সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবনী/অজানা দেশে
(পৃ. ৬৪-৬৭)
সেদিন একটা বইয়ে মাগো পার্কের কথা পড়ছিলাম। প্রায় সওয়া শশী বৎসর আগে অর্থাৎ লিভিংস্টোনের অনেক পূর্বে মাঙ্গো পৰ্কি আফ্রিকার অজানা দেশ দেখতে গিয়েছিলেন। এক-একজন মানুষের মনে কেমন নেশা থাকে, নূতন দেশ নূতন জায়গার কথা শুনলে তারা সেখানে ছুটে যেতে চায়। তারা অসুবিধার কথা ভাবে না, বিপদ-আপদের হিসাব করে না—একবার সুযোগ পেলেই হয়। মাঙ্গো পার্ক এইরকমের লোকে ছিলেন। তাঁর বয়স যখন চব্বিশ বৎসর মা, তখন তিনি নাইগার নদীর সন্ধান করতে গিয়েছিলেন। তার কিছুদিন আগে একজন ইংরজি সেই অজানা দেশে ডাকাতের হাতে মারা যান—অথচ পার্ক তা জেনেও মাত্র দুজন সে-দেশী চাকর সঙ্গে সেই পথেই বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর উদ্দেশ্য সেই নদী ধরে ধরে তিনি আফ্রিকার ঐ অঞ্চলটা বেশ করে ঘুরে আসবেন। তখনো আফ্রিকার ম্যাপে সেই-সব জায়গায় বড়ো-বড়ো ফাক দেখা যেত আর সেগুলোকে ‘অজানা দেশ’ বলে লেখা হত।
সে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সে সময়ে অনেকটা আরব ও মুর জাতীয় মুসলমানদের হাতে ছিল। ইউরোপীয় লোক সেখানে গিয়ে পাছে তাদের ব্যবসা কেড়ে নেয়, এই ভয়ে সাহেব দেখলেই তারা নানারকম উৎপাত লাগিয়ে দিত। পার্ককেও তারা কম জ্বালাতন করে নি; কতবার তাকে ধরে বন্দী করে রেখেছে—তার সঙ্গের জিনিসপত্র কেড়ে নিয়েছে তাঁর লোকজনকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে এমন-কি, তাকে মেরে ফেলবার জন্যও অনেকবার চেষ্টা করেছে। তার উপর সে দেশের অসহ্য গরম আর নানারকম রোগের উৎপাতেও তাকে কম ভুগতে হয় নি। একবার জলের অভাবে তাঁর এত কষ্ট হয়েছিল যে, তিনি গাছের পাতা শিকড় ডাঁটা চিবিয়ে তৃষ্ণা দূর করতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাতে কি তৃষ্ণা যায়? সারাদিন পাগলের মতো জল খুঁজে খুঁজে, সন্ধ্যার কিছু আগে ঘোড়া থেকে নামতে গিয়ে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। তার পর যখন তাঁর ডান হল তখন তিনি চেয়ে দেখেন, ঘোড়াটা তখনো তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে সূর্য অস্ত গেছে, চারিদিক ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসছে, কাজেই আবার তাঁকে ঘোড়ায় চড়ে জলের সন্ধানে বেরুতে হল। তার পর যখন তাঁর দেহে আর শক্তি নাই, মনে হল প্রাণ বুঝি যায় যায়, তখন হঠাৎ উত্তরদিকে বিদ্যুৎ চমকিয়ে উঠল। তা দেখে তার আবার উৎসাহ ফিরে এল, তিনি বৃষ্টির আশায় সেইদিকে চলতে লাগলেন। চলতে চলতে ক্রমে ঠাণ্ডা বোধ হতে লাগল, বাদলা হাওয়া দেখা দিল তার পর কড়কড় করে বাজ পড়ে ঝমাঝম্ বৃষ্টি নাম। পার্ক তখন তার সমস্ত কাপড় বৃষ্টিতে ধরে দিয়ে, সেই ভিজা কাপড় নিংড়িয়ে তার জল খেয়ে তৃষ্ণা দূর করলেন। তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত্রি, বিদ্যুতের আলোতে কম্পাস দেখে দিক স্থির করে, আবার তাকে সারারাত চলতে হল।
