সুকান্ত সমগ্র/অভিযান/সূর্য-প্রণাম
সূর্য-প্রণাম
উদয়াচল
আগমনী
সমবেত গান
পুব সাগরের পার হতে কোন পথিক তুমি উঠলে হেসে,
তিমির ভেদি ভুবন-মোহন আলোর বেশে।
ওগো পথিক, তোমার আলোয় ঘুচুক জরা
ছন্দে নাচুক বসুন্ধর॥
গগনপথে যাত্রা তোমার নিরুদেশে।
তুমি চিরদিনের দোলে দোলাও অনস্ত আবর্তনে,
নৃত্যে কাঁপুক চিত্ত মোদের নটরাজের নর্তনে।
আলোর সুরে বাজাও বাঁশি,
চিরকালের রূপ-বিকাশি’
আঁধার নাশে সুন্দর হে তোমার বাণীর মূক আবেশে॥
আবির্ভাব
আবৃতি
সূর্যদেব,
আজি এই বৈশাখের খরতপ্ত তেজে
পৃথিবী উন্মত্ত যবে তুমি এলে সেজে
কনক-উদয়াচলে প্রথম আবেগে
ফেলিলে চরণচিহ্ন, তার স্পর্শ লেগে
ধরণী উঠিল কাঁপি গোপন স্পন্দনে
সাজাল আপন দেহ পুষ্প ও চন্দনে
তব পুজা লাগি। পৃথিবীর চক্ষুদান
হল সেই দিন। অন্ধকার অবসান,
যবে দ্বার খুলে প্রভাতের তীরে অসি
বলিলে, হে বিশ্বলোক তোরে ভালবাসি,
তখনি ধরিত্রী তার জয়মাল্যখানি
আশীৰ্বাদসহ তব শিরে দিল আনি—
সস্মিত নয়নে। তারে তুমি বলেছিলে,
জানি এ যে জয়মাল্য, মোরে কেন দিলে?
কতবার তব কানে পঁচিশে বৈশাখ
সুদূরের তরে শুধু দিয়ে গেল ডাক,
তুমি বলেছিলে চেয়ে সম্মুখের পানে
“হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।”
বরণ
বর্ণনা
হঠাৎ আলোর আভাস পেয়ে কেঁপে উঠল
ভোরবেলা, কোন্ পুলকে, কোন্ অজানা সম্ভাবনায়?
রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করে অন্ধকার।
শিউলি বকুল ঝ'রে পড়ে শেষ রাত্রির কান্নার মতো,
হেমন্ত-ভোরের শিশিরের মতো।
অস্পষ্ট হল অন্ধকার; স্বচ্ছ, আরও স্বচ্ছ
মৃতপ্রায়ের আগ্রহের মতো পাণ্ডুর আলো এসে পড়ে
আশীর্বাদের মতো ঝরা ফুলের মরা চোখে,
শুভ্র কপোলে,—ঘুমন্ত হাসির মতো তার মায়া।
পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা এল উচ্ছ্বসিত বন্যার বেগে,
হাতে তাদের আহরণী-ডালা;
তারা অবাক হয়ে দেখলে
একী! নতুন ফুল ফুটেছে তাদের আঙিনায়
রবির প্রথম আলো এসে পড়েছে তার মুখে,
ওরা বললে, ওতো সূর্যমুখী।
পিলু-বারোয়াঁর স্বর তখনও রজনীগন্ধার বনে
দীর্ঘশ্বাসের মতো সুরভিত-মত্ততায় হা-হা করছে;
কিন্তু তাও গেল মিলিয়ে। শুধু জাগিয়ে দিয়ে
গেল হাজার সূর্যমুখীকে।
সূর্য উঠল। অচেতন জড়তার বুকে ঠিকরে
পড়তে লাগল, বন্ধ জানলায় তার কোমল
আঘাত, অজস্র দীপ্তিতে বিহ্বল।
পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা ফিরে গেল উজ্জ্বল, উচ্ছল হয়ে
বুকে তাদের সূর্যমুখীর
অদৃশ্য সুবাস।
মঙ্গলাচরণ
গান
ওগো কবি, তুমি আপন ভোলা—
আনিলে্,তুমি নিথর জলে ঢেউয়ের দোলা,
মালিকাটি নিয়ে মোর
একী বাঁধিলে অলখ-ডোর।
নিবেদিত প্রাণে গোপনে তোমার কি সুর তোলা,
জেনেছ তো তুমি সকল প্রাণের নীরব কথা,
তোমার বাণীতে আমার মনের এ ব্যাকুলতা
পেয়েছ কি তুমি সাঁঝের বেলাতে
যখন ছিলাম কাজের খেলাতে
তখন কি তুমি এসেছিলে, ছিল যে দুয়ার খোলা?
