সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবনী/আর্কিমিডিস

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ৭০-৭২)

আর্কিমিডিস

 প্রায় বাইশশত বৎসর আগে, গ্রীস সাম্রাজ্যের অধীন সাইরাকিউস নগরে আর্কি- মিডিসের জন্ম হয়। আর্কিমিডিসের মতো অসাধারণ পণ্ডিত সেকালে গ্রীক জাতির মধ্যে আর দ্বিতীয় তত ছিলই না—সমস্ত পৃথিবীতে তাঁহার সমান কেহ ছিল কিনা সন্দেহ। দিনরাত তিনি আপনার পুঁথিপত্র লইয়া কী যে চিন্তায় ডুবিয়া থাকিতেন, আর অঙ্ক কষিয়া কষিয়া কত যে আশ্চর্য তত্ত্বের হিসাব করিতেন, লোকে তাহার কিছুই বুঝিত না- দু-দশজন পণ্ডিতলোকে পরম আগ্রহে অদির করিয়া তাহার সংবাদ লইত, আর অবাক হইয়া বলিত, “পণ্ডিতের মতো পণ্ডিত যদি কেউ থাকে, তবে সে হচ্ছে আকিমিডিস।”

 সাইরাকিউসের রাজা হীয়েরো ছিলেন আর্কিমিডিসের বন্ধু। তিনি কেবলই বলিতেন, “এত বড় পণ্ডিত হইয়া তোমার কী লাভ হইল, যদি লোকে তোমার কদর না বোঝে? তুমি কেবল বিজ্ঞানের বড়ো-বড়ো তত্ত্ব আর সুক্ষ-সুক্ষ হিসাব নিয়া থাক। মানুষের কাজে লাগে এমন সব যন্ত্র করিয়া দেখাও—লোকে বুঝুক তুমি কত বড়ো পণ্ডিত।” বন্ধুর কথায় আর্কিমিডিস মাঝে মাঝে ‘কেজো জিনিস গড়িবার দিকে মন দিতেন। তাহার ফলে নানারকম 'স্কু', জল তুলিবার জন্য প্যাঁচালো পাম্প’ জলে-চালানো বাতাসে-চালানো কতরকম যন্ত্র প্রভৃতি সৃষ্টি হইল। পাখা টানিবার জন্য দেয়ালে যে চাকার ‘পুলি’ খাটানো থাকে, সেই পুলি জিনিসটাও আকিমিডিসের আবিষ্কার। বড়ো বড়ো মালপত্র বোঝাই হইয়া এত যে কলের গাড়ি আর এত যে জাহাজ পৃথিবীময় ছুটিয়া বেড়াইতেছে, আর বড়ো-বড়ো কারখানায় এত যে ভারী ভারী কলকামান লোহালক্কড় লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছে, সবখানেই দেখিবে মলি উঠানামার জন্য পুলি’ না হইলে চলে না। মুর্খ লোকে যখন আর্কিমিডিসের কলকব্জার পরিচয় পাইল, তখন তাহারাও ভাবিতে লাগিল, লোকটা পণ্ডিত বটে।

 আকিমিডিসের জীবনের একটি গল্প তোমর বোধ হয় অনেকে শুনিয়া থাকিবে। রাজা হীয়েরো এক সেকরার কাছে একটি সোনার মুকুট গড়াইতে দিয়াছিলেন। সেকরা মুকুটটি গড়িয়াছিল ভালোই কিন্তু রাজার মনে সন্দেহ হইল যে, সে সোনা চুরি করিয়াছে এবং সেই চুরি ঢাকিবার জন্য মুকুটের মধ্যে খাদ মিশাইয়াছে। কোনো সহজ উপায়ে এই চুরি ধরা যায় কিনা জানিবার জন্য তিনি বন্ধু আর্কিমিডিসকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। আর্কিমিডিস সব শুনিয়া বলিলেন, “একটু ভাবিয়া বলিব।” ভাবিতে ভাবিতে কয়েকদিন কাটিয়া গেল। একদিন স্নানের সময়ে কাপড় ছাড়িয়া সবে তিনি গানের টবে পা দিয়াছেন, এমন সময় খানিকটা জল উছলিয়া পড়মিল, হঠাৎ সেই প্রশ্নের এক চমৎকার মীমাংসা তাহার মাথায় আসিল। তখন কোথায় গেল স্নান। তিনি তৎক্ষণাৎ, 'Eureka Eureka। (পেয়েছি। পেয়েছি।) বলিয়া রাস্তায় ছুটিয়া বাহির হইলেন।

