সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবনী/খোঁড়া মুচির পাঠশালা
(পৃ. ৭৯-৮২)
পোর্টসমাউথের বন্দরে এক খোঁড়া মুচি থাকিত, তাহার নাম জন পাউণ্ডস। ছেলে- বেলায় জন তাহার বাবার সঙ্গে জাহাজের কারখানায় কাজ করিত। সেইখানে পনেরো বৎসর বয়সে এক গর্তের মধ্যে পড়িয়া তাহার উরু ভাঙিয়া যায়। সেই অবধি সে খোড়া হইয়াই থাকে এবং কোনো ভারী কাজ করা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া পড়ে। গরিবের ছেলে, তাহার তো অলস হইয়াও পড়িয়া থাকিলে চলে না—কাজেই জন অনেক ভাবিয়াচিন্তিয়া এক বুড়া মুচির কাছে জুতা সেলাইয়ের কাজ শিখিতে গেল। তার পর শহরের একটা গলির ভিতরে ছোটো একটি পুরাতন ঘর ভাড়া করিয়া সে একটা মুচির দোকান খুলিল।
জনের রোজগার বেশি ছিল না, কিন্তু সে মানুষটি ছিল নিতান্তই সাদাসিধা: সামান্যরকম খাইয়া-পরিয়াই স্বচ্ছন্দে তাহার দিন কাটিয়া যাইত। এমন-কি, কয়েক বৎসরের মধ্যে সে কিছু টাকাও জমাইয়া ফেলিল। তখন সে ভাবিল, “এখন আমার উচিত আমার ভাইদের কিছু সাহায্য করা।” তাহার দাদার এক ছেলে ছিল, সে ছেলেটি জন্মকাল হইতেই খোড়া মতন, তাহার পা দুইটা বাকা। জন দাদাকে বলিল, “এই ছেলেটির ভার আমি লইলাম।” ছেলেটিকে লইয়া জন ডাক্তারকে দেখাইল। ডাক্তার বলিলেন, “এখন উহার হাড় নরম আছে, এখন হইতে যদি পায়ে “লাস্’ বাধিয়া রাখ, তবে হয়তো সারিতেও পারে।” সামান্য মুচি, লাস্ কিনিবার পয়সা সে কোথায় পাইবে? সে রাত জাগিয়া পরিশ্রম করিয়া নিজের হাতে লাস্ বানাইল, এবং সেই লাস্ পরাইয়া, যত্ন ও শুশ্রষার জোরে অসহায় শিশুটিকে ক্রমে সবল করিয়া তাহার খোড়ামি দূর করিল।
ততদিনে ছেলের লেখাপড়া শিখিবার বয়স হইয়াছে। পাউণ্ডস নিজেই তাহাকে শিক্ষা দিবার আয়োজন করিতে লাগিল। তাহার প্রথম ভাবনা হইল এই যে, একা একা লেখাপড়া শিখিলে শিশুর মনে হয়তো ফুতি আসিবে না, তাহার দু-একজন সঙ্গী দরকার। এই ভাবিয়া সে পাড়ার দু-একটি ছেলেমেয়েকে আনিয়া তাহার ক্লাশে ভতি করিয়া দিল। দুটি একটি হইতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দেখিতে দেখিতে পাঁচ-সাতটি হইয়া উঠিল। কিন্তু তাহাতেও খোড়া মুচির মন উঠিল না—সে ভাবিতে লাগিল, “আহা, ইহারা কেমন আনন্দে উৎসাহে লেখাপড়া শিখিতেছে; কিন্তু এই শহরের মধ্যে এমন কতশত শিশু আছে, যাহাদের কথা কেহ ভাবিয়াও দেখে না।” তখন সে আরো ছাত্র আনিয়া তাহার ছোট্টো ক্লাশটিকে একটি রীতিমতো পাঠশালা করিয়া তুলিল।
যেদিন তাহার একটু অবসর জুটিত, সেইদিনই দেখা যাইত জন পাউণ্ডস খোড়াইতে খোড়াইতে রাস্তায় রাস্তায় ছেলে খুজিয়া বেড়াইতেছে। যত রাজ্যের অসহায় শিশু, যাদের বাপ নাই, মা নাই, যত্ন করিবার কেহ নাই, তাহাদের ধরিয়া ধরিয়া সে তাহার পাঠশালায় ভতি করিত। ছেলে ধরিবার জন্য তাহার প্রধান অস্ত্র ছিল আলুভাজা! প্রথমে এই আলুভাজা খাওয়াইয়া পাউণ্ডস রাস্তার শিশুদের ভুলাইয়া আনিত। আলুভাজার লোভে তাহারা পাঠশালায় আসিত, কিন্তু যে আসিত সে আর ফিরিত না। মাস্টারমহাশয়ের কী যে আকর্ষণশক্তি ছিল, আর ঐ অন্ধকার পাঠশালার মধ্যে কী যে মধু ছেলেরা পাইত, তাহা কেহই বঝিত না, কিন্তু ছায়ের সংখ্যা বাড়িয়াই চলিল।