আহবান
সমবেত গান
আমাদের ডাক এসেছে
এবার পথে চলতে হবে,
ডাক দিয়েছে গগন-রবি
ঘরের কোণে কেই বা রবে
ডাক এসেছে চলতে হবে আজ সকালে
বিশ্বপথে সবার সাথে সমান তালে
পথের সাথী আমরা রবির
সাঁঝ-সকালে চলরে সবে।
ঘুম থেকে আজ সকালবেলা ওঠ রে
ডাক দিল কে পথের পানে ছোট রে,
পিছন পানে তাকাস নি আজ চল সমুখে
জয়ের বাণী নুতন প্রাতে বল ও-মুখে
তোদের চোখে সোনার আলো
সফল হয়ে ফুটবে কবে॥
স্তব
আবৃত্তি
কবিগুরু, আজি মধ্যাহ্ণের হেচর অর্ঘ্য
দিলাম তোমায় সাজায়ে,
পুথিবীর বুকে রচেছ শাস্তিস্বর্গ
মিলনের সুর বাজায়ে।
যুগে যুগে যত আলোক-তীর্থযাত্রী
মিলিবে এখানে আসিয়া,
তোমার স্বর্গ এনে দেবে মধুরাত্রি
তাহাদের ভালবাসিয়া।
তারা দেবে নিতি শাস্তির জয়মাল্য
তোমার কণ্ঠে পরায়ে,
তোমার বাণী যে তাহাদের প্রতিপাল্য,
মর্মেতে যাবে জড়ায়ে।
তুমি যে বিরাট দেবতা শাপভ্রষ্ট
ভুলিয়া এসেছ মর্তে
পৃথিবীর বিষ পান করে নাই এখনো তোমার ওষ্ঠ
ঝঞ্চা-প্রলয়-আবর্তে।
আজিকার এই ধুলিময় মহাবাসরে
তোমারে জানাই প্রণতি,
তোমার পূজা কি শঙ্খঘণ্টা কাঁসরে?
ধূপ-দীপে তব আরতি?
বিশ্বের আজ শান্তিতে অনাসক্তি,
সভ্য মানুষ যোদ্ধা,
চলেছে যখন বিপুল রক্তারক্তি,
তোমারে জানাই শ্রদ্ধা।
অবশেষ
বর্ণনা
কিন্তু মধ্যাহ্ন তো পেরিয়ে যায়
সন্ধ্যার সন্ধানে, মেঘের ছায়ায়
বিশ্রাম করতে করতে, আকাশের
সেই ধূ-ধূ করা তেপাস্তরের মাঠ।
আর সূর্যও তার অবিরাম আলোকসম্পাত
ক’রে ঢলে পড়ল সাঁঝ-গগনে।
সময়ের পশ্চাতে বাঁধা সূর্যের গতি
কী সূর্যের পিছনে বাঁধা সময়ের গতি
তা বোঝা যায় না।
দিন যায় ভাবীকালকে আহবান করতে
একটা দিন আর একটা ঢেউ,
সময় আর সমুদ্র।
তবু দিন যায়
সূর্যের পিছনে, অন্ধকারে অবগাহন
করতে করতে।
যেতে হবে।
প্রকৃতির কাছে এই পরাভবের লজ্জায়
আর বেদনায় রক্তিম হল
সূর্যের মুখ,
আর পৃথিবীর লোকেরা;
তাদের মুখ পুব-আকাশের মতো
কালো হয়ে উঠল।
মিনতি
সমবেত গান
দাঁড়াও ক্ষণিক পথিক হে,
যেও না চলে,
অরুণ-আলো কে যে দেবে
যাও গো বলে।
ফেরো তুমি যাবার বেলা;
সাঁঝ-আকাশে রঙের মেলা—
দেখছ কী কেমন ক’রে
আগুন হয়ে উঠল জ্বলে।
পুব-গগনের পানে বারেক তাকাও
বিরহেরই ছবি কেন আঁকাও
আঁধার যেন দৈত্য সম আসছে বেগে,
শেষ হয়ে যাক তারা তোমার ছোঁয়াচ লেগে
থামো ওগো, যেও না হয়
সময় হলে॥
সূর্য-প্রণাম
অস্তাচল
প্রান্তিক
অবৃত্তি
বেলাশেষে শান্তছায় সন্ধ্যার আভাসে
বিষণ্ণ মলিন হয়ে আসে,
তারি মাঝে বিভ্রান্ত পথিক
তৃপ্তিহীন খুঁজে ফেরে পশ্চিমের দিক।
পথপ্রান্তে
প্রাচীন কদম্বতরুমূলে,
ক্ষণতরে স্তব্ধ হয়ে যাত্রা যায় ভুলে।
আবার মলিন হাসি হেসে
চলে নিরুদ্দেশে।