 যে জিনিস পাইয়া তিনি আনন্দে এমন আত্মহারা হইয়াছিলেন, বিজ্ঞানে এখনো তাহাকে ‘আর্কিমিডিসের তত্ত্ব' বলা হয়। ভারী জিনিসকে জলে ছাড়িলে, তাহার ওজন কমিয়া যায়; কি পরিমাণ কমিবে তাহাও হিসাব করিয়া বলা যায়। কোনো হাল্কা জিনিসকে জলে ভাসাইলে, তাহার খানিকটা ডোবে খানিকটা ভাসিয়া থাকে। ঠিক কতখানি ভাবে তাহারও হিসাব আছে। আকিমিডিসের তত্ত্বে এই-সকল কথারই আলোচনা করা হইয়াছে। অকিমিডিস রাজাকে বলিলেন, “ঐ মুকুটের ওজন যতখানি, ঠিক সেই ওজনের সোনা লইয়া একটা জলভরা পাত্রে পরীক্ষা করিতে হইবে। পাত্রের মধ্যে মুকুটটা ডুবাইয়া দিলে কতখানি জল উছলিয়া পড়ে, তাহা মাপিয়া দেখুন, তার পর আবার জল ভরিয়া সেই ওজনের একতাল সোনা ডুবাইয়া দেখুন কতটা জল পড়ে। মুকুট যদি খাঁটি সোনার হয়, তবে দুইবারেই ঠিক একই পরিমাণ জল বাহির হইবে। যদি খাদ মিশানো থাকে, তবে মুকুটটা সেই ওজনের সোনার চাইতে আয়তনে কিছু বড়ো হইবে, সুতরাং তাহতে বেশি জল ফেলিয়া দিবে।”

 কোনো কোনো চশমার কাচ এমন থাকে যে, তাহাতে অনেকখানি সূর্যের আলোককে অল্প জায়গার মধ্যে ধরিয়া আনা যায়। সেইরকম কাঁচ বেশ বড়ো করিয়া বানাইলে, তাহার মধ্যে রোদ ধরিয়া আগুন জ্বালানো চলে। সরার মতো গর্তওয়ালা আরশি দিয়াও এই কাজটি করানো যায়। আর্কিমিডিস এইরকম আরশিও বানাইয়াছিলেন। শোনা যায়, রোমের যুদ্ধ-জাহাজ যখন সাইরাকিউস আক্রমণ করিতে আসে, তখন তিনি এইরকম আরশি দিয়া কড়া রোদ ফেলিয়া, তাহাতে আগুন ধরাইয়া দেন। কেবল তাহাই নয়, রোমীয় সেনাপতি মার্সেলসি যখন সৈন্য-সামন্ত লইয়া সাইরাকিউস আক্রমণ করিতে আসেন, তখন আর্কিমিডিস নগররক্ষার জন্য নানারকম অদ্ভুত নূতন নূতন যুদ্ধযন্ত্রের আয়োজন করিলেন। সে-সকল যন্ত্রের পরিচয় পাইয়া রোমীয় সৈন্য বহুদিন পর্যন্ত নগরের কাছে ঘেঁষিতে সাহস পায় নাই। তাহার পরে কত যুগ যুগ ধরিয়া, দেশে দেশে আকিমিডিসের অদ্ভুত কীর্তির কথা লোকের মুখে শোনা যাইত।