একবার তিনি সারাদিন না খেয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে এক শহরে গিয়ে হাজির হতেই, সেখানকার রাজী হুর দিলেন, “তুমি গ্রামে ঢুকতে পারবে না।” তিনি সেখান থেকে এক গ্রামে গেলেন, সেখানেও লোকেরা তাকে দেখে ভয়ে পালাতে লাগল—তিনি যে বাড়িতেই যান লোকে দরজা বন্ধ করে দেয়। শেষটায় হতাশ হয়ে তিনি একটা গাছের তলায় বসে পড়লেন। এইরকম অনেকক্ষণ বসে থাকবার পর, একটি নিগ্রো স্ত্রীলোক আর তার মেয়ে এসে, তাকে ডেকে তাদের বাড়িতে নিয়ে খেতে আর বিশ্রাম করতে দিল। সে-দেশীয় মেয়েরা সন্ধ্যার পর ঘরে বসে চরকায় সুতো কাটে আর গান গায়। মাঙ্গো পার্কের নামে তারা গান বানিয়ে গেয়েছিল—সেই গানটার অর্থ এই-‘ঝড় বইছে আর বৃষ্টি পড়ছে, আর বেচারা সাদা লোকটি শ্রান্তি অবশ হয়ে আমাদের গাছতলায় এসে বসেছে। ওর মা নেই, ওকে দুধ এনে দেবে কে? ওর স্ত্রী নেই, ওকে ময়দা পিষে দেবে কে? আহা, ঐ সাদা লোকটিকে দয়া কর। ওর যে মা নেই, ওর যে কেউ নেই।'
তিনি অনেকবার ‘মুর’দের হাতে পড়েছিলেন। এক-একটা গ্রামে তিনি যান অরি সেখানকার সর্দার তাকে ডেকে পাঠায়, নাহয় লোক দিয়ে ধরপাকড় করে নিয়ে যায়। এইরকম অবস্থায় তারা তাঁর কাছ থেকে, প্রায়ই কিছু-না-কিছু বকসিস আদায় না করে ছাড়ত না। এমনি করে তাঁর সঙ্গের জিনিসপত্র প্রায় সবই বিলিয়ে দিতে হয়েছিল। একবার এক সর্দার তাঁর ছাতাটি তাঁর কাছ থেকে আদায় করে মহা খুশি। ছাতাটাকে সে ফটফট করে খেলে আর বন্ধ করে; আর হো হো করে হাসে। কিন্তু ওটা দিয়ে কি কাজ হয়, সে কথাটা বুঝতে তার নাকি অনেকখানি সময় লেগেছিল। আসবার সময় মাঙ্গো পার্কের নীল কোট আর তাতে সোনালি বোতাম দেখে সর্দারমশাই কোটটাও চেয়ে বসলেন। তখন সেটা তাকে না দিয়ে অরি উপায় কি? যাহোক, সর্দারের মেজাজ ডালা বলতে হবে, সে ছাতা আর কোটের বদলে তাকে অনেক জিনিসপত্র সঙ্গে দিয়ে, তার চলাফিরার সুবিধা করে দিল। কিন্তু সকল সময়ে তিনি এত সহজে পার পান নি। আলি নামে এক মূর রাজার দল তাকে বন্দী করে, মাসখানেক খুব অত্যাচার করেছিল। প্রথমটা তারা ঠিক করল যে, এই বিধর্মী খৃস্টানটাকে মেরে ফেলাই ভালো। তার পর কি যেন ভেবে তারা আবার বলল, “ওর ঐ বেড়ালের মতো চোখ দুটো গেলে দেও।” যাহোক শেষটায় সেখানকার রানীর অনুগ্রহে তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন।
