সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/কবিতাগুচ্ছ/মূর্খমাছি
(পৃ. ৩৬-৩৮)
মূর্খমাছি
মাকড়সা। সানবাঁধা মোর আঙিনাতে——
জাল বুনেছি কালকে রাতে,
ঝুল ঝেড়ে সব সাফ করেছি বাসা।
আয়-না মাছি, আমার ঘরে
আরাম পাবি বসলে পরে,
ফরাস পাতা দেখবি কেমন খাসা।
মাছি। থাক্, থাক্, থাক্, আর বলে না,
আনকথাতে মন গলে না——
ব্যবসা তোমার সবার আছে জানা।
ঢুকলে তোমার জালের ঘেরে,
কেউ কোনোদিন আর কি ফেরে?
বাপ্ রে! সেথায় ঢুকতে মোদের মানা।
মাকড়সা। হাওয়ায় দোলে জালের দোলা,
চারদিকে তার জাল্না খোলা,
আপনি ঘুমে চোখ যে আসে জুড়ে!
আয়-না হেথা, হাত পা ধুয়ে
পাখনা মুড়ে থাক্-না শুয়ে—
ভন্ ভন্ ভন্, মরবি কেন উড়ে?
মাছি। কাজ নেই মোর দোলায় দুলে,
কোথায় তোমার কথায় ভুলে
প্রাণটা নিয়ে টান পড়ে ভাই শেষে।
তোমার ঘরে ঘুম যদি পায়
সে ঘুম কভু ভাঙবে না হায়—
সে ঘুম নাকি এমন সর্বনেশে!
মাকড়সা। মিথ্যে কেন ভাবিস মনে?
দেখ্-না এসে ঘরের কোণে,
ভাঁড়ার ভরা খাবার আছে কত।
দে টপাটপ্ ফেলবি মুখে,
নাচবি, গাবি, থাকবি সুখে
ভাবনা ভুলে বাদশা-রাজার মতো
মাছি। লোভ দেখালেই ভুলবে ভবি,
ভাবছ আমায় তেমনি লোভী!
মিথ্যে দাদা, ভোলাও কেন খালি?
করব কি ছাই ভাড়ার দেখে?
প্রণাম করি আড়াল থেকে—
আজকে তোমার সেই গুড়ে ভাই বালি।
মাকড়সা। নধর কালো বদন ভরে
রূপ যে কত উপছে পড়ে!
অবাক দেখি মুকুটমালা শিরে।
হাজার চোখে মানিক জ্বলে।
ইন্দ্রধনু পাখার তলে –
ছয় পা ফেলে আয়-না দেখি ধীরে
মাছি। মন ফুর্ফুর্ ফুর্তি নাচে——
একটুখানি যাই-না কাছে!
যাই যাই যাই—বাপ্ রে এ কি ধাঁধা!
ও দাদাভাই, রক্ষে কর!
ফাঁদ পাতা এ কেমনতরো!
আটকা পড়ে, হাত-পা হ’ল বাঁধা।
দুষ্টুলোকের মিষ্টি কথায়
নাচলে লোকের স্বস্তি কোথায়?
এমনি দশাই তার কপালে লেখে।
কথার পাকে মানুষ মেরে
মাকড়জীবী ঐ যে ফেরে
গড় করি তায় অনেক তফাত থেকে॥
( বিখ্যাত ইংরেজি কবিতার অনুসরণে )
সন্দেশ-শ্রাবণ, ১৩২৫