 রোমীয় সৈন্যেরা সে-সকল যুদ্ধযন্ত্রের যে বর্ণনা দিয়াছে তাহা পড়িলে বেশ বুঝা যায়, সেগুলি তাহাদের মনে কিরকম ভয়ের সঞ্চার করিয়াছিল। বড়ো-বড়ড়া থামের মতো pড়া হঠাৎ দেয়ালের উপর মাথা তুলিয়া হড়হড় করিয়া শত্রুর উপর রাশি রাশি পাথর দুড়িয়া মারে, আবার পর মুহূর্তেই দেয়ালের পিছনে ডুব মারে। বড়ো-বড়ো কলের ধাক্কায় কড়ি বড়গা ছুটিয়া শত্রুর জাহাজে গিয়া পড়ে, দূর হইতে প্রকাণ্ড নখালো সাঁড়াশি চালাইয়া শত্রুর জাহাজ উপড়াইয়া আনে। এ-সকল দেখিয়া রোমের সৈন্য আর রোমের জাহাজ নগর ছাড়িয়া দূরে হটিয়া গেল। মার্সেলাস বলিলেন, “যুদ্ধ করিয়া সাইরাকিউস দখল করা কাহারও সাধ্য নয়। তোমরা পথঘাট আটকাইয়া এইখানেই বসিয়া থাকি। নগরের খাদ্য যখন ফুরাইবে, তখন আপনা হইতেই ইহারা হার মানিবে।” প্রায় তিন বৎসর বিনা যুদ্ধে রোমীয়েরা সাইরাকিউসের চারিদিক ঘেরিয়া রাখিল। তার পর নগরের লোকেদের যখন না খাইয়া মারা যাইবার মতো অবস্থা হইল তখন সাইরাকিউস দখল করা সহজ হইয়া আসিল। মার্সেলাস হকুম দিলেন, “যাও, নগর লুট করিয়া আনো। কিন্তু খবরদার, আর্কিমিডিসের কোনো অনিষ্ট করিও না।”

 আর্কিমিডিস তখন কি একটা হিসাব করিতেছেন, নগরে কোথায় কি ঘটিতেছে, তাঁহার হুঁশও নাই। কতগুলা অঙ্ক ও রেখা কষিয়া তাহারই চিন্তায় তিনি ডুবিয়া আছেন। রোমীয় সৈন্যেরা সেই পঁচাত্তর বৎসরের বৃদ্ধকে আর্কিমিডিস বলিয়া চিনিতে পারিল না। তাহারা কোলাহল করিতে করিতে ঘরে ঢুকিয়া তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করিল। কিন্তু তিনি তাঁহার চিন্তার মধ্যে এমনই তন্ময় হইয়াছিলেন যে, সে কথা তাহার কানেই গেল না। তিনি একবার খালি হাত তুলিয়া বলিলেন, “হিসাবে ব্যাঘাত দিয়ো না।” মুখ সৈনিক তৎক্ষণাৎ তলোয়ারের আঘাতে তাহার মাথা কাটিয়া ফেলিল। তাহার জীবনের শেষ হিসাব আর সম্পূর্ণ হইল না- তাহারই রক্ত ধারায় সে হিসাব মুছিয়া ফেলিল! কি তত্ত্বের আলোচনায় তিনি এমন করিয়া তন্ময় হইয়াছিলেন, তাহা জানিবারও আর কোনো উপায় নাই।

 আর্কিমিডিসের মৃত্যু-সংবাদ শুনিয়া মার্সেলাসের দুঃখের আর সীমা রহিল না। তিনি পরম যত্নে আকিমিডিসের কবরের উপর অতি সুন্দর সমাধি নির্মাণ করাইয়া তাঁহার প্রতি সম্মান দেখাইয়াছিলেন। তাহার পর দুইহাজার বৎসর চলিয়া গেল, মানুষের ইতিহাসে এই বিজ্ঞানবীর মহাপুরুষের নাম এখনো অমর হইয়া আছে।

সন্দেশ—আষাঢ়, ১৪২৪