সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবনী/দানবীর কার্নেগী

দানবীর কার্নেগী

 বড়োলোক হবার সুখ থাকলেই যে মানুষ বড়োলোক হতে পারে না, তার দৃষ্টান্ত গল্পে তোমরা পড়েছ। এখন একটি সত্যিকারের বড়োলোকের কথা বলব, যিনি গরিব বাপমায়ের ঘরে জন্মেও কেবল আপনার চেষ্টায় ও আগ্রহে, জগতের মহাধনী ক্রোরপতিদের মধ্যে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন।

 ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে স্কটল্যাণ্ডের এক সামান্য পল্লীগ্রামের এক নগণ্য পরিবারে এনড্র কার্নেগীর জন্ম হয়। তাঁর বয়স যখন তেরো বৎসর মাত্র তখন তাঁর বাবা উপার্জনের চেষ্টায় সপরিবারে আমেরিকায় চাকরি করতে যান। সেইখানে গিয়েই এক সুতোর কারখানায় তাঁতির মজুর হয়ে কার্নেগী মাসে সাড়ে বারো টাকা রোজগার করতে আরম্ভ করলেন। এই তাঁর প্রথম রোজগার। তার পর চৌদ্দ বছর বয়সে তার আরেকটু ভালো একটা চাকরি জুটল, তিনি এক টেলিগ্রাফ অফিসের ছোকরা পিয়নের কাজ পেলেন। এই কাজ তিনি কেমন করে জোগাড় করলেন, সে গল্পটিও বড়ো চমৎকার।

 টেলিগ্রাফ অফিসের দরজায় বিজ্ঞাপন ছিল, “ছোকরা পিয়ন চাই"। তাই দেখে কার্নেগী খোঁজ নেবার জন্য ভিতরে ঢুকলেন। টেলিগ্রাফের কেরানী একটা অচেনা ছোকরাকে ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেখেই, হাঁক দিয়ে বললে, “কি চাও?” কার্নেগী বললেন, “বড়োসাহেবকে চাই।” কেরানী তেড়ে উঠে বললে, “যাও, যাও, দেখা হবে না।” পরের দিন সকালে কার্নেগী আবার ঠিক তেমনিভাবে সেখানে গিয়ে হাজির। কেরানী দেখলে, সেই ছোকরা আবার এসেছে। সে আবার জিজ্ঞাসা করলে, “কি চাও?” জবাব হল, “বড়ো-সাহেবকে চাই।” সেদিনও কেরানী তাকে চটপট ঘর থেকে বার করে দিল। পরের দিন আবার সেই সময়ে সেই ছোকরা এসে হাজির-বলে, “বড়ো-সাহেবকে চাই।” ভাবল, ব্যাপারটা কি? অচ্ছিা, একবার বড়ো-সাহেবকে জিজ্ঞাসা করা যাক। বড়ো-সাহেব সব শুনে বললেন, “পাঠিয়ে দাও তো, দেখি ছোকরা কি চায়।” সেইদিনই কার্নেগী টেলিগ্রাফ অফিসের কাজে ভর্তি হলেন। বাপ-মায় ভাবলেন, ছেলে ‘চাকরে’ হয়ে উঠল—বেশ দুপয়সা রোজগার করবে।

 পিয়নের কাজ করতে করতেই কার্নেগী টেলিগ্রাফের কলকায়দা সব শিখে ফেললেন, আর কিছুদিন বাদেই তিনি সেখানকার রেলস্টেশনে তারওয়ালা বা অপারেটর হয়ে বসলেন। তার পর দেখতে দেখতে ক্রমে টেলি-বিভাগের বড়ো-সাহেব বা সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট হতেও তাঁর বেশি দেরি লাগল না। এই সময় থেকে তিনি রেলগাড়ি আর খনির তেলের ব্যবসা করে খুব টাকা করতে আরম্ভ করেন। লাভের টাকা আবার নুতন নূতন ব্যবসায় খাটিয়ে তিনি বড়ো-বড়ো কারবার জমিয়ে তুললেন। তার পর ক্রমে পাঁচসাতটা প্রকাণ্ড লোহার কারখানা কিনে ফেলে তিনি নিজে সেইগুলো চালাতে লাগলেন। পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়স না হতেই তিনি পৃথিবীর মধ্যে একজন নামজাদা লোহার মালিক হয়ে উঠেছিলেন।

