিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া, স্বীয় শুদ্ধাচারিতার অসংশয়িত পরিচয়প্রদান করিয়াছেন বটে; কিন্তু, সেই পরীক্ষার যথার্থতা বিষয়ে প্রজালোকের সম্পূর্ণ বিশ্বাস নাই। বোধ করি, অনেকে পরীক্ষাব্যাপারের বিন্দু বিসর্গ অবগত নহে। সুতরাং, সীতায় চরিত্র বিষয়ে তাহাদের সংশয় দূর হয় নাই। বিশেষতঃ, রাবণের চরিত্র, ও বহু কাল একাকিনী সীতার তদীয় আলয়ে অবস্থান, এ দুই বিষয়ের বিবেচনা করিলে, সীতার চরিত্র বিষয়ে সন্দিহান হওয়া আশ্চর্য্যের বিষয় নহে। অতএব, আমি প্রজাদিগকে কোনও অংশে দোষ দিতে পারি না। আমারই অদৃষ্টবৈগুণ্য বশতঃ, এই উপদ্রব উপস্থিত হইতেছে। আমি যদি রাজ্যের ভারগ্রহণ না করিতাম; এবং, ধর্ম্ম সাক্ষী করিয়া, প্রজারঞ্জনপ্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ না হইতাম; তাহা হইলে, অমুলক লোকাপবাদে অবজ্ঞাপ্রদর্শন করিয়া, নিরুদ্বেগে সংসারযাত্রানির্বাহ করিতাম। যদি রাজা হইয়া প্রজারঞ্জন করিতে না পারিলাম, তাহা হইলে, জীবনধারণের ফল কি? দেখ, প্রজালোকে, সীতা অসতী বলিয়া, সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছে; তাহাদের অন্তঃকরণ হইতে সেই সিদ্ধান্ত অপসারিত করা কোনও মতে সস্তাবিত নহে। সুতরাং, সীতাকে গৃহে রাখিলে, তাহারা আমারে অসতীসংসর্গী বলিয়া ঘৃণা, করিবে। যাবজ্জীবন ঘৃণাস্পদ হওয়া অপেক্ষা প্রাণত্যাগ করা ভাল। আমি, প্রজারঞ্জনের অনুরোধে; প্রাণত্যাগে। পরায়ুখ নহি; তোমরা আমার প্রাণাধিক; যদি ঐ অনুরোধে তোমাদিগেরও সংসর্গপরিত্যাগ করিতে হয়, তাহাতেও কাতর নহি; সে বিবেচনায়, সীতাপরিত্যাগ তাদৃশ দুরূহ ব্যাপার নহে। অতএব, তোমরা যত বল না কেন, ও যত অন্যায় হউক না কেন, আমি, সীতাকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া, কুলের কলঙ্কবিমোচন করিব, নিশ্চয় করিয়াছি। যদি তোমাদের আমার উপর দয়া ও স্নেহ থাকে, এ বিষয়ে আর আপত্তি উত্থাপিত করিও না। হয় সীতাপরিত্যাগ, নয় প্রাণপরিত্যাগ করিব, ইহার একতয় পক্ষ স্থির সিদ্ধান্ত জানিবে।

 এই বলিয়া, দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগ করিয়া, রাম কিয়ৎ ক্ষণ, অশ্রুপূর্ণ নয়নে, অবনত বদনে, মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর, লক্ষণকে বলিলেন, বৎস, অন্তঃকরণ হইতে সকল ক্ষোভ দূর করিয়া, আমার আদেশপ্রতিপালন কর। ইতঃপূর্ব্বেই, সীতা তপোবনদর্শনের অভিলাষ করিয়াছেন; সেই ব্যপদেশে, তুমি তাঁহারে লইয়া গিয়া মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রমে রাখিয়া আইস; তাহা হইলে, আমার প্রীতিসম্পাদন করা হয়। এ বিষয়ে আপত্তি করিলে, আমি যার পর নাই অসন্তুষ্ট হইব। তুমি কখনও আমার আত্মালঙ্ঘন কর নাই। অতএব বৎস; কল্য প্রভাতেই, মদীয় আদেশের অনুযায়ী কার্য্য করিবে, কোনও মতে অন্যথা করিবে না। আর, আমার সবিশেষ অনুরোধ এই, আমি যে হারে, এ জন্মের মত, বিসর্জন দিলাম, ভাগীরথী পার হইবার পূর্ব্বে, জানকী যেন, কোনও অংশে, এ বিষয়ের কিছুমাত্র জানিতে না পারেন। তোমার হৃদয় কারুণ্যরসে পরিপূর্ণ; এই নিমিত্ত, তোমায়। সাবধান করিয়া দিলাম।

 এই বলিয়া, রামচন্দ্র, অবনত বদনে, অশ্রুবিমোচন করিতে লাগিলেন। তাঁহারাও তিন জনে, জানকীর পরিত্যাগ বিষয়ে তাঁহাকে তদ্রূপ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখিয়া, আপত্তিকরণে বিরত হইয়া, মৌনাবলম্বন পূর্ব্বক, বাষ্পবারিবিসর্জন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, রাম, সকলকে বিদায় দিয়া, বিশ্রামভবনে গমন করিলেন। চারি জনেরই, যার পর নাই, অসুখে রজনীযাপন হইল।