এমনি করে অত্যাচার অপমান চুরি ডাকাতি সব সহ্য করে, মাঙ্গো পার্ক শেষটায় একেবারে ফকির হয়ে পড়েছিলেন, তাঁর লোকজন কাপড়চোপড় জিনিসপত্র, এমন-কি, ঘোড়াটি পর্যন্ত সঙ্গে রইল না। কিন্তু এত কষ্ট সয়েও শেষটায় যখন তিনি নাইগার নদীর সন্ধান পেলেন, তখন তার মনে হল এত কষ্ট এত পরিশ্রম সব সার্থক হয়েছে। এমনি করে তিনি দুই বৎসর সে দেশ ঘুরে, তার পর দেশে ফিরে আসেন। এই দুই বৎসরের সব ঘটনা তিনি প্রতিদিন লিখে রাখতেন। আমরা এখানে যা লিখছি তার প্রায় সবই তাঁর সেই ডায়ারি থেকে নেওয়া।
আফ্রিকার নিগ্রো জাতীয় লোকদের আমরা সাধারণত ‘অসভ্য জাতি’ বলে থাকি। কিন্তু মালো পার্ক বলেন যে, মুর বা আরব জাতীয় লোকেদের মধ্যে যারা কতকটা সভ্য হয়েছে, তাদের চাইতে এই অসভ্যো অনেক ভালো। আমাদের দেশে যেমন সঁওতালরা গ্রায়ই খুব সরল অরি সত্যবাদী হয়, মোটের উপর এরাও তেমনি। তাদের দেশে তারা বিদেশী তোক দেখে নি, কাজেই হঠাৎ অদ্ভুত পোশাক পরা হলদে চুল, নীল চোখ সাদা রঙের মানুষ দেখলে তাদের ভয় হবারই কথা। কিন্তু তবু বিপদে-আপদে পার্ক তাদের কাছেই সাহায্য পেতেন-মূর বা আরবদের কাছে নয়।
দেশের নানান স্থানে নানান জাতীয় লোক, তাদের মধ্যে সর্বদাই যুদ্ধ-বিগ্রহ চলে। একবার মাঙ্গো পার্ক মালকোভা বলে একটা শহরে এসে শুনলেন, আরো উত্তরে খুব বড়ো একটা লড়াই চলছে—ফুতা-তরা’র রাজা আবুল কাদের অসভ্য জাফদের রাজা দামেলকে আক্রমণ করেছেন। এই আবুল কাদের আর দামেলের যুদ্ধ বড়ো চমকরি। আবুল কাদের একজন দূতকে দিয়ে দামেলের কাছে দুখানা ছুরি পাঠিয়ে দিলেন, আর বলে দিলেন, “দামেল যদি মুসলমান হতে রাজি হন, তবে এই ছুরি দিয়ে আবুল কাদের নিজের হাতে তার মাথা কামিয়ে দিবেন, আর যদি রাজি না হন তবে ঐ ছুরিটি দিয়ে তাঁর গলা কাটা হবে। এর মধ্যে কোনটি তার পছন্দ?” দামেল এ কথা শুনে বললেন, “কোনোটাই পছন্দ হচ্ছে না। আমি মাথাও কামাতে চাই না, গলায় ছুরিও বসাতে চাই।” আবুল কাদের তখন প্রকাণ্ড দলবল সঙ্গে নিয়ে, জাফদের দেশে লড়াই করতে এলেম। জলিফদের অত সৈন্য-সামন্ত নেই, তারা নিজেদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে, পথের পাতকুয়া সব বন্ধ করে, শহর গ্রাম সব ছেড়ে পালাতে লাগল। এমনি করে তিনদিন পর্যন্ত আবুল কাদের ক্রমাগত এগিয়েও লড়াইয়ের কোনো সুযোগ পেলেন না। তিনি যতই এগিয়ে চলেন, কেবল নষ্ট গ্রাম আর পোড়া শহরই দেখেন, কোথাও জল নাই খাবার কিছু নাই, লুটপাট করবার মতো কোনো জিনিসপত্র নাই। চতুর্থ দিনে তিনি পথ বদলিয়ে সারাদিন হেঁটে একটা জলা জায়গার কাছে এলেন। সেখানে কোনোরকমে তৃষ্ণা দূর করে ক্লান্ত হয়ে সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে, এমন সময় ভোররাত্রে দামেল তাঁর দলবল নিয়ে, মার মার করে তাদের উপরে এসে পড়লেন। আবুল কাদেরের দল সে চোট আর সামলাতে পারল না—তাদের কেউ কেউ পালিয়ে গেল, অনেকে মারা পড়ল, কিন্তু অধি- কাংশই জাফদের হাতে বন্দী হল—সেই বন্দীদের একজন হচ্ছেন আবুল