রজনীর অন্ধকারে একটি মলিন দীপ হাতে
কাদের সন্ধান করে উষ্ণ অশ্রুপাতে
কালের সমাধিতলে।
স্মৃতিরে সঞ্চয় করে জীবন-অঞ্চলে;
মাঝে মাঝে চেয়ে রয় ব্যথা ভরা পশ্চিমের দিকে,
নির্নিমিখে।
যেথায় পায়ের চিহ্ন পড়ে আছে অমর অক্ষরে
সেথায় কাদের আর্তনাদ বারংবার বৈশাখীর ঝড়ে।
আবার সম্মুখপানে
যাত্রা করে রাত্রির আহবানে।
ক্ষণদীপ উর্বর আলোতে
চিরন্তন পথের সংকেত
রেখে যায় প্রভাতের কানে।
অকস্মাৎ আত্মবিস্মৃতির অন্তঃপুরে,
ভেসে ওঠে মানসমুকুরে
উত্তর কালের আর্তনাদ,—
“কবিগুরু
আমাদের যাত্রা শুরু
কালের অরণ্য পথে পথে
পরিত্যক্ত তব রাজ-রথে
আজি হতে শতবর্ষ আগে
অস্ত গোধূলির সন্ধ্যারাগে
যে দিগন্ত হয়েছে রক্তিম,
সেথা আজ কারো চিত্তবীণা
তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বাজে কিনা
সে কথা শুধাও?
শুধু দিয়ে যাও
ক্ষণিকের দক্ষিণ বাতাসে তোমার সুবাস
বাণীহীন অস্তরের অন্তিম আভাস।
তাই আজ বাধামুক্ত হিয়া
অজস্র উপেক্ষাভরে বিস্মৃতিরে পশ্চাতে ফেলিয়া
ছিন্নবাধা বলাকার মতো
মত্ত অবিরত,
পশ্চাতের প্রভাতের পুষ্প-কুঞ্জবনে
আজ শূন্য মনে।”
তাই উচ্চকিত পথিকের মন
অকারণ
উচ্ছলিত চঞ্চল পবনে
অনাগত গগনে গগনে।
ক্লান্ত আজ প্রভাতের উৎসবের বাঁশি;
পুরবাসী নবীন প্রভাতে
পুরাতন জয়মাল্য হাতে!
অস্তাচলে পথিকের মুখে মুর্ত হাসি॥
শেষ মিনতি
গান
ও কে যায় চলে কথা না বলে, দিও না যেতে
তাহারই তরে আসন ঘরে রেখেছি পেতে।
কত কথা আছে তার মনেতে সদাই,
তবু কেন রবি কহে আমি চলে যাই;
রামধনু রথে
বিদায়ের পথে
উঠিল মেতে।
রঙে রঙে আজ গোধুলি গগন
রঙিন কী হল, বিলাপে মগন।
আমি কেঁদে কই যেও না কোথাও,
সে যে হেসে কয় মোরে যেতে দাও
বাড়ায়ে বাহু
মরণ-রাহু
চাহিছে পেতে
আয়োজন
বর্ণনা
হঠাৎ বুঝি তোমার রথের সাতটি ঘোড়া উঠল
হ্রেষা-রবে চঞ্চল হয়ে, যাবার ডাক শুনি?
অস্তপথ আজ তোমারই প্রত্যাশায় উন্মুখ, হে কবি,
কখন তুমি আসবে?
কবে, কখন তুমি এসে দাঁড়ালে
অস্তপথের সীমানায়, কেউ জানল না; এমন কী
তুমিও না!
একবার ভেবে দেখেছ কি,
হে ভাবুক, তোমার চলমান ঘোড়ার শেষ পদক্ষেপের
আঘাতে কেমন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উঠবে আমাদের
অস্তর লোক?
তোমার রচিত বাণীর মন্দিরে কোন্
নতুন পুজারী আসবে জানি না, তবু তোমার আসন হবে
শূন্য আর তোমার নিত্য-নূতন পূজাপদ্ধতি, অর্থ্য-উপচার
আর মন্দিরের বেদী স্পর্শ করবে না। দেউলের ফাটল
দিয়ে কোন অশখ-তরু চাইবে আকাশ, চাইবে তোমার
মন্দিরে তার প্রতিষ্ঠা, জানি না। তবু একদিন তা
সম্ভব, তুমিও জানো। সেই দিনকার কথা
ভেবে দেখেছ কি, হে দিগন্ত-রবি?
