সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/ইস্কুলের গল্প/আজব সাজা
(পৃ. ১৪০-১৪২)
“পণ্ডিতমশাই, ভোলা আমায় ভ্যাংচাচ্ছে।” “না, পণ্ডিতমশাই, আমি কান চুলকোচ্ছিলাম তাই মুখ বাঁকা মতন দেখাচ্ছিল।” পণ্ডিতমশাই চোখ না খুলিয়াই অত্যন্ত নিশ্চিন্তভাবে বলিলেন, “আঃ! কেবল বাঁঁদরামি! দাঁড়িয়ে থাক।” আধ মিনিট পর্যন্ত সব চুপচাপ। তার পরই আবার শোনা গেল, “দাঁড়াচ্ছিস না যে?” “আমি সাঁড়াব কেন? তোকেই তো দাঁড়াতে বলল।” “যাঃ আমায় বলেছে না আর কিছু। গণ্শাকে জিজ্ঞেস কর। কিরে গণ্শা, ওকে দাঁড়াতে বলেছে না?” গণেশের বুদ্ধি কিছু মোটা, সে আস্তে আস্তে উঠিয়া গিয়া পণ্ডিত- মহাশয়কে ডাকিতে লাগিল, “পণ্ডিতমশাই। ও পণ্ডিতমশাই।” পণ্ডিতমশাই বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “কি বলছিস, বল-না।” গণেশচন্দ্র অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কাকে দাঁড়াতে বলেছেন পণ্ডিতমশাই?” পণ্ডিতমহাশয় এক মুহর্ত কটমটে চোখ মেলিয়াই সাংঘাতিক ধমক দিয়া বলিলেন, “তোকে বলেছি, দাঁড়া!” বলিয়াই আবার চোখ বুজিলেন।
গণেশচন্দ্র দাঁড়াইয়া রহিল। আবার মিনিটখানেক সব চুপচাপ। হঠাৎ ভোলা বলিল, “ওকে এক পায়ে দাঁড়াতে বলেছিল না ভাই?” গণেশ বলিল, “কক্ষনো না, খালি দাঁড়া বলেছে।” বিশু বলিল, “এক আঙুল তুলে দেখিয়েছিল, তার মানেই এক পায়ে দাঁড়া।” পণ্ডিতমশাই যে ধমক দিবার সময়ে তর্জনী তুলিয়াছিলেন, এ কথা গণেশ অস্বীকার করিতে পারিল না। বিশু আর ভোলা জেদ করিতে লাগিল, “শিগগির এক পায়ে দাঁড়া বলছি, তা না হলে এক্ষুনি বলে দিচ্ছি।”
গণেশ বেচারা ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি এক পা তুলিয়া দাঁড়াইয়া বহিল। অমনি ভোলা আর বিশুর মধ্যে তুমুল তর্ক বাধিয়া গেল। এ বলে ডান পায়ে দাঁড়ানো উচিত, ও বলে, না, আগে বাঁ পা। গণেশের মহা মুস্কিল! সে আবার পণ্ডিতমহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিতে গেল, “পণ্ডিতমশাই, কোন পা?”
পণ্ডিতমশাই তখন কি যেন একটা স্বপ্ন দেখিয়া অবাক হইয়া নাক ডাকিতেছিলেন। গণেশের ডাকে হঠাৎ তন্দ্রা ছুটিয়া যাওয়ায় তিনি সাংঘাতিকরকম বিষম খাইয়া ফেলিলেন। গণেশ বেচারা তাহার প্রশ্নের এরকম জবাব একেবারেই কল্পনা করে নাই, সে অত্যন্ত ভয় পাইয়া বলিল, “ঐ যা, কি হবে?” ভোলা বলিল, “দৌড়ে জল নিয়ে আয়।” বিশু বলিল, “শিগগির মাথায় জল দে।” গণেশ এক দৌড়ে কোথা হইতে একটা কুঁজা আনিয়া ঢক্ঢক্ করিয়া পণ্ডিতমশায়ের টাকের উপর জল ঢালিতে লাগিল। পণ্ডিতমশায়ের বিষম খাওয়া খুব চটপট থামিয়া গেল, কিন্তু তাঁহার মুখ দেখিয়া গণেশের হাতে জলের কুঁজা ঠকঠক করিয়া কাঁপিতে লাগিল।
ভয়ে সকলেই খুব গম্ভীর হইয়া রহিল, খালি শ্যামলাল বেচারার মুখটাই কেমন যেন আহ্লাদীগোছের হাসি-হাসি মতন, সে কিছুতেই গম্ভীর হইতে পারি না। পণ্ডিতমশাইয়ের রাগ হঠাৎ তাহার উপরেই ঠিকরাইয়া পড়িল। তিনি বাঘের মতন গুমগুমে গলায় বলিলেন, “উঠে আয়।” শ্যামলাল ভয়ে কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, “আমি কি করলাম? গণ্শা জল ঢালল, তা আমার দোষ কি?” পণ্ডিতমশাই মানুষ ভালো, তিনি শ্যামলালকে ছাড়িয়া গণ্শার দিকে তাকাইয়া দেখেন তাহার হাতে তখনো জলের কুঁজা। গণেশ কোনো প্রশ্নের অপেক্ষা না করিয়াই বলিয়া ফেলিল, “ভোলা আমাকে বলেছিল।” ভোলা বলিল, “আমি তো খালি জল আনতে বলেছিলাম। বিশু বলছিল, মাথায় ঢেলে দে।” বিশু বলিল, “আমি কি পণ্ডিতমশায়ের মাথায় দিতে বলেছি? ওর নিজের মাথায় দেওয়া উচিত ছিল, তা হলে বুদ্ধিটা ঠাণ্ডা হত।”
পণ্ডিতমহাশয় খানিকক্ষণ কটমট করিয়া সকলের দিকে তাকাইয়া তার পর বলিলেন, “যা! তোরা ছেলেমানুষ, তাই কিছু বললাম না। খবরদার আর অমন করিস নে।” সকলে হাফ হাড়িয়া বাঁচিল, কিন্তু পণ্ডিতমশাই কেন যে হঠাৎ নরম হইয়া গেলেন কেহই তাহা বুঝিল না। পণ্ডিতমশাইয়ের মনে হঠাৎ যে তার নিজের ছেলেবেলার কোন দুষ্টুমির কথা মনে পড়িয়া গেল, তাহা কেবল তিনিই জানেন।