কাদের নিজে। জাফরা মহা ফুর্তিতে আবুল কাদেরকে বেধে দামেলের কাছে নিয়ে গেল। সকলে ভাবল এইবার দামেল বুঝি তাঁর বুকে ছুরি মেরে তার শত্রুতার প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু দামেল সেরকম কিছুই না করে, জিজ্ঞাসা করলেন, “আবুল কাদের, তুমি যথার্থ বল তো –আজি তুমি বন্দী না হয়ে যদি আমি বন্দী হতাম, আর তোমার কাছে আমায় নিয়ে যেত, তা হলে তুমি কি করতে?” আবুল কাদের বললেন, “তোমার বুকে আমার বল্লম বসিয়ে দিতাম। তুমি তার বেশি আর কি করবে?” দামেল বললেন, “তা নয়। তোমায় মেরে আমার লাভ কি? আমার এই-সব নষ্ট ঘরবাড়ি কি তাতে ভালো হয়ে যাবে, আমার প্রজারা কতজনে মারা পড়েছে—তারা কি আবার বেঁচে উঠবে? তোমায় আমি মারব না। তুমি রাজা, কিন্তু রাজার ধর্ম থেকে তুমি পতিত হয়েছ। যতদিন তোমার সে দুর্মতি দূর না হয়, ততদিন তুমি রাজত্ব করবার যোগ্য হবে না—ততদিন তুমি আমার দাসত্ব করবে।” এইভাবে তিন মাস নিজের বাড়িতে বন্দী করে রেখে তার পর তিনি আবুল কাদেরকে ছেড়ে দিলেন। এখনো নাকি সে দেশের লোকেরা দামেলের এই আশ্চর্য মহত্বের কথা বলে গান করে। নাইগার নদীর আশেপাশে যে-সব নিগ্রোরা থাকে তাদের মাণ্ডিঙ্গো’ বলে। তাদের সম্বন্ধে পার্ক অনেক খবর সংগ্রহ করেছেন। তারা মনে করে, এই পৃথিবীটা একটা প্রকাণ্ড সমতল মাঠের মতো। তার শেষ কোথায় কেউ জানতে পারে না, কারণ তার চারিদিক মেঘে ঘেরা। তারা বছরের হিসাব দেয় বড়ো-বড়ো ঘটনার নাম করে, যেমন কুরবানা যুদ্ধের বছর’, ‘দামেসের বীরত্বের বছর। পার্ক যে-সকল গ্রামে গিয়েছিলেন, তার কোনো কোনোটিতে সেই বছরকে বলা হত “সাদা লোক আসবার বছর।
এর পরেও পার্ক আর-একবার দলবল নিয়ে আফ্রিকায় যান এবং সেইখানেই প্রাণ হারান। এবার গোড়াতেই জ্বর-জারি হয়ে তাঁর লোকজন সব মারা যেতে লাগল। সাতচল্লিশজন সাহেবের মধ্যে তিন মাসে কুড়িজন মারা গেল, বাকি অনেকগুলি অসুখে একেবারে কাহিল হয়ে পড়ল। চার মাসে তিনি আবার নাইগার নদীর ধারে উপস্থিত হলেন। তখন তিনি আর সঙ্গে দুই-একটি নিগ্রেী ছাড়া আর সকলেই প্রায় অকর্মণ্য হয়ে পড়েছে। তার পর তিনি নৌকায় চড়ে জলের পথে কয়েকদিন গেলেন, কিন্তু চারিদিক থেকে মূরেরা ক্রমাগত আক্রমণ করে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। শেষটা যখন তার সঙ্গের সাতটিমাত্র সাহেব বেঁচে আছে, এমন সময় অনেক কষ্টে নিগ্রোদের দেশে এসে তিনি মনে করলেন, এতক্ষণে নিরাপদ হওয়া গেল। কিন্তু এইখানেই নদী পার হবার সময় তিনি দলবলসুদ্ধ নিগ্রোদের হাতে মারা গেলেন। তার একটিমাত্র বিশ্বস্ত নিগ্রো চাকর, তাঁর চিঠিপত্র নিয়ে ফিরে এসে এই খবর দিল যে, নদীর স্রোতের মধ্যে নৌকাকে বেকায়দায় পেয়ে নিগ্রোরা তাদের মেরেকেটে সব লুটে নিয়েছে। তখন পার্কের বয়স চৌত্রিশ বৎসর মাত্র।