তোমার বেণুতে আজ শেষ সুর কেঁপে উঠল।
তুমি যাবে আমাদের মথিত করে। কোন্ মহাদেশের
কোন্ আসনে হবে তোমার স্থান? বিশ্ববীণার তারে আজ
কোন্ সুর বেজে উঠেছে, জানো? সে তোমারই বিদায়
বেদনায় সকরুণ ওপারের সুর। এই সুরই চিরন্তন,
সত্য এবং শাশ্বত। যুগের পর যুগ যে সুর ধ্বনিত হয়ে
আসছে, আবহমানকালের সেই সুর। সৃষ্টি-সুরের
প্রত্যুত্তর এই সুরের নাম লয়। তান-লয় নিয়ে তোমার
খেলা চলেছে কতকাল, আজ সেই লয়ের তান রণরণিত হচ্ছে
কোন্ অদৃশ্য তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, জানি না।
কোন্ যুগান্তরের পারেও ধ্বনিত হবে সেই সুর
কতদূর—তা কে জানে।
যাত্রা
আবৃত্তি
অমৃতলোকের যাত্রী হে অমর কবি, কোন প্রস্থানের
পথে তোমার একাকী অভিযান। প্রতিদিন তাই
নিজেরে করেছ মুক্ত, বিদায়ের নিত্য-আশঙ্কায়
পৃথ্বীর বন্ধন ভিত্তি নিশ্চিহ্ন করিতে বিপুল প্রয়াস
তব দিনে দিনে হয়েছে বর্ধিত। এই হাসি গান,
ক্ষণিকের অনিশ্চিত বুদের মতো; নশ্বর জীবন
অনন্ত কালের তুচ্ছ কণিকার প্রায় হাসি ও ক্রন্দনে
ক্ষয় হয়ে যায় তাই ওরা কিছু নয়, তুমিও জানিতে,
‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন-যৌবন-ধন-মান’
তবু তুমি শিল্পীর তুলিকা নিয়ে করেছ অঙ্কিত
সভ্যতার প্রত্যেক সম্পদ, সুন্দরের সুন্দর অর্চনা।
বিশ্ব প্রদর্শনী মাঝে উজ্জ্বল তোমার সৃষ্টিগুলি
পৃথিবীর বিরাট সম্পদ। স্রষ্টা তুমি, দ্রষ্টা তুমি
নূতন পথের। সেই তুমি আজ পথে পথে,
প্রয়াণের অস্পষ্ট পরিহাসে আমাদের করেছ
উন্মাদ। চেয়ে দেখি চিতা তব জ্বলে যায় অসহ্য
দাহনে, জ্বলে যায় ধীরে ধীরে প্রত্যেক অন্তর।
তুমি কবি, তুমি শিল্পী, তুমি যে বিরাট, অভিনব
সবারে কাঁদায়ে যাও চুপি চুপি একী লীলা তব॥
বিদায়
গান
ঝুলন-পূর্ণিমাতে
নীরব নিঠুর মরণ’সাথে
কে তুমি ওগো মিলন-রাখী
বাঁধিলে হাতে?
শ্রাবণদিনে উদাস হাওয়া,
কাঁদিল একী,
পথিক রবির চলে যাওয়া
চাহিয়া দেখি,
ব্যাকুল প্রাণে সজলঘন
নয়ন পাতে॥
বিদায় নিতে চায় কে ওরে
বাঁধরে তারে বজ্রডোরে
আলোর স্বপন ভেঙেছে মোর
আঁধার যেথায় শ্রাবণ-ভোর
ঘুম টুটে মোর সকল-হারা
এই প্রভাতে॥
প্রণতি
সমবেত গান
নমো রবি, সূর্য দেবতা
জয় অগ্নি-কিরণময় জয় হে
সহস্র-রশ্মি বিভাসিত,
চির অক্ষয় তব পরিচয় হে।
জয় ধ্বান্ত-বিনাশক জয় সূর্য
দিকে দিকে বাজে তব জয়-তূর্য
অনুক্ষণ কাঁদে মন, অকারণ অকারণ
কোথা তুমি মহামঙ্গলময় হে।
কোথা সৌম্য শান্ত তব দীপ্ত ছবি
কোথা লাবণ্যপুঞ্জ হে ইন্দ্র রবি,
তুমি চিরজাগ্রত তুমি পুণ্য
রবিহীন আজি কেন মহাশূন্য
যুগে যুগে দাও তব আশিস অভয় হে॥