 এমনি করে ১৯০১ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করে, তিনি ছাপান্ন বৎসর বয়সে সব বিষয়কর্ম থেকে অবসর নিয়ে স্কটল্যাণ্ডে সেই তাঁর জন্মস্থানে গিয়ে বসলেন। বললেন,“রোজগার যথেষ্ট করেছি, এখন এই বুড়ো বয়সে আর টাকা টাকা করে ছুটে বেড়ানো ভালো দেখায় না। এতদিন যা সঞ্চয় করেছি এখন দানের মতো দান করে তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। সেই থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাঁর দানব্রত পালন করে গিয়েছেন।

 কার্নেগীর মতো অথবা তার চাইতেও বড়োলোক পৃথিবীতে আরো আছেন—কিন্তু এমন অজস্রভাবে দান আর কেউ করেছেন কিনা সন্দেহ। কত দেশে, কত শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে, কত ছোটো ছোটো পাঠশালায়, কত বড়-বড় কলেজে, তার কীর্তির পরিচয় রয়েছে। শুধু লাইব্রেরি করবার জন্যই নানা জায়গায় তিনি প্রায় বিশ কোটি টাকা খরচ করে গেছেন। স্কটল্যাণ্ডের গরিব ছাত্রদের পড়ার সাহায্যের জন্য তিনি অন্তত তিন কোটি টাকা দান করেছেন। তাঁর নিজের জন্মস্থান সেই ছোট্টো গ্রামটি আজ বেশ একটি শহর হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে কেবল তাঁর দানের জোরে। এই শহরটির উন্নতির জন্য তিনি যে সম্পত্তি রেখে গেছেন, তার আয় হয় বছরে চার লক্ষ টাকা। বীরত্বের পুরস্কারের জন্য আমেরিকায় ও ইংলণ্ডে তিনি দুটি Hero fund বা বীর ভাণ্ডার স্থাপন করে গেছেন। বিপদের সময়ে অন্যের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে যারা নিজেরা আহত ও অকর্মণ্য হয়ে পড়ে, এই ভাণ্ডার থেকে তাদের খাওয়া-পরার সমস্ত খরচ দেওয়া হয়। এমনি করে ছোটো-বড়ো যত অসংখ্যরকমের দনি তিনি করে গেছেন, সব যদি এক সঙ্গে ধরা যায়, তা হলে তাঁর দানের হিসাব হয় প্রায় একশো কোটি টাকা।

 এত টাকা আমাদের ভালো করে কল্পনাই হয় না। হিসাব বলবার সময় ‘অযুত লক্ষ নিযুত কোটি অর্বদ বৃন্দ’ সব আমরা গড় গড় করে বলে যাই, কিন্তু সে যে কত বড়ো, অঙ্কের হিসাব তার ধারণা করতে গেলেই মাথায় গোল লেগে যায়। একশো কোটি টাকা কতখানি জান? একজন লোক যদি প্রতি সেকেণ্ডে একটি করে টাকা দান করে, তা হলে একদিনে তার ছিয়াশি হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। কিন্তু এই হিসাবেও একশো কোটি টাকা খরচ করতে তার অন্তত বত্রিশ বৎসর সময় লাগবে—তাও, যদি সারাদিন সারারাত না খেয়ে না ঘুমিয়ে সে কেবল ঐ কাজই করতে থাকে। একশো কোটি টাকা ভাঙিয়ে যদি পয়সা অনাও, তা হলে সেই পয়সা দিয়ে এই কলকাতার মতো গোটা দুই শহরকে একেবারে ঢেকে দেওয়া যাবে। এই ভারতবর্ষের সমস্ত লোক, ছেলে বুড়ো স্ত্রী পুরুষ, সবাই মিলে যদি সেই পয়সা কুড়োতে আসে, তা হলে প্রত্যেকে প্রায় দুইশো পয়সা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে।

 এই কয়েকদিন হল কার্নেগীর মৃত্যু-সংবাদ এদেশে এসেছে। তার জীবনের সঞ্চিত টাকা তিনি প্রায় সমস্তই দান করে গিয়েছেন—তার তুলনায় যা বাকি রয়ে গেছে, সে কেবল সিন্ধুকের মধ্যে এক মুষ্টির মতো।

সন্দেশ-ভাদ্র, ১৩২৬