চারহাত চওড়া, বারোহাত লম্বা, সরু বারান্দার মতো ঘর; তাহার মাঝখানে বসিয়া মাস্টারমহাশয় জুতা সেলাই করিতেছেন আর পড়া বলিয়া দিতেছেন, আর চারিদিকে প্রায় চল্লিশটি ছাত্রের কোলাহল শুনা যাইতেছে। কেহ পড়িতেছে, কেহ লিখিতেছে, কেহ অঙ্ক বুঝাইয়া লইতেছে। কেহ সিঁড়ির উপর, কেহ মেঝের উপর, কেহ চৌকিতে, কেহ বাক্সে—আর নিতান্ত ছোটোদের কেহ কেহ হয়তো মাস্টারের কোলে—এই- রকম করিয়া মহা উৎসাহে লেখাপড়া চলিয়াছে। বাহিরের লোকে ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া অবাক হইয়া এই দৃশ্য দেখিত।
গরিব মাস্টার ছাত্রদের কাছে এক পয়সাও বেতন লইত না-এতগুলি ছাত্রকে সে বই জোগাইবে কোথা হইতে? তাহাকে শহরে ঘুরিয়া পুরানো পুঁথি, ছেঁড়া বিজ্ঞাপন প্রভৃতি সংগ্রহ করিতে হইত, এবং তাহাতেই ছেলেদের পড়ার কাজ কোনোরকমে চলিয়া যাইত। কয়েকখানা শ্লেট ছিল, তাহাতেই সকলে পালা করিয়া লিখিত। পাঠশালায় সামান্য যোগ বিয়োগ হইতে ত্রৈরাশিক পর্যন্ত অঙ্ক শিখানো হইত। কেবল তাহাই নয়, এই-সমস্ত ছেলেমেয়েরা তাহার কাছে কাপড় সেলাই করিতে এবং জুতা মেরামত করিতেও শিখিত। সকলে মিলিয়া তীর-ধনুক ব্যাট-বল ঘুড়ি-লাটাই খেলনা-পুতুল প্রভৃতি নানারকম জিনিস নিজেরাই তৈয়ারি করিত। তাহাদের খাওয়া-পরার সমস্ত অভাবের কথাও গরিব মাস্টারকেই ভাবিতে হইত। এই-সমস্ত দেখিয়া-শুনিয়া জন পাউসের উপর কোনো- কোনো লোকের শ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল। তাহারা মাঝে মাঝে গরম কাপড়-চোপড় পাঠাইয়া দিত। সেই-সব কাপড় পরিয়া ছেলেমেয়েরা যখন উৎসাহে খোড়া মাস্টারের সঙ্গে বেড়াইতে বাহির হইত, তখন মাস্টারমহাশয়ের মুখে আনন্দ আর ধরিত না।
এমন করিয়া কত বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া গেল, জন পাউণ্ডস বুড়া হইয়া পড়িল, কিন্তু তাহার পাঠশালা চলিতে লাগিল। আগে যাহারা ছাত্র ছিল, তাহারা ততদিনে বড়ো হইয়া উঠিয়াছে। কতজনে নাবিক হইয়া কত দেশ-বিদেশে ঘুরিতেছে, কতজনে সৈনাদলে ঢুকিয়া যুদ্ধে বীরত্ব দেখাইতেছে। নূতন ছাত্রদের পড়াইবার সময়ে এই-সব অতি পুরাতন ছাত্ররা তাদের বৃদ্ধ গুরুকে দেখিবার জন্য পাঠশালায় হাজির হইত। তাহারই ছাত্রেরা যে সৎপথে থাকিয়া উপার্জন করিয়া খাইতেছে, এবং এখনো যে তাহারা তাহাদের খোড়া মাস্টারকে ভোলে নাই, এই ভাবিয়া গৌরবে আনন্দে বৃদ্ধের দুইচক্ষু দিয়া দরূদ করিয়া জল পড়িত।
১৮৯৩ খৃস্টাব্দে নববর্ষের দিনে বাহাত্তর বৎসর বয়সে পাঠশালার কাজ করিতে করিতে বৃদ্ধ হঠাৎ শুইয়া পড়িল। বন্ধুবান্ধব উঠাইতে গিয়া দেখিল, তাহার প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছে। হয়তো তখনো লোকে ভালো করিয়া বোঝে নাই যে কত বড়ো মহাপুরুষ চলিয়া গেলেন। তাহার পর প্রায় আশি বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, এখন ইংলণ্ডের শহরে- শহরে অসহায় গরিব শিশুদের শিক্ষার জন্য কত ব্যবস্থা, কত আয়োজন। কিন্তু এ- সমন্তের মূলে ঐ খোঁড়া মুচির পাঠশালা। সেই পাঠশালায় যাহারা পড়িতে আসিত, কেবল তাহারাই যে জন পাউণ্ডসের ছাত্র, তাহা নয়—যাহারা নিজেদের অর্থ দিয়া, দেহের শক্তি দিয়া, একাগ্র মন দিয়া, অসহায় গরিব শিশুদের শিক্ষা ও উন্নতির চেষ্টা করিতেছেন তাহারা অনেকেই গৌরবের সঙ্গে এই খোঁড়া মুচিকে স্মরণ করিয়া বলিতেছেন, “আমরাও আচার্য জন পাউণ্ডসের শিষ্য।” এই খোঁড়া মুচির নাম সকলের কাছে স্মরণীয় রাখিবার জন্য, তাহার ভক্তের মিলিয়া তাঁহার একটি পাথরের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন।